ভালোবাসার বর্ষণ পর্ব ১৩

ভালোবাসার বর্ষণ পর্ব ১৩
নীহারিকা নুর

তুরাগ সাইয়্যিদ ভাইয়া ও তার গার্লফ্রেন্ড এর সাথে এক রেস্টুরেন্টে লান্স টাইমে। এই ক্যাপশনে তুরাগ আর তরুর টেবিল সহ পাশের টেবিলে বসা একটা ছেলে একটা ফটো পোস্ট করেছে। ছেলেটা মেবি ব্লগার।

হুড়হুড় করে সেই ফটোটা তার ফ্যান ফলোয়ারদের মাঝে ছড়িয়ে গিয়েছে। তুরাগ এর ফ্যানরা অনেক দিন যাবত তুরাগকে হন্য হয়ে খুজছে কিন্তু তুরাগ এক প্রকার সব কিছু থেকে নিজেকে হাইড করে রেখেছিল। আজ সুযোগ পেয়ে অনেক ফ্যান ফলোয়াররা একটু সময়ের ভিতরেই এসে ভীড় জমিয়েছে সেই রেস্টুরেন্টে। এক এক জন এক রকম প্রশ্ন করে যাচ্ছে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

– ভাইয়া আপনি এখন আর গান করেন না কেন?
– এভাবে হুট করে নিজের প্রফেশন থেকে সরে দাড়ালেন কেন?
– এটা কি সত্যিই আপনার গার্লফ্রেন্ড?
কেউ কেউ এই ভীড়ের মাঝেও অটোগ্রাফ চেয়ে বসছে।

তুরাগ আপাতত এদের সাথে কথা বলতে অনিচ্ছুক তবে তারা তো নাছোড়বান্দা। তুরাগ এতক্ষণে বুঝতে পারে কি ভুলটা করে ফেলেছে ও।
হঠাৎ তুরাগ এর নজর যায় তরুর দিকে৷ মেয়েটা ভয়ে কেমন চুপসে গেছে। এত এত মানুষের হামলে পড়াটা ঠিক স্বাভাবিক ভাবে নিতে পারছে না মেয়েটা। মনে মনে হাসে তুরাগ৷ এই মেয়েটা উপরে উপরেই যত চঞ্চল। এখন দেখো কেমন ভয় পেয়ে আছে।
তুরাগ নিজের চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়ায়। অমনি সামনে থাকা লোক গুলো তাকে আরো ঘেরাও দিয়ে ধরে। সবার একটাই কথা।

– তুরাগ ভাইয়া এভাবে প্রশ্ন এড়িয়ে চলে যাবেন না প্লিজ। আমরা জানতে চাই।
তুরাগ কথা না বলে এগিয়ে গেল তরুর সামনে। এতগুলো লোকের ভীড়ে হাত বাড়িয়ে দিল তরুর দিকে। তরুও পরিচিত মানুষ এর হাত পেয়ে আকড়ে ধরল৷ তুরাগ ও অতি সন্তর্পণে নিজের হাতের মাঝে তরুর হাত নিল। তরু ও তুরাগ এর সাথে পা মিলিয়ে সামনে এগুতে থাকে।

এই লোক গুলোকে ঠেলেঠুলে সামনে যাওয়া ওদের জন্য কষ্টসাধ্য ব্যাপার। তুরাগ শক্ত করে তরুর হাত ধরে রেখেছে। আর তরুও পেছন পেছন যাচ্ছে। আর মনে মনে বলতেছে এ কেমন যন্ত্রণা ভাই। কোন জায়গায় গিয়ে শান্তি নেই। এদের পিছনে সব জায়গায় মানুষ লেগেই থাকে৷ তার থেকে আমরাই বরং বেশ ভালো আছি।

