মেজর পর্ব ২

মেজর পর্ব ২
জাকিয়া সুলতানা ঝুমুর

হাসান সাহেব পেশায় একজন ব্যাংকার।মিতু উনার বড়ো মেয়ে।ছোট ছেলের নাম রাতুল সে এবার ক্লাস টু তে পড়ে।মিতু এবার অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে পরে।সে লেখাপড়ায় এতো বেশী ভালো না, পরিক্ষায় পাস করার মতো ছাত্রী সে।তুখোড় মেধাবী ব্যাংকার বাবার একমাত্র মেয়ে কিনা এমন অমনোযোগী ছাত্রী!

সবার চোখে যদিও ব্যাপারটা দৃষ্টিকটু কিন্তু হাসান সাহেব এসব ব্যাপারে কখনোই মেয়েকে চাপ দেননি।উনার কাছে মিতুর চাঞ্চলতাই বেশ আনন্দদায়ক।প্রচলিত একটা কথা আছে যে,বাবার বড়ো সন্তান নাকি বোকা হয় কিন্তু তার মেয়ের বেলায় সেটা খাটেনি।মিতু খুব দুষ্টু আর চঞ্চল।এতোদিন যদিও অনেক বিয়ের প্রস্তাব আসতো কিন্তু উনি না করে দিতেন কিন্তু এবার খুবই ভালো পরিবার থেকে বিয়ের প্রস্তাব এসেছে।ছেলের মা নাকি বাড়িওয়ালার স্ত্রীর বান্ধুবী।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

একদিন বেড়াতে এসে মিতুকে দেখে পছন্দ করেছে সেই পছন্দ থেকেই পরিবার নিয়ে এসে দেখে গিয়েছে।ছেলে আর্মির মেজর, ভালো অবস্থান,ছেলের ছুটি ছিলোনা বলে আসতে পারেনি কালকে নাকি এসেছে আর এসেই মিতুর সাথে দেখা করেছে।মিতু দেখতে খুবই মিষ্টি কিন্তু মুশফিক ছেলেটা কালকে দেখা করার পরে কিছুই জানায়নি।উনারা অবশ্য হ্যাঁ শুনতেই প্রস্তুত ছিলেন কারণ মিতুকে প্রত্যাখান করার প্রশ্নই আসে না কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় ছেলেপক্ষর কাছে থেকে কোনো খবরই আসেনি। সকালেই ব্যাপারটা সবাই ভুলে যেতে চায়।

মিতুর মা মহিমা বেগম মিতুকে বকামন্দ করছে,
“এই মেয়ের জন্যই বিয়ে ভেঙ্গেছে।নিশ্চয়ই গতকাল ছেলের সাথে পটপট করেছে।কতবার বলেছি মেয়ে মানুষ এতো কথা বলতে হয় না,একটু ভারী মনের হ কিন্তু কে শোনে কার কথা।”
উনাদের অবাক করে দিয়ে তখনি হাসান সাহেবের ফোনটা তীব্রস্বরে চেচিয়ে উঠে।হাসান সাহেব মুশফিকের মায়ের নাম্বার দেখে হাতের ইশারায় মহিমা বেগমকে চুপ থাকতে বললেন।কিছুক্ষণ কথা বলে ফোন রেখে মহিমার দিকে তাকিয়ে বললো,

“উনারা আজকে রিং পরাতে আসবে।”
মহিমার মুখে হাসি ফুটে উঠে।ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললো,
“বারোটা বাজতে চললো,তাড়াতাড়ি বাজারে যাও।”
হাসান সাহেব ব্যাগ নিয়ে বাজারের দিকে ছুটে।মহিমা বেগম নিকটাত্মীয়দের ফোন করে জানায়।সবার শেষে জানায় মিতুকে।

মিতু উপন্যাসের বই পড়ছিলো।মায়ের কথা কর্নগোচর হওয়ার পরে তার হাতের বই টেবিলে নিঃশব্দে রেখে দেয়।চোখ চলে যায় ওয়্যারড্রোবের উপরে রাখা লাল শাড়িটার উপর।মেজর!আবার আসছে।মিতুর চঞ্চল মন যেনো নিমিষেই শান্ত হয়ে যায়।সকালে শাড়ি হাতে পেয়েই সে বুঝেছিলো মেজর ফিরে আসবে আর খুব দ্রুত আসলোও।মিতু উপলব্ধি করে তার কেমন ছটফট লাগছে।হাত পা কেমন ঠান্ডা হয়ে আসছে।সে চোখ বন্ধ করে শুয়ে পরে,তার মনে হচ্ছে মস্তিষ্ক ঠিকঠাক কাজ করছে না।ফোন হাতে নিয়ে জান্নাতকে ফোন দেয়।

