ভালোবাসার বর্ষণ পর্ব ১১

ভালোবাসার বর্ষণ পর্ব ১১
নীহারিকা নুর

আজকেও ঠিক সেম ভাবে সেম জায়গায় তরুকে দেখে দাড়িয়ে পড়ল তুরাগ। এই মেয়েটা এমন কেন করছে৷ কি চায় ও। ওর খাওয়া না খাওয়া নিয়ে এই মেয়ের এত মাথা ব্যাথা কেন। দূর কি জানি৷ যা হয় হোক। আজ আর কথাই বলবে না এই মেয়ের সাথে। পথ আটকালে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিবে৷ এই মেয়েকে তো মোটেই মাথায় তোলা যাবে না।

এমনিতেই নিজে নিজে অধিকার খাটাতে আসে৷ তাও আবার তুরাগ সাইয়্যিদ এর উপর৷ ভাবা যায়। তুরাগ পায়ের গতি বাড়িয়ে হাটা শুরু করল। আজ সামনে দাড়ালে সরিয়ে চলে যাবে। তুরাগ তরুর সামনে এসে দাড়াল। না তরুর কোন নড়চড় নেই। ভাবলেসহীন ভাবে বসে আছে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

তুরাগ ভেবেছিল আজকেও হয়ত ওর পথ আটকে দাড়াবে। কিন্তু তরু ঘুরেও তাকালো না সেদিকে। রাত তখন প্রায় একটা বাজে। তুরাগ এর আর সেধে সেধে কোন কথা জিজ্ঞেস করতে মন চাইলো না৷ তাই তরুর পাশ কা’টিয়ে উঠে গেল উপরে। তরু তখনো বইয়ের দিকে এক মনে তাকিয়ে আছে। তুরাগ ও আর পিছু না তাকিয়ে উপরে উঠে গেল।
রুমে এসে একদম অগোছালো মানুষের ন্যায় ধপাস করে পড়ল বিছানার মধ্যে। ফ্রেশ তো হলোই না এমনকি বাহির থেকে পড়ে আসা মোজাটাও খোলে নি। সেই ড্রেসেই শুয়ে রইল পা দুটো বাহিরের দিকে ঝুলিয়ে দিয়ে।

তরু উঠে নিজের রুমে গিয়ে বইটা রেখে আসল। এরপর পা বাড়াল তুরাগ এর রুমের উদ্দেশ্যে। তুরাগ এর রুমের সামনে এসে দেখতে পেল রুমের দরজা লাগানো। তরু বাহির থেকে তুরাগ ভাই, তুরাগ ভাই বলে বেশ কয়েকবার ডাক দিল। কিন্তু ভেতর থেকে কোন রিপ্লাই এলো না। তুরাগ কি এর মধ্যে ঘুমিয়ে পড়েছে। ধ্যাত একটা মানুষ এত তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে কীভাবে পড়ে। হয়ত ইচ্ছে করে জবাব দিচ্ছে না।

তরু দেখতে চাইল তুরাগ কি করছে। নুরনাহার এর কাছে শুনেছিল তুরাগ রুমের দরজা ভেতর থেকে কখনো লক করে না। তরুর মনে হলো আজও হয়ত লক করে নি। দেখার জন্য দরজা ধাক্কা দিতেই খুলে গেল। দরজা একটুখানি ফাঁকা করে মাথা ঢুকিয়ে দেখার চেষ্টা করলো তুরাগ কি করছে। দেখল তুরাগ যে ড্রেস এ এসেছিল সেটা পড়েই শুয়ে আছে। ডান হাতটা মাথার উপর দিয়ে রেখেছে। হয়ত মাথা ব্যাথা করছে। তরু মাথা ভেতরে দিয়েই আবার ডাকল

– তুরাগ ভাই। তুরাগ ভাই আপনি জেগে আছেন আমি জানি। কথা বলছেন না কেন তাহলে।
কোন সারা শব্দ না পেয়ে দুষ্টু বুদ্ধি আসে তরুর মাথায়। এরপর নাম ধরে ডাকে
– তুরাগ এই তুরাগ ওঠ। তোর জন্য এতক্ষণ অপেক্ষা করে আছি আর তুই ঘুমিয়ে গেলি। তুরাগ ওঠ।
চোখ বন্ধ অবস্থায়ই নাক চোখ কুচকে ফেলে তুরাগ। এতক্ষণ ধরে চোখ বন্ধ করে পড়েছিল ভেবেছিল মেয়েটা হয়ত চলে যাবে। এখন দেখো কি সাহসটা দেখাচ্ছে। মন চাচ্ছে এখন গিয়ে ঠাটিয়ে দুইটা চড় মা’রি। কিন্তু শুধু শুধু এই মেয়ের সাথে কথা বাড়াবে না তাই এখনো চুপ করে রইল যেন কিছুই শুনতে পায় নি।

