রাজনীতির রংমহল পর্ব ৪০

রাজনীতির রংমহল পর্ব ৪০
সিমরান মিমি

ডুবন্ত বাস।চারদিকে মানুষের এলোমেলো পদচারণা।পরশ দ্রুতবেগে পাশের জানালার কাচ ভাঙলো।বেরিয়ে যেতেই স্পর্শীর কথা মনে হলো।পুনরায় বাসের ভেতর স্পর্শীকে খুজতে লাগলো।এক সময় মনে হলো সে ডুবন্ত বাসের মধ্যেও শ্বাস নিতে পারছে।পাত্তা দিলো না।চারদিকে স্পর্শীকে খুজতে লাগলো।হঠাৎ ‘ই কানে বাজলো প্রাণখোলা হাসির শব্দ।এই হাসির রিনিঝিনি সুর বাসের বাইরে থেকে আসছে।দ্রুত বাসের দরজা দিয়ে বাইরে বের হতেই দেখলো স্পর্শী রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে পরশের দিকে তাকিয়ে হাসছে।

অবাক হয়ে গেল পরশ।সেই সাথে যেন প্রাণ ফিরে পেল। দ্রুত ছুটে গিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো নিজের বুকের সাথে।এরইমধ্যে মাতাল করা কন্ঠের আওয়াজ কানে এলো।
-নেতামশাই,কি করছেন?আরে বাবা চ্যাপ্টা হয়ে যাবো তো।এতো জোরে কি কেউ জড়িয়ে ধরে।ছাড়ুন।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

ঘুম ঘুম কন্ঠে জড়িয়ে যাওয়া গলায় স্পর্শী বললো।ধড়াস করে চোখ খুলে সামনে তাকালো পরশ।স্পর্শী তার বুকের ওপর এখনো শুয়ে হাসছে।দ্রুত তাকে ছেড়ে দিয়ে ধড়ফড় করে বসলো।আশে পাশে বারকয়েক তাকিয়ে জায়গাটা দেখে নিলো।এখানে না আছে কোনো বাস, আর নাতো রাস্তা।তাহলে কি সে এতোক্ষণ ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছিলো?
দুহাত দিয়ে মাথা চেপে ধরলো।হার্টবিট এখনো অস্বাভাবিক ভাবে চলছে।যতই দৃশ্যগুলো স্বপ্ন হোক, কিন্তু পরশ সেটাকে একদম মানতে পারছে না।পুনরায় দুহাত দিয়ে স্পর্শীকে জড়িয়ে ধরলো।দ্রুত শ্বাস নিয়ে বললো-

আমরা লঞ্চে যাব,ওকে পাখি।একদম বাসের কথা মনেই আনবে না।
স্পর্শী থমকালো।পরশকে এতোটা উত্তেজিত দেখে আগেই বুঝেছিলো সে কোনো খারাপ স্বপ্নে দেখেছে।কোনো রুপ বাকবিতন্ডায় না জড়িয়েই মাথা নাড়িয়ে হ্যা বললো।

বিকাল সাড়ে তিনটা।ঘুম থেকে উঠেই দুজন মিলে বিরিয়ানি খেয়ে নিয়েছে।এরপর প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ব্যাগে গুছিয়ে পা ফেললো পিরোজপুরের উদ্দেশ্যে। বাসে করে সদরঘাট আসতেই স্পর্শী আবারো দুটো বিরিয়ানির প্যাকেট নিলো।ধীর পায়ে এগিয়ে আসলো লঞ্চের কাছে।

বিকেল সাড়ে চারটা।ইতোমধ্যে লঞ্চ চলতে শুরু করেছে।কেবিনের মধ্যে শুয়ে আছে পরশ।ধীর পায়ে তাকে পাশ কাটিয়ে স্পর্শী চলে এলো কেবিনের বাইরে।সামনের ঢালু জায়গাটায় শত শত লোক কাথা বিছিয়ে বসে আছে।তাদেরকে পাশ কাটিয়ে চলে এলো লঞ্চের কার্ণিশে।দমকা বাতাসে গায়ের জামাকাপড় গুলো এদিক-সেদিক উড়ছে।আশে-পাশে ছোট ছোট নৌকাগুলোকে বেশ দারুন লাগছে দেখতে।এই ঠান্ডা বাতাসের সাথে প্রাণ খোলা দম নিয়ে আলতো হেসে উঠলো স্পর্শী।বহুদিন পর সে এমন প্রাণ খোলা হাসি হেসেছে।

হঠাৎ করেই পেছন থেকে কেউ একজন আলতো ভাবে জড়িয়ে ধরলো তাকে।স্পর্শী পিছু ফিরলো না।এই পুরুষালি গন্ধ টা তার বহু বছরের চেনা।এত দুরত্ব থাকার পরেও রাত হলে তার ব্যাবহার করা ঘামে জর্জরিত শার্ট টা বুকে নিয়ে শুয়েছে স্পর্শী।প্রতিটা ক্ষণ,প্রতিটা মুহুর্ত এই শ্যামপুরুষের অস্তিত্ব কে নিজের সাথে পরিচিত করেছে।সে কি করে ভুলবে এই গন্ধ?
পরশ আলতো হাসলো।মাথা নিচু করে সবার চোখের আড়ালে ঠোট ছুইয়ে দিলো স্পর্শীর কাধে।হিমশীতল বাতাসের ঝটকার মধ্যে এই চুমুটা স্পর্শীকে বরফশীতল করে দিলো।কেপে উঠলো সে।কিছুক্ষণ ওভাবেই জমে রইলো।বেশ কিছু মুহুর্ত পার হবার পর মুখ খুলে বললো-

