মন পাথরে হঠাৎ ঝড় সিজন ২ পর্ব ১০

মন পাথরে হঠাৎ ঝড় সিজন ২ পর্ব ১০
Tahrim Muntahana

সময়টা গোধূলি বিকেল। সূর্যের ধরণ নিভুনিভু। শহরের অলিগলিতে এখনো বেশ মুখোরিত ভাব। অনেকেই বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিচ্ছে চায়ের দোকানে। আবার কেউ প্রকৃতির মাঝে ডুবে আছে। ছোট ছোট ছেলেরা খেলা শেষ করে পা চালিয়ে বাড়ি ফিরছে; একটু দেরী হলেই যে মায়ের বকা ফ্রি। অনেকেই পরিবারের জন্য নাস্তা রেডি করছে আবার অনেকেই নিজেদের মতো অনলাইন দুনিয়ায় ব্যস্ত। একেকজনের জীবন একেকরকম! মানুষের ব্যস্ত জীবন নিয়েই ভাবছিলো আদর।

গাড়ি থামার ফলে ভাবনায় ব্যাঘাত ঘটায় খানিকটা বিরক্ত‌ হয় সে। পরক্ষণেই মনে পড়ে সে তো ভাবতে আসেনি; এসেছে শপিং করতে! হৃদযা সুবাহ আগেই নেমে পড়েছে। ওরা তিনজন‌ই আগে এসেছে। হৃদযা-সুবাহ ভার্সিটি শেষ করে আদরের অফিসে চলে গিয়েছিলো। সেখান থেকেই এসেছে। এখন সবার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। হৃদযা যদিও চেয়েছিলো তারা তিনজন ই করবে তবে আদর সবাইকে নিয়ে একসাথে মজা করতে চেয়েছে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

বসে বসে তিনজন কি কি কিনবে ঠিক করছিলো তখনি দুটো গাড়ি এসে ওদের সামনে বরাবর থামে। নেমে আসে কয়েকপাল ছেলে-মেয়ে। এরা সবাই সুবাহ’র কাজিন। হৃদযাদের তেমন নিকট আত্মীয় নেই আর আদরদের বলতে আত‌ইয়াবের নানা বাড়ি থেকে আসবে কয়েকজন তবে আজ না দুদিন পর। সুবাহ সবাইকে পরিচয় করিয়ে দিলো। তারপর ঢুকে পড়লো ভেতরে। হঠাৎ ই আদর দাড়িয়ে যায়; মুখটা মলিন‌। সকাল থেকে হৃদানের সাথে কথা হয় না। হৃদযা রা ছিলো বলে ফোন ও দেয় নি। এখন মন খারাপ হচ্ছে। সে তো সবার সাথে মজা করতে চেয়েছে সেখানে প্রিয় মানুষ না থাকলে কিভাবে হয়!

হৃদযা বুঝতে পারলো ব্যাপার টা তাই আদরের হাত ধরে ভেতরে চললো। ওরা সময় মতো চলে আসবে।
চোখ বন্ধ করে গাড়িতে বসে আছে রামিয়া। মনের মধ্যে একসময় সুখ সুখ অনুভব হচ্ছে আবার যেন একদলা কষ্ট এসে হানা দিচ্ছে। নিজের একান্ত অনুভূতি গুলো সে নিজের মাঝেই রেখেছে। না জানতে পেরেছে তার আপু না জানতে পেরেছে তার ভাইয়া!

সবার সামনে সে খুব সুখি অথচ একা গভীর রাত ই জানে‌ তার একেকটা আত্মচিৎকার। গুমরে গুমরে কাঁদার শব্দগুলো একসময় ঘরের মধ্যেই বিলীন হয়ে যায়। জীবনের সমীকরণ মেলাতে মেলাতেই শপিংমলে এসে উপস্থিত হয় সে। মুহূর্তেই মুখে হাসি ফুটে উঠে। আজ প্রথম সে শপিংমলে এসেছে। আর ভাইয়ের বিয়ে বলে কথা! গাড়িতে ব্যাগপত্র রেখেই দৌড় দেয় আদর। হুট করেই ভেতরে এত মানুষ দেখে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়।

