ভালোবাসার বর্ষণ পর্ব ১৫

ভালোবাসার বর্ষণ পর্ব ১৫
নীহারিকা নুর

ছাদের রেলিং ঘেঁষে দুই রমনী দাড়িয়ে আছে। একজন বাহিরে তাকিয়ে প্রকৃতি বিলাসে বিভোর। অপরজন প্রকৃতি বিলাসকারীনি রমনীকে খুটিয়ে খুটিয়ে দেখায় ব্যাস্ত। হঠাৎ প্রকৃতি থেকে চোখ ফিরিয়ে মোহনার দিকে নজর দিল তরু। মোহনা তখনো এক নজরে তরুর দিকে তাকিয়ে আছে। তরু জিজ্ঞেস করলো

– আপনি মোহনা তাই না৷
– জ্বি৷
– আপনি এভাবে কি দেখছেন মোহনা আপু?
– আমাকে আপু বলতে হবে না। হয়ত আমরা সেম এজ হবো৷ আর দেখছিলাম কি শুনবে?
– হুম।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

– জানো তোমার চোখ দুটো না একদম আমার আপুর মতো৷ কত মিল দুজনের।
– কি বলছো আপু?
– হুম সত্যি। ওখানে বেড এ শোয়া দেখলে না ওটাই আমার আপু।
– তার নাম কি?
– সে কি তুমি আপুর নাম জানো না অথচ আপুকে দেখতে চলে এসেছো।
– আসলে তুরাগ ভাই আমাকে নিয়ে এসেছে। আমি তেমন কিছুই জানি না।
– ওহ আই সি৷ তুরাগ ভাইয়া কি হয় তোমার?

– আমার ফুপির ছেলে৷ আচ্ছা তোমার আপুর নামটা তো বললে না।
– আমার আপুর নাম মিথিলা।
– আপু কি অসুস্থ? এভাবে ভর দুপুরে শুয়ে আছে কেন?
তরুর কথার প্রতিউত্তরে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল মোহনা৷ তারপর বলল
– আপুর জীবন তো এখন বিছানায় শুয়ে শুয়েই কা’টে।
– মানে? বুঝিনি একটু পরিষ্কার করে বলো তো।
– তুমি সত্যিই কিছু জানোনা?
– সত্যিই জানি না আমি। আমাকে কখনো কেউ এসব ব্যাপারে বলে নি।
– আপির দুটো পায়ের একটা পা ও নেই।

কথাগুলো বলতে নিয়ে মোহনার চোখ ভিজে উঠছিল। কথাগুলো দলা পাকিয়ে আসছিল গলার কাছে।
তরু সামনে এগিয়ে গিয়ে মোহনার হাত ধরল। তরুর হাতের উপরেই টুপটাপ দু ফোটা নোনাজল পড়ল।
এই মুহুর্তে তরুর ও ভীষণ খারাপ লাগল। কিছুক্ষণ আগেও কেমন একটা রাগ রাগ হচ্ছিল মেয়েটার উপর।

তরু যে তুরাগকে ভালোবাসে এমনটা নয়। তবুও কেন যেন তুরাগকে অন্য কারো পাশে দেখে খারাপ লেগেছিল। তবে সেই হিংসের রেশটুকুও এখন খারাপ লাগায় রুপ নিল। তবে জানার আগ্রহটুকু কোনভাবেই দমিয়ে রাখতে পারল না৷ মোহনার হাত চেপে ধরে সামনের দিকে এগুলো। ছাদের এক কর্নারে একটা দোলনা বসানো। সেখানে গিয়ে বসল দুজন। মোহনা ততক্ষণে নিজেকে সামলে নিয়েছে। তরু আসার পর ওদের দুজনকে ছাড়া আর কাউকে দেখতে পায়নি তাই জানতে চাইল
– আচ্ছা তোমাদের সাথে আর কেউ থাকে না।

– হ্যা আম্মু থাকে। অবশ্য তিনি দিনে থাকেন না। দিনের বেলায় তাকে তার অফিসে যেতে হয়।
– তিনি কি চাকরি করেন?
– হুম৷ আসলে আপুর ওরকম পরিস্থিতি বাবা মেনে নিতে পারেন নি। তিনি ছিলেন হার্ট এর পেশেন্ট। হার্ট ব্লক হয়ে মা’রা গিয়েছিলেন তিনি। এরপর বাবা যে অফিসে চাকরি করত সেই অফিসেই আম্মুকে একটা কাজের ব্যাবস্থা করে দেয়া হয়েছে। এই ভাবেই আমাদের সংসার চলতেছে।

