শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ১৯

শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ১৯
তানিয়া মাহি

সন্ধ্যায় শুভ্রতা ছাদে পায়চারি করছে, তার কানে শুধু একটা কথাই বাজছে, ” প্লিজ শুভ্রা আমার ব্যক্তিগত মানুষ হয়ে যা প্লিজ।”
এত তাড়াতাড়ি কি সত্যিই সবকিছু শুরু করা যায়? মানুষ বিশ্বাসঘাতক বলবে না? বলবে না যে আগে থেকে সব ঠিক করা ছিল বলেই চাচাতো ভাইকে বিয়ে করছে? অপরা*ধ না করেও যে অপরা*ধী হয়ে থাকতে হবে।
শুভ্রতা ছাদ থেকে নেমে আসবে ঠিক তখনই শাহাদাত সাহেব এসে উপস্থিত হন। শুভ্রতা পা থামিয়ে দেয়।

” বাবা তুমি এখন ছাদে কেন?”
” তোর কাছেই আসলাম।”
” কিছু বলবে?”
” সারাদিন দেখলাম কেমন অন্যমনস্ক হয়ে আছিস। কি হয়েছে বল তো?”
” কিছু হয় নি বাবা।”
” চল বসে কথা বলি।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

শাহাদাত সাহেব গিয়ে চেয়ারে বসেন, শুভ্রতাও পাশে একটা চেয়ার টেনে বসে৷ তাদের বাসা থেকে কিছু দূরেই রেলস্টেশন। লাল, সোনালি আলো জ্ব*লছে রাস্তার পাশেও কিছুদূর পরপরই ল্যাম্পপোস্টের আলো। শুভ্রতা বাহিরের দিকে তাকিয়ে আছে।
” শুভ্রতা!”
” হ্যাঁ, হ্যাঁ বাবা।” বাবার ডাকে হকচকিয়ে ওঠে শুভ্রতা। সে প্রায় অনেকটাই অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিল।
শাহাদাত সাহেব বলেন, ” তোর বিয়ের কথা যদি এখন চিন্তা করি তাহলে তুই কি বলবি?”
শুভ্রতা বাবার কথায় শব্দ করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে। সে মনে মনে এটা ভেবেছিল যে বাবা এসে বিয়ের কথা তুলবে। শুভ্রতা বলে,

” বাবা আমি এখনই বিয়ে, সংসার, কোন বাড়ির দায়িত্ব এসবে জড়াতে চাই না। আমি পড়া শেষ করে তারপর এসব নিয়ে ভাববো। আর তাছাড়া এখনই নতুন কোন মানুষের সাথে ঘর করতে আমি পারব না বাবা, এটা আমার পক্ষে সম্ভব হবে না। লোকে কি বলবে বলো তো? ভালোবেসে বিয়ের ডিভোর্স হয়েছে তাও আবার দুইমাস যেতে না যেতেই আবার বিয়ে?”
” তোর এতকিছু করতে হবে না। তুই দুইদিন না খেয়ে থাকলে কেউ দুমুঠো ভাত নিয়ে আসবে না। তুই কি কোনভাবে এখনো ইমতিয়াজকে….”

” না বাবা, প্লিজ ওর নাম ও আমার সামনে উচ্চারণ করবে না। ওকে আমার আর সহ্য হয় না একদম সহ্য হয় না। ওর জন্য এক ফোঁটা ভালোবাসা অবশিষ্ট নেই আর।”
” তাহলে বিয়ে কেন করবি না?”

” বাবা, নিহান ভাই এত সম্মানের একটা জায়গায় অবস্থান করছে। কাজের ক্ষেত্রে সফল, ভালো দেখতে সে কিনা আমাকে বিয়ে করতে চাইছে। উনি আমার ওপর দয়া করতে চাইছেন? আমার তো উনার দয়া লাগবে না। এত ভালো একটা ছেলের জন্য বড়মা নিশ্চয়ই একটা ভালো, সুন্দরী, ওয়েল এডুকেটেড মেয়েই চাইবেন, আমার মতো ডিভোর্সিকে তিনি মানবেন না। মেয়ের মতো তিনি আমাকে ভালোবাসেন আমি এই ভালোবাসাগুলো হারাতে চাই না। বড়মা এসব শুনলে অনেক কষ্ট পাবে। তুমি নিহান ভাইয়ের সাথে কথা বলো বাবা, উনি যেন আমাকে নিয়ে না ভাবে।”