চোখ নাক কুচকানো দেখেই তরু শিওর হয়ে গেল যে তুরাগ ঘুমায় নি। তাই এবার বুলি করতে শুরু করলো। তুরাগ এর পায়ের দিকে তাকিয়ে হাত দিয়ে নাক চেপে ধরে বলতে লাগল ছি ছি তুরাগ ভাই আপনি এত নোংরা। বাহির থেকে মোজাটাও খুলেন নি। ওয়াক। কি গন্ধ। আমিও তো বলি বাড়ির এত সুন্দর পরিবেশটা এমন বিচ্ছিরি গন্ধে ভরে গেল কেন। এখন বুজছি। ছি ছি ছি ছি। আমার ফুপির ছেলেটা এমন নোংরা আমি তো জানতাম ই না।

তুরাগ লাফ দিয়ে উঠে বসে। শরীরটা অনেক ক্লান্ত ছিল। সামনে বিছানা দেখে পা আর একটু এদিক ওদিক নড়তে চায়নি। তাই তো এই অবস্থায়ই বিছানার মধ্যে শুয়ে পড়েছিল। কিন্তু এই মেয়ে তো এইটুকুর জন্য ওরে…। না আর সহ্য করা যাচ্ছে না। অতিরিক্ত করছে মেয়েটা।

তুরাগ বেড থেকে নেমে আসে৷ তরু তখন ও সেখানেই দাড়িয়ে আছে। তুরাগ এক পা দু পা করে এগিয়ে গিয়ে তরুর সামনে দাড়ায়। তরু তখন ও অনড় সেদিকেই তাকিয়ে রয়েছে। তুরাগ সরাসরি তরুর চোখের দিকে তাকালো। তরুও তখন তুরাগ এর চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। তুরাগ স্লো ভয়েস এ তরুর কানের কাছে গিয়ে বলে
– মিস তরুলতা আপনার কি আমাকে ভয় লাগছে না।

একদম কানের কাছে মুখ নিয়ে কথা বলায় তরুর সারা শরীর কেপে উঠল। কেমন একটা শিহরণ বয়ে গেল শরীরে। তরু সেটা বুজতে না দিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করে বলল
– এসব কি কথা তুরাগ ভাই। আমি আপনাকে ভয় পাব কেন।
– তোমার সত্যিই ভয় লাগছে না মিস তরুলতা।

– না লাগছে না। দেখুন আপনি এভাবে সব সময় বাহিরের খাবার খেলে সিক হয়ে পড়বেন। ফুপি আপনার জন্য কষ্ট পায়। কান্না করে এগুলো আমার সহ্য হয় না। প্লিজ তুরাগ ভাই চলেন না। আপনাদের সাথে কি হয়েছিল আমি জানি না। কিন্তু আমার এই রিকোয়েস্ট টা রাখেন প্লিজ তুরাগ ভাই।
তুরাগ ভেবেছিল এভাবে কথা বললে হয়ত তরু ভয় পাবে। কিন্তু এই এমন কেন। হার্টলেস। মনে হচ্ছে কোন অনুভূতিই নেই। নিজে যা বলে যাচ্ছে তাই।

তুরাগ সরে আসে তরুর সামনে থেকে। এরপর হুট করে তরুর হাতের কনুই বরাবর চেপে ধরে। এমন ভাবে ধরেছে মনে হচ্ছে নখ বসে যাচ্ছে। উফফ হাতে এত বড় বড় রাক্ষস এর মতো নখ। ব্যাথায় তরুর চোখ দিয়ে পানি বেরিয়ে আসার উপক্রম। তাও দাঁতে দাঁত চেপে দাড়িয়ে আছে। তুরাগ হাতের কনুই চেপে রেখেই এক প্রকার টানতে টানতে দরজার সামনে নিয়ে এলো তরুকে। দরজার বাহিরে বের করে হাত ছেড়ে দিল।

