শহর জুড়ে সন্ধ্যা নামুক পর্ব ২৭

শহর জুড়ে সন্ধ্যা নামুক পর্ব ২৭
তাসনিম জাহান রিয়া

আগে যখন তোমাকে প্রশ্রয় দেয়নি তাহলে এখন দিব? তোমরা বোকা বোকা ভাবনাই আমার হাসি পাচ্ছে। এই ঘটনার আগে যদি আমাদের বিয়ের কথা হতো। তাহলেও হয়তো তোমার পরিবার মেনে নিতো বা মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতো। এখন বিষয়টা তারা কখনোই মানবে না। এই বিয়ের ব্যাপারে আলোচনা করে আমাকে প্লিজ হাসির খোড়াক বানিয়ো না। আমার সম্মান বলতে তো আর কিছু রইলো না। যতটুকু আত্নসম্মান আছে তা নিয়ে বাঁচতে দাও। এইটুকু আত্নসম্মান না থাকলে আমার আর বাঁচার ইচ্ছে থাকবে না।

আমার নিজের কোনো পরিবার নেই। আমার বাবা থেকেও নেই। কারণ আমি উনাকে বাবা বলে মানি না। উনি মাত্র আমার নাম মাত্র বাবা। মিস্টার জামান শেখের কোনো ভ্যালু আমার লাইফে নাই।
বাবা তো বাবাই হয়। বাবা আবার নাম মাত্র কীভাবে হয়?

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

আপনাদের কাছে বাবা মানে সুপারম্যান। যাকে আপনারা চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করতে পারেন। আপনাদের কাছে বাবা মানে ভরসার হাত, রক্ষাকর্তা। বাবা সাথে আছে মানে কোনো বিপদ নেই। বাবা মানেই ভালোবাসা। আমার কাছে বাবা মানেই ঘৃণা। উনাকে বাবা হিসেবে তো দূরে থাক একজন মানুষ হিসেবেও বিশ্বাস করি না। আমার কাছে সব থেকে ঘৃণিত লোক তিনি। বাবারা নাকি সন্তানের সুখের জন্য সব করতে পারে আর উনি আমার সব সুখ-শান্তি কেড়ে নিয়েছেন।
বাবারা এমন হয় নাকি? বাবার সাথে রাগ করে আছো বলো এভাবে বলছো।

রাগ থেকে বলছি না। ঘৃণা থেকে বলছি। আমি উনাকে ঘৃণা করি। আমার জীবনের গল্প শুনবেন?
মেঘলার দৃষ্টি শীতল। মিহান মেঘলার মৌনতাকেই সম্মতির লক্ষণ ধরে নেয়।
উহু গল্পটা আমার না আমার মায়ের। আমার মায়ের ক্ষুদ্র জীবনের গল্প। বিশ বছর বয়সেই যার জীবনের সমাপ্তি ঘটেছিল। যাকে শেষ করে দিয়েছিলেন আমার জন্মদাতা পিতা।

তোমার মা তো বেঁচে আছেন। মিসেস শায়লা শেখ তোমার মা না?
না। উনি আমার মা না। উনি আমার মায়ের খুনি। উনি আমার মায়ের জীবনটা শেষ করে দিয়েছেন। আমার বোনটাকে মেরে ফেলেছেন।
মিহান তুমি একটু স্পষ্ট করে বলবে।

মিসেস শায়লা শেখ মিস্টার জামান শেখের প্রথম স্ত্রী আর আম্মু উনার দ্বিতীয় স্ত্রী। মিসেস শায়লা শেখ আর মিস্টার জামান শেখের বিয়ের পর উনারা দুজন বহু বছর নিঃসন্তান ছিলেন। ডক্টর দেখানোর পর জানতে পারেন সমস্যাটা মিসেস শায়লা শেখের। মিস্টার জামান শেখ একটা সন্তানের জন্য মরিয়া হয়ে ওঠেন। তখন মিসেস শায়লা শেখ মিস্টার জামান শেখকে দ্বিতীয় বিয়ের অনুমতি দেন।