– আচ্ছা তুমি আমাকে বলো না সবটা।
মোহনা মনে মনে ভাবল মিথি আপু তো ঘুমুচ্ছে। সে যতক্ষণ নিজ থেকে না জাগবে ততক্ষণ তুরাগ ভাই ও ডাকবে না৷ সেটা অনেক সময় এর ব্যাপার। ততক্ষণে নাহয় পুরনো স্মৃতিচারণ করাই যায়।

মিথিলা খুবই হাস্যজ্বল এবং চঞ্চল প্রকৃতির মেয়ে ছিল। আর গান ছিল ওর সবথেকে বেশি পছন্দের।পছন্দের বেশ কয়েকজন সিঙ্গার এর তালিকায় তুরাগ সাইয়্যিদ ও ছিল। তুরাগ ভাইয়া তখন ফেমাস একজন সিঙ্গার। আপু যখন অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী ছিল তখন ওদের কলেজে একটা প্রোগ্রাম হয়েছিল। কিসের প্রোগ্রাম আমি ঠিক জানি না৷ তবে বেশ বড় করে ঝমকালো আয়োজন করা হয়েছিল। গান পরিবেশন এর জন্য ইনভাইট করা হয়েছিল তুরাগ সাইয়্যিদ ভাইয়াকেও।

আপু খুব এক্সাইটেড ছিল পছন্দের সিঙ্গারকে সামনে থেকে দেখতে পাবে সেই ভেবে। সেদিন খুব সুন্দর ভাবে সেজেছিল ও। সাদামাটা চলাফেরা করা মেয়েটা হুট করে সাজায় সেদিন বেশ সুন্দর লেগেছিল। আম্মু সেদিন আপুর চোখের নিচ থেকে একটু কাজল নিয়ে ঘাড়ে লাগিয়ে দিয়েছিল। বলেছিল কারো নজর না লাগুক৷ কিন্তু কাজ তো হয় নি। নজর তো লেগেছিল। তুরাগ সাইয়্যিদ ভাইয়ার। তিনি স্টেজে বসেই লক্ষ্য করেছিলেন আপুকে। তবে সেদিন কিছুই বলা সম্ভব হয়নি।

কিন্তু পরে তিনি ঠিকই আপুকে খুজে বের করেছিলেন। একটা গিফট বক্স পাঠিয়ে দিয়েছিল আমাদের ঠিকানায়। উপরে প্রেরকের ঠিকানা দেয়া ছিল না তাই প্রথমে আমরা কেউই বুঝতে পারিনি যে বক্সে কি আছে। ভেতরে ছিল নীল রঙের একটি শাড়ী, এক মুঠ কাচের চুড়ি, এক পাতা টিপ, বেলী ফুলের গাজড়া। আর ছিল নীল রঙের একখানা চিরকুট। চিরকুটে ঠিক কি লেখা ছিল সেটা আমার আজও অজানা। আপুকে দেখতাম সেটা খুব যত্নে রেখে দিত। আমি তখন অনেকটাই ছোট তবুও এতটুকু বুঝতাম গিফটগুলো যে দিয়েছে সে নিশ্চয়ই ভীষণ রোমান্টিক।

এরপর কে’টে গেছে বেশ কিছু দিন। এরকমই এক বসন্ত বিকেলে আপুকে দ্বিতীয় বারের মতো সাজতে দেখেছিলাম আমি৷ সেই অপরিচিত ব্যাক্তির দেয়া সমস্ত জিনিস গুলো দিয়ে সেদিন সযত্নে সেজেছিল। আম্মুর থেকে পারমিশন নিয়েই বেরিয়েছিল বাসা থেকে। সেদিন বাসা থেকে হাসি মুখেই বেড়িয়েছিল। যখন ফিরল তখন চোখ মুখে খুশি যেন উপচে পড়ছে। বাসায় ফিরে আবেগে আপ্লুত হয়ে জড়িয়ে ধরেছিল সেদিন।

সেদিন রাতের খাবার শেষ করে দু বোন বসেছিলাম গল্পের আড্ডায়। আমি ছোট হলেও আপু সব কিছু শেয়ার করত আমার সাথে। সেদিন আপু তুরাগ ভাইয়ার কথা জানিয়েছিল আমাকে৷ কিন্তু আমার মন বলছিল তখন উল্টো কথা। ওকে আমি সেদিন বুঝিয়েছিলাম আপু এই ভুলটা তুমি করো না। এদের মতো সেলিব্রিটিদের বিশ্বাস নেই। আজ তোমাকে ভালো লাগছে তাই তোমার কাছে আসছে। দুদিন পরে নতুন কাউকে ভালো লাগবে সেদিন তেমাকে ছুড়ে ফেলে দিবে দেখো। সেদিন আপু আমাকে বেশ জোড়েই একটা ধমক দিয়েছিল আর বলেছিল

