বৃষ্টি ভেজা কাঠগোলাপ পর্ব ৩৬

বৃষ্টি ভেজা কাঠগোলাপ পর্ব ৩৬
সাদিয়া জাহান উম্মি

জানালার পর্দা ভেদ করে সকালের মিষ্টি রোদ রুমে প্রবেশ করছে।আলোকিত করছে পুরো রুম।কাল গোটা রাতটা যেমন বৃষ্টিময় ছিলো।সকালটা তেমনই স্নিগ্ধ। নির্মল বাতাসে রুমের পর্দাগুলো দুলছে।সতেজ ভাব তার মধ্যে।দীর্ঘ রাতের পর এ যেন এক প্রেমময়ী স্নিগ্ধ সকাল।কিচির মিচির পাখিদের ডাক শোনা যাচ্ছে।বাগানের ওইপাশটায় একটা বড় আম গাছ আছে সেখান থেকেই ভেসে আসছে এই মিষ্টি পাখিদের গান।

সেই গানের ধ্বনিগুলো কানে প্রবেশ করতেই পিটপিট করে চোখ মেলে তাকায় আরাবী। হাত দুটো উপরে উঠিয়ে আড়মোড়া দিয়ে।হা করে হাই তুলে ও।ঘুমের রেশ কাটাতে এদিক ওদিক তাকাতেই দেখা মিলে হৃদয়ের গহীনে থাকা প্রেমিকপুরুষটির। জায়ান একধ্যানে তাকিয়ে আছে আরাবীর দিকে।দৃষ্টিতে একরাশ মুগ্ধতা।জায়ানের ওই চোখের দিকে আরাবী নির্দ্বিধায় তাকিয়ে থাকলে জায়ান দুষ্টু হেসে ঠোঁট কামড়ে ধরে।জায়ানকে এমন করতে দেখে ভড়কে যায় আরাবী।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

হঠাৎ কাল রাতের সেই ভালোবাসাময় মুহূর্তগুলো একে একে স্মরনে আসতেই লজ্জায় জবুথবু হয়ে যায় আরাবী।শরীরের লোমকূপ শুদ্ধ দাঁড়িয়ে যায় ওর।দ্রুত লজ্জা থেকে নিজেকে বাঁচাতে গায়ের কম্বলটা ভালোভাবে টেনে নিয়ে পুরো নিজেকে আপাদমস্তক ঢেকে দেয় আরাবী।সাথে সাথে কানে ভেসে আসলো জায়ানের হালকা হাসির শব্দ।এই প্রথম লোকটাকে এমন হাসির শব্দ পেলো আরাবী।ইচ্ছে করলো একটু দেখতে যে লোকটা এইভাবে হাসলে কেমন লাগে দেখতে।তবে লজ্জায় সেই সাহস আর করলো না।হঠাৎ কম্বলে হেচঁকা টান অনুভব করতেই সেটা শক্ত করে ধরে রাখার চেষ্টা করলো আরাবী।কিন্তু ব্যর্থ হলো ও।জায়ান সরিয়ে দিয়েছে কম্বল।আরাবী লজ্জায় কি করবে দিশা পাচ্ছে না।জায়ান মুচঁকি হেসে বলে, ‘ এতো লজ্জা পাওয়ার কি আছে?আমিই তো! আর এইভাবে নিজেকে আপাদমস্তক ঢেকে রেখে লাভ কি? আমিতো সব দেখেই নিয়েছি। অবশ্য তুমি চাইলে এই দিনের আলোতে আবারও দেখে….’

জায়ানকে আর বলতে না দিয়ে আরাবী জায়ানের মুখ চেপে ধরে। লজ্জায় হাঁসফাঁস করতে করতে বললো, ‘ অসভ্য আপনি।চরম অসভ্য!’
জায়ানের মুখে আরাবী যেই হাতটা দিয়েছিলো।সেই হাতটা ধরে জায়ান সেই হাতের তালুতে চুমু দেয়।শিরশির করে উঠে সেই জায়গায়টায় আরাবীর।হাত সরিয়ে নিতে চাইলেও সরালো না আর। থাক না লোকটার হাতে বন্ধি ও।ও চায় লোকটা যেন সারাজীবন ওকে তার বক্ষপিঞ্জিরায় বন্ধি করে রাখে। জায়ানের দৃষ্টি আরাবীর পুরো মুখমন্ডলে বিচড়ণ করছে।জায়ান ঘোর লাগা কন্ঠে বলে, ‘ তুমি অনেক সুন্দর আরাবী।অনেক সুন্দর।তোমাকে ধন্যবাদ আরাবী।কাল আমার জীবনের সবচেয়ে সুখময় রাত ছিলো।’

আরাবী লাজুক হাসলো।জায়ান আরাবীর কপালে চুমু খেলো।আরাবী আবেশে চোখ বন্ধ করে নিলো।
চুমু খেলো আরাবীর গালে।জায়ান সরে আসতেই আরাবী ওর লাজুক রাঙ্গা মুখ লুকায় জায়ানের বক্ষে।জায়ান ও আরাবীর কোমড় জড়িয়ে ধরে।আরেকটু ঘনিষ্ঠ হয় আরাবীর।এইভাবেই অতিবাহিত হয়ে যায় অনেকক্ষন।একটু পর জায়ান আরাবীকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে অপরাধী কন্ঠে বলে, ‘ আমি সরি আরাবী। আমি যদি তোমাকে ইগনোর না করতাম। তোমার সাথে সাথে থাকতাম তাহলে কাল এমন কিছু হতো না।’

