মেঘফুল ফুটলো মনে পর্ব ১৪

মেঘফুল ফুটলো মনে পর্ব ১৪
আবরার আহমেদ শুভ্র

রাত সাতটা বেজে পয়ত্রিশ মিনিট! জ্যামেপূর্ণ চট্টলার রাস্তাঘাট। এই সময় একটু বেশিই জ্যামজট আর হট্টগোলে পূর্ণ থাকে চট্টগ্রামের প্রায়শ প্রতিটা রাস্তা। তবুও অনেকেরই দেখতে ভালো লাগে চট্টলার এই দৃশ্যটুকু! প্রতিদিনকার রুটিনে অভ্যস্ত হয়ে আছে এই শহরের প্রতিটি মানুষ! তবুও জীবন কারোর থেমে নেই! সময়ের ব্যস্ততার সাথে তাল মিলিয়ে চলছে মানুষের জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত। কেউ বেঁচে আছে জীবন ছন্দে তাল মিলিয়ে আর কেউই বা বেঁচে আছে ছন্দ হীন জীবনের সাথে যুদ্ধ করে! টিকে থাকার লড়াইয়ে জীবনকে করে তুলছে গতিময়।

তানজিম আর ফুয়াদ একসাথে হেটে চলেছে নগরীর কোন এক রাস্তা ঘেষে। আজ দূর আকাশে চাঁদটাও বেশ বড় করেই দেখা যাচ্ছে, সাথে আছে শতশত অগণিত তারার মেলা। চাঁদটা হয়তো উঁকি দিয়ে হাসছে তাদের দেখে! তানজিমের আজ কোনো জড়তা-সংকোচ কাজ করছে না ফুয়াদের সাথে হাঁটতে! তবে বেশ ভালোই লাগছে ওর। কখনও কোনো পুরুষের সাথে একান্তে এভাবে হাটতে বের হয়নি, বা হাটে নি সে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

তবুও মনের মাঝে কেন যেন এখন পূর্ণতা অনুভব করতে পারছে সে! তাছাড়া খানিকটা আড়ষ্টতাও কাজ করছে তার মাঝে। ফুয়াদ লক্ষ্য করলো তার প্রিয়তমের এই আড়ষ্টতা! তাই তাকে সহজ হওয়ার সময় দিয়ে একসাথেই কয়েকটা প্রশ্নের ঝুলি খুলে বসল সে,
–আজ হঠাৎ এদিকে এলি যে? তাও একা! কোনো কাজ ছিলো কি? তাছাড়া একলা এলি কেন? কোনো বিপদ হলে কি করতি?

একসাথে এত্তগুলা প্রশ্ন উত্তর দিতে হিমশিম খেলো সে।
চক্ষুদ্বয় ছোট ছোট করে বলে উঠলো,
–একসাথে এত্তগুলা প্রশ্ন করে কেউ? কোনটা রেখে কোনটার উত্তর দিবো বলবেন?
মাথা চুলকিয়ে হালকা হেসে নিজের বোকামি শিকার করলো সে,
–না মানে, একটা একটা করে উত্তর দিলেই তো হয়।
–তারপর বল, এদিকটায় কেন এসেছিলি?
তানজিম তার দিকে তাকিয়ে হেসে উত্তর দিলো,

–বই কিনবো বলে এসেছিলাম। বই নিয়ে আপনার মেডিকেলের সামনে দিয়েই যাচ্ছিলাম, ভাবলাম আপনারও বের হওয়ার সময় হয়েছে তাই একসাথে যাওয়ার জন্য এখানে ওয়েইট করছিলাম। আজ ফুফির বাড়ীতেই যাবো, অনেকদিন হলো তো, একদমই যাওয়া হয় না পড়াশোনার জন্যে।

তানজিমের কথা শোনে চোখ কপালে ফুয়াদের! যে মেয়ে কখনও আড়ষ্টতা ছাড়া তার সামনেই আসে নি, সে মেয়েই আজ তার জন্য অপেক্ষা করছে তাও তার মেডিকেল চেম্বারের সামনে তার সাথে তার বাড়িতে যাবে বলে। মনে মনে খুব বেশি খুশি হলো সে। কারণ, তানজিম এখন অনেকটা সহজ হচ্ছে তার ব্যাপারে। সে হাসি মুখে বলে উঠলো,
–ভালো করেছিস, তা এখানে না দাঁড়িয়ে আমার চেম্বারে গেলেই তো হতো। তাহলে এতো গরমের মধ্যে ঘাম নিয়ে এখানে দাঁড়াতে হতো না।

