মন পাথরে হঠাৎ ঝড় সিজন ২ পর্ব ২৪

মন পাথরে হঠাৎ ঝড় সিজন ২ পর্ব ২৪
Tahrim Muntahana

অফিস থেকে একপ্রকার ছুটিই নিয়েছে আদর। সাফিন‌কে তার দায়িত্ব দিয়ে পুরো দমে ফ্যাশন সেন্সের দিকে ঝুঁকেছে‌। যে করেই হোক তাকে হৃদানের টিম কে জেতাতে হবেই। না হলে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে হৃদানের বিজনেস পরিচিতি পাবে না! সেই উদ্দশ্যেই চট্টগ্রাম এসেছে। হৃদান চট্টগ্রাম থেকেই নিজের মডেলিং এর শুরু টা করেছিলো।

ইতিমধ্যে এই কথাটিও নেট দুনিয়ায় ভাইরাল‌ হয়ে গেছে। সবাই শুভেচ্ছা জানাচ্ছে আদরকে। আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছে সেই দিনটার। হৃদানের কাজকর্মের সকল ডিটেলস পান্চুর কাছে থাকতো তাই খুব একটা অসুবিধা আদরের হয় নি। পান্চু নিজেও সমান তালে কাজ করে যাচ্ছে। আদর আজকেই ফিরে যাবে হৃদানের টিমকে নিয়ে। কিছু বোঝাপড়া বাকি আছে যে।
পশ্চিমাকাশে সূর্যটা নিভু নিভু জ্বলছে। একটু পরেই অন্ধকার ঘনিয়ে আসবে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

আদর বসে আছে চৌধুরী বাড়ির ড্রয়িং রুমে। হৃদানের টিম মেম্বারের মধ্যে তিনজন মেয়ে তিনজন ছেলে। একজন আসেনি, এসে যাবে। সবাই কে চৌধুরী বাড়িতেই নিয়ে এসেছে আদর। কি দরকার হোটেলে থাকার। আর মাত্র দুটো দিন বাকি। আদর উপরে উপরে স্ট্রং দেখালেও ভেতরে সে দুর্বল হয়ে পড়ছে। হৃদানের ফ্যাশন হাউজের কথা সে ওই দিন ই জানতে পেরেছে।‌ যদি ব্যর্থ হয়? নাবিল চৌধুরী আদরের পাশে বসলেন। আদুরে ভঙ্গিমায় মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,

চিন্তা করিস না মা। তোর আব্বু আছে তো? ব্যবসায়ের দিকটা আমি দেখে নিবো, তুই শুধু ওদের ঠিক রেখে রেম্প‌ওয়ার্ক আর পোশাকের দিক টা দেখে নিস!
আদর মাথা নাড়িয়ে সায় জানালো। ভয় কমে এসেছে। এমন সময় একজন ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলে উঠলো,

পোশাকের দিকটাও দেখতে হবে না আঙ্কেল। আমি সব নিয়ে এসেছি। হৃদান আগেই সব ডিজাইন করিয়ে রেখেছিলো। প্ল্যান‌ অনেক আগের ছিলো। নতুন ব্যবসায় তো! পোশাক ও বানাতে দিয়েছিলো। আর কোনো অসুবিধা হবে না‌। শুধু রেম্প‌ওয়ার্ক টা ভালো করলেই হবে!

নাবিল চৌধুরী ছেলেটিকে জড়িয়ে ধরলো। নাম পিয়াস! হৃদানের বন্ধু। সেও একজন মডেল। আদর একপলক সবগুলো কাপড় দেখে নিলো। কতটা নিখুঁত ডিজাইন, নিখুঁত কাপড়। বুক ভারী হয়ে আসে তার। কাউকে কিছু না বলেই নিজের ঘরে চলে যায়। সবাই খানিকটা অবাক হলেও নাবিল চৌধুরী দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। অসহায় বিচলিত কন্ঠে রামিয়াকে ডেকে বলে উঠলো,