” নিহান ছেলেটা তো ঠিক কতটা পছন্দ করে বুঝতে পারিস না? তোর বিয়ের সময় কি পরিমাণে কান্না করেছিল মনে নেই তোর?”
” সব মনে আছে বাবা কিন্তু আমার পক্ষে সম্ভব না বাবা। তুমি উনার সাথে কথা বলে নিষেধ করে দিও, আমি এখনই বিয়েতে জড়াতে চাই না। আমি আসছি।”
শুভ্রতা চলে যায় সেখানে থেকে৷ শাহাদাত সাহেব শুভ্রতার যাওয়া দেখে আবার আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে, ” এই মেয়েটা নিজের ভালো কবে বুঝবে? কবে বুঝবে কে তার জন্য ভালো আর কে মন্দ!”

দুই তিনদিন ক্লাস করার পর ভার্সিটি ছুটি হয়ে যাওয়ায় শুভ্রতা তার মামার বাড়ি দুই সপ্তাহের মতো সময় কাটিয়েছে। এখানে সে কয়েকদিন ধরে অনেক চিন্তাভাবনা করেছে, সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে বিয়ে করবে। তবে বিয়েতে কিছু শর্ত রাখবে সে। মামাবাড়ি থেকে একাই বাড়ি ফিরতে পারে শুভ্রতা। বাড়িতে এখন শাকিরার বিয়ের অনুষ্ঠান শুরু হবে নিহানের সাথে আলাদা কথা বলা যাবে না তাই সে নিজেই নিহানকে কল দেয়। কয়েকবার রিং হতেই কল রিসিভ হয়।

” নিহান?”
” হ্যাঁ, কে?”
” আমি শুভ্রতা। চিনতে পারেন নি, নম্বর সেভ নেই?”
” আছে, তুই তো নিহান ভাই বলিস তাই…”
” যাকে বিয়ে করব বলে মনস্থির করেছি তাকে আর ভাই কীভাবে বলি বলেন?”
” বিয়ে!”

” হ্যাঁ, কেন বিয়ে করবেন না? নাকি সময় নিয়েছি জন্য ভেবেছেন না করে দেব এই সুযোগে অন্য মেয়েকে বিয়ে করবেন বলে ঠিক করেছেন? এমন যদি হয় তাহলে শুভকামনা। ”
” আরে না না আমার ভালোবাসা এত ঠুনকো নাকি! আট নয় বছর যার মুখে ভালোবাসি শব্দটা শুনব বলে অপেক্ষায় আছি তাকে পনেরো দিনের ব্যবধানে হৃদয় থেকে সরাবো কি করে?”

” আমি স্বার্থপর হতে চাই, আমি একটু ভালো থাকতে চাই, ভালোবাসা চাই যেটা আমি আমার প্রাক্তনের কাছে পাইনি।”
শুভ্রতা একটু থেমে আবার বলে, ” বাড়িতে কি আত্মীয়রা সবাই এসে গেছে?”
” বিয়ের এক সপ্তাহ বাকি, এত জলদি এসে কি করবে সবাই? তবে কাল পরশু আমজাদ কাকা, ইরা, কাকি আসবে।”
” বিকেলে আমার মামাবাড়ি চলে আসুন।”
” কেন?”

” আমি বাসায় যাব, আপনি এসে আমাকে নিয়ে যাবেন।”
” ঠিক আছিস তুই?”
” ঠিক না থাকার কি আছে?”
” তুই তো আমার বাইকে উঠতেই চাস না। সেদিন আমার সাথে যাবি না জন্য কি কান্ডটাই না করলি।”
” আপনার থেকে দূরে থাকার জন্য ওসব করেছি।”
” আর এখন?”

” জানি না, তবে আমারও মাঝেমাঝে ভালোবাসা পেতে ইচ্ছে করে। আমিও চাই কেউ আমাকে ভালোবাসুক। বিয়ের তিনবছরে প্রায় দুই বছরই কেটেছে আমাদের ঝগড়া আর মনোমালিন্যে ভালোবাসাটা কেমন ছিলই না। ভালোবাসার অভাবে হৃদয়টা মরুভূমি হয়ে গেছে। এক ফোঁটা জলের ন্যায় ভালোবাসাটা খুব করে প্রয়োজন।”

