ভালোবাসার বর্ষণ পর্ব ১৪

ভালোবাসার বর্ষণ পর্ব ১৪
নীহারিকা নুর

এত রাতে একটা মেয়ের ঘরে আসতে আপনার বিবেকে বাধল না তুরাগ ভাই।
তরুর কথা শুনে তুরাগ কোন উত্তর না দিয়ে রুমের মধ্যে এগিয়ে আসল। তুরাগকে এভাবে আগাতে দেখে তরু কান থেকে ফোনটা নামিয়ে ফেলেছিল। তবে জায়গা থেকে এক পা ও নড়ল না। তুরাগ ঠিক তরুর বরাবর দাড়াল। তাদের মাঝে অল্প কিছু দূরত্ব বিদ্যমান। তুরাগ মাথাটা নিচু করল। তরু ফট করে মাথাটা সরিয়ে নিল। কিন্তু বেশি দূর যেতে পারল না এর আগেই কানের পাশে ফিসফিস করে কারো বলা কথা কানে বাজতে লাগল

– ভয় পাবেন না মিস তরুলতা। আপনার মনটা বড্ড বেশি নির্লজ্জ তাই অল্পতেই উল্টা পাল্টা ভেবে ফেলে। আপনার প্রতি আমার কোনো ইন্টারেস্ট নেই বুজছেন। আর কি বললেন বিবেকে বাধে নি আমার। কাল গভীর রাতে যখন আমার রুমে গিয়েছিলেন তখন। আপনারা করলে কোন দোষ নেই শুধু আমরা করলেই অন্যায়। এটা তো ঘোর অন্যায় মিস তরুলতা।
এতটুকু বলে কানের কাছ থেকে সরে আসল তুরাগ। তারপর কন্ঠস্বর ছেড়ে একটু জোড়েই বলল

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

– না বাধে নি। মামি ফোনের লাইন কে’টেছে?
– না আম্মু লাইনেই আছে।
– কথা শেষ করে নিচে আসবেন মিস তরুলতা। ক্ষুধা লেগেছে প্রচুর। বাহির থেকে খেয়ে আসিনি।
– ফুপিকে বলেন।
– আম্মু শুয়ে পড়েছে।
– আচ্ছা আসছি আমি।

তুরাগ আর কথা না বলে যেভাবে এসেছিল সেভাবেইচলে যায়। তরু তখনো স্টাচু হয়ে সেখানেই দাড়িয়ে আছে। কেমন একটা অদ্ভুত অনুভুতি হচ্ছে। এখনো মনে হচ্ছে কানের কাছে কথা গুলো বাড়ি খাচ্ছে। কান অনেক সেনসিটিভ একটা অঙ্গ। আর এই বেটা খবিশ কানের কাছে ফিসফিস করে কথা বলে সব সময়। হঠাত তরুর খেয়াল হলো তহমিনা বেগম এখনো লাইনে। তরু তাড়াহুড়ো করে আবার ফোন কানে তোলে

– হ্যা আম্মু আছো
– তুরাগ এসেছিল তোর রুমে।
– হ্যা আম্মু ক্ষুধা লাগছে নাকি তার। ফুপি ঘুমিয়ে পড়েছে তাই আমাকে ডাক দিল। একটু আগে ফোন দিতে এসে আমাকে সজাগ দেখে গিয়েছে তো তাই।
– সে তো আমি শুনতেই পেলাম। কিন্তু আপা যতটুকু বলেছিল তুরাগ নাকি বাসায় খাবার খায় না।
– এখন খায় আম্মু্।

– ওহ আচ্ছা। আচ্ছা তোর ফুপিকে বিরক্ত করিস না ওকে খাবার তুলে দে তুই। আমি রাখলাম। আর ফুপির ফোন দিয়ে ফোন দিস মাঝে মাঝে।
– জ্বি আম্মু ভালো থেকো।
তরু ফোনের লাইন কে’টে ফোন হাতে নিয়েই নিচে নামছিল। তুরাগ ততক্ষণে ডায়নিং এ গিয়ে বসেছে। তরু ফোনটা রেখে একটা চেয়ার টেনে তুরাগ এর ঠিক বরাবর অপর পাশের চেয়ারে। তুরাগ মাথা নিচু করে ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে আছে। কি যেন দেখছে। তরু সেদিক থেকে নজর ফিরিয়ে প্লেটে খাবার তোলায় ব্যাস্ত হয়ে পড়ল। তুরাগ কথায় চোখ ঘুরিয়ে তরু তার দিকে তাকায়। তুরাগ ফোনটা টেবিল এর উপর রাখতে রাখতে বলে

