রাজনীতির রংমহল পর্ব ২৯

রাজনীতির রংমহল পর্ব ২৯
সিমরান মিমি

আমাদের জীবনে ভালো খবর গুলো অন্যদের নিকট পৌছাতে যতটা সময় লাগে,তার চেয়েও অধিক কম সময় লাগে খারাপ খবর ছড়াতে।এই খবরগুলো যেন বুলেটের গতিতে একে অন্যের কাছে পৌছে যায়।নিচ থেকে একজন নার্সের মুখে ছেলের মৃত্যুর খবর পেতেই পাগলিনীর মতো দোতলা থেকে ছুটতে ছুটতে নিচে নামলো পিয়াশা।

স্পর্শীও তার পিছু পিছু ছুটে এসেছে।মহীউদ্দীন শিকদার যেন শরীরের সকল বলশক্তি হারিয়ে ফেলেছেন। প্রতিটা পা যেন পাথরের ন্যায় ওজন হয়ে গেছে।অতিকষ্টে নিচে নেমে সামনে ভিড় দেখতেই পুনরায় স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন।পিয়াশার চিৎকার পরশের কানে যেতেই ইশারা দিয়ে লাশটাকে চাদরে মুড়িয়ে দিতে বললো। এমন নৃঃশংস মৃত্যু যে সহ্য করতে পারবে না মা-বাবা।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

সামনে সাদা চাদরে মোড়ানো লাশটার দিকে ছুটে গেলেন পিয়াশা।শুধু মুখ টা দেখা যাচ্ছে।সেটাও রক্তের প্রলেপে লাল হয়ে রয়েছে।লাশ থেকে পঁচা দুর্গন্ধ ছুটছে।ছিন্নভিন্ন শরীরটা ধীরে ধীরে নরম হয়ে হয়ে যাচ্ছে।এক চিৎকারেই জ্ঞান হারালেন পিয়াশা।কয়েকজন নার্স তাকে ধরে একপাশে নিয়ে গিয়ে চোখে পানির ছিটা দিচ্ছেন।লাশ থেকে কয়েক হাত দুরেই স্তব্ধ হয়ে লাশের দিকে তাকিয়ে আছেন মহীউদ্দীন শিকদার।

“কি এমন পাপ তিনি করেছিলেন?যার কারনে আজ এত বড় শাস্তি পেলো।বাবা হয়ে ছেলের লাশ কাধে নেওয়ার চেয়ে বেশী কষ্টের কাজ যে আর পৃথিবীতে নেই।পাশেই তাকে ধরে কাদছেন আলতাফ শিকদার।
স্পর্শী অদুরে গেট ধরে দাঁড়িয়ে কাদছে।ওই লাশের সামনে যাওয়ার সাহস যে তার নেই।সবার মুখে শুনেছে খুব নৃঃশংস ভাবে খুন করা হয়েছে।সে যে রক্ত দেখতে পারে না। ভীষণ ভয় হয়।

কিচ্ছুক্ষণেই জ্ঞান ফিরলো পিয়াশার।উঠেই পুনরায় পাগলিনীর মতো করতে লাগলো। ছুটে যেতে লাগলো মাটিতে মোড়ানে লাশের দিকে।পরশ এতোক্ষণ স্তব্ধ হয়ে চেয়ারে বসে ছিলো।সবাই যখন পিয়াশাকে সামলাতে হিমশিম খাচ্ছিলো তখন ধীর পায়ে সে গিয়ে মাকে ধরলো।
পেছন ফিরে পরশকে দেখেই তেতে উঠলো পিয়াশা।অতর্কিত ভাবে পরশের বুকের উপর কিল -ঘুষি-থাপ্পড় মারতে লাগলো।চিৎকার করে বললো-

তুই খুশি হয়েছিস?তাই না।আরে তুই তো চেয়েছিলিই যাতে আমার ছেলেটা মরে যায়।এই জন্য তো তুই ওকে লায় দিতি।কত বার বারণ করেছিলাম এসবে না জড়াতে।কিন্তু তুই তো তোর মর্জি ছাড়া চলিস না।নিজে যেভাবে রাজনীতির পেছনে ছুটলি। ছোট ভাইটাকেও লেলিয়ে দিলি।আজ দেখ,তোর রাজনীতি কি দিয়েছে আমাকে।আমার মেয়েটার শ্বাস চললেও বেচে নেই ও।মরে গেছে।ছেলেটাকেও শেষ করে দিলো।
থেমে,

