শহর জুড়ে সন্ধ্যা নামুক পর্ব ২৮

শহর জুড়ে সন্ধ্যা নামুক পর্ব ২৮
তাসনিম জাহান রিয়া

আমরা বোনের মৃত্যুর খবরটাও আমি জানতে পারলাম না। তার লাশটা নিজের চোখে দেখতে পারিনি। আমার বোনের মৃত্যুর কিছুদিন পরেই নানা মারা যান। এতো এতো শোক সহ্য করতে না পেরে আম্মু মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে আমার বোনের আর নানার কবরের পাশে বসে থাকতো সারাদিন। কেউ খাবার দিলে খেতো আর নাহলে না খেয়েই থাকতো। একদিন সকালে গ্রামবাসী আম্মুর দ্বিখন্ডিত লাশ পায়। উনারা ধারণা করে নেন যে আম্মু নিজে থেকেই ট্রেনের সামনে ঝাঁপ দেয় আত্মহত্যা করার জন্য।

মেঘলা মিহানের কাঁধে হাত রাখে। মিহান চোখের অশ্রুটুকু মুছে নেয়। মিহান আলতো হেসে বলে,
আমার আম্মুটা সারাজীবনের অভাগী। বেঁচে থাকতো তো শান্তি পেলোই না মারা যাওয়ার পরও শান্তি পেলো না। না পেলো জানাজা, না পেলো গোসল। সন্তানের হাতের দু মুঠো মাটিও কপালে জুটলো না।
মিহান নিজেকে সামলাও।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

সারাজীবন তো নিজেকে সামলেই আসলাম। এতোগুলো ধাক্কা খাওয়ার পরও নিজেকে সামলে নিয়েছি। আর কতো নিজেকে সামলাবো? আমি ভিতর থেকে একদম শেষ হয়ে গেছি। নিজের বোন, নানা, মা কারো মৃত্যুর খবর আমি পাইনি। তাদের শেষ দেখাটাও আমি দেখতে পাইনি। আল্লাহ্ কেনো সব কষ্ট আমার কপালেই লিখে রেখেছেন বলতে পারেন আপনি? আমার সাথে আপনার জীবন জড়ানো উচিত না। আপনি একদম আমাকে বিয়ে করবেন না।
আমার বিষাক্ত জীবনের সাথে আপনার জীবন জুড়ে গেলে আপনার জীবনও বিষাক্ত হয়ে যাবে।

মিহান আর এক মুহূর্তও দাঁড়ায় না। দ্রুত পায়ে বেরিয়ে যায়। হাসিখুশি মানুষের ভিতরের মনে হয় সব থেকে বেশি কষ্ট লুকিয়ে থাকে। তারা সবাইকে হাসায়। কিন্তু তাদের হাসানোর মতো কেউ থাকে না।
তন্ময় মুহিবের কানের কাছে ফিসফিস করে বলে। তন্ময় কখনো ফিসফিস করে কথা বলতে পারে না। সে ভাবে সে ফিসফিস করে কথা বলছে কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সে কথাটা স্বাভাবিকভাবেই বলে।

এই মুহিব এতক্ষণ ধরে ভিতরে কী করছে মিহান? বিয়ের আগেই বাসর সেরে ফেলছে নাকি?
এখন মাইর খাবি তন্ময়। ভিতরে যে আছে সে আমার বড় বোন।
তোর বড় বোন। কিন্তু আমাদের বন্ধু আর ভাবি ভিতরে একটু ফাজলামো করবো না।
শ্রেয়সী বন্ধ দরজার দিকে তাকিয়ে বলে,

সবার একটা লুকানো অতীত থাকে। মনের কোণে একটা গোপন ব্যথা থাকে। যার খবর কেউ রাখে না।
তাদের কথার মাঝেই দরজা খোলার শব্দ হয়। দরজা খুলে বের হয়ে আসে মিহান। সবার দৃষ্টি এখন মিহানের দিকে। মিহানের চোখ-মুখ অস্বাভাবিক লাগছে। তাই কেউ কিছু জিজ্ঞেস করার সাহস পাচ্ছে না।
মিহান বের হওয়ার কিয়ৎক্ষণ পরেই বেরিয়ে আসে মেঘলা। সবাই উৎসুক হয়ে তাকিয়ে আছে মেঘলার দিকে। সবাই মেঘলার মতামত শোনার জন্য অপেক্ষা করছে। মেঘলা সবার দিকে একবার দৃষ্টি বুলিয়ে নেয়। অতঃপর খুব মৃদু স্বরে বলে,