“দোস্ত ব্যাটা তো আবার পল্টি নিলো।”
“কি হয়েছে?”
“গতকাল কোনো সাইন না দিয়ে আজকে নাকি ডিরেক্ট রিং পরাতে চলে আসবে!”
জান্নাত উৎফুল্ল গলায় বললো,
“দোস্ত তুমি তো গেছো।”
মিতু এমনিতেই টেনশনে আছে,সে বিরক্তি নিয়ে বললো,
“দূর।”

“কিসের দূর!জামাই কিন্তু আর্মি।তোমহারা খবর হো গেয়া মেরি জান।”
মিতু আমতা-আমতা করে বললো,
“কিসের খবর?”
জান্নাত হেসে বললো,
“দুষ্টুমি করেছি।”
“তুই আমাদের বাসায় আয়।”
“কেনো?”
“আমার ভয় লাগছে,আর উনাকেও দেখে যাবি।”
“আরেহ বাবা!এখনি উনি হয়ে গেছে?”
“ধুর!তাড়াতাড়ি আয়।”

মুশফিক সাদা পাঞ্জাবি পরে,আয়নার দিকে তাকিয়ে নিজেকেই নিজে বললো,
“মেজর!তোমার ইউনিটের সৈন্যরা তোমার বাধ্য অথচ আজকে নিজে এক চঞ্চল রমনীর বাধ্য হতে যাচ্ছো।কি মনে হয় বাধ্য হতে পারবে?নাকি বদমেজাজিই থেকে যাবে।”
মুশফিক হাসে।গায়ে বডিস্প্রে দিয়ে বুক ভরে শ্বাস নিয়ে নিজেকে প্রস্তুত করে।চোখের তারায় ভেসে উঠে চঞ্চল মেয়েটার ছবি।উহু মেয়ে না ও মিতুল,চঞ্চল হরিণি মিতুল।

মুশফিকের যদিও এখনি বিয়ে করার ইচ্ছে ছিলো না কিন্তু মায়ের জোরাজোরিতে রাজি হতে হলো।তবুও রাজী হতো না কিন্তু মিতুকে দেখে তার মনে হয়েছে মেয়েটা ভালো,সাদা মনের,ওকে বিয়ে করাই যায়।
সন্ধ্যার দিকে মুশফিক তার সপরিবারে মিতুদের বাড়িতে যায়।গিয়ে সবাই কথাবার্তা বলে,কথাবার্তার এক পর্যায়ে ঠিক করা হয় আজকে রিং পরানোর দরকার নেই আজকে বিয়ে হয়ে যাক।মুশফিকের সামনে আর ছুটি নেই,সুতরাং শুভ কাজে দেরী করে লাভ কি?

মুশফিক দাম্ভিকতার সাথে চুপচাপ বসে আসে।সবাই মুগ্ধ হয়ে মুশফিককে দেখছে,তামাটে গায়ের রঙেও কাউকে এতোটা সুদর্শন লাগে তা কেউ কল্পনাও করেনি।মিতুর মতো চঞ্চল মেয়ের জন্য যোগ্য বর পাওয়া যাওয়াতে সবাই খুশী।বিয়ের পরে মুশফিক সবার সাথে খুশবিনিময় করে।গম্ভীরমুখে কিঞ্চিৎ মুচকি হাসি ফুঁটে উঠে।
যেহেতু হঠাৎ করে বিয়ে মিতুর মা হাবিবা বললো,
“লাল কাপড় থাকলে ভালো হতো।”
মিতু হাসফাস করে বললো,

“আম্মু আমার কাছে একটা লাল কাপড় আছে।”
হাবিবা কাপড়টা উল্টেপাল্টে দেখে বললো,
” সুন্দরই তো।কবে কিনেছিস?”
মিতু মিথ্যা কথা বলে,
“আজকেই এনেছি,ছবি তুলবো বলে এনেছিলাম।”
“তাহলে তো ভালোই হলো,তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে যা।”

