রাজনীতির রংমহল পর্ব ২৮

রাজনীতির রংমহল পর্ব ২৮
সিমরান মিমি

দুপুর দুইটা।রোদের উত্তাপে মানুষ জন কাহিল হয়ে পড়েছে।কেউ কেউ পানির স্রোতের মধ্যে ডুবে শীতলতা অনুভব করছে।কেউ কেউ দুরের জঙ্গলের পাশে পাশে হাটছে।আবার কেউ কেউ রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে ফটো তুলছে।
ডাবের উপর হামলে পড়েছে স্পর্শীয়া।পানি নয় সে নরম নারকেল খেতে ব্যাস্ত।আঠারো বছরের কিশোর ছেলেটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে তাকিয়ে আছে স্পর্শীর দিকে।

কিছুটা বিরক্ত ও হয়েছে।এই যে স্তুপের মধ্য দিয়ে বড় বড় ডাব গুলো বেছে বেছে কিনছে। তারপর পানি খেয়ে সেই ডাব না ফেলে বরং ছেলেটাকে জোর করছে সেটা কেটে দেওয়ার জন্য।পাশেই দুহাত বুকের উপর বেধে ঠোট কামড়ে ধরে হেসে স্পর্শীর পাগলামি দেখছে পরশ।এ যাবৎ চার টা ডাব খেয়েছে স্পর্শী।তবে পানি গুলো বাধ্য হয়ে পরশ কেই খেতে হচ্ছে।
ধীরে ধীরে রোদের প্রখরতা বাড়ছে।গায়ের ভেজা পোশাক ইতোমধ্যে শুকিয়ে গেছে।হাতের ঘড়িতে টাইম দেখতেই দ্রুত স্পর্শীকে টেনে তুললো। রিসোর্টে ফিরে যাবার কথা শুনতেই বেকে বসলো স্পর্শী।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

সে এখন কিছুতেই রিসোর্টে ফিরবে না। আরো ঘোরা বাকি রয়েছে৷মেজাজ বিগড়ে গেল পরশের।এতো এতো ঘোরাঘুরি, স্ত্রীয়ের সাথে প্রথম বার হানিমুনে আসা,এতো হাসি-মজা দুষ্টুমির মধ্যেও কোথাও যেন কিছু ফাকা হয়ে আছে।না কিছু ভালো লাগছে আর নাতো খারাপ লাগছে।একপ্রকার মনের মধ্যে অস্থিরতা শুরু হয়ে গিয়েছে।শুধুমাত্র স্পর্শী মন খারাপ করবে ভেবে এখনো পর্যন্ত তাল মিলিয়ে যাচ্ছে।কিন্তু এবারে আর নিজেকে সামলাতে পারলো না।বড্ড খামখেয়ালী করছে আজকাল স্পর্শী।হাতের ডাব টা ছুড়ে দূরে ফেলে হাত ধরে টেনে হিচড়ে অনেকটা দূরে নিয়ে এলো।

অবাক হয়ে গেল স্পর্শী।হাতের কবজি যেন ছিড়ে পড়ে যাচ্ছে।ব্যাথায় চোখে পানি টলমল করছে।এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল পরশের দিকে।যে লোকটা ফুলের পাপড়ির ন্যায় তাকে ছোয়,ছিড়ে যাবার ভয়ে।সে কিনা আজ এমন ভাবে টেনে হিচড়ে নিয়ে এলো।থমকে দাঁড়িয়ে পড়লো পরশ।স্পর্শীর দিকে তাকাতেই হুশ ফিরলো।চোখের ওই টলমল করা পানি দেখে বুকের ভেতর টা মোচড় দিয়ে উঠলো।উত্তেজিত হয়ে দুহাত দিয়ে স্পর্শীর দু-গাল আঁকড়ে ধরলো।বললো-

