মেজর গল্পের লিংক || জাকিয়া সুলতানা ঝুমুর

মেজর পর্ব ১
জাকিয়া সুলতানা ঝুমুর

মুশফিক বিশ মিনিট ধরে সুলতান ডাইন রেস্টুরেন্টে বসে আছে।অপেক্ষা খুবই বিরক্তিকর।বিরক্তিতে মুখের মিষ্টি হাসিসূলভ চেহারা গায়েব হবার যোগার।সুচারু গম্ভীর চোখের দৃষ্টি বারবার হাতঘড়ির দিকে স্থির হচ্ছে।সে প্রচুর ডিসিপ্লেন মানে,আসলে তার পেশা যা তাতে মানতে হয়।সে ছোটবেলা থেকেই বেশ গুছানো, নিয়মমাফিক সব করতে পছন্দ করতো,এখন যেহেতু আর্মির মেজর এখন নিয়মানুবর্তিতা,চরিত্র,ব্যবহার,

সময়জ্ঞান,সবকিছুই যেনো র,ক্তে মিশে গিয়েছে।রেস্টুরেন্টে মানুষ গিজগিজ করছে;মানুষের কোলাহলে তার মেজাজ আরো খারাপ হচ্ছে শান্ত পরিবেশ সে পছন্দ করে।তাছাড়া ঢাকায় এতো রেস্টুরেন্ট থাকতে মেয়েটা এখানেই কেনো আসতে বললো?সে ভাবে কাঙ্ক্ষিত মানুষ আসলে প্রথমে এই কথাটাই জিজ্ঞেস করবে,নিরিবিলি জায়গা রেখে এখানে কেনো?

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

তাছাড়া বলিষ্ঠ বলবান শরীরের জন্য সবাই তার দিকে ফিরে ফিরে তাকাচ্ছে এটাও খুব বিরক্তিকর। সময়ের অপব্যবহার সে একদম পছন্দ করে না।মায়ের উপর আকাশসম রাগ হচ্ছে,এমন একজনকে তার জন্য পছন্দ করেছে যে কিনা সময়ের কাজ সময়ে করতে পারে না।তার মতো মানুষকে বিশ মিনিট ধরে এই কোলাহল পূর্ণ জায়গায় বসিয়ে রেখেছে এটা যদি তার ইউনিটের সেনারা শুনে তাহলে নির্ঘাত অবাক হতো কেননা মুশফিক স্যার মানেই কড়া মানুষ।

কফিতে শেষ চুমুক দিতে দিতে মুশফিক তার মাকে ফোন দেয়।সাহেরা খাতুন যেনো ফোনের কাছেই বসে ছিলো,সাথে সাথেই রিসিভ করে বললো,
“আব্বু!মেয়ে পছন্দ হয়ে গিয়েছে তাই না?আমি জানতাম তোর পছন্দ হবেই,দেখলি মায়ের পছন্দ কতো ভালো?”
মুশফিক শান্তহয়ে তার মায়ের খুশীখুশী মন্তব্য শেষ করার সুযোগ দিলো।উনার কথা শেষ হলে মুশফিক গম্ভীর গলায় বললো,

“কিসের পছন্দ আম্মু?তোমার পছন্দের মেয়ে তো এখনো আসেইনি।আমি আর এক মিনিটও অপেক্ষা করতে পারবো না।যেই মেয়ের সময়ের প্রতি জ্ঞান নেই সেই মেয়েকে নিয়ে আমি আমার মূল্যবান জীবনটা কাটাতে পারবো না।”
সাহেরা খাতুন আর কিছু বলার আগে মুশফিক ফোন রেখে দেয়।ওয়েটারকে ডাকলে বিল কতো হয়েছে তা জানতে চায় তখনি চোখে পরে কালো শাড়ি পরে জ্যোৎস্নার মতো মায়াবী এক মেয়ে তার দিকে আসছে।