রামু তোর বোনের সাথে থাক, আবার পাগলামি শুরু করবে।
রামিয়া কথাটা শুনা মাত্র‌ই দৌড়ে বোনের ঘরে চলে গিয়ে বোন কে জড়িয়ে ধরে। আদর মাত্র‌ই ব্লেট হাতে নিয়েছিলো‌। রামিয়ার জড়িয়ে ধরায় নিজেকে ধাতস্থ করে সে‌। শব্দ করে কেঁদে উঠে। সময় পেরিয়ে যায়, কান্নার গতিবেগ ও কমে আসে। রামিয়ার বুকেই ঘুমিয়ে পড়ে। রামিয়া আদরের পাশেই বসে থাকে। বলা যায় না কখন‌ কি করে বসে। ড্রয়িং রুমের সবাই নাবিল চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে আছে। তিনি কিছুই বলছেন না শুধু চুপচাপ নিচের দিকে তাকিয়ে আছেন। পান্চু পরিবেশ টা স্বাভাবিক করতে বলে উঠলো,

আপনারা এসব নিয়ে ভাববেন না। কাজে মন দিন, আপনাদের উপরেই বসের স্বপ্ন পূরণ নির্ভর করছে। আর হ্যা আদরের সামনে বস বিষয়ক কোনো কথায় কেউ বলবেন না প্লিজ। ম্যাম কে আপনারা স্বাভাবিক দেখলেও সে স্বাভাবিক নয় বরং ট্রমার মধ্যে আছে। এ‌ই নিয়ে চৌদ্দ বার আত্মহত্যা করার চেষ্টা করছে তবে সজ্ঞানে নয়। হুট করেই ডিপ্রেশনে চলে যায় তখন এমন করে বসে। যাই হোক আমার একটাই অনুরোধ আমার বসের স্বপ্ন টা পূরণ করে দিন না!
গলা ধরে আসে পান্চুর। দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা বাহাদুর চোখের জল লুকিয়ে বাইরেই চলে যায়। সবাই খানিকটা ইমোশনাল হয়ে যায়। মনে মনে নিজেদের কেও তৈরি করে নেয়। দেখা যাক কি হয়!

গভীর রাত! সবাই শান্তির ঘুমে ডুবে আছে। আদর বসে আছে গাড়িতে। ড্রাইভিং সিটে পান্চু সতর্কতার সাথে গাড়ি চালাচ্ছে। আদরের মাথায় ভূত চেপেছে আয়েশার কাছে যাবে। অন্ধকার ঘরে এখন শুধু আয়েশা একা নয় বরং আরো দুজন মানুষ বন্দি রয়েছে। আজ আদর একদম তৈরি হয়েই এসেছে।

গাড়ি থামতেই অধৈর্য পায়ে হেঁটে যায় আদর। বাহাদুর আগে থেকেই ছিলো। আদর কে দেখেই দরজা খুলে দেয়। তিনজন ঢুকে আবার দরজা বন্ধ করে দেয়। শব্দ শুনেই আয়েশা আতকে উঠে। আবার যন্ত্রণা! বাতি জ্বলে উঠতেই আয়েশা চাপা আর্তনাদ করে উঠে পাশে ভাইকে এবং অতি পরিচিত একজন দেখে। আদর হো হো করে হাসে। হাসতেই থাকে, শত্রুর চোখে ভয় দেখে আনন্দ লাগার‌ই কথা! আদর চেয়ারের উপর বসে পিয়ানি কে বিয়ে করতে চাওয়া ছেলেটাকে বলে,

তোর জন্ম পরিচয় সব জানতে চাই। সময় দুই মিনিট। নিচে দেখছিস পিঁপড়া, সব শরীরে ছেড়ে দিবো!
ভয় পেয়ে যায় ছেলেটি। তড়িঘড়ি করে বলে উঠে,
আমার নাম হিমেল। আমার বাবা আরমান, মা আয়েশা! সিঙ্গাপুর থাকি।
আদর চোখ ছোট ছোট করে আয়েশার দিকে তাকায়। হিমেল ও মায়ের দিকে তাকিয়ে। আদর হেসে উঠে। মনের মধ্যে চলছে অন্যকিছু। পান্চুকে বলে উঠে,

মি. হিমেলের অল ডিটেলস বের করো। তার পরেই হবে আসল খেলা!
পান্চু মাথা নেড়ে সায় জানিয়ে চলে যায়। আদর ফোকাস করে পারভেজের দিকে।
তুই ও তোর বোনের সাথে আছিস তাইতো? আরমান কে আয়েশা? ভার্সিটি লাইফের বন্ধু? তাকেই শেষমেষ বিয়ে করলি? তুই না আব্বুকে ভালোবাসতি? যার জন্য রিদিমা‌ চৌধুরী কে মারলি! চাইলে তো নাবিল চৌধুরী কে বিয়ে করতে পারতি। আরমানের মতো প্লে বয় কে কেন? উফ সরি আমি তো ভুলেই গেছিলাম সমানে সমানে মিলেছে। যাই হোক তোদের আর বলতে হবে না। শুধু দেখে যা কি হয়!