– তুই ছোট মানুষ। তোর এসব বোঝার বয়স হয়নি।
আপু নাকি তুরাগ ভাইয়ের চোখে ভালোবাসা দেখেছিল সেদিন।
আসলে সেদিন আমিই ভুুল ছিলাম। আপুই ছিল সঠিক। তুরাগ ভাই সত্যি সত্যিই আপুকে তার সর্বোচ্চ দিয়ে ভালোবেসেছে। তবে আপুর ভাগ্যে এত ভালোবাসা সয়নি।

কথা বলতে বলতে মোহনার চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ে। কিছু সময় থেমে যায় মোহনা। তরু আবার জিজ্ঞেস করে
– তারপরে কি হয়েছিল? আমার তো মনে হচ্ছে তুরাগ ভাইয়া এখনো তোমার আপুকে ভালোবাসে। তাহলে?
– তুরাগ ভাইয়ার ভালোবাসা ঠিকই ছিল। ওদের ভেতরে সব কিছুই ঠিকঠাক ছিল কিন্তু কাল হয়ে দাড়য়েছে আমাদের দারিদ্র্যতা।
– মানে?

– ওদের সম্পর্কের তখন প্রায় ছ মাস হতে চলেছিল তখন একদিন তুরাগ ভাইয়া আপুকে বলে যে আপুকে ভাইয়ার ফ্যামিলির সাথে পরিচয় করাতে নিয়ে যাবে। প্রথমে আপু রাজি ছিল না পরে ভাইয়ার জোরাজুরিতে রাজি হয়েছিল। সেদিন যখন তুরাগ ভাইয়া পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল সেদিন সবাইই হাসি মুখে মেনে নিয়েছিল। তুরাগ ভাইয়ার ছোট বোন আছে না তুরফা আপু কোন ইউনিভার্সিটিতে যেন পড়ে ওই আপুও সেদিন ছুটিতে বাসায় এসেছিল।

মিথিলা আপুর সাথে তুরফা আপুর ও একটা ভালো সম্পর্ক হয়। ভাইয়ের গার্লফ্রেন্ড হিসেবে বেশ পছন্দ হয়েছিল মিথিলা আপুকে। সেদিন ভালোভাবেই তুরাগ ভাইয়া আপুকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে গিয়েছিল। এদিকে তুরফা আপুর সাথে মিথি আপুর ফ্রেন্ডশিপ এর গভীরত্ব দিন দিন আরো বেড়ে যাচ্ছিল। এরপরে আরো কয়েক মাস কে’টে গিয়েছে। আপুর আর তুরাগ ভাইয়ার ফোনেই কথা হতো কিন্তু কখনো দেখা করত না। এরপর সেমিষ্টার ব্রেকে তুরফা আপু বাসায় আসে।

সে আপুর সাথে দেখা করতে চায়। তাদের বাসায় যাওয়ার জন্য রিকোয়েস্ট করে। এরপরে দুইজন মিলে প্লান করে যে তুরাগ ভাইয়াকে না জানিয়েই আপু যাবে। এরপর ভাইয়াকে সারপ্রাইজ দিবে। কিন্তু কে জানত আপু নিজেই সারপ্রাইজড হয়ে যাবে সেদিন।

তুরফা আপু যখন মিথিপুকে নিয়ে বাসার ভেতরে প্রবেশ করে তখন সামনেই দেখা হয় নুরনাহার আন্টির সাথে। মিথিপু নুরনাহার আন্টিকে সালাম দেয় কিন্তু তিনি সালামের জবাব না দিয়ে বেড়িয়ে যায় রুম থেকে। আপু প্রথমে বুঝতে পারে না তার এমন আচরণের কারণ। তুরফা আপু সবটা স্বাভাবিক করতে মিথিপুর হাত ধরে তার রুমে নিয়ে গিয়েছিল। অপেক্ষা করতে করতে প্রায় বিকেল ঘনিয়ে আসছিল।

তবুও তুরাগ ভাইয়ের আসার নাম ছিল না৷ এদিকে আপু চাচ্ছিল বাসায় চলে আসতে কিন্তু তুরফা আপু আসতে দিবে না হাত ধরে বসেছিল। তখন সেখানে নুরনাহার আন্টি আসে। তিনি তখনো মুখ গোমড়া করে ছিলেন। তারপর তিনি যা বলেন তা শোনার জন্য আপু মোটেও প্রস্তুত ছিল না। ( তুরফা আপুকে উদ্দেশ্য করে বলেছিল তোরা দুই ভাই বোন কি শুরু করেছিস। নিজেদের লেভেল কি ভুলে গিয়েছিস।

