শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ২১

শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ২১
তানিয়া মাহি

বিয়ে উপলক্ষ্যে বাড়িতে মানুষ আসা শুরু করেছে কিন্তু বিয়ের কনে আর শুভ্রতা কোন আনন্দ করতে পারছে না। পরিক্ষার রুটিন অনুযায়ী শাকিরার বিয়ের দিনেও পরিক্ষা আছে। পরিক্ষা দিয়ে তারপর বিয়েতে বসতে হবে। পরিক্ষার রুটিন আগে দিলে হয়তো বিয়ের তারিখ পরিবর্তন করে অন্য তারিখে করা যেত কিন্তু একদম শেষ সময়ে এসে রুটিন দিয়েছে।
শাকিরা আর শুভ্রতা একই সাথে পড়ছে, শাকিরা পড়ার মাঝেমাঝে অসহায়ের মতো শুভ্রতার দিকে তাকাচ্ছে। একসময় রাগে বই বন্ধ করে ফেলে।

” ধুর, আমার বিয়ের দিনেও পরিক্ষা থাকতে হলো!”
শুভ্রতা শাকিরার অবস্থা দেখে হাসবে নাকি ওর মতই মন খারাপ করবে বুঝতে পারছে না। সে বলল,
” তোর বিয়ে এখনো তিনিদিন পর, আগে এই তিনটা পরিক্ষা শেষ হোক তারপর তো ওটা! কালকের পরিক্ষার জন্য আপাতত পড়। রায়হান ভাইকে বলব যেন তোকে নিয়ে যায়।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

” টেস্ট পরিক্ষা না দিলেও কিন্তু কিছু হতো না। শুধু ওই লোকের জন্য আমার প্যারা নিতে হচ্ছে। জীবনে বিয়েই করব একবার সেই বিয়ের দিনও যদি পরিক্ষা দিতে হয় বই পড়তে হয় তাহলে কেমন লাগে বল তো?”
” বিষয়টা তোর কাছে কেমন জানি না তবে আমার কাছে কিছু বেশ ভালোই লাগছে। শাড়ি গহনা পড়ে যাবি পরিক্ষা দিতে আর সবাই তোর দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখবে। নতুন বউ/ বিয়ের কনে পরিক্ষা দিচ্ছে বিষয়টা কিন্তু দারুণ!”

” ধুর তোর সাথে কথা বলে লাভ নেই।”
” পড়া শেষ কর নইলে কাল কি পরিক্ষা দিবি? আমি যেগুলো পড়তে বললাম ওগুলোই পড় কাজে দিবে।”
শাকিরা অসহায়ের ভঙ্গিতে আবার পড়া শুরু করে। বর্তমানে তার জীবনে একটা দুঃখ, একটাই আক্ষেপ আর সেটা হলো বিয়ের দিনে পরিক্ষা।

মামাবাড়ি থেকে এসে মাত্র একদিন ক্লাস করতে পেরেছে শুভ্রতা আর সেদিনই জানিয়ে দিয়েছে পরিক্ষাটা তাড়াতাড়ি নিয়ে শেষ করবে কেন না কয়েকদিন পরই রাষ্ট্রপতি নিজে সেখানে আসবেন। উনার আশায় থাকলে পরিক্ষার সময় অনেক পিছিয়ে যাবে তাই পরিক্ষাটাই আগে নিয়ে নিবে। সারাবছর যারা পড়াশোনা করেছে তারা খুশি হলেও যারা পড়াশোনা করেনি তাদের মাথায় বাজ পড়ে। রুটিন দেওয়ার পরপরই ফাউজিয়া শুভ্রতাকে বলেছিল,

” তুই আমাকে কি কথা দিয়েছিলি মনে আছে তো?”
শুভ্রতা কি কথা দিয়েছে সেটা কিছুতেই মনে করতে পারে না তাই জিজ্ঞেস করে, ” কি কথা বল তো?”
” টেস্ট পরিক্ষায় তোকে টপার হতে হবে। পারবি তো?”
” ভালো রেজাল্ট করতে পারব টপার হতে পারব কিনা জানি না।”
” না, শুধু ভালো রেজাল্টে হবে না। তোকে সবার চেয়ে ভালো করতে হবে রেজাল্ট।”
” আচ্ছা দেখি।”