মুশফিক ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকে,বুঝা যাচ্ছে এটাই ছবিতে দেখানো সেই মেয়ে যার প্রশংসা শুনতে শুনতে সে ক্লান্ত কিন্তু এখন কি করা উচিত!দেরী করে আসার কারণে ধমকে বুকের ছাতি বাঁকাটাঁকা করে দেয়া উচিত নাকি অন্ধকার রাতে চাঁদ যেমন জ্যোৎস্না দিয়ে উজ্জ্বলতা বাড়ায় তেমনি কালো শাড়িতে ফর্সা চাঁদের মতো রমনীকে ক্ষমা করে দেয়া উচিত!মুশফিক কিছু বলার আগেই মেয়েটি তার কাছে এসে পৌছায় তার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললো,

“মেজর!”
মুশফিক হতভম্ব হয়ে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে আছে,প্রথম দেখায় কেউ এমন করে সম্মোধন করতে পারে এটা তার জানা ছিলো না।সে কিছু বলার আগেই মেয়েটি আবার বললো,
“আমি দুঃখিত মেজর সাহেব।অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেছেন?বিশ্বাস করেন আমি ইচ্ছে করে দেরী করিনি,আমার এমনি হয় রেডি হতে হতেই এতো লেট হয়ে যায়।ইটস অকে না?”
মুশফিক মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বললো,

“হুম।”
ওয়েটার এতোক্ষন তাদের সব কথা যেনো গিলছিলো।মেয়েটি তার দিকে তাকিয়ে বললো,
“আপনি দুই প্লেট কাচ্ছি নিয়ে আসেন।অবশ্যই আলু এক্সট্রা দিবেন।”
ওয়েটার চলে গেলে মেয়েটা মুশফিকের দিকে তাকিয়ে বললো,
“এতো নিরিবিলি রেস্টুরেন্ট থাকতে এখানে ডাকার কারণ নিশ্চয়ই বুঝেছেন? কাচ্ছি আমার ভিষণ পছন্দ।”
মুশফিক চুপচাপ তাকিয়ে আছে।আশ্চর্যভাবে তার রাগ কমে যাচ্ছে,মেয়েটার ছটফটে ভাব বেশ লাগছে।মেয়েটা টেবিলের উপর হাত রেখে ঠোঁটের কোণে হাসি ঝুলিয়ে বললো,

“আমি মিতু।মিতু হাসান।”
মুশফিক শীতল চোখে তাকিয়ে,দাম্ভিক গলায় বললো,
” মুশফিক আহসান।”
মিতু এদিক ওদিক তাকাচ্ছে।সে সবার সাথে খুব সহজে মিশে যেতে পারলেও তার সামনে বসে থাকা গম্ভীরমুখো মানুষটার সাথে কি কথা শুরু করবে সেটাই বুঝতে পারছে না।মুশফিক মিতুর দিকে তাকিয়ে আছে।চোখের লম্বা পাপড়ি ঝাপটে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে।সে বললো,

“মিতু;আপনার বোধহয় সময়ের প্রতি যত্ন নেই।”
মিতু হাসে।মুশফিক বললো,
“প্রথম সাক্ষাতে কাউকে বিশ মিনিট অপেক্ষা করানো কি ভালো হলো?”
মিতু তার লম্বাচুলে হাত ভুলিয়ে বললো,
“আমি জানি খুবই খারাপ হয়েছে কিন্তু আমি কি করবো বলেন তো!রেডি হতে এতো সময় কেনো লাগে সেটাই বুঝি না।আমি সবসময় লেট হই।”

মুশফিক মিতুর সহয স্বাভাবিক কথা বলার ভঙ্গিমার দিকে তাকিয়ে আছে।মিতু খুবই ছটফটে এক মেয়ে।তাকে যে ধারণা দেয়া হয়েছিলো এই মেয়ে তার উল্টো।সে মিতুর দিকে তাকিয়ে থাকে।চোখের দৃষ্টিতে দাম্ভিকভাব যেনো আলোর বিচ্ছুরণের মতো বেরোচ্ছে।মিতু মুশফিকের দিকে তাকিয়ে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করলো।হঠাৎ বললো,
“কি ভাবছেন?”