একটা থার্ড ক্লাস মেয়েকে নিয়ে এত বাড়াবাড়ি করার কি আছে। কি ভেবেছিস কোন ফ্যামিলি থেকে বিলং করে সে খবর আমি জানিনা। সব জানি৷ ভেবেছিলাম নিজের ছেলের জন্য দেখে শুনে ভালো ফ্যামিলি থেকে মেয়ে নিয়ে আসব। কিন্তু না ছেলে পছন্দ করে নিয়ে আসল যার কোন ফ্যামিলি স্টাটাসই নেই। বাবা সামন্য বেতন ভুক্ত কর্মচারী। নিজের রুপ দেখিয়ে ঠিকই আমার ছেলেকে ফাঁ’সিয়েছে।)

এরপর তুরফা আপুকে বাদ দিয়ে সরাসরি মিথি আপুকেই বলেছিল – এই মেয়ে তোমার কি আত্মসম্মান বলতে কিছু নেই নাকি। নিজেদের অবস্থান ভুলে গেছো। তোমার ফ্যামিলির কি যোগ্যতা আছে আমাদের ফ্যামিলির সাথে তাল মিলিয়ে চলার। শোন মেয়ে বিয়ে শুধু দুজন ছেলে মেয়ের মাঝেই হয় না এর সাথে জড়িয়ে আছে দুটো পরিবারের সম্পর্ক। দুটো পরিবারের মধ্যে সম্পর্ক গড়ে ওঠে এই বিয়ের মাধ্যমে। নিজের এই রুপ যৌবন দেখিয়ে কতদিন আটকে রাখবে আমার ছেলেকে শুনি। যদি আত্মসম্মান এর ছিটে ফোটাও থাকে তাহলে নিজ ইচ্ছায় আমার ছেলের জীবন থেকে সরে যাবে। তুরাগ এর সামনে আমি তোমাকে কিছু বলিনি মানে এই নয় যে তোমাকে আমি মেনে নিয়েছি।

এত তিক্ত কথা শুনিয়ে গটগট পায়ে সেখান থেকে চলে গেলেন নুরনাহার আন্টি। তুরফা আপু তখনো এল ধ্যানে মায়ের দিকে তাকিয়ে ছিল। কারণ তিনি নাকি আগে কখনো তার মায়ের এই রুপ দেখেন নি।
আপু ছিল নরম মনের মানুষ। এত কথা হজম করার মতো মন ওর ছিল না। সেদিন ভীষণ কষ্ট পেয়েছিল ও। কান্না আসছিল প্রচুর। আর এক মুহুর্ত ও দেরী না করে নিজের পার্স টা নিয়ে দৌড়ে বেড়িয়ে গিয়েছিল।

গেটের কাছে দেখা হয়ে গেল তুরাগ ভাইয়ার সাথে। তিনি আপুকে দেখে বেশ অবাক হয়েছিলেন৷ কিন্তু আপু তার চোখের জল লুকাতে তুরাগ ভাইয়ের সাথে কথা না বলে মুখ অন্য দিকে ঘুরিয়ে দৌড়ে বেড়িয়ে যায়। তুরাগ ভাইয়াও আপুর পেছন পেছন দৌড় লাগায়। এটা দেখে আপু কোন দিকে না তাকিয়ে রাস্তার মধ্যে দিয়ে ছুটে যায়।

কিন্তু ওদিক থেকে দ্রুতগামী ছুটে আসা মাইক্রো লক্ষ্য করেনি। মুহুর্তের মাঝে সমস্ত কিছু চোখের সামনে শেষ হয়ে গিয়েছিল। মাইক্রোতে ধাক্কা লেগে ছিটকে সামনে পড়ে আপু৷ সেদিন ছিটকে পাশে পড়লে হয়ত আপুর পা দুটো আজ থাকত। কিন্তু পড়েছে সামনে।

ভালোবাসার বর্ষণ পর্ব ১৪

আর মাইক্রোর দুটো চাকা আপুর পায়ের উপর দিয়ে চলে যায়। গগন বিধারি চিতকার দেয় আপু। তুরাগ ভাই পাগলের মতো হয়ে গিয়েছিল সেদিন। তার মনে হচ্ছিল তার চোখের সামনে সব শেষ হয়ে গিয়েছিল সব। জায়গায় সেন্স হারিয়েছিল আপু। তুরাগ ভাইয়া ছুটে এসে আপুর মাথা নিজের কোলে তুলে নিয়েছিল। রক্তের বন্যা বয়ে যাচ্ছিল। ভাইয়া সেদিন চিতকার করে কাদছিল।

ভালোবাসার বর্ষণ পর্ব ১৬