আরাবী মস্তিষ্কে টনক নড়ে। তার তো এটা জিজ্ঞেস করতে মনে নেই।কেন জায়ান আরাবীর সাথে এমন করছিলো।যেখানে দোষটা জায়ানেরই। মুহূর্তেই আরাবীর মুখশ্রী শক্ত হয়ে উঠে।তেজি কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো, ‘ আমার উত্তর চাই।যেখানে রাগ দেখানোর কথা ছিলো আমার।সেখানে আপনি কেন আমার সাথে এমন করলেন?’
জায়ানের মুখ অবয়ব মুহূর্তেই বদলে যায়।গম্ভীর কন্ঠে বলে, ‘ সেদিন আমার হাতে এ্যালকোহলের বোতল দেখেছিলে তুমি।সেই কারনে আমাকে কতোগুলো কথা বললে।তুমি কিভাবে বিশ্বাস করলে আমি মদ খাই? তুমি এইভাবে বলায় আমি তাই ত্যাড়ামি করি তোমার সাথে।কিন্তু তুমি কি অনায়াসে বললে মদ না ছাড়লে তোমাকে ছেড়ে দিতে। সত্য মিথ্যা যাচাই না করে তুমি এই কথা কিভাবে বললে?তাই এই কারনে আমার তোমার প্রতি রাগ হয়।এইজন্যে আমি তোমার সাথে কোন কথা বলিনি।’

আরাবী খানিক নুইয়ে গেলো।তবে দমলো না প্রশ্ন করলো, ‘ তবে ওই মদের বোতল আপনার কাছে কিভাবে এলো? যদি আপনি ড্রিংক না করেন।’
জায়ান থমথমে কন্ঠে বলে, ‘ এই রুমে একদিন ইফতি ওর ফ্রেন্ড্সদের নিয়ে পার্টি করেছিলো।আমি তখন বিডিতে ছিলাম না।বিজন্যাসের কাজে নিউইয়র্কে গিয়েছিলাম। ওই গাধায় তো জানে না আমি কোথাও গেলে আমার রুমে সি সি ক্যামেরা লাগিয়ে রাখি।তার ওর এইসব কীর্তিকলাপ আমি অনায়াসে জেনে যাই।দেশে এসে এই কারনে সেদিন ওকে মেরেছিলাম।ওরা মদ পান করেছিলো।যদিও সেগুলো ওতোটা নেশালো ছিলো না।৪০% এ্যালকোহল ছিলো।

তাও আমি ওকে মেরেছিলাম।এরপর থেকে আর ও এমন করেনি ওর ওই বন্ধুদেরও সঙ্গ ছেড়ে দেয়।সেই থেকে আমি আর কাউকে আমার রুমে আসতে দেইনি। মানে কাউকেই না শুধু মা আসতো।তবুও আমি বাসায় থাকলে।তো সেদিন আমি পুরনো ফাইলগুলো ঘাটাঘাটি করছিলাম।সেই ফাইলগুলো ছিলো বড় কয়েকটা ব্যাগের মাঝে।আলমারির নিচের তাকে।আমি সবগুলো ব্যাগ চেক করছিলাম।সেখানের একটা ব্যাগেই আমি ওই মদের বোতল পাই।ইফতিরা বোধহয় লুকিয়ে রেখেছিলো পরে খাবে বলে।আমি ওটা পেয়ে ওটাকে বারান্দার ডাস্টবিনে রাখার জন্যে গিয়েছিলাম। আর তখনি তুমি বারান্দায় আসো।আর আমার হাতে মদের বোতল দেখে উল্টাপাল্টা ভেবে বসো।’

জায়ানের সম্পূর্ণ কথা শুনে অনুশোচনায় আরাবী মাথা নিচু করে নেয়।আসলেই ও বড্ড ভুল করে ফেলেছে।আগে জায়ানকে একবার ভালোভাবে জিজ্ঞেস করার দরকার ছিলো।আরাবী ধরা গলায় বলে, ‘ আমি দুঃখিত আপনাকে এতোটা হার্ট করার জন্যে।আসলে মদকে আমি প্রচুর ঘৃনা করি।তাই সেদিন আপনার হাতে মদের বোতল দেখে আমার মাথা ঠিক ছিলো না।তাই আপনাকে উল্টাপাল্টা বলে ফেলেছিলাম।আমি অনেক সরি।’