দুজন কথা বলার সময় সাহিল স্যার আবার ক্লাসে প্রবেশ করেন। কিছুক্ষণ আগেই নিজের ক্লাস শেষ করে গিয়েছিলেন তিনি। স্টুডেন্টদের মতে তারা সাহিল স্যারের ক্লাস সবচেয়ে বেশি উপভোগ করে। তাই সাহিল স্যার দ্বিতীয়বার ক্লাসে আসায় সবাই খুশি হয়। ক্লাসে আসতে দেরি হওয়ায় শুভ্রতা প্রথম ক্লাসটা করতে পারেনি।
সাহিল স্যারের হাতে কিছু কাগজ, সবার আগ্রহ সেদিকেই। তিনি সবার উদ্দেশ্যে বলেন,

” আপনাদের পরিক্ষা যেহেতু হুট করেই নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে তাই সব টিচার তার নিজ নিজ বিষয়ের ওপর আপনাদের জন্য সাজেশন তৈরি করেছেন। আমি একে একে পেইজ আর প্রশ্ন নম্বর বলব আপনারা লিখে বা দাগিয়ে নিবেন। আশা করছি এগুলো শেষ করলে পরিক্ষায় ভালো করতে পারবেন।”

সাহিল শেখ একেএকে সব বিষয়ের সাজেশন দিয়ে শেষ করল। সবাই যার যার মতো দাগিয়ে নিলো আর লিখে নিলো। নিজের কাজ শেষ হলে কারো সাথে কোন কথা না বলেই ক্লাস থেকে বেরিয়ে গেল।
শুভ্রতা আর ফাউজিয়া বসে পড়া নিয়ে আলোচনা করছে। শুভ্রতা নিজের খাতা বের করে ফাউজিয়ার দিকে এগিয়ে দিলো। ফাউজিয়া শুভ্রতার হাতে থেকে খাতাটা নিয়ে বলল,

” কি এখানে?”
” আমি সাজেশন বানিয়েছি পড়ার জন্য। স্যারদের সাজেশনের সাথে আমারগুলোর সাথে অনেকগুলোই মিল আছে। আমার এখানে কম প্রশ্ন আছে। দেখ একটু…”
ফাউজিয়া শুভ্রতার খাতার সাজেশনগুলো দেখতে থাকে। খাতা দেখে বলে, ” পরিক্ষার আগে এমন সাজেশন বানাস নিজে নিজে?”

” হ্যাঁ। ”
” এভাবেই অল্প পড়ে ভালো রেজাল্ট করিস! আমার অনেক পড়তে হয়।”
” বুঝতে হবে ম্যাডাম।”
” খাতা দে তোরগুলো কম আছে, ছবি তুলে নিই।”
” নিয়ে নে ।”
ফাউজিয়া ছবি তুলে নেয়। শুভ্রতা মনে মনে ভাবে এগুলো এবার শাকিরাকে দিতে হবে কারণ বিয়ের জন্য সে ক্লাসে আসতে পারছে না। মেয়েটার ভাগ্য কেমন যেন অন্যরকম হয়ে গেল৷ বিয়ের সময় পরিক্ষা!

রাতে হঠাৎ জ্বরজ্বর অনুভব করল শুভ্রতা। তার প্রায়ই এমন হয় বিশেষ করে পরিক্ষার সময়। পরিক্ষার সময় চাপ বেড়ে যাওয়ায় অনেকবার সে অসুস্থ হয়ে যায়। রাত পোহালেই পরিক্ষা আর রাত কি-না জ্বর! বাড়ির সবাই শাকিরাদের বাড়িতে আছে। নেহা আর স্নিগ্ধার পরিক্ষা শেষ হওয়ায় তারা দুজন সবার নাগালের বাহিরে। শুভ্রতার বাবা শাহাদাত সাহেবের কাজের চাপ থাকায় এখনো বাড়ি ফিরেন নি। ওখান থেকেই হয়তো তারাবী নামাজ পড়তে গিয়েছেন মসজিদে।