– আমাকে একদিন খাবার টেবিলে আনার জন্যই কি ওইদিন কান্নার নাটক করেছিলেন মিস তরুলতা। আমি যাতে আমার জেদ এর কাছে হার মানি এটাই আপনার উদ্দেশ্য ছিল তাই না।
– কি বলছেন আপনি এসব। আমি এমনটা করতে যাব কোন দুঃখে।
– তাহলে আজকে কেন খাবার রেডি করে বসে ছিলেন না।

তরুর মেজাজ খারাপ হয় তুরাগ এর কথা শুনে। এই বেটা বলে কি। তরু কি এর চাকরি করে নাকি যে প্রতিদিন ওনার জন্য রাত জেগে খাবার নিয়ে বসে থাকবে। মনের কথা মুখ ফসকে বলেও ফেলল
– কেন আমি কি আপনার বেতন ভুক্ত কর্মচারী নাকি যে প্রতিদিন আপনার জন্য বসে থাকব।
– ওহ আচ্ছা এই কথা। তাহলে সমস্যা নেই কাল থেকে বাহিরেই খাব কি বলেন।
তরু বুঝল মুখ ফসকে ভুল জায়গায় ভুল কথা বলে ফেলেছে। তাই বলল

– না না তুরাগ ভাই আপনি এমনটা করবেন না। তাহলে ফুপি অনেক কষ্ট পাবে। এমনিতেই আপনি তার কথা শোনেন না সেজন্য প্রায়ই কান্না করে। আপনাকে বাসায় খেতে দেখে সব থেকে বেশি খুশি তিনিই হয়েছেন এখন আপনি কি চান তাকে আবার কষ্ট দিতে। এটা করা আপনার মোটেও উচিত হবে না।

– তাহলে কি আপনার এই কাজের জন্য বেতন চাই নাকি? লাগলে দিতেই পারি আমি। তবে আপনাকেই কাজটা করতে হবে। আমার বাসায় ফিরতে প্রতিদিনই লেট হয়। আর এতরাতে আম্মুকে আমি বিরক্ত করতে পারব না। এখন আপনি ভাবেন।

তরু মনে মনে ভাবল এই লোকেরে খেতে রাজি করাতে কত বড় একটা ধমক শোনা লাগছে। এখন যদি না করে দিলে সত্যি সত্যি আবার না খায়। তাই তরু বলল
– নাহ তুরাগ ভাই কি যে বলেন না। আমাকে কি আপনার ছোটলোক মনে হয় যে এতটুকু কাজ করে টাকা নিব। আমি এমনি করে দিব। শত হোক দিলদরদি মানুষ আমি। আমি এমনিতেই মানুষ এর সেবা করি।

তুরাগ বুঝল লাস্ট কথাগুলো ওকে খোচানোর জন্যই তরু বলেছে। কিন্তু আর রিপ্লে করল না তুরাগ। কথা বাড়ালেই কথা বাড়বে তাই চুপচাপ খাওয়ায় মনযোগ দিল। খাওয়া যখন শেষ তরু গুছিয়ে রাখছিল সব তখন তুরাগ বলল
– মিস তরুলতা কালকে তৈরি হয়ে থাকবেন আপনাকে একটা জায়গায় নিয়ে যাব। কাল আমি একা যাব ভেবেছিলাম। কিন্তু আপনার অনেক আগ্রহ দেখে মনে হলো আপনাকেও নিয়ে যাই একবার।

তরু প্রথমে বুঝতে পারল না কি জবাব দিবে। আজকে যে সমস্যায় পড়ল তারপর আবার তুরাগ এর সাথে বাহিরে যাওয়ার মতো সাহস করে উঠতে পারছিল না। তাই বলল
– ফুপি আপনার সাথে বাহিরে যেতে নিষেধ করেছে।
– এসব লেইম এক্সকিউজ দিবেন না। আপনি শুধু তৈরি হয়ে থাকবেন। আপনার সব প্রশ্নের উত্তর সেখানে আছে।
তরু কোন জবাব দিল না। ও নাহয় একটু জানতেই চেয়েছিল ওর মায়ের কাছে তাই বলে এই লোকটা এমন ভাবে বলবে।
– আমি আপনার সাথে যাব না তুরাগ ভাই।

– আমি কারো ইচ্ছে অনিচ্ছা জানতে চাই নি৷ আমি শুধু আমার কথাটা জানালাম৷ কাল একবার সুযোগ দিয়েছি। এটা যদি মিস হয় তো আর জীবনে ইচ্ছাও পোষণ করতে পারবে না আমার ব্যাপারে জানার। মাইন্ড ইট।
তুরাগ তরুকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে সেখান থেকে গটগট পায়ে সেখান চলে গেল।
তরু ভেবাচেকা খেয়ে সেখানেই বসে রইল।