মিতু কিছু বুঝে উঠার আগেই যেনো বিয়ে হয়ে গেলো।বিয়ে হওয়ার পর থেকে সে পাথরের মতো বসে আছে।অন্যরকম এক অনুভূতি হচ্ছে যা মিতু বুঝতে পারছে না।
হঠাৎ বিয়ে হয়ে যাওয়াতে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় আজকে মিতুদের বাড়িতেই মুশফিক রাত্রিযাপন করবে সবাই সম্মতি দিলেও মুশফিক ঘোর প্রতিবাদ করে,সে কিছুতেই এখানে থাকবে না বউ নিয়ে বাসায় চলে যাবে এটাই তার সিদ্ধান্ত।বর যেহেতু থাকবে না সুতরাং কেউ আর না করলো না।

এই রাতেই তাকে নিয়ে যাওয়া হবে সেটা জানার পরে মিতু বাচ্চাদের মতো হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করে।চঞ্চল মেয়েটার মন যে খুব নরম তা সবাই জানে,মিতুর কান্নায় সবাই কাঁদে,এই বিদায়ের মুহূর্তটা এতো কষ্টদায়ক কেনো?কেনো মেয়ে হয়ে জন্মালেই বাবা মাকে ছেড়ে যেতে হবে?এই বিচ্ছেদের কি কষ্ট তা কি কেউ অনুধাবন করতে পারে না?পারলে কেনো অমন নিয়তি সবার হয়।

গাড়িতে বসেও মিতু ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদে।মিতুর কান্নায় মুশফিক বারবার মিতুর দিকে তাকায়।এতো কাঁদার কি আছে ভাই,যখন মন চায় তখনই তো বাবার বাড়ি যেতে পারবে তাহলে এতো কান্নাকাটি করার কি আছে।সে আস্তে করে বললো,
“এতো কান্না করার কি আছে?কালকে সকালেই নিয়ে আসবো।”

রাত দুইটা।মুশফিকের রুমে মিতু বসে আছে।সারা রুমে সাদার ছড়াছড়ি।খাট,আলমারি,সোফা,জানালার পর্দা,দেয়ালের রঙ,দেয়ালে টাঙ্গানো পেইন্টিং সবই সাদা।মিতুর মনে হয় সে সাদা মেঘের রাজ্যে বসে আছে।এই বাড়ির সবাই খুব ভালো,খুবই মিষ্টি তাদের আচরণ কিন্তু একজন ব্যতিক্রম সে হচ্ছে মুশফিক।মেজর মানুষরা বুঝি এমনই হয়?এতো গম্ভীর,পেচামুখো।আসার পর থেকে একটা কথাও বলেনি,কার সাথে যেনো এক নাগারে ফোনে কথাই বলছে, মিতু কয়েকবার মুশফিকের দিকে তাকিয়েছে।সত্যি কথা বলতে মুশফিক খুবই সুন্দর।সাদা পাঞ্জাবি যেনো সৌন্দর্য আরো দ্বিগুন করে দিয়েছে।দীপ্তিময় দুটো বড়ো বড়ো চোখ কথা বলায় আভিজাত্য ভঙ্গিমা,পাঞ্জাবির উপর দিয়ে হাতের শক্ত পেশী ফুটে আছে যা দেখে মিতুর বুকটা কেঁপে ওঠে।

মুশফিক রুমে আসে।মিতু তার দেয়া
লাল কাপড়টা পড়ে আছে,মেয়েটাকে ভালোই দেখাচ্ছে।শাড়ি পরে মাথায় ঘোমটা দেয়াতে যেনো খুব মায়াবতী লাগছে তা দেখে মনে হলো উপহারের শাড়ি পড়ে যদি এতো সুন্দর লাগে তাহলে সে বারবার উপহার দেবে। সাদা মেঘের রাজ্যে এমন ফুটফুটে পরীকে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে মুশফিক ভাবলো যে মানুষ নয় ভুলবসত কোনো পরীকে বিয়ে করে ফেলেছে।সে চুপচাপ মিতুর দিকে তাকিয়ে আছে।