আর মনে মনে বিড়বিড় করে বলছে সে, ‘আমার চেম্বারে গেলে তো আমার জন্যেই ভালো হতো। এখানে দাড়িয়ে থেকে কারো কুনজর তোর উপরে পড়তি না।’
–যেতাম তবে এস এ ফার্স্ট টাইম তো তাই। ভেতরে যেতে কেমন যেন লাগছিলো তাই আর যেতে মন চাই নি।
কথা বলতে বলতে দুজনে বাসার সামনে এসে পড়েছে। তা দেখে ফুয়াদ তানজিমকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো,
–আচ্ছা বেশ, অনেক কথা হয়েছে। চল ভিতরে যায়, মাম্মা নিশ্চয়ই তোকে দেখে খুব খুশি হবে।

তানজিমও ফুয়াদের কথায় সায় দিয়ে মাথা নাড়ালো। ফুয়াদ কলিং বেল বাজাতেই একজন সুন্দরী রমনী এসে দরজা খুলে দিলো। হয়তো সে এতোক্ষণ কলিং বেলে বাজবার অপেক্ষায় ছিলো। তানজিম অবাক হলো মেয়েটিকে দেখে। কিন্তু চুপসে গেলো ফুয়াদ, মনে মনে ভেবে উঠল,
–তাহলে কি সত্যি সত্যিই মাম্মা এটা করতে পারলো? আমার এতো বড় ক্ষতি করতে পারলো মাম্মা? আমার কথার দাম দিলোই না সে? কখনও ক্ষমা করবো মাম্মা আমি তোমাকে, কখনোই না! বলে যথাসম্ভব নিজেকে শান্ত করতে করতে মুখে মিথ্যে হাসি ঝুলিয়ে দিয়ে রুমে চলে গেলো সে।

মেয়েটি তানজিমকে দেখে বলে উঠলো,
–আমি যদি ভুল না করি, তুমি নিশ্চয় তানজিম! এম আই রাইট?
মাথা নাড়লো তানজিম, মেয়েটি আবারও প্রশ্ন করলো,
–আমাকে নিশ্চয় চিনতে পেরেছো! আমি নিশি!

তানজিম মাথা দুদিকে নাড়ালো, তানজিমের এমন আচরণে বিরক্ত হলো মেয়েটি। বলে উঠল,
–এই তুমি কি বোবা হয়ে গেছো নাকি? আগে কতো সুন্দর করে গুছিয়ে কথা বলতে আর এখন তো দেখি কথাও বলতে পারো না,হা হা! ব্যাপার কি বলোতো? ও তুমি কথাই বলতে পারবে এখন!
তানজিমের এবার বেশ রাগ হলো, এমনিতেই টায়ার্ড তার উপর এমন কথা যেন আগুনে ঘি ঢালার মতো,
–আপনি কি জানেন আপনি কত্তবড় পাগল? সবে মাত্রই বাহির থেকে এসেছি, একটু ফ্রেশ হয়ে রেস্ট নিতে দিন। তা না করে যত্তসব হাবিজাবি প্রশ্ন করেই যাচ্ছেন! মানুষের মুখের ভাব বুঝতে পারেন না আপনি যে মানুষের কোন সিচুয়েশনে কি করা প্রয়োজন? যত্তসব!

বলে রাগে দুঃখে তার ফুফির রুমে চলে গেলো সে। তার ফুফি ফারহানা খানম বিছানায় উপুড় হয়ে শোয়ে কি যেন পড়ছে। হঠাৎ করে রুমে কারোর উপস্থিতি টের পেয়ে চোখ তুলে সেদিকে তাকালো। তানজিমকে দেখে মনটা খুশি হয়ে গেলো তার। বিকেল থেকেই তিনি তানজিমের কথা ভাবছেন মেয়েটাকে একবার তার বাড়ীতে আসতে বলবেন বলে। কিন্তু তার ননদের মেয়ে নিশি আসা মাত্রই সেটা বেমালুম ভুলে গেলেন। তাই আর বলতে পারেন নি তিনি। কিন্তু এখন তানজিমকে দেখে মনে মনে খুশিই হলেন বেশ। তাকে উদ্দেশ্য করে ফারহানা খানম বলে উঠলেন,