হঠাৎ তুরাগ এর থেমে যাওয়ায় সাথে সাথে তরুর পা ও সেখানেই থেমে যায়। তরু চারদিকে চোখ বুলিয়ে বুঝতে পারে ওরা এই মুহুর্তে রেস্টুরেন্ট এর সামনে অবস্থান করতেছে। তরু চোখ বুলিয়ে সবাইকে দেখতে ছিল। এত দিন পর তুরাগকে সামনে পেয়ে অনেকেই বেশ এক্সাইটেড। তুরাগ ফোন করে প্রান্তকে ফোন দিল। ফোন দিয়ে বলল প্রান্ত যেখানে আর যেই অবস্থায়ই থাকিস না কেন এই মুহুর্তে *** রেস্টুরেন্টের সামনে চলে আয়।

– কেন কোন সমস্যা?
– আমি একা হলে সমস্যা ছিল না কিন্তু সাথে মামুর মেয়ে আছে আর এই পাবলিক এর ভীড়ে ও ভয় পাচ্ছে ওকে বাসায় ড্রপ করে দিবি তুই। এদিক টা আমি সামলে নিতে পারব। তুরাগ ফোন কে’টে ফোনটা পকেটে রাখল। এরপর সামনে থাকা লোকগুলোর দিকে তাকালো। তারপর বলতে লাগল

– কি যেন বলছিলেন আপনারা? এটা আমার গার্লফ্রেন্ড কি না। আপনাদের কি কমন৷ সেন্স নেই। কোথা থেকে কে এসে একটা পিক আপ দিল অমনি আপনারা মৌমাছির মতো ছুটে আসলেন। একটা ছেলে আর মেয়ে রেস্টুরেন্টে এক টেবিল এ বসলেই তারা গার্লফ্রেন্ড বয়ফ্রেন্ড হবে এমনটা কি কোথাও লেখা আছে।

– তাহলে আপনি যাকে নিয়ে এসেছেন সে কে হয় আপনার?
– সে আমার একমাত্র মামার একমাত্র কন্যা।
– তাহলে বলতে চাচ্ছেন সে আপনার বোন হয়।
– হ্যা ওরকমই। দেখুন সামনে থেকে সরে দাড়ান।
– ভাইয়া প্লিজ গান এর ব্যাপারে কিছু বলেন।

– দেখুন আমি গানটা কন্টিনিউ করছি না তার মানে তো এই নয় যে আমি গান ছেড়ে দিয়েছি। এই মুহুর্তে আমি এসব নিয়ে কথা বলতে আগ্রহী নই। প্লিজ।
দূরে প্রান্তকে বাইক নিয়ে দাড়িয়ে থাকতে দেখে তরুকে নিয়ে সেদিকে পা বাড়ালো তুরাগ। গাড়ির চাবি টা প্রান্তকে দিয়ে বলল

– প্রান্ত ওকে বাসায় পৌছে দে। আর বাইকের চাবি দে আমাকে আমি বাইক নিয়ে যাচ্ছি। কাজ আছে আমার।
প্রান্ত পকেটে হাত ঢোকাল। তুরাগ ভেবেছিল চাবি হয়ত পকেটে। কিন্তু প্রান্ত চাবি বের না করে একটা মাস্ক বের করলো।
– এটা কি
– আরে ভাই একটা মাস্ক পড়ে বের হলে তো আজ এই সমস্যায় পড়তি না।
– হুহ ধন্যবাদ। আর মনে ছিল না আমার।
– আচ্ছা।

সন্ধ্যায় ফেরার কথা ছিল নুর নাহার এর। কিন্তু সে দুপুর এর দিকেই চলে আসল। বাসায় এসে লক করা দেখে এক্সট্রা চাবি দিয়ে ভেতরে এসেছিল। কিন্তু বাসায় এসে দেখল বাসা একদম খালি। বাসায় কেউ নেই। তুরাগকে নিয়ে তার চিন্তা নয়। তিনি চিন্তা করছেন তরুকে নিয়ে। মেয়েটা এই শহরে নতুন। কোথায় না কোথায় গেল। এখন কি হবে। মেয়েটার কাছে তো একটা ফোন ও নেই যে তিনি ফোন করবেন।