আই এম সরি পাখি।বেশী ব্যাথা পেয়েছো হাতে?কই দেখি।ইশশ লাল হয়ে গেছে।আমি একটুও বুঝতে পারি নি।
আমলে নিল না স্পর্শী।চুপটি করে তাকিয়ে রইলো পরশের দিকে।তারপর ধীর কন্ঠে শুধালো-
রিসোর্টে চলুন।
বলেই হাটা শুরু করলো সামনে।পরশ হতাশার শ্বাস ফেললো।মুখটা কেমন তেতো হয়ে আছে।স্পর্শী যে কষ্ট পেয়েছে সেটা বুঝতে পারলেও সেই রাগ ভাঙানোর জন্য মন সাড়া দিচ্ছে না।ধীর পায়ে সেও রিসোর্টের দিকে চলতে শুরু করলো।

রুমে ঢুকেই ব্যাগ থেকে টপ্স জিন্স বের করে গোসলে ঢুকলো স্পর্শী।পরশ ও কিছু বললো না।টাওয়াল নিয়ে ঢুকে গেল নিজেও গোসল করতে।ইচ্ছে করেই অনেকটা দেরী করলো স্পর্শী। পরশ ইতোমধ্যে গোসল সেড়ে রুমে চলে গেছে।অনেকক্ষণ পর রুমে ঢুকতেই স্পর্শী অবাক হয়ে গেল।বিছানার উপর শুয়ে কপালের উপর হাত দিয়ে পরশ শুয়ে আছে।দ্রুত গতিতে তার পাশে গিয়ে বসলো স্পর্শি।কপালে, বুকে বারকয়েক হাত দিয়ে উত্তেজিত কন্ঠে বললো-

আপনার কি শরীর খারাপ লাগছে? কি হয়েছে বলুন না।খারাপ লাগছে?
চোখ খুলে তাকালো পরশ।স্পর্শীর দিকে তাকিয়ে বললো-
স্পর্শীয়া,কিচ্ছু হয় নি আমার।শান্ত হও।
কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো স্পর্শী। তারপর শান্ত কন্ঠে বললো-

খাবার টা রুমে আনিয়ে নিই।নিচে যাওয়ার কোনো দরকার নেই।কেমন?
সাড়া দিলো পরশ।শরীর টা ভেঙে আসছে।হয়তো সারাদিন রোদে থাকার কারনে।এখন উঠে আবার খেতে যেতে ইচ্ছে করছে না।

বেশ কিছুক্ষণ পর রুম সার্ভিসের এক কর্মী খাবার নিয়ে এলো।এই রিসোর্টের মালিকের নিজস্ব রেস্টুরেন্ট রয়েছে।রিসোর্টের পাশেই সেই নামকরা রেস্টুরেন্ট।বেশিরভাগ টুরিস্ট’ই এখান থেকে খায়।খাবার সাজিয়ে টেবিলে রেখে পরশকে আলতো স্বরে ডাকলো।খেতে ইচ্ছে করছে না তার।কিন্তু স্পর্শীর জন্য বাধ্য হয়ে টেবিলে আসলো।স্পর্শীর দিকে তাকিয়ে শুকনো হাসি দিয়ে খাওয়া শুরু করলো সে।সাথে সাথেই একটা কাশি দিল।মুহুর্তে ই সমস্ত খাবারের ঝাল নাকে উঠে গেল।দম নিতে পারছে না পরশ।স্পর্শী দ্রুত হাতে জগ থেকে পানি ঢেলে দিল। ঢকঢক করে পানি খাওয়ার পরেও ঝাল কমলো না পরশের।খাবার ফেলেই বাথ্রুমের দিকে ছুটলো সে।স্পর্শীও পিছন পিছন ছুটলো।