” কখন আসব আমি? ”
” আসরের পর আসলেই হবে। আপনি কি ফ্রি আছেন?”
” এখন কাজে আছি, সন্ধ্যা পর্যন্ত ব্যস্ত থাকব। সন্ধ্যার পর গেলে সমস্যা হবে?”
” না, আসুন। সন্ধ্যার পরের সময়ে বের হলে আরও ভালো লাগবে। ”
” আচ্ছা ঠিক আছে।”
শুভ্রতা ফোন কেটে দেয়। পনেরো দিন পর সে নিজেই আজ নিহানকে কল দিয়েছিল। যেদিন বাড়ি থেকে এখানে আসে সেদিন সে নিহানের সাথে কথা বলেছিল। সে যখন ব্যাগ নিয়ে বেড়িয়েছে মামার সাথে তখন নিহান পিছন থেকে নিম্নস্বরে বলে ওঠে,

” আমার থেকে আর কতদিন পালিয়ে পালিয়ে বেড়াবি শুভ্রা? তুই আমাকে ভালো না বাসলে আমি সারাজীবন একা থাকব তবু তুই ছাড়া অন্যকাউকে নিজের করব না।”

” পাগলামি করবেন না নিহান ভাই। আপনি মেয়ে হলে এই সমাজের ভিন্নরূপ আপনার নজরে পড়ত। মেয়ে নন বলেই এমন এমন কথা বলতে পারছেন। আপনি আমার জায়গায় থাকলে বুঝতেন কীভাবে দিন পার করতে হয় আমার। ”
” বিশ্বাস কর এই সমাজের ধার আমি ধারি না, যে সমাজ একটা সাধারণ মানুষের দূর্দশায় পাশে না দাঁড়িয়ে কোণঠাসা করে ছাড়ে সেই সমাজকে নিন্দা জানাই। যে সমাজ একটা নারীকে দুঃখের সময় কাটিয়ে জলদি সুখের সাগরে ভাসতে দেয় না সেই সমাজের ধার আমি সত্যিই ধারি না। আমি তোকে নিয়ে অন্যকোথাও চলে যাব বিশ্বাস কর, কারো খারাপ কথা তোকে শুনতে হবে না। ”

” ওখানে গিয়ে লুকিয়ে রাখবেন যে আমার একবার বিয়ে হয়েছিল, ডিভোর্স হওয়ার দুই মাসের মাথায় ভালো থাকার জন্য আবার বিয়ে করে নিয়েছি?”
” অন্যের কথা কেন ভাবছিস তুই? তোর ইচ্ছে করে না কারো গভীর ভালোবাসা শুধু তোর জন্য হোক? যে পুরুষ তোকে অসম্ভব ভালোবাসে তার হতে ইচ্ছে করে না? তোর এই তিনবছরের সংসারের কাছে আমার নয় বছরের ভালোবাসা কিছুই না? আমি তো শুধু ভালো একটা সময়ের অপেক্ষা করছিলাম আর এর মধ্যেই সবকিছু তচনচ হয়ে গেল। তোকে না পেলে কেউ আমার হবে না শুভ্রা এটা মনে রাখিস। আর বেহায়া হতে পারব না আমি। আজই এই বিষয়ে শেষ কথা, এমনকিছু করিস না যেন আমি নরম তুলো থেকে কঠিন পাথর হয়ে যাই।”

” আমারও ভালো থাকার ইচ্ছে হয় নিহান ভাই। কিন্তু সেই ইচ্ছেকে আমি তীব্র হতে দেই না, এই সমাজ চিল শকুনের মতো ছিড়ে খাওয়ার জন্য সবসময় তৈরি থাকে। আমার সময় লাগবে সবকিছু ঠিক করতে।”
” আমার সারাজীবনটাই তোর জন্য বরাদ্দ করে দিলাম ভেবে দেখার জন্য। আমার শেষ নিঃশ্বাস ফেলার আগ মুহূর্তে এসেও যদি বলিস নিহান ভাই আমি আপনাকে ভালোবাসি তখনও হাসতে হাসতে শেষ নিঃশ্বাস ফেলব। আল্লাহ আমার ভালোবাসার মানুষকে ভালো রাখুক।”

শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ১৮

নিহান আর শুভ্রতার সেদিনই শেষ কথা হয়েছিল। এরপর কেটে গিয়েছে দুই সপ্তাহ, এই দুই সপ্তাহে শুভ্রতা অনেক ভেবে সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে এবার থেকে নিজের কথা ভাববে। একজন জ্ঞানবুদ্ধিহীন মানুষও নিজের ভালো বোঝে তাহলে সে কেন বুঝবে না!

শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ২০