তবে শর্ত দেন যে মেয়েকে বিয়ে করবেন সেই মেয়ের বাচ্চা নিয়ে এসে উনার হাতে তুলে দিতে হবে। মিসেস শায়লা শেখ নিজেই মেয়ে দেখা শুরু করেন। এর মাঝে জামান শেখ আমার আম্মুর গ্রামে যান। জামান শেখের গ্রামে যাওয়াই আমার আম্মুর জন্য কাল হয়েছিল। দুই বেণী করা এক স্কুল পড়ুয়া কিশোরীর প্রেমে পড়ে যান জামান শেখ।

আমার আম্মুকে দেখার পর থেকেই উনি আম্মুকে বিয়ে করার জন্য পাগল হয়ে যান। নানার কাছে প্রস্তাব পাঠান। নানা তৎক্ষণাৎ নাকোচ করে দেন। নানার ইচ্ছে ছিল আম্মুকে অনেক পড়াশোনা করানোর। আম্মু ছিল স্কুলের বেস্ট স্টুডেন্ট। আমার আম্মুর চোখ জুড়ে ছিল ডক্টর হওয়ার স্বপ্ন। নানার রিজেকশন উনার ইগোতে লাগে। আরো বেশি মরিয়া হয়ে ওঠেন আম্মুকে বিয়ে করার যান। বিভিন্ন কলা কৌশল করে আম্মুকে বিয়ে করে ফেলেন।

মেঘলা কৌতূহলী হয়ে প্রশ্ন করে,
আন্টিকে কীভাবে বিয়ে করেছিলেন? তোমার নানা তো রাজি ছিলেন না।
এতো কৌতুহল ভালো না। বিয়ে কীভাবে হলো সেটা নাই বা জানলেন। আমার বলতে রুচিতে বাধছে।
মিহান মেঘলার পাশ থেকে উঠে দাঁড়ায়। স্লান পায়ে হেঁটে জানলার কাছে দাঁড়ায়। জানালার পাশের আম গাছটার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে। মেঘলা অস্থির হয়ে বলে,

তারপর কী হলো?
তারপর? তারপর আমার আম্মুর জীবনটা শেষ হয়ে গেলো। আমার আম্মুর স্বপ্নগুলো গলা টিপে হত্যা করে ফেললো জামান শেখ। আমার আম্মুকে ভিতর থেকে শেষ করে দিল। জামান শেখের সাথে আম্মুর বিয়ে হলেও উনি কোনোদিন আম্মুকে উনার বাসায় নিয়ে যাননি। সমাজের কারো কাছে আমার আম্মুকে স্ত্রী বলে পরিচয়ও দেননি। আম্মু থাকতো নানার কাছে। নানার আর কোনো সন্তান ছিল না। আমার একটা মামা ছিল। মামা আর নানু এক্সিডেন্টে মারা যান।

তারপর থেকেই নানা আর আম্মু একা থাকতেন। জামান শেখ আম্মুর পড়াশোনাটা বন্ধ করে দেন। সপ্তাহে একবার গ্রামে যেতেন জামান শেখ। বিয়ের এক বছর পর আমি হই। তখন আম্মুর বয়স ষোল। আমার একটা বছর কাটে ঐ গ্রামে। এক বছর পর আম্মু যখন দ্বিতীয় বারের মতো অন্তঃসত্ত্বা তখন আম্মু জানতে পারেন উনি জামান শেখের দ্বিতীয় স্ত্রী। আম্মু অনেক ভেঙে পড়েছিলেন। এর মাঝে অমানুষের মতো জামান শেখ আম্মুর কাছ থেকে আমাকে কেড়ে নিয়ে আসেন।