এত মানুষ থাকবে সে ভাবেই নি। এখন আপুদের কিভাবে খুঁজে বের করবে। অসহায় চোখে এদিক ওদিক তাকায়; সবাই সবার মতো ব্যস্ত। ভিষণ কান্না পায় তার; গার্ডদের নিয়ে আসলে কি হতো। এর জন্য‌ই বলে বেশী খুশি হতে নেই। অন্যদিকে রামিয়ার দৌড় দেখে গার্ড রাও পিছু‌ নেয়। একটু ভুল হলে চাকরী থাকবে না। কিছুটা এগোতেই রামিয়াকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে এগিয়ে যায়। জোরে ধমক দেওয়ার ইচ্ছে থাকলেও দিতে পারে না। আদর কে ফোন করে লোকেশন জেনে রামিয়া কে‌ নিয়ে চলতে থাকে আর রামিয়া সব ভুলে হা করে সবকিছু ঘুরে ঘুরে দেখছে। দ্বিতীয় ফ্লোরে উঠতেই আদরদের দেখতে পায় সে। আদর বোনকে একহাতে আগলে নিয়ে সব দেখায়।

কেনাকাটা অর্ধেক ও শেষ হয় নি। যে ভিড় দাঁড়িয়ে থাকা মুশকিল। আদর এখনো কিছু কিনে নি হৃদান আসলে তবেই সে নিজের জন্য নিবে। তার জন্য মুখ গোমড়া করে ঘুরছে সে। আরো বিশ মিনিট পর হন্তদন্ত হয়ে আসলো হৃদান। মাস্ক থাকায় মুখের ভাবমূর্তি কেউ বুঝতে পারলো‌ না। ঘেমে নেয়ে একাকার অবস্থা। আদর কথা না বলেই ভিড় ঠেলে দোকানের দিকে এগিয়ে গেল। হৃদান কিছু বললো না। শুধু পিছু নিলো।

এমনিই মাথা ধরেছে তার উপর এত ভিড় ঠিক নিতে পারছে না। আদর একপলক পেছনে তাকিয়ে হৃদান‌ কে দেখে নিলো। সে রাগ করেছে তা কি হৃদান‌ বুঝে নি? হৃদান ওদের নিয়ে বড় একটি দোকানে গেল। নিজেই নিজের মতো আদরের জন্য‌ সবকিছু কিনে‌ নিলো সাথে ম্যাচিং করে নিজের জন্য‌ও নিয়েছে। আত‌ইয়াব আসতে পারবে না ফোন করে বলে দিয়েছে। হৃদযার একটু মন‌ খারাপ হলেও‌ কিছু বলেনি। ডক্টরদের‌ কাজ ই এমন। আত‌ইয়াব প্রেয়সী কে খুশী করতে এও বলেছে যে কালকে আবার তাকে নিয়ে আসবে। তাই হৃদযা বিয়ের কেনাকাটা গুলো স্কিপ রেখেছে।

রেগে বোম হয়ে আছে সুবাহ। মৃহান‌ সেই কখন থেকে বলছে এসে গেছে‌ প্রায় এখন পর্যন্ত আসতে পারলো‌ না। এত মানুষের মধ্যে রাগ টাকেও প্রকাশ করতে পাচ্ছে না। এমন সময় হৃদান এসে ‘এটা তোমার’ বলে সুবাহ’র হাতে কিছু ব্যাগ ধরিয়ে দিলো। সুবাহ কিছু বলবে তার আগেই সে হন্তদন্ত হয়ে চলে গেলো। কিছুই ঢুকলো‌‌ না‌ তার মাথায়। হৃদযার হাতেও সেইম শপিং ব্যাগ। তাই বুঝলো হৃদান‌ ওদের গিফট করেছে। খুশিই হয়েছে দুজন!

দৌড়াতে দৌড়াতে সুবাহ’র সামনে দাঁড়ালো মৃহান। হাঁপাচ্ছে সে। কিছুক্ষণ চুপচাপ নিঃশ্বাস নিয়ে সুবাহ’র দিকে তাকাতেই মৃহানের রাগ হয়। এখনো রনির হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে। এ‌ই রনি টা কে হে আজ‌ও জানতে পারলো না। তার জন্য‌ই তার বেশী রাগ হচ্ছে। রনি বিষয়টা আগেই ধরতে পেরেছিলো যেদিন নাবিল‌ চৌধুরী বিয়ের কথা বলে তাই হেসে বলল,
ভাই হ‌ই সুবাহ’র। আমার নিজেরও ব‌উ আছে ভাই সাথে ফ্রি ব‌উ আমার অন্তঃসত্ত্বা!