সকালের নাস্তার পর্ব চুকেছে বেশ কিছু সময় আগে। এটো বাসন গুলোও পরিষ্কার করা হয়ে গেছে। দুপুর এর রান্না বসাতে এখনো ঢের দেরী। সুফিয়া ফোন করেছিল। সে আসবে। আসতে একটু লেইট হবে। তবুও বারবার করে বলে দিয়েছে নুরনাহার যেন কাজে হাত না লাগায়৷ যা থাকে সব এসে ও করবে। মেয়েটা বড্ড পছন্দ করে নুরনাহারকে। সুফিয়ার আসার কথা শুনে নুরনাহার ও কিছুটা নিশ্চিত মনে বসে আছে। ড্রইং রুমে সোফায় বসে টিভি দেখছেন।

এই মুহুর্তে তার টিভি দেখার সঙ্গী হচ্ছে তরু। যদিও তরুর এসবে মন নেই। তার মন বলছে কখন তুরাগ উঠে জিজ্ঞেস করে যে আপনি তৈরি তো মিস তরুলতা। কিন্তু তরু তো এখনো তৈরি হয় নি। আর ফুপিকে বা কি বলে রাজি করাবে। তাই চুপচাপ দুই পা সোফার উপরে তুলে গুটিশুটি মে’রে বসে আছে। নুরনাহার অবশ্য বেশ কিছুক্ষণ আগেই লক্ষ্য করেছে যে তরু এভাবে গুটিশুটি হয়ে বসে আছে।

তবুও তরুকে বেশি ঘাটাতে গেলেন না এই মুহুর্তে। হঠাৎই সেখানে আগমন ঘটে তুরাগ এর। নুরনাহার টিভি থেকে চোখ সরিয়ে ছেলের দিকে তাকায়। তুরাগ একদম তৈরি হয়েই নিচে নেমেছে। আজ আর ফর্মাল ড্রেস নয়। একটা টি-শার্ট আর জিন্স পড়া। নুর নাহার বুঝলেন আজকেও তাহলে তার ছেলে অন্য কোথাও যাচ্ছে বলে বের হচ্ছে। কিন্তু এই মুহুর্তে তুরাগ যদি নিজে না বলে তাহলে আগ বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করবেন না তিনি তাই চুপ করে রইলেন৷ তুরাগই আগে কথা বলল

– আম্মু আমি একটা কথা বলতে এসেছি রাখবে বলো।
তুরাগ এর স্বাভাবিক কথা শুনে ভেতরে ভেতরে খুশিতে আপ্লুত হয়ে গেলেন নুরনাহার। কিন্তু বাহিরে সেটা চেপে রেখে বললেন
– হ্যা কি বলবে বলো।
– আম্মু আমি একটু ঢাকার বাহিরে যাচ্ছি।

ঢাকার বাহিরে যাচ্ছে শুনেই বুকটা ধ্বক করে উঠল নুর নাহার। তার মন বলছে তুরাগ সেই মেয়েদের বাসায় যাবে আবার। নুর নাহার কিছু বলবে তার আগেই তুরাগ বলে
– আমি একা যাব না তরুকে সাথে নিয়ে যেতে চাচ্ছি আশা করছি তুমি আপত্তি করবে না। তরু যেতে রাজি আছে। তুরাগ এর কথা শুনে তিনি তরুর দিকে তাকালেন। তরু নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। নুর নাহার বুঝলেন তরু যেতে চায়৷ তবুও তার মন সায় দিচ্ছে না। তুরাগ বলে উঠল

– ওহো আম্মু চিন্তা করো না। তোমার আদরের ভাতিজিকে যেভাবে নিয়ে যাব ঠিক সেভাবেই ফেরত দিব। তবে রাস্তার ময়লায় কালো হয়ে গেলে সেই দায় কিন্তু আমার না।
তুরাগ এর কথা শুনে তরু চোখ ছোট ছোট করে তুরাগ এর দিকে তাকায়। সোজা ভাবে কথা বলতে পারে না নাকি পেচিয়ে কথা বলা রক্তে মিশে আছে।
নুর নাহার জানতে চাইলেন

– তুমি কি মিথিলাদের বাসায় যাবে?
এবার আর তুরাগ আর কোন জবাব দেয় না। নুর নাহার যা বোঝার বুঝে যায়। কিন্তু তিনি এটা বুঝতে পারছে না যে তুরাগ তরুকে কেন নিয়ে যেতে চায়।
– তরুকে কেন নিবে?