তুরাগকে ফোন দিয়েছিলেন। কিন্তু তুরাগ ফোন তোলে নি৷ চিন্তায় মাথা ভারী হয়ে যাচ্ছে নুর নাহার এর। এই ছেলে মেয়ে গুলোকে নিয়ে আর পারা গেল না। তিনি রুমের এ মাথা থেকে ও মাথা পায় চারি করে যাচ্ছেন। এমন সময় দরজার কলিং বেল বেঝে উঠল। নুর নাহার এক প্রকার দৌড়ে গেলেন দরজা খোলার জন্য। তিনি ভেবেছিলাম হয়ত তরু একাই তাই দরজা খুলতে খুলতে বলতে লাগলেন

– তুই যে এভাবে বের হয়ে গেলি যদি কিছু হয়ে যেত।
দরজা খুলে তরুকে প্রান্তর সাথে দাড়িয়ে থাকতে দেখে চুপ করে গেলেন নুরনাহার। প্রান্ত বলল
– আরে আন্টি আপনার ছেলে ওকে নিয়ে গিয়েছিল ও একা যায় নি। শুধু শুধু টেনশন করছেন।
– ওহ আচ্ছা। ভেতরে আসো বাবা।

– না আন্টি একটু তাড়া আছে৷ বুজতেই পারছেন নির্বাচন এর সময় এগিয়ে আসছে।
– তা তোমার গুনধর বন্ধু কোথায়। ওকে নিয়ে গেল তো পৌঁছে দিল না কেন।
– ওর কাজ আছে একটু আন্টি। আমাকেও যেতে হবে এখন।
– চা কফি খেয়ে যাও।
– না আন্টি অন্যদিন।

– আচ্ছা এসো কিন্তু। এখন তো আর আসোই না বাবা।
– আসব আন্টি। আজ আসি। ভালো থাকবেন। আল্লাহ হাফেজ।
– আল্লাহ হাফেজ।
প্রান্ত যাওয়ার পরে দরজা আটকে ভেতরে আসতে না আসতেই ফোনটা তার নিজস্ব শব্দে বাজতে শুরু করল। নুরনাহার তরুর সাথে কথা বলবেন তা আর পারলেন না। ফোনটা চোখের সামনে ধরলে সেখানে “ভাই” লেখাটা জ্বলজ্বল করছে দেখে দেরী না করে ফোনটা রিসিভ করল নুরনাহার।

– আপা কি হচ্ছে এসব।
– আরে কি হচ্ছে না বললে বুঝব কীভাবে।
– তরুর ভালোর জন্য ওকে তোমার ওখানে পাঠালাম। আর এখন ওর নামে এসব কি শুনছি।
– এত না পেচিয়ে সরাসরি বললেই তো পারিস।
– ও তোমার ছেলের গার্লফ্রেণ্ড হলো কবে। এসব কি নিউজ দেখছি সোশ্যাল মিডিয়ায়।

– কি হচ্ছে আমি কিছু বুজতেছি না। আমাকে দে তো দেখি।
– দিচ্ছি দেখো। আর যদি এরকম কিছু আমার নজরে আসে তাহলে তো ওকে তোমার কাছে রাখা পসিবল হবে না। তোমাকে ভরসা করে থাকতে দিচ্ছি কিন্তু। এমনিতেই এদিকে চিন্তার শেষ নেই আমার তার ওপর ওকে নিয়ে এক্সট্রা চিন্তা নিতে পারছি না আমি। তুমি দেখো আপা।
– হুম ফোন রাখ দেখছি আমি।

দুই পাশের সোফায় দুজন বসে আছে। দুজনই নিরব। কারো মুখে কোন কথা নেই। তরু মাথা নিচু করে বসে আছে। নিরবতা ভেঙে নুরনাহার বলল
– আজ কেন বেরিয়েছিলি। তোকে তো আমি বলেছিলাম বাসায় থাকতে তাই না। আজ যদি না বের হতি তাহলে কি এমন একটা পরিস্থিতিতে পড়তি।
– স্যরি ফুপি। আর এমন হবে না।

