মন পাথরে হঠাৎ ঝড় সিজন ২ পর্ব ৫
Tahrim Muntahana
রাতের শেষভাগ! নিস্তব্দ পুরো শহর! একটু পর আবার সবাই শান্তির ঘুমকে দূরে ঠেলে বিছানা ছাড়বে। ভেসে আসবে মুয়াজ্জিনের মিষ্টি কণ্ঠের আযান। জানান দিবে; সময় হলো , আর কত ঘুমাবে, আর কত জীবিকার তাড়নায় এদিক ওদিক ছুটোছুটি করে ক্লান্ত শরীর নিয়ে বিছানায় পড়ে থাকবে! শান্তির জন্য জেগে ওঠো! মনের শান্তি যে বড্ড প্রয়োজন!
এই মুহূর্তে আদরের মনের শান্তিটা খুব করে প্রয়োজন। সারাটা রাত একভাবে বসেছিলো। কখন খবর আসবে? একটা নজর বোনকে দেখতে পারবে! নামায টা আদায় করে গাড়ি নিয়ে বের হয় আদর। এতকিছুর মাঝে হৃদান কে খবর দেওয়ার কথা মনেও আসেনি। সে কোথায় যাবে কোথায় খুঁজবে কিছুই জানে না শুধু জানে তার বোন নিখোঁজ, খুঁজে বের করতে হবে। অন্যমনস্ক হয়ে গাড়ি চালাচ্ছিলো আদর। হুট করে সামনে থেকে গাড়ি চলে আসায় খুব একটা সুবিধা করতে পারেনি।
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
জোরে ব্রেক কষে মাথা নিচু করে রাখে। যখন টের পেলো কিছু হয়নি তখন অবাক হয়ে সামনে তাকালো। কিছুটা দূরত্বে একটি গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে! আদর ঝটপট নেমে এগিয়ে গেল। খুব বেশী যেতে পারলো না তার আগেই গাড়ি থেকে নেমে আসলো সাফিন। আদরের দিকে তাকিয়ে হাসলো সে। হাসির কারণ খুঁজে পেলো না আদর। তাকে আরো অবাক করে দিয়ে বলে উঠলো,
বোন কে খুঁজছো? ভাবছো কি হলো? কোথায় আছে জানো না? কিভাবে পাবে তাও জানো নাহ তাইনা?
আদরের আর বুঝতে বাকি রইল না এসবের পেছনে সাফিন রয়েছে! আদর রেগে কিছু বলবে তার আগেই সাফিন বলে উঠে,
আমিই আমার প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দিই! তোমার বোন আমার কাছে একদম আরামে আছে। পাবে! বোনকে খুব শীঘ্রই পাবে কিন্তু ওয়ান কন্ডিশন! আমার সাথে যেতে হবে! এন্ড যা যা করতে বলবো সব করতে হবে। আই প্রমিস তোমার বোন দুই বেস্ট এন্ড তোমার বড়আম্মুর কোনো ক্ষতি আমি করবো না! কাজ শেষ তো সবাই একদম ফ্রি! রাজী?