মুশফিককে গতকাল ভয় না লাগলেও আজকে ভিষণ ভয় লাগছে।এই যে একলা রুমে মেজরের সাথে আছে তার ভিষণ ভয় লাগছে, চঞ্চলতা যেনো জানালার ফাঁক গলে বেরিয়ে যায়।মুশফিকের দিকে তাকিয়ে জান্নাতের বলা কথাটা মনে হয়ে যায়।”তোমহারা খবর হো গেয়া।”
মিতু জিভ দিয়ে শুকনো ঠোঁট ভিজায়।

মুশফিক মিতুর দিকে তাকিয়ে হাসে।আসার পরে মিতু অসুস্থবোধ করছিলো,তার স্যার তাকে ফোন দেয়াতে সে কলে ব্যস্ত ছিলো।সে এগিয়ে এসে মিতুর দিকে তাকিয়ে বললো,
“এখন শরীর কেমন লাগছে?”
গমগমে কন্ঠের কথা শুনে মিতু নড়েচড়ে বসে।মাথা নাড়িয়ে বললো,
” ভালো।”

“তুমি আর একটু অপেক্ষা করো আমি কাপড় পালটে আসি।”
মিতু খেয়াল করে মুশফিক এখনো বিয়েতে পরা পাঞ্জাবি বদলায়নি।কি এমন জরুরী ফোনে ব্যস্ত ছিলো যে কাপড়ও পাল্টায়নি।মুশফিক তাকে তুমি করে সম্মোধন করছে,সম্পর্কের সাথে সাথে কথা বলার ভঙ্গিমাও যেনো পালটে গেছে।
মুশফিক খুব দ্রুত ফ্রেশ হয়ে আসে।তোয়ালে দিয়ে চুল মুছতে মুছতে বারান্দায় যায়,তোয়ালে মেলে দিয়ে রুমে আসে।আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মিতুর দিকে তাকায়,চঞ্চল মেয়ে কি ভয় পাচ্ছে?পাচ্ছে বোধহয় তাইতো কেমন বিবর্ণ লাগছে।সে বিছানায় বসে।

“শাড়িটা পছন্দ হয়েছে?”
“জ্বি।”
“খুব?”
“হুম।”
“হঠাৎ বিয়ে হওয়াতে তুমি কি রাগ করেছো মিতু?”

মিতু মুশফিকের দিকে তাকায়।উনি স্বাভাবিক কথা বলে তার সাথে সহয হতে চাইছে কিন্তু আড়ষ্টতায় সে কথা বলতে পারলো না।মুশফিক মিতুর দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
“আমার ছুটি কম তাই এতো তাড়াহুড়ো করে বিয়ে হলো।”
“আচ্ছা।”

মুশফিক এতো দক্ষ, চৌকুস এক মেজর,যে নির্দিধায় অনেকক্ষন কথা বলে যেতে পারে অথচ আজকে যেনো সে কথা খুঁজে পাচ্ছে না।
“আলতাটা এনেছো?”
মিতু মাথা নেড়ে বললো,
“ব্যাগে আছে।”

মুশফিক মিতুর সাথে আরো অন্যান্য কথা বলছে কিন্তু মিতু যেনো কথা বলতে চাইছে না।কেমন সংকুচিত হয়ে আছে।মুশফিক বুঝতে পারে মিতুর মনোভাব।সে বললো,
“তুমি কি আমাকে ভয় পাচ্ছো?”
মিতু চুপ করে থাকে।মুশফিক মিতুর লজ্জা আর ভয় মিশ্রিত মুখের দিকে তাকিয়ে বললো,
“শুয়ে পড়ো।”

মেজর পর্ব ১

মিতু কোনো কথা না বলে চুপচাপ শুয়ে পরে।মুশফিক নিজেও শুয়ে পরে,সে স্পষ্ট বুঝতে পারছে মিতু তার সানিধ্য কামনা করছে না।বুকে কেমন ছটফট নিয়ে ঘুমিয়ে পরে।
ভোর সকালে মিতু কপালে কারো হাতের স্পর্শ পায়।
চোখ খুলে শুনতে পায়,গমগমে কন্ঠ নরম হয়ে গিয়েছে,আলতো কন্ঠে মুশফিক বলছে,
“মিতুল,এই মিতুল,আমি চলে যাচ্ছি তুমি উঠবেনা?”

মেজর পর্ব ৩