– আমাকে সেখানে যেতে নিষেধ করা হয়েছে। কিন্তু অনেক দিন সেখানে যাই না৷ তাই একটু খোজ খবর নেয়াটা জরুরি। আমি একা গেলে আমার উপর রেগে যাবে। তবে তরুকে দেখলে কিছু বলবে না তাই।
নুর নাহার আর কিছু বললেন না। তার ছেলে এতদিন পরে আবার আগের মতো তার সাথে কথা বলেছে এটাই অনেক। তাই তিনি চুপ করে রইলেন। তুরাগ তরুকে তাড়া দিলেন দ্রুত তৈরি হওয়ার জন্য।

নুরনাহার চুপচাপ তবে তাকে দেখে মনে হচ্ছে তার সম্মতি আছে। তরুর সব কিছুতে আগ্রহটা একটু বেশিই তাইতো জানার ইচ্ছেটাকে চেপে রাখতে পারছে না। উঠে গেল সেখান থেকে। আলমারি খুলে সেখান থেকে বেছে বেছে হালকা আকাশি রঙের একটা থ্রিপিস বের করল। ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে তৈরি হয়ে নিল। তার সাথে ম্যাচিং করে একটা হিজাব বেধে নিল। চোখের নিচে টেনে কাজল পড়ল। ঠোটে হালকা কালার এর একটা লিপস্টিক। ব্যাস তৈরি। যত দ্রুত তৈরি হওয়া সম্ভব হলো।

এতটা পথ জার্নি পুরোটা রাস্তা দুজনেই নিরব ছিল। তরুর জানতে ইচ্ছে করছিল অনেক কিছু তবে তুরাগকে এভাবে চুপচাপ থাকতে দেখে তরুও আর কিছু জিজ্ঞেস করে নি। দীর্ঘ পথ জার্নির শেষে অবশেষে গন্তব্যে এসে পৌছালো ওরা। তুরাগ সামনে সামনে যাচ্ছে আর তার পেছন পেছন যাচ্ছে তরু। একটা বাড়ির সামনে এসে থেমে গেল তুরাগ। বাড়িটা বেশি বড় নয়। খুব ছোট্ট একটা বাড়ি। হয়ত দুটো কি তিনটি রুম থাকতে পারে ভেতরে। তবে বাহিরের পরিবেশ টা দেখে বেশ পছন্দ হলো তরুর।

কয়েক বার দরজায় টোকা দিতেই একটা মেয়ে এসে দরজা খুলে দিল। কোন ক্লাসে পড়ে সেটা দেখে বোঝা সম্ভব হলো না তরুর। তবে তরুর ধারণা হলো মেয়েটা হয়ত ওর বয়সীই হবে। তুরাগকে দেখে সালাম দিল মেয়েটা। তুরাগ সালাম এর জবাব দিয়ে কুশল বিনিময় করল। মেয়েটা সামনে থেকে সরে ওদের ভেতরে প্রবেশ করতে দিল। তুরাগ জানতে চাইল তোমার আপু কোথায় মোহনা?
মেয়েটা তার মিষ্টি কন্ঠে জবাব দিল

– আপু ওর রুম ছাড়া আর কোথায় থাকবে ভাইয়া।
মেয়েটির কথা শুনে তুরাগ এর মুখে নেমে এলো অন্ধকার। তরু নিরব চাহনিতে সবটাই অবলোকন করে যাচ্ছে। মোহনা মেয়েটা তুরাগকে সাথে আসতে বলে একটা রুমের দিকে গেল। তুরাগ আর তরুও পেছনে পেছনে গেল। সেখানে ঢুকে দেখতে পেল বেড এর উপরে একটা মেয়ে শুয়ে আছে। মেয়েটা বোধহয় ঘুমিয়ে আছে। দেখতে ভীষণ মিষ্টি লাগছে মেয়েটাকে। একটা চেয়ার টেনে বেড এর পাশে বসল তুরাগ। তরু সেখানে বসতে নিলে মোহনা বলল

ভালোবাসার বর্ষণ পর্ব ১৩

– আপু তুমি আমার সাথে বাহিরে আসো। তরু তুরাগ এর দিকে তাকালো। তুরাগ ইশারায় ওকে যাওয়ার জন্য বোঝাল। দ্বিমত করল না তরু। মোহনার সাথেই বেরিয়ে এলো। দরজা অবধি এসে একবার পেছন ঘুরে তাকালো। দেখতে পেল তুরাগ সেই ঘুমন্ত মেয়েটির মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। তৎক্ষনাৎ চোখ ঘুরিয়ে নিল তরু। কেন যেন এ দৃশ্য দেখতে মন সায় দিল না তরুকে। দ্রুত পায়ে বের হয়ে এলো সে রুম থেকে।

ভালোবাসার বর্ষণ পর্ব ১৫