–কখন এসেছিস মা?
ফুফির কথায় হাসিমুখে জবাব দিলো তানজিম,
–এইতো ফুফু এখনই এলাম সবে। তুমি শোয়ে আছো যে? শরীর খারাপ করছে নাকি?
তানজিমের তার প্রতি ব্যস্ততা দেখে তিনি বলে উঠলেন,

–আহা, এতো ব্যস্ত হইস না। আমার শরীর আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছে। এইতো শোয়ে উপন্যাস পড়ছিলাম।
–ওও, তাহলে তো ঠিক আছে।
–অনেক কথা হয়েছে, এখন ফ্রেশ হয়ে আয়। সারাটা পথ জার্নি করে এসেছিস। ফ্রেশ হয়ে এলে হালকা লাগবে।
–হুম।
বলে সে ফ্রেশ হতে ওয়াশরুমে প্রবেশ করলো।

–আসবো ভাইয়া?
কারো সাড়াশব্দ না পেয়ে উঁকি মেরে দেখলো রুমে কেউ আছে কিনা। কিন্তু কেউকে না দেখে প্রবেশ করলো নিশি। নাফিশা ইবানত নিশি। ফুয়াদের ফুফাতো কাজিন হয় সম্পর্কে। চারদিকে তাকিয়ে আবারও ডাক দিলো সে,
–ফুয়াদ ভাইয়া! রুমে আছো তুমি?

বারান্দায় দাঁড়িয়ে দূর আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল সে। হঠাৎ নিজের রুমে কারোর আওয়াজ শোনে রমে এলো সে। নিশিকে দেখে অবাক হলো। নিশি কখনোই অনুমতি ব্যথিত তার রুমে প্রবেশ করে না। মনে মনে ভাবলো সে,
–তাহলে কি মাম্মা তাকে সবকিছুরই অধিকার দিয়ে দিলো? যেখানে নূন্যতম আমার মতামতটা নেয়ার প্রয়োজনবোধ করলে তুমি?
জোরে জোরে কয়েকটা শ্বাস নিয়ে বারান্দা থেকে রুমে এলো সে। নিশির সাথে হাসি বিনিময় করলো সে। নিশি বলে উঠলো,

–তোমাকে কোনো বিষয়ে টেন্স দেখাচ্ছে ভাইয়া? তুমি কোনো ডিপ্রেশনের মাঝে আছো?
অবাক হলো ফুয়াদ। হওয়ারই কথা! তবে অবাক হওয়ার বিষয়টি নিশিকে বুঝতে দিলো না সে,
–আরে ডিপ্রেশনে কেন থাকবো? আজ সারাদিনের জার্নি, আর মেডিকেলের ঝামেলার কারনে টায়ার্ড লাগছে। দ্যাটস্ ইট্!
–নো প্রবলেম, এই নাও তোমার জন্যে কফি নিয়ে এসেছি। তারপরে হালকা ডিনার করে লম্বা একটা ঘুম দিলেই সকল টায়ার্ডনেস কেটে যাবে। যাস্ট ফলো দিস।

নিশির কথায় হাসি দিলো ফুয়াদ। হাসি মুখে বলে উঠলো,
–ওকে ম্যাডাম আপনি যা বলেন। যা গিয়ে দেখ তানজিম কোথায়। ওকে একটু সময় দে্। অনেকদিন পর এসেছে এখানে্। আর নেক্সট টাইম আমার রুমে আসতে পারমিশন নিয়ে আসবি। গট ইট! বলে ফুয়াদ আবারও বারান্দায় চলে গেলো। কিন্তু নিশির দিকে মুখ করে তাকিয়ে রইল ওর রিয়াকশন দেখতে।

তানজিমের নাম শুনে মনে মনে একটুই নয় অনেক বেশিই বিরক্ত হলো নিশি। যেটা তার চোখেমুখে স্পষ্টত। ফুয়াদ সেটা খেয়াল করলেও পাত্তা দিলো না। কারণ, সে জানে কিভাবে কাঁটা দিয়ে কাঁটা তুলতে হয়ে। মনে মনে বিড়বিড় করে উঠল সে,

মেঘফুল ফুটলো মনে পর্ব ১৩

–আমার প্রিয়তমার উপস্থিতিতে অনুপস্থিতিতে আমার কাছে ঘেঁষতেও যেন তোর বিরক্ত লাগে সেই অবস্থা করবো আমি। আমার কাছে আসার একমাত্র অধিকার আমার কেশবতীর আছে।

মেঘফুল ফুটলো মনে পর্ব ১৫