আমি এই বিয়েতে রাজি।
সবাই কিছুক্ষণ থম মেরে বসে থাকে। পরমুহূর্তেই চিৎকার করে ওঠে। মিহান এখনো স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার বিশ্বাস হচ্ছে না। এদের চিৎকারে অনুপম কান চেপে ধরে। তন্ময় লাফিয়ে গিয়ে মিহানকে জড়িয়ে ধরে।
মামা কী জাদু করলা ভিতরে বইসা? কইন্যা এতো তাড়াতাড়ি রাজি হয়ে গেলো? আমারেও একটু কও। আমি অনন্যার বাপের ওপর জাদু করমু। যাতে এমন ঠাস করে বিয়ে দিতে রাজি হয়ে যায়।

মিহান না চাইতেও হেসে ফেলে। হুট করেই যেনো দুঃখ ভাবটা উড়ে গেলো। বন্ধুরা পাশে থাকলে আর কী লাগে? এরা কখনো মন খারাপ হতে দেয় না। মিহানের মনে হচ্ছে অদ্ভুতভাবে আজকে যেনো তার কাজটাই তন্ময় করছে। হাজেরা খাতুন মৃদু স্বরে বলে,
মিহান তোমার আর মেঘলার বিয়াটা আমি খুব তাত্তাড়ি দিবার চাই। নাহলে আমার মাইয়াডারে শকুনের নজর থেইক্কা বাঁচানো যাইবো না।

আপনি একদম টেনশন করবেন না। এক সপ্তাহের মাঝে আমি উনাকে বিয়ে করবো। আজকে যাব এক সপ্তাহের মাঝে সব গুছিয়ে আপনার মেয়েকে আমার করে নিয়ে যাব।
শ্রেয়সী উৎসাহ নিয়ে বলে,
এই আনন্দে আজকে তাহলে পিকনিক হয়ে যাক। শহরে পিকনিক তেমন ভালো লাগে না। গ্রামের মনোরম পরিবেশে পিকনিক করার মজায় আলাদা। কলাপাতায় খাব। উফ।
শ্রেয়সীর কথায় সবাই হইহই করে ওঠে।
আমাকে এবার যেতে হবে।

আপনি কোথায় যাবেন? এখন কোথাও যাওয়া হবে না। আপনি আমাদের সাথে পিকনিক এটেন্ড করবেন।
শ্রেয়সী ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড। আমার কাজ আছে। তোমাদের বন্ধুদের মাঝে আমি থেকে কী করবো? তোমরা বন্ধুরা বন্ধুরা আনন্দ করো। আমি থাকলে মন খুলে আনন্দ করতে পারবে না। স্ল্যাং ইউস করতে পারবে না।
শেষ কথাটা অনুপম যে একটু খোঁচা দিয়ে বলেছে সেটা কারো বুঝতে বাকি নেই। অনুপম সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে যায়। নিতু বাড়ির পাশের আম গাছটা দেখে বলে,

এই পিকনিক পড়ে করা যাবে। আগে চল আমরা আম ভর্তা খাই। আগে যখন গ্রামে থাকতাম তখন সবাই মিলে করতাম। উফ দারুণ খেতে ছিল।
আম্মা তুমি পেয়াজ, কাঁচা মরিচ আর লবণ নিয়ে আসো। আমি আম পেড়ে নিয়ে আসছি।
মুহিব যেতে নিলে ইভা থামিয়ে দেয়।