নাকে মুখে পানি দিয়ে দেয়াল ধরে দাঁড়িয়ে পড়লো পরশ।চোখ দুটো লাল হয়ে অনবরত পানি পড়ছে।শ্বাস নিতে গেলেই পুনরায় সমস্ত ঝাল নাকে উঠে যাচ্ছে।কাশিও দিতে পারছে না।স্পর্শী পরশকে এমন অবস্থায় দেখে হাউমাউ করে কেদে উঠলো।দ্রুত হাতে ধরে কাপা কাপা কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো-

আপনার কি হলো নেতামশাই?এমন করছেন কেন?খাবার কি গলায় আটকেছে?বলুন না।ডক্টর ডাকবো।
এই মুহুর্তে স্পর্শীর কথার জবাব দিতে পারছে না পরশ।তারপরেও অতি কষ্টে ইশারায় চুপ করতে বলে রুমের দিকে এগোলো সে।বিছানার সামনে আসতেই ধপ করে শুয়ে পড়লো। স্পর্শী আরো ঘাবড়ে গেল।ছুটে এসে পাশে বসে হাতের তালু ঘষতে লাগলো। ঘাবড়ানো কন্ঠে বললো-

আপনার কি শরীর খারাপ লাগছে নেতামশাই?আমার কাছে বলুন না।
পরশ তাকালো।দম নিয়ে কষ্ট করে বললো-
আমার শরীর টা ভালো লাগছে না স্পর্শীয়া। একটু ঘুমাবো।তুমি প্লিজ আমায় ডিস্টার্ব করো না।খেয়ে নাও।

চুপ করে পাশে দাঁড়িয়ে রইলো স্পর্শী।ফুপিয়ে ফুপিয়ে নিঃশব্দে কেদে যাচ্ছে সে।পরশ ঘুমে তলিয়ে গেছে ইতোমধ্যে।ধীর পায়ে কোনো শব্দ না করে বিছানায় উঠলো স্পর্শী। বাইরে খেতে যাওয়ার উদ্দেশ্যেই শার্ট পড়েছিল পরশ। এখন গরমে ঘেমে নেয়ে অস্থির হয়ে গেছে। আলতো হাতে বোতাম গুলো খুলে দিয়ে বুকের উপর আলতো করে চুমু বসালো।কপালের উপরেও চুমু দিয়ে জড়িয়ে ধরলো পরশকে।একপর্যায়ে সেও তলিয়ে গেল ঘুমের দেশে।

রাত সাতটা।বুকের উপর ভারী কিছু অনুভব হতেই চোখ খুললো পরশ।বুকের উপর তাকাতেই এলোমেলো চুলে ঢাকা ঘুমন্ত স্পর্শীকে নজরে এলো।ঠোট এলিয়ে নিঃশব্দে হাসলো।আলতো হাতে চুলগুলো একপাশে নিয়ে বালিশে মাথা রাখলো।চোখের নিচে থাকা অশ্রুটুকু শুকিয়ে দাগ হয়ে গেছে।মাথা নিচু করে স্পর্শীর ঠোটের উপর চুমু খেল পরশ।ঘুমের মধ্যেই ঠোট দুটো কুচকে ফেললো স্পর্শী।পরশ হাসলো।পুনরায় গাঢ় করে চুমু দিলো।এবারেও নাক চোখ কুচকে ঘুমের মধ্যে এক হাত উঠিয়ে ঠোট মুছলো।তারপর কাত হয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে শুয়ে পড়লো।

বেশ মজা লাগছে পরশের।স্পর্শীকে জ্বালাতে আবারো ঠোটের উপর গাঢ় চুমু দিলো।ঘুমের মধ্যেই দম বন্ধ হয়ে গেল স্পর্শীর।শ্বাস নিতে না পেরে ধড়ফড় করে চোখ খুলে উঠে বসলো।পরশকে সামনে দেখতেই কপাল কুচকে নাকের পাটাতন ফুলিয়ে ফেললো।দুপুরের কথা মনে পড়তেই মুহুর্তে উত্তেজিত হয়ে ঝাপিয়ে পড়লো পরশের বুকে।নুয়ে যাওয়া কন্ঠে বললো-