এমনিতেই শরীর ক্লান্ত তার এত ড্রামা দেখতে দেখতে তুরাগ এর মেজাজ চটে গেছে৷ বাহিরে তরুকে দাড় করিয়ে মুখে যা আসল তাই বলতে গেল। কিছুটা এমন
– এই মেয়ে তুমি এত ছেচড়া কেন। এত বার না করার পরেও এখনো এখানে দাড়িয়ে আছো। তোমার কি কোন মান সম্মান নেই নাকি। আর এত রাতে একজন যুবক ছেলের ঘরে একটা মেয়ে যাওয়ার মানে বোঝো তুমি। নাকি তাও বোঝো না।

ফিডার খাও তুুমি। এই অবস্থায় যদি কেউ তোমাকে আর আমাকে দেখতো তাহলে কি হতো বিষয়টা সে সম্পর্কে কোন ধারণা আছে তোমার। আমার লাইফ আমার ইচ্ছে। আমি যা ইচ্ছে করবো। কে কষ্ট পেল সেটা আমার দেখার বিষয় না। সেদিন আমিও এমন কষ্ট পেয়েছিলাম। কই সেদিন তো দেখার কেউ ছিল না। এখন কোথা থেকে এসেছো তুুমি। আমি জাস্ট বিরক্ত এখন। তোমার যদি লজ্জা থাকে ফারদার আমার সামনে আর আসবে না।
এতটুকু বলে তরুর মুখের উপরেই দরজা বন্ধ করে দেয় তুরাগ।

এতক্ষণ কথাগুলো শুনে তরুর কান ঝা ঝা করতে থাকে। তরুর আপনজনরা কখনো ওর সাথে এমন ব্যাবহার করে নি। সেদিন বিয়ে ভাঙার পরেও সবাই চেষ্টা করেছে বাহির এর মানুষ এর কথা যেন ওর কানে না আসে। তুরাগ কে তো তরু পর ভাবে নি৷ আপন ভেবেই একটু অধিকার খাটিয়েছিল। তাই বলে এভাবে অপমান করবে। কথাগুলো বেশ গায়ে লাগে তরুর। কান্নারা দলা পাকিয়ে আসে। সেখান থেকে দৌড়ে চলে যায় তরু।

তুরাগ এতক্ষণ দরজার পাশেই দাড়িয়ে ছিল। তরুর দৌড়ে যাওয়ার শব্দ কানে আসতেই সেখান থেকে সরে আসে। এরপর একটা টাওয়াল নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে যায়। প্রায় মিনিট ত্রিশ এর মতো লাগিয়ে ফ্রেশ হয়। একবারে শাওয়ার নিয়েই বেড়িয়েছে। মাথা ব্যাথা কমার নাম নেই। তবে মাথা ব্যাথার জন্য কোনো পেইন কিলার নেয় না তুরাগ। ঘুমালে এমনিতেই ঠিক হয়ে যায়।

তাই আলমারি থেকে একটা ট্রাওজার আর টিশার্ট নিয়ে পড়ে টাওয়ালটা শুকাতে দিয়ে আবার গিয়ে শুয়ে পড়ে। কিছুক্ষণ আগে কি হয়েছে সেটা প্রায় তুরাগ এর মাথা থেকে বেরিয়েই গিয়েছে। চোখ বন্ধ করে চেষ্টা করতে থাকে ঘুমানোর। চোখ বন্ধ করে থাকতে থাকতে চোখে প্রায় ঘুমঘুম ভাব চলে এসেছিল। হঠাৎ কারো ফোঁপানোর শব্দ কর্নকুহরে যেতেই ঘুম ঘুম ভাবটা কে’টে যায়। প্রথমে বোঝার চেষ্টা করে এত রাতে কোথা থেকে কান্নার আওয়াজ আসছে।

এরপর একটু আগে ঘটে যাওয়া ঘটনার কথা মনে হতেই লাফ দিয়ে বেড থেকে নামে তুরাগ। ও যা সন্দেহ করছে সেটা সত্যি কিনা পরোখ করতেই রুম থেকে বেরিয়ে আসে। দোতলা থেকেই নজর দেয় ডায়নিং এর দিকে। সেখানে কম পাওয়ার এর একটা লাইট জ্বলতেছে। সেই আবছা আলোয় কাটো অবয়ব দেখা যাচ্ছে ডায়নিং এ। তুরাগ আর একটু সামনে আগায়। দেখতে পায় কেউ টেবিল এর সাথে মাথা ঠেকিয়ে মাথা নিচু করে বসে আছে। চুলের খোপাটা খোলা। কোমড় অব্ধি লম্বা চুলগুলো ছড়িয়ে আছে। ফোপানোর শব্দটা সেখান থেকেই আসছে।