আদর এবার বিচলিত হয়ে পড়লো। হৃদযা সুবাহ কে বার বার ফোন দিচ্ছে ফোন বন্ধ। রাগে নিজের চুল খামচে ধরলো আদর। নিজেকে খুব অসহায় লাগছে। তার জন্য অন্যকেউ সাফার করবে! এটা সে কিছুতেই মেনে নিতে পারবে না। এই মুহূর্তে সাফিনের কথা মেনে নেয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই ভেবেই নিঃশব্দে মাথা নাড়ালো। সে জানেনা সামনে কি অপেক্ষা করছে তার জন্য। তার জন্য অন্যকেউ যেন সাফার না করে ; এর জন্য যা করতে হবে সে রাজি। জীবন দিয়ে হলেও বাঁচাবে ওদের।
আদরের সম্মতি পেতেই সাফিনের মুখে হাসি ফুটে। খুব তাড়াতাড়িই তাকে সবটা শেষ করতে হবে। আদরকে গাড়িতে উঠতে বলে সাফিন এগিয়ে যায় আদরের গাড়ির দিকে। ড্রাইভিং সিটের পাশেই আদরের ফোনটা পড়ে আছে। ফোনটা উঠিয়ে নিয়ে হাঁটা ধরে নিজের গাড়ির দিকে। সে এমন ভাবে প্রত্যেকটা প্লেন সাজিয়েছে কেউ সন্দেহ করার আগেই তার কাজ শেষ হয়ে যাবে। নিজেকে নিয়ে সাফিনের গর্ব হচ্ছে। মনে হচ্ছে জীবনে প্রথম সে এত ভালো কাজ করছে নিজের ভাইয়ের মুখে হাসি ফুটাবে বলে!
গাড়িতে একটা কথাও বলে নি আদর। যেকোনো পরিস্থিতিতে সে শান্ত থাকতে পারে। গাড়ি গিয়ে থামলো দুতালা এক বাড়ির সামনে। শহর থেকে বেশ দূরে বোঝায় যাচ্ছে। আদর একপলক তাকিয়ে দেখলো পুরো বাড়িটা। রাত হলেও চারপাশের লাইটিংয়ে ভালোয় লাগছে বাড়িটা। সাফিন বাড়ির ভেতরে ঢুকে আদর কে বসতে বলে। আদর বসে না; দাঁড়িয়ে থাকে। সাফিন হাসে; অকারণেই তার হাসি পাচ্ছে আজ। মনের মধ্যে এক পৈশাচিক আনন্দ অনুভব করছে সে। হয়তো সেদিনের করা অপমানের কথা ভুলতে পারে নি মন! সাফিন আয়েশ করে বসে বলে উঠে,
কাল সকালে তোমার বিয়ে আমার ভাইয়ের সাথে। কোনো ঝামেলা ছাড়ায় বিয়েটা করে নাও দুপুরের মধ্যে সবাই ছাড়া পেয়ে যাবে!
আদর হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল। বিয়ে! তাও আবার রাফিন কে! মনের মধ্যে বার বার হৃদানের মুখটা উঁকি দিচ্ছে। ভালোবাসাময় প্রহর গুলো, ভালোবাসার কথাগুলো, হৃদানের সেই মায়াবি চোখ বার বার আদর কে ধাক্কা দিচ্ছে। যেন ভেতর থেকে কেউ বলছে তুই ঠকাচ্ছিস ওই মানুষটিকে, মানুষটিকে তুই ভেতর থেকে শেষ করে দিবি!
আদর আর ভাবতে পারলো না। মাথা ধরে নিচে বসে পড়লো। এক সময় নিস্তেজ হয়ে পড়ে রইলো ফ্লোরে। সারাদিন না খাওয়া, সকালে এত কিছু ঘটে গেল, এতটা প্রেশার নিতে পারে নি শরীর! সাফিন ঘটনার আকস্মিকতায় চমকে যায়। হঠাৎ কি হলো! দুটো মেয়ে সার্ভেন্ট কে ডেকে বললো ভেতরে নিয়ে যেতে। জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। খুব বেশি গুরুতর নয়! তাই সার্ভেন্টদের খেয়াল রাখতে বলে নিজে চলল ভাইকে দেখতে। জ্ঞান ফিরলো কিনা কে জানে!
