রাজনীতির রংমহল পর্ব ৪০ শেষ অংশ 

রাজনীতির রংমহল পর্ব ৪০ শেষ অংশ 
সিমরান মিমি

তালা খুলে জোড়ালো হাতে গেট খুললো স্পর্শী।মড়মড় শব্দে থমকালো ধরণী।যাবতীয় ব্যাগপত্র হাতে নিয়ে দুজন মিলে পা চালালো বাড়ির সদর দরজার সামনে।
ভোর প্রায় পাচটা।বাড়ির সদর দরজা ভেতর থেকে বন্ধ।ত্রস্ত হাতে তিনচার বার কলিং বেল বাজালো পরশ।ক্ষানিকক্ষণ অপেক্ষা করার পরেও ওপাশ থেকে দরজা খোলা হলো না।মেজাজ বিগড়ে গেল স্পর্শীর।এমনিতেই শরীর’টা ঘুমে ঢলে পড়ছে।পরশকে সামনে থেকে সরিয়ে একটানা বেল বাজাতেই লাগলো যতক্ষণ না দরজা খোলা হয়।

বেলের শব্দে অস্থির হয়ে কান চেপে ধরলো পিয়াশা।এইতো আরেকটু পরেই নামাজ পড়তে উঠবে।কিন্তু হঠাৎ এই অসময়ে গেট পেরিয়ে সদর দরজায় অসভ্যের মতো বেল বাজাচ্ছে কে?ভাবতেই দ্রুত স্বামীকে ঘুম থেকে তুললো।তখন ও বেল বাজাচ্ছে স্পর্শী।পরশের হাজারো বারণ সে কানে তুলছে না।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

জোড়পায়ে হেটে পিয়াশা আর মহীউদ্দীন শিকদার দরকার সামনে এলো।সামান্য ভীতি, এবং বিগড়ানো মেজাজ নিয়ে দরজা খুলতেই ওপাশ থেকে দৃশ্যমান হয় পরশের উজ্জ্বল মুখ।মুহুর্তে ‘ই আতকে ওঠে দুজনে।পিয়াশা ধীর পায়ে আরেকটু সামনে এলো।এ যেন স্বপ্নে দেখছে সে।দুহাত উচু করে আলতো করে ছুয়ে দিল পরশের চিবুক।মুহুর্তে’ই চোখ বন্ধ করে নিলো পরশ।

এতো স্বপ্ন নয়,সত্যি।স্বপ্ন হলে যে কখনোই ছোয়া যেত না।কিন্তু পরশ এখানে কি করে আসবে?মস্তিষ্কে এমন অজস্র চিন্তা-ভাবনা হানা দিচ্ছে পিয়াশার।দুর্বল চিত্তে এসব ভাবতেই ভাবতেই আচমকা ঢলে পড়লো পরশের বুকের উপর। সাথে সাথেই মা কে ধরে নিলো পরশ।

মহীউদ্দীন শিকদার ও যেন পূর্বের ন্যায় জমে গেছেন।সাময়িক ভাবে মস্তিষ্ক তার কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে।শুধুমাত্র ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে আছেন পরশের মুখের দিকে।
পরশ মাকে ধরে সোফায় শোয়ালো।এরইমধ্যে স্পর্শী পানি নিয়ে এসেছে।আঙুল ভিজিয়ে চোখের উপর ছেটা দিতেই চোখ খুললো পিয়াশা।সামনে পরশকে দেখেই হাউমাউ করে কেদে জড়িয়ে ধরলো।
পরশ চোখ বন্ধ করে মাকে সান্তনা দিতে লাগলো।বলল-

মা,আমি আসছি তো।এবার প্লিজ তোমরা কান্না থামাও।
থমকে গেল মহীউদ্দীন শিকদার। নিজেকে সামলে শান্ত কন্ঠে বলল-
কিন্তু তুমি ছাড়া পেলে কিভাবে?এখনো তো আট বছর বাকি সাজার।আর ছাড়াই যখন পাবি তখন গত শুক্রবার আমাকে বললি না কেন?

