শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ২০

শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ২০
তানিয়া মাহি

ফাউজিয়া রুমের জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখছিল এমন সময় কলিংবেল বেজে ওঠে। তার মা গিয়েছে বাজারে, এতক্ষণে চলে আসার কথা তবুও দেরি কেন হচ্ছে কে জানে! দুইদিন পর রোজা শুরু হবে। রোজা থেকে বাজার করা সম্ভব হবে না। এই সময় রোদের তাপ খুব তীব্র হয়েছে।

ফাউজিয়াদের বাসায় সচরাচর কেউ আসে না। বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে মায়ের সাথে এখানেই আছে। আশেপাশে বড় বড় বিল্ডিং মানুষও অনেক কিন্তু কেউ কারো খোঁজ নেয় না। জায়গাগুলো গ্রাম থেকে যতই শহর হতে শুরু করেছে মানুষের মাঝে মানুষের জন্য টানও কমতে শুরু করেছে। এখানে কেউ মা*রা গেলেও দেখতে আসে না প্রতিবেশী।
ফাউজিয়া মাথায় ওরনা জড়িয়ে দরজা খুলতে চলে যায়। দরজা খুলেই দেখে সাহিল স্যার তার মাকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার মায়ের মাথাটা সাহিল স্যারের বুকে, চোখ বন্ধ। ফাউজিয়া মায়ের এই অবস্থা দেখে থতমত খেয়ে যায়। তাড়াতাড়ি করে মাকে ধরে রুমে নিয়ে এসে বিছানায় বালিশে হেলান দিয়ে বসায়।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

তার মা কোন কথা বলতে পারছে না বেশ ক্লান্ত দেখাচ্ছে তাকে। সাহিল শেখ বলে,
” আমি জানতাম না এটা আপনাদের বাসা। রাস্তা দিয়ে হেটে যাচ্ছিলাম এমন সময় দেখি আপনার মা বাজারে ব্যাগ নিয়ে এই গরম আর তুখোড় রোদে হেটে আসছেন। ঠিকমতো পা ফেলতে পারছেন না, হয়তো উনার মাথা ঘুরছিল বেশ ক্লান্ত ছিলেন। আমি উনার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে রাস্তায় বসে পড়েন। আমি গিয়ে ধরে তুলে দোকানের চেয়ারে একটু বসিয়ে মাথায় একটু পানি দিয়ে উনার কাছে বাড়ি কোথায় জেনে নিয়ে এসেছি। এখানে এসে আপনাকে দেখছি। ”

” আমি অনেকক্ষণ যাবৎ মা’র জন্য অপেক্ষা করছিলাম। প্রেশারটা বেড়ে গিয়েছে, অনেক চিন্তায় আছি। কয়েকমাস যাবৎ অনেক ওষুধ খেতে হচ্ছে। আমি যেতে চাইলাম সাথে বাজারের জন্য মা তবু নিয়ে গেল না। ”
” আপনার বাসায় পুরুষ কেউ নেই? উনাকে কেন বাজারে যেতে হবে?”
” না আমাদের বাসায় পুরুষ কেউ নেই।”
” আপনার বাবা?”

” আমার বাবা মা*রা গিয়েছেন। আমার কোন ভাই নেই। বড়বোন ঢাকায় থাকে বরের সাথে। আমি আর মা এখানে থাকি, আপু মাঝেমাঝে আসে এখানে।”
” ওহ আচ্ছা। ”
সাহিল হাতের ঘড়ির দিকে খেয়াল করে। সাহিল ফাউজিয়ার মন অন্যদিকে নিতে চায় কারণ যেকোন মেয়ে তার বাবার মৃ*ত্যুর কথা বলতে পছন্দ করে না তারা একাকিত্ব বোধ করে।

” আন্টির নম্বরটা দিন আমি খবর নিব আর মাঝেমাঝে আমি বাজার করে পাঠিয়ে দেব। আপনাদের কাউকে বাজারে যেতে হবে না, এখানে অন্যকিছু ভেবে সংকোচ বোধ করবেন না এটা মানবিকতা। ”
” না না স্যার আপনার এতকিছু করতে হবে না। এরপর থেকে ক্লাস করে আসার সময় আমিই নিয়ে আসব বাজার করে।”
” আপনাদের ক্লাস হয়তো ছুটি দিয়ে দেবে খুব তাড়াতাড়ি। ঈদের পরই তো পরিক্ষা এবার একটানা হয়ে সপ্তাহখানেকের মাঝেই শেষ হয়ে যাবে হয়তো।”