তাতে তোর কি?তুই তো এমপি হয়ে গেছিস। তোর জন্য আমার ছেলে-মেয়ে দুইটা আজ ভুগছে।তোর খামখেয়ালী পনার জন্য। রাজনীতি করতি করতি ভালো কথা।আবার শত্রুর বাড়ির মেয়ে তুলে এনে বিয়ে করেছিস। আমি কি কিছু বুঝি না নাকি।আমার ছেলেমেয়ে দুইটাই তোর জেদের কারনে শেষ। তোর শত্রুরা করছে এমন।তুই তো এখন খুশী?এমপি হয়েছিস,ক্ষমতা পেয়েছিস,বউ ও পেয়েছিস,সুখে সংসার ও করবি।

পিয়াশা আর কিছু বলতে পারলো না।ঢলে পড়লো পুনরায় পরশের বুকের উপর। মাকে নার্সদের হাতে দিয়ে পরশ কঠিন চিত্তে দাঁড়িয়ে রইলো লাশের দিকে।কেউ যদি বুঝতো ওর ভেতরে কি ঝড় চলছে তাহলে ভুলেও ওর দিকে আঙুল তোলার সাহস পেতো না।ছোট বেলা থেকে বাবা-মায়ের থেকেও পাভেল যে তার নেওটা ছিলো। এই হাতে হাত ধরিয়ে হাটতে চলা শিখিয়েছে ওকে।কাধে নিয়ে চষে বেরিয়েছে সারা বাড়ি। সেই ভাইটা আজ তার ভুলের কারনেই আর নেই।

দুহাত দিয়ে মুখ ঢেকে ঢুকরে কেদে উঠলো স্পর্শী।পিয়াশার প্রত্যেকটা কথা যেন বুকের ভেতর বিষের বানের মতো ঢুকে পড়েছে।তার জন্যই কি হয়েছে এমন?কই, কেউ তো জানেই না এখনো প্রেমাকে কে ধর্ষন করেছে?তাহলে তার পরিবার কে কিভাবে দোষারোপ করলো?

এই শোক মুহুর্তে ক্রিংক্রিং করে ইনস্পেটরের ফোনটা বেজে উঠলো।দ্রুত ভিড়ের বাইরে গিয়ে রিসিভড করে কানে নিতেই ওপাশ থেকে কেউ কিছু বুঝিয়ে বললো।তার কথার সাথে হু-হা জবাব দিয়ে পুনরায় পরশের সামনে এলো।জিভ দিয়ে গলা ভিজিয়ে বললো-

স্যার,আপনাদের মিসিং হওয়া গাড়িটার খোজ পাওয়া গেছে।
চকিতে তাকালো পরশ।গাড়ি তো সুজন চালাতো।গাড়ির খবর পাওয়া মানে সুজন কে পাওয়া। আর এই ঘটনা গুলোর কিছুটা হলেও সুজন জানবে।গম্ভীর কন্ঠে পরশ ইনস্পেকটর কে জিজ্ঞেস করলো-
কোথায়?

ইনস্পেকটর খানিকটা ঢোক গিললো।এত বিপদের মধ্যে কি আবার এই বিপদ টা জানানো তাদের ঠিক হবে?ক্ষানিকটা ভেবে বললো-
রায় বাড়ির সামনে দিয়ে যে চিকন রাস্তা চলে গিয়েছে জঙ্গলের ভেতর দিয়ে।সেই জঙ্গল শেষ হওয়ার পরেই বিশাল ধানক্ষেত।জায়গাটা খুবই নির্জন।রাস্তা থেকে অনেক’টা দূরে ধানক্ষেতের মধ্যে গাড়িটা পুড়ে যাওয়া অবস্থায় পেয়েছি।আর ড্রাইভিং সিটে পুড়ে যাওয়া একটা লাশের অবতার পেয়েছি।আমরা সন্দেহ করছি ওটাই হয়তো সুজন।

এ যেন আরো এক ধাক্কা।প্রেমা,পাভেল,এবারে সুজন।ওকেও তো কম ভালোবাসতো না পরশ।ধীরে ধীরে পৃথিবীর প্রত্যেকের উপর থেকে যেন সমস্ত বিশ্বাস উঠে যাচ্ছে।কারো কথা বিশ্বাস হচ্ছে না।নিজের কঠিন চিত্তকে বজায় রেখে গম্ভীর কন্ঠে পরশ আবারো বললো-