কিছুক্ষণ আগেই রাফিনের জ্ঞান ফিরেছে। বর্তমানে সে ঝিম মেরে বসে আছে। কিছুই মাথায় ঢুকছে না। পিটপিট করে চোখ খুলে যখন নিজেদের এই বাড়িটাই নিজের জন্য বরাদ্দকৃত ঘরেই নিজেকে আবিষ্কার করলো তখন বিষ্ময়ে হতবাক হয়ে গিয়েছিলো। কয়েকবার দরজায় টোকা দিয়েছে কেউ সাড়া দেয়নি তাইতো চুপ করে বসে আছে। রাফিনের ভাবনার মাঝেই খট করে দরজা খোলার শব্দ হয়। রাফিন ঘুরে তাকায়। ভাইকে দেখে দৌড়ে যায়। সাফিন হেসে ঝাপটে ধরে। রাফিন কিছু বলার সুযোগ পায় না তার আগেই সাফিন উৎফুল্ল হয়ে বলে উঠে,
ওয়েট এন্ড সি মেরা ভাই! অনেক বড় একটা সারপ্রাইজ অপেক্ষা করছে। যেটা পেলে তোর মুখ থেকে হাসি সরবেই নাহ!
রাফিন অবাক হলো না বরং বিচলিত হয়ে বলল,
ভাইয়া তোমাকে আমার অনেক কিছু বলার আছে। অনেক বড় ফুল করে ফেলেছি আমি। আমি আদরের জন্য রা….
আর বলতে পারলো না, সাফিন থামিয়ে দিলো তাকে। তাড়াহুড়ো করে বলে উঠলো,
তোর সব কথা পরে শুনবো। আগে কালকের দিনটা যাক। ঘুমিয়ে পড়!
সাফিন বেরিয়ে যেতেই রাফিন হতাশ হয়ে বসে পড়লো। ভেতরে ভেতরে শেষ হয়ে যাচ্ছে সে; কাউকে শেয়ার করতে পারলে হালকা লাগতো; সঠিক পথটা খুঁজে পেতো। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো। চোখের সামনে ভেসে উঠলো রামিয়ার হাসি মাখা মুখ! চোখ খিচে বন্ধ করে নেয় সে। দুটানায় পড়ে পাগল হয়ে যাচ্ছে!
হাতে হাত রেখে এক অজানায় ভেসে বেড়াচ্ছে আতইয়াব-হৃদযা। দুজনের ঠোঁটের কোণেই মিষ্টি হাসি বিরাজ করছে। প্রেমে মত্ত হয়ে পাহাড়ের বুকে শ্বাস ফেলছে। এমন সময় হঠাৎ করেই কারো চিৎকারের শব্দ ভেসে আসে। লোকটি চরম আক্রোশে আতইয়াব কে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয় পাহাড়ের নিচে। কেঁদে চিৎকার করে উঠে হৃদযা!
ধপ করে উঠে বসে হৃদযা! আলো-আঁধারি ঘর! শুধু ভারী নিশ্বাসের শব্দ শোনা যাচ্ছে। পাশেই একজন অচেতনের মতো গভীর ঘুমে তলিয়ে আছে। নেই কোনো চিন্তা; নেই কোনো ভাবনা! হৃদযা আবছা আলোয় নিজেকে ভিন্ন জায়গায় আবিষ্কার করলো। বুঝতে পারলো সে ভয়ংকর স্বপ্ন দেখেছে তবুও নিজেকে শান্ত করতে পারছে না। পাশের জনকে ধাক্কা দিতেই হৃদযার চিনতে দেরি হলো না মেয়েটি সুবাহ!