আলতো হাসলো পরশ।এতোক্ষণ স্পর্শী সোফার এক কোনায় দাঁড়িয়ে ছিলো।তাকে ইশারা করে বলল-
জানিনা,আমিও বুঝতে পারি নি কিছু।ও হঠাৎ কাল কে গিয়ে ছাড়িয়ে নিয়ে এলো।উকিল মানুষ, কখন কোন প্যাচ খাটিয়েছে কে জানে?ওর থেকে পরে জেনে নিও।আমার শরীর’টা ভীষণ ক্লান্ত লাগছে।একটু বিশ্রাম নেব।সকালে কথা হবে।
বলেই ব্যাগ হাতে দোতলায় চলে গেল পরশ।পিয়াশা ছলছল চোখে স্পর্শীর দিকে তাকালো।মুখ’টা বেশ শুকনো লাগছে।কোনো প্রশ্ন না করেই শান্ত কন্ঠে বললো-

তুমিও যাও। বিশ্রাম নাও।অনেক ক্লান্ত দেখাচ্ছে।
স্পর্শী হয়তো এই কথার’ই অপেক্ষা করছিলো। দ্রুত দোতলার দিকে ছুটলো।পিয়াশা টলমল চোখে সেদিকে তাকিয়ে মহীউদ্দীন কে বললো-
আমার কেন জানি সবকিছু স্বপ্নের মতো লাগছে।আল্লাহ,এই স্বপ্ন যেন কোনোদিন আর না ভাঙে।

সকাল সাড়ে আটটা।ঘুমে টলতে টলতে খাবার টেবিলে এসে বসতেই পুনরায় ছিটকে দূরে সরে৷ দাড়ালো প্রেমা।সামনেই বড় ভাই আর ভাবী বসে আছে।বারকয়েক চোখে ঝাপটা দিলো।এটা কি তার ঘুমের ঘোরের দোষ।ধুর!নিজেকে কেমন পাগল পাগল লাগছে।আজকাল নিজের লাগাম ছেড়ে বড্ড বাইরে উড়ছে সে।সারারাত না ঘুমানোর ফলস্বরূপ বারো বছরের সাজাপ্রাপ্ত বড় ভাইকে সামনে দেখছে।

চেয়ার টেনে পরশের দিকে আড়চোখে তাকাতে তাকাতে বসলো প্রেমা।পিয়াশা হেসে দিয়ে মেয়েকে বললো-
কি বিশ্বাস হচ্ছে না?আমার ও ভোর রাতে একদম বিশ্বাস হচ্ছিলো না।মন বলছিলো স্বপ্নে দেখছি।

প্রেমা অবাক চোখে মায়ের দিকে তাকালো।পুনরায় পরশের দিকে তাকাতেই দেখলো মুচকি হাসছে।নিজেকে বিশ্বাস হলো না প্রেমার।গত চার বছরে কুড়ে কুড়ে খাওয় সকল গ্লানি,ভাইয়ের প্রতি ভালোবাসা যেন উগড়ে পড়লো তৎক্ষনাৎ। অষ্টাদশী কন্যা নিজের আবেগের বহিপ্রকাশ হিসেবে চিৎকার করে কেদে উঠলো।ঝাপিয়ে পড়লো ভাইয়ের বুকের উপর।
এমন কান্ডে পুরাই হতবাক পরশ।তার সেই বুঝদার বোনটা এতটা আবেগপ্রবণ হয়ে গেছে ভাবতেই অবাক হয়ে গেল। আলতো হাতে বোনকে সামলে বললো-

এ বাবা,তুমি তো দেখছি কাদছে।আমি আসছি তাতে কষ্ট পেয়েছো বুঝি?
নাক টেনে বুক থেকে সরে বসলো প্রেমা।কান্নারত কন্ঠে বললো-
তুমি আমাকে রাগাতে চাইছো তো?কিন্তু আমি তো অবুঝ নই।একটুও রাগ করবো না।ভাইয়া,তুমি ফিরে কি-ভাবে এলে?
থেমে,

ভাবি, তুমি আমাকে এই সারপ্রাইজের কথাই বলেছিলে রেজাল্টের দিন।থ্যাংক ইউ সো মাচ ভাবি।
বলেই পুনরায় জড়িয়ে ধরলো স্পর্শীকে।স্পর্শী নাক ছেটালো।এই মুহুর্তে শশুর বাড়ির সবাইকে তার ছিচকাদুনে লাগছে। নিজের অভিব্যাক্তি কে বাইরে প্রকাশ না করে আলতো ভাবে প্রেমার পিঠে হাত বুলিয়ে দিলো।কিছু বলার প্রয়াস করতেই কর্কশ কন্ঠে ফোনের রিং বেজে উঠলো।