আপনি ঠিক আছেন তো নেতামশাই?এখনো কি কষ্ট হচ্ছে আপনার?
আলতো হেসে জড়িয়ে ধরলো পরশ। আদুরে কন্ঠে বললো-
উহুম,হচ্ছে না তো।তবে খুব খিদে পেয়েছে।চলো নিচে গিয়ে খেয়ে তারপর ঘুরবো।সারা বিকাল টা তো নষ্ট করে দিলাম।
স্পর্শী কিচ্ছু বললো না।দ্রুত বাথরুমে গেল ফ্রেশ হতে।গায়ের শার্ট খুলে আরেকটা শার্ট পড়লো পরশ।অভ্যাসবশত বালিশের পাশ থেকে ফোন হাতে তুলতেই ভ্রু কুচকে ফেললো।ধুর!চার্জ নেই।বন্ধ হয়ে গেছে ফোন।চার্জারে ফোন লাগাতেই স্পর্শী চলে এলো। স্বভাবসুলভ মুচকি হাসি দিয়ে স্পর্শীর হাত ধরে রুম থেকে বেরিয়ে গেল।

খাওয়া শেষ হতেই পুনরায় রিসোর্টের দিকে হাটা শুরু করলো পরশ। অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো স্পর্শী। দ্রুতপায়ে হেটে পরশের সামনে দাঁড়িয়ে বললো-
ঘুরবেন না নেতামশাই?
আলতো করে গাল টিপে দিল পরশ।তারপর শান্ত কন্ঠে বললো-
সোনা,ফোনটা নিয়ে আসি। রাত হয়েছে তো।

মুহুর্তেই মনটা ফুরফুরে হয়ে গেল স্পর্শী।তাল মিলিয়ে পরশের সাথে ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বললো-
আমার টাও নিয়ে নেই।খালা মনিকে একটা ফোন দিয়ে জাফলং দেখাবো।ওর খুব ইচ্ছে ছিলো এখানে আসার।
কথা বলতে বলতে রুমে ঢুকলো দুজন।চার্জার থেকে ফোণ খুলে হাতে নিল পরশ। ইশ,ফোনটা অন করে রেখে যেতেও ভুলে গেছিলো সে।ত্রস্ত হাতে ফোন অন করতেই একগাদা নোটিফিকেশনে প্রায় হ্যাং হয়ে যাওয়ার পালা।

মিনিট দুয়েক পর ফোনের দিকে তাকাতেই চমকে উঠলো পরশ।পার্টির সদস্য থেকে শুরু করে বাবা,মা,কাকা,সুমনের ফোনকলে কললিস্ট ভরে গেছে।একেকজনের সিম থেকে মিনিমাম বিশটা মিসড কল।বাড়িতে কল দিবে ভাবতেই একটা নোটিফিকেশনে চোখ আটকে গেল পরশের।দ্রুত হাতে সেখানে ক্লিক করতেই ফেসবুকে ঢুকলো। অসংখ্য সাংবাদিক,রাজনৈতিক নেতা তাকে ট্যাগ করে পোস্ট করেছে।

“স্কুলে যাবার পথে গণধর্ষণের শিকার হলেন পিরোজপুরের বর্তমান সংসদ সদস্য পরশ শিকদারের চৌদ্দ বছরের একমাত্র ছোট বোন।আমরা এই ঘৃন্য এবং কুৎসিত অপরাধের বিরুদ্ধে তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি।আইন শৃঙখলা বাহিনীদের কাছে আমাদের সবার একটাই দাবি যে, শীঘ্রই এই অপরাধীদের আইনের আওতায় এনে গেফতার করে দৃষ্টান্তমুলক শাস্তির ব্যাবস্থা করুন।