” জি।”
” নম্বরটা দিন আমার বাড়ি ফিরতে হবে। আর আপনার বান্ধবীর কি খবর? ক্লাসে আসছে না কেন?”
” মামাবাড়ি গিয়েছে হয়তো আগামীকাল আসবে স্যার। অনেকদিন ওকে দেখি না আমারই খারাপ লাগছে। ”
ফাউজিয়া কপালে হাত দিয়ে আফসোস করে বলে, ” উফফফ দেখেছেন স্যার আমি আপনার সাথে এভাবেই দাঁড়িয়ে কথা বলছি। প্লিজ বসুন না স্যার আমি অন্তত এক গ্লাস শরবত করে নিয়ে আসছি। এই গরমে ভালো লাগবে।
” না, আপনাকে ওসব করতে হবে না। আমি বাড়ি ফিরব এক্ষুণি। মা আমার জন্য অপেক্ষা করছেন। অন্যদিন শরবত খাওয়া যাবে। ”

ফাউজিয়া আরো দুই একবার বলে কিন্তু কাজ হয় না। নম্বরটা নিয়েই সাহিল বেরিয়ে যায় সেখান থেকে। হাটতে থাকে নিজের বাড়ির উদ্দেশ্যে। ফাউজিয়া দরজা আটকে মায়ের পাশে এসে বসে।

শুভ্রতার মামাবাড়ি পৌঁছতে পৌঁছতে নিহানের প্রায় সাতটা বেজে যায়। সে কোনো একটা কাজে আটকে গিয়েছিল। শুভ্রতার কিঞ্চিৎ রাগ হয়েছিল এতক্ষণ অপেক্ষা করতে কিন্তু কিছু করার তো নেই মানুষের ব্যস্ততা থাকতেই পারে। কিছুক্ষণের মধ্যে শুভ্রতা আর নিহান বাড়ির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ে। সারারাস্তা দুজন কোন কথা বলে নি বাড়ির কাছাকাছি এসে শুভ্রতা বলে,
” গাড়ি একটু থামান প্লিজ আমার কিছু কথা আছে।”

নিহান শুভ্রতার কথা শোনামাত্র গাড়ি রাস্তার একপাশে থামায় আর শুভ্রতা গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ায়।
” হ্যাঁ বল কি বলবি?”
” রাস্তার ওই পাশে টঙে বসবেন?”
” ঠিক আছে।”

শুভ্রতা আর নিহান গিয়ে টঙের পাশে বেঞ্চটায় বসে। নিহান দুজনের জন্য দুই কাপ চা অর্ডার করে। দুজন পাশাপাশি বসে আছে। শুভ্রতা বাহিরে আকাশের দিকে তাকিয়ে মুক্ত বাতাসে শ্বাস ফেলছে। চোখ বন্ধ করে প্রকৃতির মমতা অনুভব করছে। নিহান সেদিকেই তাকিয়ে আছে। চা এলে সে নিজে এক কাপ নিয়ে অন্য কাপ শুভ্রতার দিকে বাড়িয়ে দেয়।
” নে চা খাবি না?”
” হ্যাঁ দিন।”

শুভ্রতা চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে বলে, ” আমি আপনাকে কিছু কথা বলব বলেছিলাম। ”
নিহান চায়ে চুমুক দিয়ে বলে, ” হুম শুনছি বল।”
” আপনি যাচ্ছেন কবে বাড়ি থেকে?”
” কেন?”
” জানতে চাইছি।”
” তিনমাস আছি এখানে তার মাঝে একমাস প্রায় শেষ হতে চলল।”
” বিয়েতে আমার কিছু শর্ত আছে।”

” বিয়েতে শর্ত? তুই শর্ত সামনে রেখে বিয়ে করবি? ভালোবাসি বলে সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে চাইছিস তুই?”
” আমি সুস্থ মস্তিষ্কে নতুন সম্পর্কে জড়াতে চাইছি। ”
” এখন কি তুই অসুস্থ মস্তিষ্কের? ”
” আমার নির্ঘুম রাত কীভাবে যায় সেটা আমি ছাড়া কেউ জানে না নিহান ভাই। সকালে উঠে চারপাশটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগে আমি আপনাকে বোঝাতে পারব না। আমার সারাটাদিন ঠিক কেমন অসহায়ের মতো থাকি সেটাও বুঝবেন না। এসব থেকে বেরিয়ে আসতে আমার সময় লাগবে।”

” আর কত সময় শুভ্রা? আর কত অপেক্ষা করাবি আমায়? আমি যে যুগ যুগ ধরে পিপাসায় কাতর হয়ে আছি। আমাকে কেন ভালোবাসতে পারিস না শুভ্রা?”