তখনি পান্চু আসে। হিমেলের দিকে রাগি দৃষ্টি ফেলে বলে উঠে,
বাবা মায়ের মতোই হয়েছে আদর। সবচেয়ে বেশী অবাক হয়েছি হিমেলের বোন কে দেখে। নাম হিয়া কিন্তু মেয়েটা তো চট্টগ্রাম থাকতো। বাড়িওয়ালার মেয়ে হিসেবে।
আদর ভ্রু কুঁচকে কিছুক্ষণ ভাবে। বাহাদুর কে ইশারা দিতেই ফোন নিয়ে বাইরে চলে যায়। কাজ হয়ে গেছে। আদর হিমেলের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে আয়েশার দিকে তাকায়। এবার সময় এলো ক্ষত’র বদলে ক্ষত সৃষ্টি করা।
বড়‌আম্মুওওও। নাবিল চৌধুরী কে সন্তান হারা করেছো না। এখন তোমার সামনে তোমার ছেলেকে মারলে তোমার কষ্ট হবে?

চিৎকার করে উঠে আয়েশা। কোনো মা’ ই নিজের সন্তানের মৃত্য দেখতে পারে না। আদর হাসতে থাকে। থেকে যায় ওদের আর্তনাদ দেখার জন্য। পান্চু একজন গার্ডকে ডেকে নিয়ে আসে। শুরু হয় হিমেলের উপর অত্যাতার‌। আয়েশা না পারছে চিৎকার করতে না পারছে সহ্য করতে; আগেই তার মুখ বেঁধে দেওয়া হয়েছে। কয়েক ফোটা রক্ত এসে লাগে আদরের সাদা শার্টে। তৃপ্তি নিয়ে নজর বুলায় শার্টে।একসময় হিমেল শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে; চুপচাপ হয়ে যায় আয়েশা! আদর জ্বালা আরো বাড়িয়ে দিতে বলে উঠে,

কষ্ট হচ্ছে বড় আম্মু? কোথায় কষ্ট হচ্ছে আমাকে বলো আমি আরো কষ্ট দিবো। ইশ কেঁদো না বড়‌আম্মু। এ‌ই দেখো তোমার কষ্ট দেখে আমার ও কষ্ট হচ্ছে। কালকের জন্য অপেক্ষা করো। আরেকটা মৃত্য দেখবে। প্রাণপ্রিয় মেয়ের আর্তনাদ দেখবে‌। ইশ‌ কি আনন্দ লাগছে!
হাসতে হাসতে বেরিয়ে যায় আদর। পান্চু বুঝেছিলো এমনটাই হবে তাই আগে থেকেই গাড়িতে বসে আছে। আদর দীর্ঘশ্বাস ফেলে গা এলিয়ে দেয়। কার্ণিশ বেয়ে গড়িয়ে পড়তে থাকে জলরাশি।

সকাল ছয়টা বাজে। চৌধুরী বাড়ি গম গম করছে। কিছুটা আমেজ ফিরে এসেছে বাড়িতে। সম্পূর্ণ ক্রেডিট পিয়াসের। আসার পর থেকে সবাইকে মাতিয়ে রেখেছে। একটু হলেও কষ্টটা ভুলতে পেরেছে সবাই। ছেলেরা সবাই নামাজ পড়ে ঘুরতে বেরিয়েছিলো। সবে ফিরেছে; সুবাহ ব্রেকফাস্ট বানাচ্ছে, সাহায্য করছে হৃদযা-পিয়ানি। রামিয়া পড়তে বসতে চেয়েছিলো তবে এত আমেজ দেখে পড়ায় মন বসে নি। নিজেও নিচে নেমে আসে।