সবাইকে অবাক করে দ্রুত টেবিলের উপর থেকে ফোন ছিনিয়ে নিলো প্রেমা।স্ক্রিনে “প্রিতম” নামটা দেখতেই সবাইকে পুনরায় হতভম্ব করে ফোন নিয়ে দ্রুত রুমের দিকে ছুটলো।এমন কান্ডে ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল স্পর্শী।বিষয়টা মোটেও ঠিকঠাক লাগছে না তার কাছে।মুখের খাবার’টা গিলে শাশুড়ির উদ্দেশ্যে বললো-

এটা কি হলো? মা,কে ফোন দিয়েছে প্রেমাকে?ফোন পাওয়া মাত্রই এভাবে ছুটলো যে।
আলতো হাসলো পিয়াশা।গলা পরিস্কার করে পরশ আর স্পর্শীর উদ্দেশ্যে বললো-
প্রিতম ফোন দিয়েছে হয়তো।
ভ্রু কুচকে ফেলল পরশ।চিন্তিত কন্ঠে বললো-
এই প্রিতম টা কে?
মহীউদ্দীন শিকদার এবার গমগমে গলায় বললো-

আসলে ঘটনা টা হুট করেই ঘটে গেছে।তাই তোমাদের কিছু জানানো হয় নি।গত শুক্রবার তোমাকে দেখে আসার পরের দিনেই প্রিতম ওর বাবা -মা কে নিয়ে হাজির হয় আমাদের বাড়িতে।ছেলেটা পুলিশে চাকরি করে।প্রেমা কে পছন্দ করে অনেকদিন ধরে। না বললেও আমরা বুঝতে পেরেছি ওদের মধ্যে একটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে।সেটার রেশ ধরেই শনিবারে আংটি পরিয়ে গেছে ওরা।খুব শীঘ্রই বিয়েটা করাতে চায়।আমি তো এই সপ্তাহেই তোমাকে জানাতাম।
চিন্তার রেখা পড়লো পরশের কপালে।হুট করেই মুখের অবয়ব টা গাম্ভীর্যে পরিণত হলো।আপনা আপনি চোয়াল শক্ত হয়ে গেল।কন্ঠে কাঠিন্যতা এনে ধীর আওয়াজে বললো-

ওরা কি প্রেমার সম্পর্কে সবটা জানে?কিছু কি লুকিয়েছো তোমরা?
আতকে উঠলেন মহীউদ্দীন শিকদার। চার বছর আগের সেই বিভীষিকা ময় দিন গুলো চোখের সামনে ভেসে উঠলো।মুহুর্তে ‘ই শান্ত কন্ঠে বললো-

যা জানানোর সেটা প্রেমাই আগে জানিয়েছে।ওনারা সব টা জানে।এতে কোনো আপত্তি নেই।মেয়েকে পছন্দ করেছে ওরা।
বুকের উপর থেকে যেন শক্ত কোনো পাথর সমান ওজন সরে গেল পরশের।স্পর্শী ও যেন প্রাণ ফিরে পেল।তার পরিবারের জন্য মেয়েটার জীবন আজ এমন একটা প্রশ্নর সম্মুখে দাড়িয়েছে।একটা সুখের সংসার হোক তার,একটা ভালোবাসার মানুষ পাক সে,এটাই তো চেয়েছে স্পর্শী।চোখ দুটো ছলছল করে উঠলো।ইশশ!যদি পাভেল টা বেচে থাকতো তাহলে আজ প্রতিটা পদক্ষেপে স্পর্শীর এতটা নিচু হতে হতো না।

রাজনীতির রংমহল পর্ব ৪০

খাবার টেবিলে বসা চার জনের চোখেই ভেসে উঠলো চার বছর আগের মর্মান্তিক ঘটনা গুলো। শান্ত ভাবে কিছু না বলেই চেয়ার ছেড়ে উঠে গেলেন পিয়াশা,মহীঊদ্দীন।পরশ ও থমকে প্লেটের দিকে তাকিয়ে রইলো।স্পর্শী ঠোট কামড়ে ধরে কান্না আটকাতে চাইলো।কিন্তু পারলো না।ফুপিয়ে ওঠার শব্দ টা পেতেই আলতো হাতে জড়িয়ে ধরলো পরশ।পরিশ্রান্ত কন্ঠে বললো-
তোমার কোনো দোষ নেই স্পর্শীয়া।আমার ভাগ্য’টা ই এমন ছিলো হয়তো।প্লিজ কেদো না।

রাজনীতির রংমহল পর্ব ৪১