” আমাকে কয়েকটা মাস সময় দিবেন? আমি কথা দিচ্ছি আপনার ভালোবাসার মানুষ আপনার হবে। এমনিতেও ডিভোর্স হওয়ার পর দ্বিতীয় বিয়ে করার আগে কিছু মাস ব্যয় করার নিয়ম আছে। সেই সময় পার না হলে বিয়ে করা ঠিক না, হয়তো সেটা বিয়ে বলে কবুল হয় না। আমার দ্বিতীয় বর্ষ শেষ হতে পাঁচ ছয় মাস লাগবে। দুই একদিন পরেই হয়তো টেস্ট পরিক্ষার রুটিন দিয়ে দিবে। এই ছয়টা মাস আমি আপনার থেকে সময় চাইছি। এই ছয়মাসে আপনি আমার সাথে প্রতিদিন ফোনে কথা বলবেন না মাঝেমাঝে খবর নিতে পারেন। আমি চাই না বিয়ের আগে আমি আরও একবার প্রেমে পড়ি। ”

” আমি পারব শুভ্রা, আমি তোর জন্য অপেক্ষা করব। তুই শুধু আমাকে কথা দে তুই অন্যকারো হবি না কখনো!”
” কথা দিলাম নিহান ভাই আমি আপনাকে ঠকাবো না। ”
” আজকে থেকে আমি তোকে আমার ভালোবাসার কথা আর জানাবো না, বিরক্ত করব না সবটা সময় তুই নিজের মতো থাকবি। ”
” হুম।”
” ক্লাসে…..”

” আমি একাই যাতায়াত করতে পারি নিহান ভাই এটা নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবে না।”
নিহান চায়ের কাপটা নিচে রেখে দুই হাত একত্র করে ঘষতে ঘষতে বলে, ” কে যেন বলেছিল আমাকে আর ভাই বলবে না?”
” ধীরে ধীরে ঠিক হয়ে যাবে।”
” জি, ঠিক করে নিন। আর এই যে আপনার ম্যাচুরিটি স্বভাবটা আমার পছন্দ না। মেয়েরা বাচ্চামি না করলে ভালো লাগে?”
” হ্যাঁ তাই তো। বেশি বাচ্চামি করলে তো ঠিকই ধমক দিয়ে গম্ভীরমুখে বলবেন শুভ্রা বড় হবি কবে তুই?”
” নাহ বলব না।”

শুভ্রতা নিহানের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে বলে, ” চলুন তবে এখন বাসায় যাই দেরি হয়ে যাচ্ছে।”
” সবাই জানে আপনি আমার সাথে আছেন কেউ চিন্তা করবে না।”
” তাই বলে কি রাত করে ফিরতে হবে নাকি চলুন তো।”

আকাশে একটা গোল চাঁদ উঠেছে। দুই একেই নতুন চাঁদ দেখা দিবে প্রতিটা মুসলিমের ঘর আলো করে আসবে রমজান। এই একটা মাস রাত জেগে, তারাবী নামাজ,তাহাজ্জুদ, ইবাদতে মশগুল থাকবে আর তারপরই ঈদ।
নিহান আর শুভ্রতা নিজেদের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়। শুভ্রতার আজ মন ভালো। তার অনেকদিনের ইচ্ছে ছিল রাতে ঘুরবে আর আকাশ দেখবে সেটা আজ পূরণ হয়ে গেল।

শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ১৯

রাতে আকাশ আর চারপাশ যেন নতুন সাজে সজ্জিত হয়। শুভ্রতা অন্ধকারের মাঝে আলোর ছটা, আকাশে চাঁদ, হালকা বাতাস অনুভব করতে থাকে আর নিহান তার প্রিয় মানুষকে।

শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ২১