মুশফিক মেয়েটার সাহসের তারিফ করে।সাহস আছে বটে!সাহস না থাকলে তার সামনে এমন পটপট করার সাহস পেতো?সে ভারী পুরুষালী গলায় গমগমে আওয়াজ তুলে বললো,
“আমাকে যেমন মিতুর বর্ণনা দেয়া হয়েছিলো আপনি সম্পূর্ণ ভিন্ন মিতু।”
মিতু হাসে।মুশফিকের চোখে চোখ রেখে বললো,

“এখন আমাকে যেমন চঞ্চল দেখছেন আমি সবসময়ই এমন।আপনার আম্মু আর ভাইয়ারা যেদিন আমাদের বাসায় যায় সেদিন আমাকে কড়া করে বলে দেয়া হয়েছিলো যে লাজুক,নম্র-ভদ্র হয়ে থাকতে।আব্বু আম্মুর কথা মানতেই আমি শান্ত লক্ষী মেয়ে হয়ে বসে ছিলাম।আমার আম্মুর ধারনা আমি যেই পরিমাণ দুষ্টু চঞ্চল এমন দেখলে নাকি আমাকে কেউ বিয়ে করবে না।কিন্তু আমার মনে হলো যার সাথে সারাজীবন কাটাবো সেই যদি না জানে আমি কেমন তাহলে ব্যাপারটা কেমন না?তাই ভাবলাম আপনাকে নিজের অভস্থ রূপেই প্রকাশ করি।”

মিতুর কথাগুলো শুনে মুশফিকের ঠোঁটের কোনে মুচকি হাসির রেখা ফুটে উঠে,সেটা মিতুর চোখে পরার আগেই মিলিয়ে যায়।মিতুর চিন্তাভাবনা তার ভালো লেগেছে।মেয়েটা কি একটু নরম মনের?সাধারণত নরম মনের মেয়েরাই এমন সহয হয়।মিতু মুশফিকের দিকে তাকিয়ে উনার মনোভাব বুঝার চেষ্টা করে কিন্তু গম্ভীর মেজরের মনের কথা বুঝে যাওয়া কি এতো সহয!মুশফিক সহয গলায় বললো,
“আম্মুর দেখানো ছবিতে দেখলাম আপনি খুব সাজুগুজু করে বসে আছেন,আজকে সাজেননি কেনো?”
মিতু প্রস্তর হাসে।

“বললাম না সেদিন আম্মুর ইচ্ছায় সব হয়েছে, আর আজকে আমার ইচ্ছায়।আমি বেশী সাজগুজু পছন্দ করি না। কিন্তু শাড়ি পড়েছি নিজ ইচ্ছায়।শাড়ি পরা আমার খুব পছন্দের কাজ।।পারলে তো প্রতিদিনই শাড়ি পরি।”
মুশফিক মিতুর দিকে তাকিয়ে আছে।আর কিছু বলার আগে খাবার চলে আসে।দুজনে কথা বলতে বলতে খাবার খায়।মিতু মুগ্ধ হয়ে মুশফিকের খাবার খাওয়া দেখে।কি সুন্দর করে খাবার খাচ্ছে।একটা মানুষের খাবার খাওয়া এতো সুন্দর হতে পারে!

খাবার খাওয়ার পরে মুশফিল বিল দিয়ে উঠে দাঁড়ায়।মিতুকে রিক্সায় তুলে দিয়ে গম্ভীর গলায় বললো,
“আজ তাহলে বিদায় মিতু।ভালো থাকবেন।”
মিতু বারকয়েক মুশফিকের দিকে তাকায় কিন্তু মুশফিক ততক্ষণে লম্বা লম্বা পা ফেলে দূরে চলে গিয়েছে।মিতু বিষন্ন মুখে তার বান্ধুবী জান্নাতকে ফোন দেয়।জান্নাত খুশী গলায় বললো,
“দোস্ত !তাইলে দাওয়াত পাচ্ছি তাই না?”
মিতু আস্তে করে বললো,