পিয়ানি চা নিয়ে সবাই কে দিচ্ছে। আড়চোখে সাফিন কে দেখছে। এখানে আসার পরের দিন ই সাফিন কে চিনেছে সে। এতটা খু্শি হয়েছিলো অসুস্থতা ভুলে গিয়েছিলো। তবে ব্যাপারটা বুঝতে দেয় নি কাউকে। কালকের প্রতিযোগিতা নিয়েই আলোচনা করছিলো সবাই। পিয়াস হৃদানের‌ প্ল্যান সব‌ই বলেছে সে হিসেবেই কাজ চলছে। এমন সময় বাইরে থেকে গাড়ির হর্ণ আসতেই আলোচনায় ব্যাঘাত ঘটে। কে এলো এত সকালে? দরজা খুলায় আছে, তাই আর কেউ উঠে দেখতে গেল না। এলোমেলো পায়ে প্রবেশ করলো আদর। কেমন‌ বিধ্বস্ত লাগছে। আদর সোজা এসে নাবিল চৌধুরীর পায়ের কাছে বসে। কোলের উপর মাথা রেখে বলে উঠে,

এ‌ই যে রক্ত দেখছো এটা কার রক্ত জানো? তোমার ছেলেকে যে কেড়ে নিয়েছে তার ছেলের! একদিন আমার স্বামীর রক্তে শুভ্র লেহেঙ্গা রাঙা ছিলো না? আজ দেখো স্বামীর হত্যাকারীর সন্তানের রক্তে শুভ্র শার্ট রাঙা।
সবাই অবাক হয়ে দেখছে আদর কে। আদর নিজের মতোই বলে যাচ্ছে,

সবকিছু কেড়ে নিবো, আমার স্বামীকে কেড়ে নিয়েছে ওর স্বামীকেও কেড়ে নিবো। আমার সামনে আমার হৃদ কে আঘাত করেছে না? ওর সামনেই কষ্ট দিয়ে দিয়ে ওর স্বামীকে মারবো। ওর ভাইকেও মারবো ওর সামনে; তখন না বুঝবে ভাই মরলে বোনের কেমন‌ লাগে। কিন্তু ওকে মারবো না। আমার হৃদকে মা হারা করেছে ওকে আমি সন্তান হারা স্বামী হারা সব করবো। প্রত্যেকটা দিন অন্ধকার ঘরে পড়ে থাকবে। একটু একটু করে কষ্ট দিবো।
নাবিল চৌধুরী চমকে গেছে শেষের কথা শুনে। মা হারা করেছে মানে? পিয়াস উঠে আদরের সামনে বসে‌। কেমন মায়া হচ্ছে তার। হুট করেই বলে উঠে,

তোমার জীবন পরিবর্তন হতে বেশী দেরী নেই। ফোকাস করো কম্পিটিশনে।
আদর শুনেছে কি শুনেনি বুঝা গেল না। বিড়বিড় করতে করতে হাঁটা ধরলো। বেশী পথ যেতে পারলো না তার আগেই ঢলে পড়তে নিলেই আগলে নিলো আত‌ইয়াব। হৃদযার দিকে একপলক চোখ রাঙিয়ে ত
উপরে চলে গেল। হৃদযা নিজেও রান্না ঘরে চলে গেল। কাঁদবে না কথা দিয়েও সে রাখতে পারেনি; তার ই বা কি দোষ! নাবিল চৌধুরী চেপে ধরলো পান্চুকে। অগত্যা সব স্বীকার করতে হলো। নাবিল চৌধুরী হতাশ কন্ঠে বলল,

তখন আমার ব্যবসায় টা খারাপ যাচ্ছিলো। আমার করা সব ডিল‌ ক্যান্সেল হয়ে যাচ্ছিলো। বিরাট লস হয়ে গিয়েছিল ‌ তার জন্যেই সবসময় কাজে ডুবে থাকতাম। এরমধ্যে বার বার চিঠিতে হুমকি আসতে লাগলো। সব মিলিয়ে রিদি কে সময় ই দিতে পারছিলাম না। বাড়ি ফিরলে রিদিমার প্রশ্ন করায় রাগ উঠে যেত। ঝগড়া হতো‌‌। কিন্তু তখনো বুঝতে পারেনি রিদিমাকে হারিয়ে ফেলবো।

মন পাথরে হঠাৎ ঝড় সিজন ২ পর্ব ২৩

পরিস্থিতি গুমোট হয়ে গেছে বলে পিয়াস সবাইকে ব্রেকফাস্টের তাগাদা‌ দিলো। মনটা পিয়াসের ও খারাপ। কি থেকে কি হলো! তবে কাল ভালো কিছু হবেই পিয়াসের বিশ্বাস!

মন পাথরে হঠাৎ ঝড় সিজন ২ পর্ব ২৫