জায়ান আরাবী চিবুক ধরে ওকে নিজের মুখোমুখি করলো।সাথে সাথে আরাবীর চোখের কোন ঘেঁষে গড়িয়ে পরলো একফোঁটা জল।জায়ান বেশ শক্ত হাতেই আরাবীর চোখের জল মুছে দেয়।তারপর একমুহূর্ত ব্যয় না করে আরাবীর অধরজোড়া নিজ আয়ত্বে নিজের অধরের ভাঁজে নিয়ে নেয়।আরাবীর কেঁপে উঠে একহাতে জায়ানের চুল খামছে ধরে।আরেকহাতে জায়ানের ঘার।ধারালো নখগুলো দাবিয়ে দেয় জায়ানের ঘাড়ে।কিছুক্ষন পর সরে আসে জায়ান।আরাবী জোড়েজোড়ে নিশ্বাস নিচ্ছে।আরেকটু হলেই দমটা আটকে যেতো।হঠাৎ জায়ানের তীব্র আক্রোশভরা কন্ঠ শোনা গেলে।সেদিকে তাকায় জায়ান, ‘ শুধু শুধু আর কখনো কাঁদবে না।যদি কাঁদতে দেখি তাহলে ঠিক এইভাবেই দম আটকে মেরে ফেলবো।’

আরাবী জায়ানের এমন কথায় মুখ গোমড়া করে ফেললো।কিন্তু গালগুলো লজ্জায় টুকটুকে হতে ভুললো না।এমন সময় পাশের টি-টেবিলে রাখা এলার্ম ক্লকটা সশব্দে বেজে উঠলো।আরাবী চমকে গেলো।তাকিয়ে দেখলো ঘড়িতে এখন সকাল নয়টা বাজে।তারই এলার্ম বাজছে।চোখ বড় বড় হয়ে যায় আরাবীর।সাথে হালকা আওয়াজে চেঁচালো, ‘ আল্লাহ! এতো দেরি হলো কিভাবে?কতো সকাল হয়ে গিয়েছে।আর আমি এখনো বিছানায় শুয়ে।সবাই কি ভাব্বে?আজ বিয়ের পরে প্রথম দিন আর আমি কিনা এতো দেরিতে উঠলাম।’

জায়ান আরাবীকে টেনে নিজের কাছে নিয়ে আসলো।আরাবী তাকাতেই জায়ান ভ্রু-কুঁচকে বলে, ‘ লিসেন ওতো আদর্শবান হওয়া লাগবে না।তুমি বিয়ের আগে যেমন ছিলে ঠিক তেমনভাবেই থাকবে। বুঝলে?’
‘ কিন্তু!’ আরাবীকে বলতে না দিয়ে জায়ান হালকা ধমকে বললো, ‘ কোন কিন্তু না আমি যা বলবো তাই।’
আরাবী জায়ানের ধমক খেয়ে মিনমিনে গলায় বললো, ‘ আচ্ছা,বুঝলাম।কিন্তু এখন তো উঠতে দিবেন?’
জায়ান আর কথা বাড়ালোনা।ছেড়ে দিলে আরাবীকে।বিছানা থেকে নেমে দাড়ালো।আরাবীও উঠতে নিলে পেটে হালকা ব্যাথা অনুভব করে মুখ কুঁচকে ফেললো।তা দেখে জায়ান আবারও দ্রুত পায়ে ওর কাছে এসে বললো, ‘ কি হয়েছে?’
আরাবী ব্যাথাতুর কন্ঠে বলে, ‘ পেটে হালকা ব্যাথা করছে।’

জায়ানকে চিন্তিত দেখালো।বললো, ‘ আমি এইজন্যেই তোমাকে না করেছিলাম।কিন্তু তুমি নিজেই আমায় অনুমতি…!’
জায়ানকে থামিয়ে দিলো আরাবী, ‘ উফ! চুপ করুন তো।ও কিছু না।আমি ঠিক আছি।’
আরাবী আবারও বিছানা থেকে নামার জন্যে উদ্যত হতেই জায়ান আরাবীকে কোলে তুলে নেয়।আরাবী হকচকিয়ে গিয়ে জায়ানের গলা জড়িয়ে ধরে বলে, ‘ আরে কি করছেন?আমি যেতে পারবো তো!’

জায়ান আরাবীর কোন কথার জবাব দিলো না।চুপচাপ আরাবীকে ওয়াশরুমে নামিয়ে দিয়ে চলে গেলো রুমে। একটু পর আবার ফিরে আসে।হাতে আরাবীর জামাকাপড়।ক্লথ হ্যাংগারে সেগুলো রেখে দিয়ে জায়ান গম্ভীর গলায় বলে, ‘ তুমি কি পারো না পারো সেটা আমার থেকে ভালো কেউ জানে না বুঝলে?এখন জলদি গোসল করে নাও।গরম পানি দিয়ে করিও।আমি বাহিরেই আছি।’

বৃষ্টি ভেজা কাঠগোলাপ পর্ব ৩৫

জায়ান চলে যেতেই আরাবী ওয়াশরুমের দরজা আটকে দিয়ে মুচঁকি হাসলো।এই গম্ভীর, একরোখা,জেদি লোকটা যে এইভাবে ওকে এমন ভালোবেসে ফেলবে ভাবতেই পারিনি। আরাবী হালকা হেসে বলে উঠে, ‘ পাগল একটা!’

বৃষ্টি ভেজা কাঠগোলাপ পর্ব ৩৭