আমি শুনেছি চুরি করা আম দিয়ে ভর্তা খেলে নাকি আরো মজা লাগে।
মুহিব চোখ বড় বড় করে ইভার দিকে তাকায়। চমকায় না। কারণ সে জানে তার বন্ধুদের দ্বারা কোনো কিছুই অসম্ভব না। মুহিব অবাক হয়ে বলে,
তুই এখন আম চুরি করে খাবি?
অবশ্যই।

ইভার কথায় সবাই সায় জানায়। অগত্যা মুহিব বাধ্য হয়ে নিয়ে যায় তাদের আম চুরি করার জন্য। মুহিবদের বাড়ির পিছনে একটা পুকুর আছে। এই পুকুরের পর দুইটা ফসলের জমি আছে। তারপর চারদিকে টিন দিয়ে আবৃত করা একটা বাড়ি। টিনের বেড়ার ওপর দিয়ে কিছু আম ঝুলে আছে। মুহিব ওদের ওখানেই নিয়ে যায় আম চুরি করার জন্য।
আম কীভাবে চুরি করবো?
প্রিয়ন্তির কথার প্রতিত্তরে মিহান বলে,

মুহিব তুই তো গাছে ওঠতে পারিস। তাহলে তুই গাছে ওঠে পড়।
বাল মেজাজ খারাপ করবি না। আমাকে বাগের মুখে ঠেলে দিচ্ছিস। গাছে ওঠতে গেলে বাড়ির ভিতর ঢুকতে হবে। বাড়ির ভিতর ঢুকলে আমার পা ভেঙে গলায় ঝুলিয়ে দিবে।
শ্রেয়সী মুহিবের কাধে হাত রেখে বলে,

আমরা থাকতে এতো চাপ নেস কেনো? তুই আমাদের বন্ধু তোকে আমরা বিপদে ফেলতে পারি বল? তোর জন্য কাজটা সহজ করে দিচ্ছি। তুই ইভাকে উঁচু করে ধর। ইভাই আম গাছ থেকে পাড়তে পারবে।
ইভা, মুহিব দুজন শ্রেয়সীর দিকে চোখ বড় বড় করে তাকায়।
আমি? ইভাকে?

কেনো সমস্যা কোথায়? আমরা বন্ধু না?
নিতুর কথায় মিহান কিছু একটা ভাবে। মুহিবের কানে ফিসফিস করে কিছু একটা বলে। মুহিব আশেপাশে তাকিয়ে ইভার কোমড় আঁকড়ে ধরে উপরে তুলে। আম চুরি করার পর তারা পেঁয়াজ পাতা, ধনিয়া পাতা আর কাঁচামরিচ ক্ষেত থেকে চুরি করে। তন্ময় গলার স্বর উঁচু করে বলে,
আন্টি একটু লবণ নিয়ে আসেন।

কেনো? ঘর থেকে লবণ নিবি কেনো? এটাও চুরি কর। চুরি করা লবণ দিয়ে আম ভর্তা করলে আরো মজা লাগবে।
মুহিবের কথা বলতে দেরি কিন্তু প্রিয়ন্তির খুশিতে গদগদ হয়ে কথা বলতে দেরি হলো না।
গুড আইডিয়া। চল লবণ চুরি করে নিয়ে আসি। আজকে চুরি করতে আমার সেই লেগেছে।
যা চুরি করতে যা। চুল ছিঁড়ে রেখে দিবে। পরে এই টাকলা মেয়েকে আর নাহিন ভাইয়া বিয়ে করবেন না।

শহর জুড়ে সন্ধ্যা নামুক পর্ব ২৭

প্রিয়ন্তি আড়চোখে শ্রেয়সীর দিকে তাকায়। শ্রেয়সীর এদিকে কোনো খেয়াল নেই। সে নিতুর সাথে আম কাটতে ব্যাস্ত। পাড়ার কিছু মহিলা এসেছিল মেঘলাকে দেখতে মুহিবদের বাসায়। মুখে বলেছে এটা কিন্তু তাদের উদ্দেশ্য ছিল মেঘলাকে কিছু কথা শোনানোর। কিন্তু মিহানদের জন্য সুবিধা করতে পারেনি।

শহর জুড়ে সন্ধ্যা নামুক পর্ব ২৯