ওটা যে আমার’ই গাড়ি ছিলো তার প্রমাণ কি?
এ যেন নানা অজুহাত দিয়ে নিজেকেই নিজে সান্ত্বনা দিচ্ছে পরশ।কিন্তু তাকে পুনরায় ব্যর্থ করে ইন্সপেক্টর বললেন-
গাড়ির নেইম-প্লেট পুড়ে যায় নি স্যার। গড়িটা আপনার’ই।

ধীরে ধীরে পাভেলের লাশ আরো পচতে শুরু করেছে।শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ছিন্নভিন্ন হওয়া লাশটা যে অন্য স্বাভাবিক মৃতদেহের মতো নয়।কাল সকালে প্রাণপাখি উড়ে যাওয়া মৃতদেহটা সারা দিন-রাত যে জঙ্গলের মধ্যে এক ছোট্ট ডোবার পাশে কচুরি দিয়ে ঢাকা ছিলো। আশে-পাশের লোকজন ধীরে ধীরে নাক চেপে ধরা শুরু করে দিয়েছে।সুমন চোখ মুছে পাভেলের কাছে এলো।

ভাই বলে ডাকতেই যেন তার উদ্দেশ্য বুজতে পারলো পরশ।আরেকবার ভাইয়ের লাশের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বললো-
গোসল করিয়ে রেডি কর।আমি আসার পর জানাজা হবে।

থমথমে পায়ে হেটে প্রেমার কেবিনে ঢুকলো।স্পর্শীও পেছনে ছুটে এসেছে।পরশের সাথে কেবিনে ঢুকতেই হাত ধরে টেনে দরজার বাইরে বের করে দিলো। মুখের উপর দরজা টা দিয়ে ধীর পায়ে স্ট্রেচারের পাশে দাড়ালো।এতোক্ষণ নিরব হয়ে ছাদে ঝোলানো আংটার দিকে তাকিয়ে ছিলো প্রেমা।পরশকে ঢুকতে দেখেই চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর ভান ধরে থাকলো।যেন ভাই-বাবা-মা কারো সামনে চোখে চোখ রেখে কথা বলতে সে চায়না।ভীষন লজ্জা,কষ্ট,অসস্তি,নিজের শরীর টার প্রতি ঘৃনা আকড়ে ধরে তাকে।

পরশ সবটাই বুঝতে পারলো।বোনের দুহাত ধরে একটানে বসালো।আচমকা এমন আক্রমণে ভয় পেয়ে গেল প্রেমা।দুরুদুরু বুকে চোখ খুলে ভাইয়ের দিকে এক পলক তাকিয়েই চোখ নিচে নামিয়ে ফেললো।এতোক্ষণের চাপানো কান্নাটা যে ধীরে ধীরে চোখ দিয়ে অশ্রু রুপে বের হয়ে যাচ্ছে।
–কারা ছিলো?

গম্ভীর কন্ঠে এমন কথা শুনে কেপে উঠলো প্রেমা।ঝরঝর করে কান্না করে দিয়ে বললো-
আমি ঘুমাবো এখন।তুমি যাও এখান থেকে।কিচ্ছু জানি না আমি।
মুহুতেই দুগাল চেপে ধরলো পরশ।প্রেমা যন্ত্রনায় আতকে উঠলো।ভয়ে শিউরে উঠলো লুকিয়ে জানলার বাইরে থাকা স্পর্শী।দুহাত দিয়ে মুখ চেপে ধরে কান্নাটা আটকালো।দাতে দাত চেপে পরশ বললো-

তোমাকে এখানে পাভেল নিয়ে এসেছে।ও জানতো কারা ছিলো? কি হলো বলো?
পরশের এক ধমকে শিউরে উঠলো প্রেমা।হেচকি তুলে কান্না করতে করতে বললো-
হ্যা,ভা…ইয়া জা….ন….তো।

পরশ গাল ছেড়ে দিয়ে পাশে বসল।আলতো হাতে বোনটাকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরলো।শান্ত কন্ঠে বললো-
কিন্তু এখন তুমি ছাড়া আর কেউ জানে না।পাভেল নেই। ওকে মার্ডার করেছে ওরা।বাইরে হস্পিটালের সামনে ওর ছিন্নভিন্ন লাশ পড়ে আছে।তোমার জন্যই হয়তো পাভেল ওদের কাছে গেছিলো।এখন ওকেও খুন করে ফেলেছে।ওর একটা হাত একদম কেটে ফেলেছে।গলার এখানটাতেও কোপ মেরেছে।দেখবে তুমি লাশ।চলো,দেখবে।