নেতামশাই?
পরশ আধো কন্ঠে বললো-
হু,
-চলুন না ছাদে যাই।

দুজনের মধ্যেই কিছুক্ষণ নিরবতা কাজ করলো।শেষে পরশ বললো-
ভয় পাবে না তো?ছাদে অনেক বাতাস।
আলতো হাসলো স্পর্শী।লোমশ হাতটা দুহাত দিয়ে ধরে নিজের সামনে নিলো।পাতলা ঠোট দুটো আলতো ছুইয়ে বললো-
আপনি আছেন তো।

চারতলা লঞ্চ।চারদিকে শত শত যানবাহন চলছে।দূরত্বের সেই জলজ বাহন গুলোকে নৌকাসমতুল্য লাগছে স্পর্শীর কাছে।আচমকা হাতের ফোনটা সামনের একটা কিশোর ছেলেকে দিয়ে বললো –
একটা ছবি তোলো তো ভাইয়া।
ছেলেটা মুচকি হেসে ফোন নিলো।স্পর্শী পুনরায় লঞ্চের কার্ণিশে চলে এলো।পরশের হাতটাকে দুহাত দিয়ে পেচিয়ে বললো-
আজকের এই মুহুর্তে আপনি আমার জ্যাক হয়ে যান।আর আমি হই রোজ।চলুন না নেতামশাই এই ক্ষুদে লঞ্চ টাকে টাইটানিক বানিয়ে দিই।

তারপর কোনো কিছু না বলেই নিজের হাত দুটোকে দুদিকে মেলে দিলো স্পর্শী।পরশ আলতো হাসলো।আশে-পাশে প্রচুর জোয়ান ছেলে।অন্যসময় বাধ সাধলেও আজকে নিশ্চুপ রইলো।প্রিয়তমার এই হাসি হাসি মুখটাকে কিছুতেই বিলীন হতে দিতে চাইলো না।অধর মেলে নিজেও দুহাত ছড়িয়ে দিলো দুদিকে।সাথে সাথেই ফোনের স্ক্রিনে কয়েকবার ক্লিক পড়লো।

ভোর চারটা।এখনো ফজরের আযান দেওয়া হয় নি।লঞ্চ থেকে নিজের চিরপরিচিত এলাকার মাটিতে পা রাখতেই ঝিম মেরে দাঁড়িয়ে পড়লো পরশ।বহুবছর পর আজ সে তার পরিচিত এলাকায়।দুহাতে ব্যাগ নিয়ে স্পর্শীকে সামনে হেটে এলো বাজারের মধ্যে।এখনো চারদিকে অনেক অন্ধকার।এই সময়ে গাড়ি পাওয়া যাবে না বুঝেই দুজন মিলে পা বাড়ালো শিকদার মঞ্জিলের দিকে।টানা পনেরো মিনিট হাটার পরে নিজের পরিচিত বাড়িটার সামনে পৌছালো পরশ।মুহুর্তে ‘ই চোখ পড়লো গেটের বাম পাশের পারিবারিক গোরস্থানের দিকে।বুকটা খা খা করে উঠলো।

ইচ্ছে করলো ছুটে ওদিকটায় যেতে।এরইমধ্যে স্পর্শীর ক্লান্ত ঘুম-ঘুম চাহনি টা নজরে এলো।গেটের ভেতর থেকে তালা মারা।এদিকে ফোনের৷ চার্জ ও শেষ। আজ এতোদিন পর নেতামশাইকে কাছে পাবে, এই উত্তেজনায় ফোনে চার্জ দেওয়ার কথাই ভুলে গিয়েছিলো স্পর্শী।কিন্তু হার মানলো না।নিজের সেই পরিচিত ত্যাড়া প্রকৃতিতে মুহুর্তেই ফিরে এলো।হাতের যাবতীয় জিনিস পত্র নিচে রেখে পরশের দিকে তাকিয়ে দাত কেলিয়ে হাসলো।

তারপর চারদিকে তাকিয়ে একটা ইটের অর্ধ টুকরো হাতে নিলো।লোহার রডের ভেতর হাত গলিয়ে গায়ের সমস্ত জোড় দিয়ে চারবার বাড়ি মারলো তালার উপরে।নিঝুম ভোরবেলায় শব্দগুলো যেন ভয়ংকর আওয়াজ তুললো।
পরশ উত্তেজিত হয়ে জিভ কেটে স্পর্শীকে বলল-
এই এই ছাড়ো।কি করছো এসব।স্পর্শীয়া ছাড়ো।

স্পর্শী শুনলো না।পুনরায় ভাঙা তালাটাকে খুলতে খুলতে দাত কেলিয়ে পরশকে বললো-
শ্বশুর বাড়িতে প্রথম বারের জন্য ডাকাতি করতে নেমেছি।তালা না ভাঙলে কি ডাকাত ডাকাত ফিলিংস আসবে নেতামশাই?
পরক্ষণেই হেসে বাচ্চামো কন্ঠে বললো-

রাজনীতির রংমহল পর্ব ৩৯

একটা জিনিস খেয়াল করেছেন নেতামশাই?আমরাই হলাম প্রথম ডাকাত।যারা ব্যাগপত্র সাথে নিয়ে ডাকাতি করতে নেমেছি।ব্যাপার’টা কি দারুন,তাই না?

রাজনীতির রংমহল পর্ব ৪০ শেষ অংশ