মৃহান লজ্জায় মাথা নিচু করে‌ নেয় আবার ফট করে মাথা তুলে বলে উঠে,
সেদিন মে সুবু বললো ভাবির ভাই!
আপনি জেলাস হন‌ কিনা দেখার জন্য‌ই বলেছে। আর সত্যি বলতে ভাবির ভাই ই। আমার ব‌উ তো এতিম ছিলো সুবাহ’র বাবা মেয়ে বানিয়েছে সেই হিসেবে ওই বাড়ির জামাই আমি মানে আপনার সমন্ধি হ‌ই।
মৃহান‌ সুবাহ’র দিকে কটমট চোখে তাকিয়ে রনি কে জড়িয়ে ধরে। হাসতে হাসতে বলে উঠে,

আমার কাজে আমি মুটেও লজ্জিত নয় মি. রশি না রনি। এটাই স্বাভাবিক আমার ব‌উ অচেনা ছেলের হাত ধরে ঘুরবে আমি কেনো মেনে নিবো! আমি তো জানতাম না ভাই! না দুলাভাই!

মৃহানের কথায় সবাই হেসে দেয়। সবাই আবার হ‌ইচ‌ই করে শপিং করতে থাকে। অন্যদিকে হৃদান ফোনে কথা বলছে রেগে। একপ্রকার শাষাচ্ছেই! কিছুক্ষণ কথা বলে নিজেকে স্বাভাবিক করে আদরের কাছে যায়। হাতে কয়েকটা কোক। মেয়েটার সাথে কথাই বলেনি। কে জানে মন‌‌ খারাপ করে কি করছে!‌ হৃদান কে দেখেই আদর মাথা‌ নিচু করে‌ নেয়।‌ হৃদান‌ হেসে এক হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে‌ বলে উঠে,

আ’ম সরি আদু। মাথা ব্যাথা করছিলো তাই কথা বলিনি তখন!
হৃদানের কথায় উদ্ধিগ্ন হয়ে যায় আদর। মিষ্টি হেসে ঠিক আছে বুঝিয়ে বিদায় নিয়ে চলে আসে হৃদান। আদরের বিষয়টা‌ খটকা লাগে। হঠাৎ কি হলো এমন‌ করছে কেন?‌

হ‌ইচ‌ইয়ে আর ভাবতে পারে না। সবার শপিং শেষ করে কিছুটা খাওয়া-দাওয়া করে যার যার বাড়ি চলে যায়। বিয়ে যেহেতু দুটো একসাথে হবে তাই রিসোর্টে হবে। দু’দিন পর তারা রিসোর্টের উদ্দেশ্যে বের হবে। তার আগে দু’দিন এদিকটা গুছিয়ে নিবে। গাড়িতে বসেও আদর‌ হৃদানের ভাবনাতেই পড়ে যায়। হৃদানের আচরণ টা কেমন‌ যেন লাগছে। এটা কি ঝড়ের পূর্বাভাস?

ধীর পায়ে হেঁটে চলছে সাফিন। গন্তব্যহীন ভাবে হাঁটছে আজ। সবকিছু যেন বিষাদে ছেঁয়ে গেছে। বর্তমানে দু’ভাই সিডনিতে অবস্থান করছে। বাংলাদেশ থাকবে কোন মুখে! নিজেদের দোষেই হয়তো হারিয়েছে তারা। হৃদয়টা বড্ড পুড়ছে তার। একটু আগেই শুনতে পেল হৃদযার বিয়ে। তখন থেকেই বুকে চিনচিন ব্যাথা করছে। তার একটা ভুল সর্বস্ব কেড়ে নিলো। বাবার কথায় রাজি না হলে আজ হৃদযা তার কাছে থাকতো। দীর্ঘশ্বাস ফেলে পিচঢালা রাস্তার পাশে ঘাসের উপর বসে পড়ে। ভাবতে থাকে ক’দিন‌ আগের কথা;