এরকম অহরহ পোস্টে ভরপুর তার আইডি।মাথা হ্যাং হয়ে গেল পরশের।ধপ করে বিছানার উপর বসে পড়লো।পুরো শরীর যেন ভর ছেড়ে দিয়েছে।সাময়িক ভাবে মাথা ফাকা হয়ে গেল তার।আশেপাশের কোনো কিছুই তার স্নায়ুতন্ত্র গ্রহণ করতে অপরাগ।মাথার ভেতর শুধু একটা শব্দই ঘুনে পোকার মতো খুটে বেরোচ্ছে ” গণধর্ষণ”।
পরশকে বিছানায় বসতে দেখে স্পর্শী ভ্রু কুচকে সামনে এলো। লোকটার এমন শান্ত, স্থির, স্তব্ধতা দেখে ভয়েরা পুনরায় ঝেকে বসলো।মন বলতে লাগলো-

আবারো অসুস্থ হয়ে যায় নি তো।
বিছানার উপর আলগোছে স্ক্রিন জ্বলতে থাকা ফোনতা দেখে ভ্রু কুচকে ফেললো।এইমাত্রই তো ফোন দেখছিলো তাহলে হঠাৎ কি এমন হলো? ফোন হাতে নিতেই শিউরে উঠলো স্পর্শী।সময়ের দিকে তাকাতেই আরো অবাক হয়ে গেল।মুখ দিয়ে অস্পষ্ট স্বরে বের করলো-

আল্লাহ!আজ সকাল নয়টার সময় এই পোস্ট করা হয়েছে।আর আমরা এখনো কিচ্ছু জানি না।
স্তব্ধতায় মুড়িয়ে যাওয়া পরশের দিকে চাইতেই আতকে উঠলো স্পর্শী।চোখ দুটো অস্বাভাবিক মাত্রায় লাল হয়ে আছে।যেন অশ্রুরা চাইলেও বের হতে না পেরে রক্তের ন্যায় ধারণ করেছে চোখের কার্ণিশে।

স্পর্শী ফোপাতে ফোপাতে পরশের ফোন নিয়ে “বাহাদুর” কে ফোন দিলো।ফোন বন্ধ।আশ্চর্য ব্যাপার!
পরশের দিকে তাকিয়ে দেখলো এখনো স্তব্ধ হয়ে ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে রয়েছে।দ্রুত পায়ে রুমের বাইরে বের হলো স্পর্শী।তাদের রুমের তিন রুম পরেই বাহাদুর ভাইয়ের রুম।এক ছুটে সেদিকে গেল। প্রায় দুমিনিট ধরে দরজা ধাক্কানোর পরে ঘুম ঘুম অবস্থায় দরজা খুললো বাহাদুর।
রেগে চেচিয়ে উঠে বললো-

আপনার ফোন কোথায় বাহাদুর ভাই?এক্ষুনি বের হোন।আমরা বাড়ি যাব।
বাহাদুর অবাক হলো। তারপর আমতা আমতা করে বলল-
আজকে ঘুরতে গেছিলাম।ভিড়ের মধ্যে হারাইয়া গেছে।

কথায় বলে বিপদ যখন আসে চারদিক দিয়ে আসে।আজ বাহাদুরের ফোনেও হয়তো বাড়ি থেকে ফোন এসেছে।দ্রুতপায়ে রুমে ঢুকতেই দেখলো পরশ বাথ্রুম থেকে বেরিয়েছে।চোখ দুটো কঠিন হয়ে আছে।হয়তো কেদেছে।চোয়াল টা ইস্পাতের ন্যায় শক্ত করে স্পর্শীর উদ্দেশ্যে বললো-
দু মিনিটের মধ্যে গোছগাছ করো।
কোনো সাড়া দিলো না স্পর্শী।সাহস হলো না।সান্ত্বনা দেবার মতো সাহস ও হারিয়ে ফেললো সে।