উত্তেজিত হয়ে হেচকির সাথে বারবার আতকে উঠে মাথা নাড়তে লাগলো।সে যাবে না।ওমন ভয়ংকর দৃশ্য সে দেখতে পারবে না।দুহাত দিয়ে কান চেপে চিৎকার করে চেচাতে লাগলো।পরশ খানিকটা ক্ষান্ত হলো।বোনের দুগাল ধরে ভাঙা ভাঙা কন্ঠে বললো-

কারা ছিলো সোনা?ভাইয়াকে বলো।
–সু..জ…ন ভাই।সুজন ভাই ছিলো।ভাবির ভাইয়েরা ছিলো।আর আর ওই কালো করে ছেলেটা ছিলো যে ইলেকশনের সময় কোপাকুপি করে জেলে গেছিলো।
–আরিফ

প্রেমা দ্রুত মাথা নাড়ালো।যেন তার কথা বলতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছিলো।
স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো পরশ।যেন নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছে না।সুজন কিভাবে?যেন বোনের কোথাও ভুল হচ্ছে।তড়িৎ গতিতে বোনের দিকে তাকিয়ে ভাঙা কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো –
সুজন ও ছিলো?

প্রেমার দম বন্ধ হয়ে আসছে কথা গুলো বলতে।মাথা নাড়িয়ে বললো-
সুজন ভাই তোমাকে মারতে চেয়েছিলো ভাইয়া।ও ওওই সোভাম সরদারের হয়ে কাজ করছিলো। আমি ফোনে শুনেছি।আর ওও আমায় দেখে ফেলেছিলো।তাই তুলে নিয়ে গেছিলো ওদের ওই ক্লাবে।

চাদর জড়িয়ে কেদে উঠলো প্রেমা।পরশ নির্বিকার ভাবে বোনের দিকে তাকিয়ে রইলো।ক্ষানিকক্ষণ পরেউ ত্রস্ত পায়ে কেবিনের বাইরে চলে এলো।জানলার কাছে স্পর্শীকে দেখে ক্ষোভ জমানো চোখে তাকালো।সেই চোখে কোনো রকম মায়া দেখতে পেলো না স্পর্শী।পেলো শুধু মাত্র কিছু অসহায়তা,ভুল।তাহলে কি পরশ ও ভাবছে স্পর্শীর সাথে জড়ানো তার ভুল ছিলো। দুহাত দিয়ে মুখ চেপে ধরে কেদে উঠলো স্পর্শী।পরশ নির্বিকার ভঙ্গিতে পাশ কাটিয়ে চলে গেল।

পরশ যেতেই দ্রুত পায়ে কেবিনে ঢুকলো স্পর্শী।প্রেমা একা একা চিৎকার করে কাদছে।দ্রুত তার পাশে বসে দুহাত দিয়ে আগলে বুকে জড়িয়ে ধরলো।প্রেমার কান্নার বেগ কমতেই স্পর্শী বললো-
তুমি যখন শুনেছিলে সুজন ভাই খারাপ লোক,তোমার ভাইকে মারতে চাইছে তখন কেন পালালে না?ছুটে তোমার ম্যামের বাড়িতে ঢুকতে।তারপর বাড়িতে ফোন করতে।
কান্নাজড়ানো কন্ঠে প্রেমা বললো-

আমি বুজতে পারি নি সুজন ভাই এতো খারাপ। উনি যে আমার কোনো ক্ষতি করবে তা ভাবতেই পারি নি।ভেবেছিলাম,আমি ওনাকে ভাইয়ার ভয় দেখালে ভয় পেয়ে যাবে।আর ও দলের সাথে মিশবে না। আমি তো ভেবেছি উনি ক্ষমা চাইলে আর ভাইয়াকে কিচ্ছু বলবো না।কিন্তু উনি……

রাজনীতির রংমহল পর্ব ২৮

ঢুকরে কেদে উঠলো প্রেমা।মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে স্পর্শী বললো-
এটা সিনেমা নয় প্রেমা।আমি জানি সুজন ভাইয়ের প্রতি তুমি দুর্বল ছিলে।সেই বিয়ের অনুষ্ঠান থেকেই তোমার গতিবিধি আমি দেখেছি।কিন্তু তোমার এই দুর্বলতাই আজ এমন ঘটনার সৃষ্টি করলো।একটু যদি সাবধান হতে।
নিরব হয়ে স্পর্শীর বুকে লেপ্টে থেকে আফসোস করতে লাগলো প্রেমা।

রাজনীতির রংমহল পর্ব ৩০