এ‌ইতো ক’দিন হলো এখানে এসেছে। আসার আগে চৌধুরী বাড়িতে গিয়েছিলো হৃদযাকে একনজর দেখার জন্য। দেখতে পায়নি! হয়তো এটাও তার কপালে ছিলো না। হৃদানের নামে একটা প্যাকেজ ফেলে আসে মেইন‌ গেটের সামনে। খুব দরকার ছিলো এটা। তেমন‌‌ কিছু না শুধু একটা চিঠি।

না জেনে নিজের কাজের জন্য ভুল স্বীকার, মাফ চাওয়া, বাবার জন্য ঘৃণা প্রকাশ এগুলোই ছিলো। খুব দরকার ছিলো এটার নাহলে সে নিজেই শান্তি পেতো না। একদিন যাবে। হুট করে সবার সামনে দাঁড়াবে সে। যখন‌ তার করা অন্যায় গুলো সবার স্মৃতিতেই ঝাপসা হবে সেদিন হুট করেই সামনে‌ দাঁড়িয়ে মনে করিয়ে দিবে; হাতজোড় করে ক্ষমাও চাইবে! তখন ক্ষমা পাবে হয়তো। না পেলেও সমস্যা নেই; পাপের শাস্তি বলেই চালিয়ে নিবে জীবন!
ভাবতে ভাবতেই উঠে দাড়ায় সাফিন। পিছুটান রেখে লাভ নেই। জীবন তো চালাতে হবে। সুখে হোক বা দুঃখে!

নিজের কর্মচারীর উপর তোড়জোড় করছে একটা কালো পোশাকধারী লোক। রাগে অগ্নিশর্মা সে। রাগ হবেই‌ না কেন। পাখিকে খাঁচায় ঢোকানোর আগেই কে যেন নিজের খাঁচায় বন্দী করে ফেলেছে। এতে যে তার এতদিনের করা সাজানো খু্ঁটি গুলো ভেঙে যাবে। কিন্তু কে নিয়ে গেল সে এটাই ধরতে পারছে না। মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ে সে। নিজের এসিস্ট্যান্ট কে দেখেই চিৎকার করে বলে উঠে,

খোঁজ পেলি? কোন কালপ্রিট এমন‌ করেছে? জেল থেকে পালানোর সব ব্যবস্থা আমি করলাম আর কি হলো! কে নিয়ে গেল রাজীব কে?
বস এখনো কোনো খোঁজ পাইনি। তবে আমি ধারণা করছি রাজীব আহমেদ কে তার ভাইয়ের মেয়ে মানে আদর বা হৃদান‌ চৌধুরী নিয়ে গেছে। আত‌ইয়াব তো নিবে না; হাজার হলেও বাবা আবার আরেকদিকে বোন।

এসিস্ট্যান্টের কথায় বস বলে‌ লোকটার ভ্রু কুচকে আসে। আদর-হৃদান‌ কেন‌ নিবে? আর ওরা না নিলেই বা আর কে নিবে? ওদের উদ্দেশ্য কি? ওরা সবটা জেনে যায় নি তো? মাথায় অনেকগুলো প্রশ্ন ঘুরঘুর করছে। তার পতন‌ কি নিশ্চিত! বসকে চুপ দেখে এসিস্ট্যান্ট আবার বলে,

বস আমার মনে হয় আদর বা হৃদান রাজীব আহমেদ কে মেরে ফেলার জন্য‌ই নিয়ে গেছে। যদি অন্য কারণ থাকতো‌‌ বা আপনার কথা জানতে পারতো তাহলে তো আগেই ধরতো। খুশি মনে শপিং করতো না। বাবার খুনিকে ছাড় দিবে না মনে হয়!

মন পাথরে হঠাৎ ঝড় সিজন ২ পর্ব ৯

কথাগুলো শুনে বসের চিন্তা দূর হয়। বাহ! এমন এসিস্ট্যান্ট পেয়ে তার গর্ব হচ্ছে। আসলেই তো! তাছাড়া আর কি কারণ থাকবে। চিন্তামুক্ত হয়ে বস নিজের আস্তানা থেকে বের হয়। তার প্লেন‌ মতোই সব হচ্ছে তাহলে! এত বছরের সবকিছু তাঁর কথাতেই হয়েছে; ভবিষ্যতেও হবে। সে যেভাবে চালাবে সবাইকে সেভাবেই চলতে হবে! হাহাহা!

মন পাথরে হঠাৎ ঝড় সিজন ২ পর্ব ১১