রাতের অন্ধকার রাস্তার মধ্যে গাড়ি চালাচ্ছে ড্রাইভার বাহাদুর।পিছনের সিটে মাথা হেলিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে বসে আছে পরশ।পাশেই স্পর্শী হাসফাস করছে পরশের সাথে কথা বলার জন্য।লোকটা বাইরে নিজের কাঠিন্যতা দেখালেও ভেতরে ভেতরে যে ভীষণ ভেঙে পড়েছে।আলতো করে পরশের হাতে হাত রাখলো স্পর্শী।নির্বাক চাহনিতে সেদিকে তাকালো পরশ।কাপা কাপা কন্ঠে একহাত জড়িয়ে ধরে কান্না ভেজা গলায় স্পর্শী বললো-

আপনি প্লিজ শান্ত হোন।দেখবেন,সব ঠিক হয়ে যাবে।
সরাসরি দৃষ্টি দিল স্পর্শীর দিকে পরশ।ভেতরটা ভেঙে চুড়ে চুরমার হয়ে যাচ্ছে।শান্ত গলায় গম্ভীর কন্ঠে পরশ বললো-
তুমি ভাবতে পারছো স্পর্শীয়া,আমার এইটুকু বোনটা ঠিক কতটা ছটফট করেছে।তোমাকে তো ফুলের পাপড়ির মতো যাতে নষ্ট হয়ে না যায় সেভাবে ছুই। তাও তো মাঝেমধ্যে কেদে ফেলো। সেখানে আমার ওই টুকু বোনটা কিভাবে সহ্য করেছে ভাবতে পারছো।বলতে হলতে গলা ভেঙে এলো।উফফফফ!যন্ত্রনায় কলিজা টা ছিড়ে যাচ্ছে পরশের। গাড়ির গতিবেগকে ভীষণ স্লো মনে হচ্ছে।ছটফটিয়ে তেজস্বী গলায় বললো-

বাহাদুর ভাই,গাড়ি থামান।
নিমিষেই মনিবের আদেশ শুনে গাড়ি থামালো।দরজা খুলে বাইরে বের হয়ে পরশ বললো-
আপনি পেছনে যান,আমি চালাচ্ছি।স্পর্শীয়া,সামনে এসো।
কোনোরুপ বাকবিতন্ডায় না জড়িয়েই পরশের আদেশ মানলো দুজন।সিটবেল্ট বাধতেই দুর্বার গতিতে গাড়ি স্টার্ট করে চালাতে লাগলো পরশ। যেন উড়ে যেতে চাইছে পিরোজপুরে।স্পর্শী ঘাবড়ে গিয়ে পরশের দিকে তাকালো।ভীষণ ভয় করছে তার।এক হাত বাড়িয়ে পরশের ঘাড় চেপে ধরে চোখ বন্ধ করল।পাত্তা দিল না পরশ। আরো স্পিড বাড়িয়ে চলতে লাগলো সিলেটের আঁকাবাকা রাস্তায়।

রাত তিনটা।পিরোজপুরে ঢুকতেই বামহাতে ফোন নিয়ে বাবার নাম্বারে কল দিলো পরশ। ওপাশ থেকে রিসিভড হতেই কঠিন গলায় সোজাসাপ্টা প্রশ্ন করলো পরশ।
কোন হস্পিটাল?কত নম্বর কেবিন?
–ওপাশ থেকে মহীউদ্দীন শিকদার ভাঙাচোরা গলায় বললো-
সদরে আছি।২০৪ কেবিনে।

ফোন কেটে দিলো পরশ।সুনশান-নিস্তব্ধ পিরোজপুর সদর।গাড়ি থেকে নামতেই ভেতর থেকে দ্রুতপায়ে কেউ একজন এসে গেট খুলে দিল। ত্রস্ত পায়ে গাড়ি থেকে নেমেই হাসপাতালের ভেতরে চলে গেল পরশ। স্পর্শী ও পেছন পেছন দ্রুতপায়ে হেটে গেল সেদিকে।
কেবিন নং-২০৪