হঠাৎ করেই মনে পড়ে হৃদানকে অফিসে পাঠিয়ে দিয়ে রিকশায় বাড়ি ফিরছিলো সে। ঠিক তখনি ম্যাসেজ আসে সুবাহ’র নম্বর থেকে। একটা এড্রেস লিখে তাড়াতাড়ি যেতে বলেছে। সেও এত কিছু না ভেবে রওনা হয়। পোঁছানোর সাথে সাথে কেউ পেছন থেকে নাকে রুমাল চেপে ধরে। তারপর আর মনে নেই! হৃদযা এক হাতে মাথা চেপে ধরে আরেক হাতে সুবাহ কে ঠেলতে থাকে। কিছুক্ষণ পর পিটপিট করে চোখ খুলে সুবাহ কিছুই বুঝতে পারেনা। হঠাৎ কিছু একটা মনে হতেই কেঁদে উঠে সে! বিড়বিড় করে বলে উঠে,
কারা তোমরা? আমাকে কেন নিয়ে যাচ্ছো? ছেড়ে দাও আমাকে। প্লিজ ছেড়ে দাও। আমাকে মেরো না তোমরা! আমি বাঁচতে চাই! মৃহানের সাথে অনেক বছর বাঁচতে চাই।
হৃদযা বুঝতে পারলো অতিরিক্ত ভয়ে সুবাহ ভুলভাল বকছে। ঝাপটে ধরে শান্ত করার চেষ্টা করে,
সুবূ আমি হৃদু। কিচ্ছু হয়নি তোর। শান্ত হো। এই দেখ আমি হৃদু সুবু।
একসময় সুবাহ শান্ত হয়ে হৃদযাকে আকড়ে ধরে। অসম্ভব রকমের ভিতু সে। তার মধ্যে ওত গুলো ছেলেকে দেখে আরো ভয় পেয়ে গিয়েছিলো। ভেবেছিলো আজ মৃত্যু অবধারিত!
দুজন কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকে। তারপর দুজনেই উঠে দাড়ায়। চুপচাপ বসে থাকলে হবে না। এদের মতলব কি ধরতে হবে! কোথায় আছে এটাও জানেনা। বাঁচতে হলে আগে সবকিছু জানতে হবে!
সকাল আটটা বেজে চল্লিশ মিনিট। শহরের প্রতি কোণায় কোণায় এখন হিয়ান খান-রাজীব আহমেদের নিউজ। আতইয়াব ড্রয়িং রুমে পাইচারি করছে। আদর নেই। খবর নিয়েও কোনো লাভ হয়নি। বাহাদুরের আসার অপেক্ষা করছে সে। বাহাদুর এসেই জানায় আদরের গাড়ি পেয়েছে কিন্তু আদর কে না। আতইয়াব ভয়ে আতকে উঠে। একদিনের মধ্যে কি হয়ে গেলো! কোথায় গেল তার ফুল দুটো? আতইয়াবের হঠাৎ করেই খেয়াল আসে এত কিছুর মাঝে হৃদানকে কিছুই জানানো হয়নি! ফোনটা হাতে নিয়ে ফোন করতে যাবে ঠিক তখনি ম্যাসেজ আসে। আমার ফুল নামটা জ্বলজ্বল করছে। খুশিতে চোখ দুটো চকচক করে উঠে তার।
আমি ঠিক আছি ভাইয়া; রামিয়া কেও পেয়েছি। চিন্তা করো না। আমরা দুপুরের মধ্যে চলে আসবো!
বাংলায় লেখা ম্যাসেজটা দেখে আতইয়াব কিছুক্ষণ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকে। এটা আদর পাঠিয়েছে? সে খুব ভালো করেই জানে আদর বাংলায় লিখে কখনই ম্যাসেজ করেনা। খুব স্লো তাই ম্যাসেজ করলে ইংলিশ অথবা বাংলিশে করে। আজ হঠাৎ এরকম সময়ে এমন ম্যাসেজ আশা করা যায় না! আতইয়াবের ভাবনার মাঝেই হৃদান এসে উপস্থিত হয়। চোখে মুখে তার আতঙ্কের ছাপ। মনে হচ্ছে প্রিয়জনের হারানোর ব্যাথায় এখনি সে জর্জরিত!
মন পাথরে হঠাৎ ঝড় সিজন ২ পর্ব ৪
কি হতে যাচ্ছে এখন? হৃদানদের কি বুঝতে দেরি হয়ে যাবে? আদর কে কি চিরতরে হারিয়ে ফেলবে হৃদান?
সাফিন আর কি কি পরিকল্পনা করেছে? সে কি এত সহজেই সফল হবে?