“না বোধহয়।কোনো হ্যাঁ সূচক কথাবার্তা হয়নি।গম্ভীর মানুষ, খুঁচিয়ে কথা বের করতে হয়।যোগাযোগের কোনো মাধ্যম নিয়ে বা দিয়ে যায়নি।যাওয়ার আগে একটুও হাসেনি।উনার বোধহয় আমাকে ভালো লাগেনি।”
জান্নাত উৎফুল্ল গলায় বললো,
“না লাগলে নাই,আমার বান্ধুবী একটা গোলাপ।এমন মেজর কতো আসবে যাবে। ”

জান্নাতের কথায় মিতুও হাসে।খানিক মন খারাপ হলেও সে জানে আল্লাহ কপালে যা রেখেছে তাই হবে।তাছাড়া এই গম্ভীর মেজর আনরোমান্টিক হবে বোধহয়।মিতুর চাই রোমান্টিক এক বর,যে তাকে খুব ভালোবাসবে এই ব্যাটা তো শুধু জ্ঞানই দেবে।

বাসায় যাওয়ার পরে অবশ্য মিতু সবার থেকেই বকাঝকা খায়।বাচাল মেয়ের জন্য এমন ছেলে হাতছাড়া হয়েছে এই আফসোসে সবাই হতাশার নিঃশ্বাস ফেলে।মিতু মনে মনে মেজরকে খুব বকে দেয়,পেঁচামুখো মানুষ,তার মতো পরীকে প্রত্যাখান!রাতে ঘুমাতে গিয়ে মিতু টের পেলো এই গম্ভীরমুখের মানুষটা তার চোখের পর্দায় সুপার গ্লু দিয়ে আটকে গিয়েছে।দীপ্তিময় দুটো চোখ যেনো এখনো তার দিলে তাকিয়ে আছে।মিতু বিরবির করে বললো,
“আপনি খুব খারাপ মেজর সাহেব।”

রোদেলা এক সকাল।মোবাইলের কড়কড়ে শব্দে মিতু চোখ খুলে তাকায়।অচেনা নাম্বার রিসিভ করার পরে এক ছেলে বললো,
“আপু,আপনার একটা পার্সেল আছে।প্লিজ রিসিভ করুন।”
মিতু ভ্রু কুঁচকে বললো,
“আমি তো কিছু অর্ডার করিনি তাহলে কিসের পার্সেল?”

“মিরপুর, রোড নাম্বার ২, নিনিয়া ভিলা।এই ঠিকানা দেয়া আর আপনার নাম্বার।”
মিতু আড়মোড়া ভেঙ্গে উঠে।কে তাকে পার্সেলে করে কিছু পাঠাবে সেটাই বুঝতে পারছে না।সিড়ি বেয়ে চারতলা থেকে নিচে আসে।পার্সেল নিয়ে বাসায় যায়।

পার্সেলের সাথে তাজা টিউলিপ ফুল।ফুলটা মিতুর খুব পছন্দের।বিছানায় বসে পার্সেলটা খুলে আর খুলেই সে হতভম্ব।একটা শাড়ি।লাল টকটকে শাড়ি।শাড়ির সাথে একটা আলতার কৌটা।এসব কে পাঠাবে!তখনি চোখে পড়ে নীল একটা চিরকুট।মিতুর জীবনের প্রথম চিরকুট।দুরুদুরু বুকে চিরকুট খুলে।
মিতুল,

তোমার নাম মিতু কিন্তু আমার কাছে মিতুল।নামটা সুন্দর না?সুন্দর না হলেও আমি এই নামেই ডাকবো।
লাল শাড়িটা তোমার।আলতাটা আমার জন্য রেখো চঞ্চল মেয়ে,খুলবে না কিন্তু ওটার প্রথম ব্যবহার আমি করবো।
শোনো জ্যোৎস্নার মতো উজ্জ্বল মায়াবী মেয়ে,
শাড়ি পরতে ভালোবাসো তাই না?আমার কাছে এসে কিন্তু রোজ শাড়ি পরতে হবে।
রাজী??

মেজর পর্ব ২