তুরাগ এর এবার মনে হয় ও একটু বেশিই বলে ফেলেছে হয়ত। তুরাগ নিচে নেমে আসে। আস্তে আস্তে তরুর পেছনে এসে দাড়ায়। পেছন থেকেই মাথায় হাত রাখে।
হঠাৎ করে মাথায় কারো স্পর্শ পেয়ে চমকে ওঠে তরু। মাথা উঠিয়ে পেছন ঘুরে তাকায় তরু। পেছনে তুরাগকে দেখে মাথাটা সরিয়ে নেয়। তুরাগ এর নজর যায় তরুর চোখের দিকে। কান্না করতে করতে চোখ গুলো একদম রক্তিম বর্ন ধারণ করেছে। চোখের ভেজা পাপড়ি গুলো দেখেই বুকের ভেতর কেমন একটা দ্রিম দ্রিম করতে থাকে।

এই চোখগুলোই যেন তুরাগকে দুর্বল করতে সক্ষম। সামনে থাকা একটা চেয়ার টেনে তুরাগ বসে। এতক্ষণ কান্না করার ফলে হিচকি উঠে গেছে তরুর। হিচকি থামানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে তরু। কিন্তু সে ব্যার্থ। তুরাগ তরুর দিকে কিছু সময় অপলক তাকিয়ে থাকে। তরুকে দেখতে এখন মনে হচ্ছে সামনে একটা বার্বিডল বসে আছে। তুরাগ বলে

– তরু আমি খেতে এসেছি। খাবার রেডি করো কুইক।
এতক্ষণ মাথা নিচু করে বসে ছিল তরু। তুরাগ এর কথায় মাথা তুলে তাকায়।
– এভাবে তাকিয়ে আছো কেন খাবো খাবার দাও।
– আপনি সত্যিই খাবেন।
– তো আমি কি তোমাকে মিথ্যা বলছি।

তরু উঠে তুরাগ এর জন্য খাবার বেড়ে দেয়। তুরাগ জিজ্ঞেস করে তুমি খেয়েছো?
তরু মাথা নেড়ে না বোঝায়। তুরাগ উঠে নিজে তরুকে খাবার বেড়ে দেয়। এরপর দুজনই শব্দহীন ভাবে খেতে থাকে। হঠাৎ করে তুরাগ বলে ওঠে

– আমার সামনে এভাবে কাঁদবেন না মিস তরুলতা। সেটা আমার সহ্য হয় না।
তরু কথা না বলে নিচের দিকে তাকিয়ে খেতে থাকে। মনে মনে ভীষণ খুশি তরু। এতদিন যে কাজটা কেউ করতে পারল না সেই কাজটা এই কান্নার কারনেই সফল হয়েছে। আবার বলছে কাদবেন না। হুহ বললেই হলো।
তুরাগ খেয়ে নিজের রুমে চলে যায়। তরু সবটা গুছিয়ে রেখে এরপর রুমে যায়।

সকাল বেলা নাস্তার টেবিলে তুরাগকে দেখে সবাই মনে হলো আকাশ থেকে পড়েছে। তুরাগ এর বাবা তায়েফ সাইয়্যিদ তো নিজের খাওয়া বাদ দিয়ে ছেলের দিকে তাকিয়ে আছে। শুধু মাত্র তরু নিচের দিকে মাথা করে খেয়ে যাচ্ছে। তখনই নুর নাহার বলে ওঠে

ভালোবাসার বর্ষণ পর্ব ১০

– নাস্তা শেষ করে আমার রুমে এসো তরু। কথা আছে তোমার সাথে।
নুরনাহার এর কথা শুনে তুরাগ আর তরু একসাথে নুর নাহার এর দিকে তাকায়। ওদের মনে হচ্ছে কাল রাতের ঘটনা হয়ত তিনি দেখেছে।

ভালোবাসার বর্ষণ পর্ব ১২