পুরো হাসপাতাল অন্ধকার।শুধুমাত্র রিসিভশনে এবং করিডোরে দু-একটা লাইট জ্বলছে।কেবিনের সামনে দরজার বাইরে বেঞ্চিতে মাথা হেলিয়ে বসে আছে মহীউদ্দীন শিকদার। আশেই আলতাফ শিকদার বসা।কিছুটা দুরেই সুমন মাথা হেলিয়ে ঘুমিয়ে রয়েছে।পরশের উপস্থিতি পেতেই চোখ তুলে চাইলেন মহীউদ্দীন শিকদার। পরশকে দেখেই হামলে পড়লেন বুকের উপর।নিরুপায় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো পরশ। কি বলে সান্ত্বনা দেবে সে বাবাকে।বেশ কিছুক্ষণ পর শান্ত গলায় বললো-
ও কোথায়?

চোখের পানি মুছে ভাঙা কন্ঠে বললো-
ঘুমাচ্ছে।সারাক্ষণ কাদে।আমার বুজদার মেয়েটা চিৎকার করে বাচ্চাদের মতো কাদে।পাগলের মতো করছে আমার মেয়েটা ।ডাক্তার বাধ্য হয়ে ঘুমের ইঞ্জেকশন দিয়ে দিয়েছে।আজ সারাদিন ঘুমের মধ্যেই আছে।সন্ধ্যার দিকে ঘুম ভেঙেছিলো একবার।ওর চিৎকারে বাধ্য হয়ে আবার ঘুমের ইঞ্জেকশন দিয়েছে।

আলতো হাতে কেবিনের দরজা খুললো।রুমের লাইট জ্বালানো।বাচ্চাদের মতন ঠোট উলটে ঘুমিয়ে আছে প্রেমা।তার পাশেই টুলে বসা অবস্থায় সিটে মাথা দিয়ে ঘুমিয়ে আছে পিয়াশা।স্পর্শী ধীরপায়ে পিয়াশার পাশে গেল।গায়ে হাত দিতেই চট করে তাকালো। স্পর্শীকে দেখতেই কান্নার বাধ ভাঙলো তার।শাশুড়ীকে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে নিজেই কেদে দিল স্পর্শী।
এক মুহুর্ত ও দাড়ালো ওখানে পরশ।দ্রুতপায়ে বাইরে এসে কাঠকাঠ কন্ঠে বাবাকে জিজ্ঞেস করলো-
কারা ছিলো?

হতাশ হয়ে মহীউদ্দীন শিকদার বললেন-
জানি না।মেয়েটাকে কি জিজ্ঞেস করবো।ওর কান্নাই তো থামাতে পারছে না কেউ।
থমথমে কন্ঠে পুনরায় পরশ বললো-
ওকে হাস্পাতালে কে এনেছে?
ওপাশ থেকে সুমন বলল-
পাভেল।

চমকে উঠলো পরশ।এতো বড় ঘটনা ঘটলো অথচ পাভেল তাকে একবারেও ফোন করলো না।মাত্র একটা দিন ছিল না বাড়িতে।এই একটা দিন ও সামলাতে পারলো না।ভাবতেই রাগে গা শিরশির করছে।পাভেলকে হাতের কাছে পেলে এই মুহুর্তে ঠিক কি করে বসবে জানা নেই পরশের।রাগী স্বরে সুমনের দিকে তাকালো পরশ।বললো-
কোথায় ও?