আমাকে এনে তুলে দেন মিসেস শায়লা শেখের কাছে। উনি আমাকে অনেক আদর যত্ন করতেন। নিজের সন্তানের মতো বড় করতে লাগলেন। কিন্তু উনাকে আমি কখনোই মা হিসেবে মেনে নিতে পারিনি। এতো এতো অন্যায়ের মাঝে জামান শেখ একটা ভালো কাজ করেছিলেন। আমাকে মাঝে মাঝে আম্মুর কাছে নিয়ে যেতেন। তবে সেটা শায়লা শেখের অগোচরে।
আমার বয়স যখন দুই বছর তখন আমার বোন হয়। আমার বোনের সাথে আমি খেলতাম। ওকে আদর করতাম।

শায়লা শেখ যখন আমার বোনের কথা জানতে পারেন তখন তিনি ওঠে পড়ে লাগেন আম্মুর কাছ থেকে আমার বোনকে কেড়ে নেওয়ার জন্য। কিন্তু আম্মু আমার বোনকে শক্ত হাতে আগলে রেখেছিলেন। তখন শায়লা শেখ বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করতে শুরু করেন। আম্মুর সাথে ভালো সম্পর্ক গড়ে তুলেন। নিয়মিত যাওয়া আসা শুরু করেন নানারবাড়িতে। আমার বোনের যখন তিন বছর তখন আমার বয়স পাঁচ বছর। সায়লা শেখ প্রথম বারের মতো জানতে পারলেন উনি মা হতে চলেছেন।

ঠিক তখন থেকেই তিনি মায়ের সাথে সমস্ত যোগাযোগ ছিন্ন করে দেন। আমাদের গ্রামে যাওয়া বন্ধ করে দেন। আমার মায়ের সাথে আমার যোগাযোগ বন্ধ করে দিলেন। আমি আম্মুর কাছে যাওয়ার জন্য চিৎকার করে কাঁদতাম। কিন্তু উনাদের মনে কোনো মায়ার উদগ্রীব হতো না। আগে জামান শেখ মাস শেষে কিছু টাকা পাঠাতেন সেটাও বন্ধ করে দিলেন। নানা তখন বৃদ্ধ মানুষ।

ইনকাম করার মতো অবস্থা উনার ছিল না। আম্মু অন্যের বাসায় কাছ করে যা পেতেন তা দিয়েই উনাদের সংসার চলতো। এক বেলা না খেয়ে দিন কাটতো। শায়লা শেখ যখন দুই মাসের প্রেগনেন্ট তখন প্রেগনেন্সির টাইম ইঞ্জয় করার জন্য কক্সবাজার যান। তখন আমার ছোট বোনটার ভীষণ জ্বর হয়। আমার বোনকে ঔষধ কিনে দেওয়ার মতো পয়সাও আম্মুর কাছে ছিল না। আম্মুর আত্নসম্মান ছিল প্রবল। সেই আত্নসম্মান বিসর্জন দিয়ে উনি ফোন করেছিলেন জামান শেখের কাছে একটু সাহায্যের আশায়। কিন্তু উনি সাহায্য করার বদলে আম্মুর কোনো কথা না শুনেই ফোন কেটে দেন। তারপর জানেন কী হলো?

শহর জুড়ে সন্ধ্যা নামুক পর্ব ২৬ শেষ অংশ

কি?
আমার বোনটা বিনা চিকিৎসায় মারা গেলো। টাকার জন্য আমার বোনের জীবনটা শেষ হয়ে গেলো। হায়রে টাকা। সেই জামান শেখের টাকায় আমি দুই হাতে উড়াই আর সেই টাকার জন্যই আমার বোনের জীবনটা শেষ হয়ে গেলো। জানেন এখনো আমার কানে বাজে আমার বোনের কথাগুলো। ওর ভাই ডাক শুনে আমার কলিজা জুড়িয়ে যেতো।
তারপর কী হয়েছিল? আন্টির সাথে কী হয়েছিল?

শহর জুড়ে সন্ধ্যা নামুক পর্ব ২৮