তরু তো পড়েছে মহা বিপদে। ছেলে হুমকি দিয়ে নিয়ে যায়। সেখানে গিয়ে পড়ে আরেক পরিস্থিতিতে। আর এখন আবার ছেলের মা ধমকাচ্ছে। ওদিকে বাবা ফোন দিয়ে ঝাড়ি দেয়। ওফফ যাওয়াটাই ভুল হয়ে গেছে আজকে।
নুরনাহার আর তেমন কিছু বললেন না। আজ যা হয়েছে এতে তরুর দোষ দেখতে পাচ্ছেন না তিনি। পুরোটাই একটা মিসআন্ডারস্টান্ডিং। আমাদের চোখ দিয়ে আমরা যা দেখি তা সর্বধা সত্যি হয় না। কিন্তু তা পাবলিক বুঝলে তো কাজেই লাগত।

প্রতিদিন রাতে ঘুমানোর আগে মেয়ের রুমে একবার এসে মেয়েকে দেখা যাওয়াটা তহমিনার প্রতিদিনকার রুটিন এর মধ্যে একটি ছিল। এখন ও তার ব্যাতিক্রম হয় না। মাঝে মাঝেই ভুল করে তরুকে ডেকে ফেলেন। আবার মেয়ের রুমে চলে যান। আজ রাতেও ভুলবসত একবার উকি দিলেন মেয়ের রুমে। কিন্তু সেখানে ফাকা দেখে বুকটা ধ্বক করে উঠল। আজ সারাদিনে একটা বারের জন্যও কথা হয় নি মেয়েটার সাথে।

এখন মনটা খুব করে চাচ্ছে মেয়েটার সাথে কথা বলতে। কিন্তু এত রাতে ননদের ফোনে ফোন দিবে বিষয়টা তার কাছে ভালোও লাগতে ছিল না। মন আর বিবেক এর সাথে যুদ্ধ করে অবশেষে বিবেক মনের কাছে হেরে গেল। সে ফোন দিয়ে বসল ননদ এর নাম্বারে। প্রথম বার বেজে ওঠার পরেই ফোন রিসিভ হলো। সস্তির নিঃশ্বাস ফেলল তহমিনা৷ যাক আপা তাহলে ঘুমান নি। কিন্তু তার চিন্তাকে উল্টো করে দিয়ে ওপাশ থেকে পুরুষালী কন্ঠ ভেসে এলো।

– হ্যা মামি বলো।
– তুরাগ তুমি? এটা তো আপার নাম্বার।
– হ্যা আম্মু ফোনটা ড্রইং রুমে রেখেই ঘুমুতে চলে গেছে।
– ওহ আচ্ছা। আমি একটু তরুর সাথে কথা বলতে ফোন দিয়েছিলাম।
– ওহ। তোমার মেয়ে জেগে আছে বোধহয়। দাড়াও ডেকে দিচ্ছি।
বেশ অনেকক্ষণ কথা হলো মা মেয়ের মাঝে। কথার এক পর্যায়ে তরু জানতে চাইল

– আচ্ছা আম্মু একটা কথা জিজ্ঞেস করব?
– হ্যা কর।
– আচ্ছা তুরাগ ভাইয়া এমন গোমড়ামুখো কেনো। কেমন যেন একটা স্বভাবের। ফুপিদের সাথে কথাও বলে না ঠিক মতো।
– ও আসলে সেদিন মিথিলার এক্সিডেন্ট এর পরেই এমন চেন্জ হয়ে গিয়েছে।
– কি বলো আম্মু। সেই যে মিথিলা আপু ছিল উনি এক্সিডেন্ট করেছিল? কি বলো এগুলা। আমি তো জানি না এগুলা। তোমরা আমাকে এগুলো কখনো বলো নি কেন?

ভালোবাসার বর্ষণ পর্ব ১২

আপনার সব প্রশ্নের উত্তর আমি দিব মিস তরুলতা। তবে আপনি বলুন আপনার আমাকে নিয়ে এত হেডএক কেন?
হঠাৎ পেছনে তাকিয়ে তুরাগকে দেখে চমকে যায় তরু। তুরাগ এখন আবার এ রুমে কেন এসেছে। আর আম্মু যদি ফোনে তুরাগ এর কন্ঠ শুনে ফেলে তাহলেই বা কি ভাববে।

ভালোবাসার বর্ষণ পর্ব ১৪