–জানি না ভাই।কিচ্ছু জানি না।প্রেমাকে হস্পিটালে দিয়ে কোথাও একটা চলে গেছে ও।হয়তো আপনার ভয়ে এখনো হস্পিটালে আসে নি।আমি ওর মতো গর্দভ একটাও দেখি নি।এই অবস্থায় কি করে দূরে রইলো।
সামান্য চিন্তার রেখা ফুটলো পরশের কপালে।এরইমধ্যে সুজনের কথা খেয়ালে পড়তেই অবাক হয়ে গেল।কেউ সুজনের ও কোনো খোজ জানে না।সুমনের উদ্দেশ্যে বললো-

পার্টির ছেলেদের খবর দে।যেখান থেকে পারিস সুজনের খোজ নে।
মাথা নাড়িয়ে ফোন হাতে বাইরে চলে গেল সুজন।পরশ সেখানেই বসে পড়লো।হয় পরশ না হয় প্রেমা।দুজনের কারো একজনের মুখ থেকে সত্যিটা না জানা অবধি সন্দেহের বশে কিছু করে ওঠাটা বোকামি হয়ে যাবে।

সকাল সাড়ে সাতটা।কপালে হাত দিয়ে বেঞ্চের উপর বসে আছে পরশ।হঠাৎ কানে এম্বুলেন্সের শব্দ যেতেই চমকালো।পরক্ষণেই সে যে হস্পিটালে আছে সেটা মনে হতেই চিন্তা ঝেড়ে ফেললো।নিচ থেকে অধিকতর লোকজনের আওয়াজ, পুলিশের গাড়ির সাইরেন,এম্বুলেন্সের আওয়াজ পেতে চকিতে দাড়ালো। কোনো গুরুতর রোগীকে হয়তো। এরইমধ্যে দ্রুতপায়ে এক পুলিশের ইন্সপেক্টর তার কাছে এলেন।ভাঙা ভাঙা কন্ঠে বললেন-

এমপি সাহেব, একটু নিচে আসুন।
পরশ তার দিকে একবার তাকিয়ে ভ্রু কুচকে ফেলল।দেখেই বোঝা যাচ্ছে ঘাবড়ে আছে ভীষণ। জোর পায়ে তার সাথে নিচে নামতেই দেখলো এম্বুলেন্স থেকে সাদা কাপড়ে মোড়ানো এক রক্তাক্ত লাশ বের করছে।হস্পিটালের সামনের ফাকা জায়গাটুকুতে লাশটাকে শুইয়ে মুখের উপর থেকে চাদরটা সরিয়ে দিল।
ইনস্পেকটর পরশের কানের কাছে গিয়ে ঘাবড়ে যাওয়া কন্ঠে বললেন-

রায় বাড়ির পেছনের জঙ্গলে পেয়েছি লাশ টা।
কথাটা কর্ণো গোচর হতেই লাশের দিকে তাকালো পরশ।শুকিয়ে যাওয়া রক্তে রক্তাক্ত লাশটা কেমন পরিচিত লাগছে।ধীর পায়ে আরেকটু সামনে আগালো।নিজ হাতে চাদরটা ধরে একটানে অনেকটা খুলে ফেললো।সাথে সাথেই চোখ বন্ধ করে আর্তনাদ করে উঠলো সবাই।

রাজনীতির রংমহল পর্ব ২৭

পাভেল নিশ্চিন্তে দুচোখ দিয়ে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে।চোখে সামান্য পলক ও পড়ছে না।গলার কাছে ধারালো কিছুর কোপে প্রায় দুই ইঞ্চি ফাক হয়ে আছে।সেখান থেকে বেরোনো লাল রক্তগুলো জমাট বেধে শুকিয়ে আছে।সাদা রঙা শার্টটা কেটে বুকের উপরে পড়া বড় কোপটা ভয়ংকর আকারে ধারন করেছে।ডান হাতটা সামান্য চামড়ায় বেধে বাকিটা ঝুলে পড়ে আছে পাশে।ব্যাস আর দেখতে পারলো না পরশ। পাশের দুম করে বসে পড়লো।পৃথিবীটা থমকে গেল মনে হয়।
পাশ থেকে সুমন সহ আরো কয়েকজন ছেলে এসে ধরলো পরশকে।শুধু কানে বাজছে চারপাশ থেকে ভেসে আসা জনগণের আর্তনাদের ধ্বনি।

রাজনীতির রংমহল পর্ব ২৯