শুভ্রতা নিজের কপালে হাত দিয়ে দেখে কপালটা বেশ গরম হয়ে গিয়েছে। রোজার সময় ইফতারিতে ফ্রিজের ঠান্ডা পানি না খেলে ভালো লাগে না তাই সে বেশ খানিকটা পানি খেয়েছিল। ফ্রিজের ঠান্ডা পানি সচরাচর খাওয়া হয় না। আজ হঠাৎ খেয়েই হয়তো এমন হয়েছে। সে ড্রয়িংরুমে গিয়ে থার্মোমিটার নিয়ে নিজেই তাপমাত্রা মেপে দেখল। শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে একশো ডিগ্রি ফারেনহাইটে পৌঁছেছে। রাতে জ্বর আরও বাড়তে পারে।

ফার্স্ট এইড বক্সের মধ্যে জ্বরের কোন ওষুধ নেই। শুভ্রতা রুমে চলে যায় বাবাকে ফোন দিয়ে ওষুধ নিয়ে আসতে বলবে বলে। সে রুমে গিয়ে দেখে তার ফোন নেই। তার মানে স্নিগ্ধা ফোন নিয়ে গিয়েছে। শাকিরাদের বাড়ি যাওয়ার আগে ফোন চেয়েছিল, না দেওয়ায় হয়তো না বলেই ফোন নিয়ে গিয়েছে। একা একা তার একটুও ভালো লাগছিল না। কয়েকবার পড়া শেষ করা হয়ে গিয়েছে। এখন আর না পড়লেও হবে। মাথাটা ভারী ভারী লাগছে তার।

বাড়ির মেইন দরজা লক করে সমস্ত শরীরে ওরনা জড়িয়ে নেয় সে। শাকিরাদের ওখানে যাওয়ার উদ্দেশ্যে বের হয়েছে। তার মাথাটা এখনো কেমন যেন করছে মনে হচ্ছে ভূমিকম্প হচ্ছে। মাথায় হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে যায় সে।
পিছন থেকে আবিরা ডাক দেয়, ” কে ওখানে? শুভ্রতা?”
শুভ্রতা পিছনে ফিরে তাকায়, আবিরাকে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। আবিরা তার দিকে এগিয়ে এসে বলে, ” একা একা কোথায় যাচ্ছিলি এই অন্ধকারে? বাহিরের আলোটা তাহলে জ্বেলে দিবি না?”
শুভ্রতা আমতা আমতা করে বলে, ” আসলে আপু, আমার একটু জ্বরজ্বর লাগছিল।”

” কি বলিস! কাল না তোর পরিক্ষা? ”
” হ্যাঁ। বাবাকে কল করে ওষুধ নিয়ে আসতে বলব আর দেখি রুমে ফোন নেই স্নিগ্ধা নিয়ে গিয়েছে।”
” জ্বর বাধালি কীভাবে? নামাজ পড়েছিস?”
” হ্যাঁ পড়েছি। মা তো ওই বাড়িতে গিয়েছে সবাই একসাথে নামাজ পড়ে৷ আর তাছাড়া বিয়ে বাড়ি নামাজ শেষ করে হয়তো আড্ডা দিচ্ছে। বাবা তো তারাবী নামাজে গিয়েছে আমি ভুলেই গিয়েছি। ”

” আচ্ছা দাঁড়া এখানে। ভাইয়া আসছে, চলেই এসেছে হয়তো। ভাইয়া নামাজ শেষ করে ব্রিজের ওখানে বসে ছিল হয়তো আমি কল দিয়ে বিস্কুট দিয়ে যেতে বলেছি চা খাব। ভাইয়া আসলে তুই ভাইয়ার সাথে এখানে দাঁড়া আমি স্নিগ্ধার থেকে তোর ফোনটা এনে দিচ্ছি।”

শুভ্রতা আর না করে না। সে আবিরার হাত ধরে দাঁড়িয়ে থাকে। দুই মিনিট যেতেই নিহান চলে আসে। বাহিরের বড় উঠোনে দুজনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সেখানে এগিয়ে যায়। নিহানকে দেখেই আবিরা বলে ওঠে,

শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ২০

” ভাইয়া এখানে একটু দাঁড়াও তো, আমি শুভ্রতার ফোন এনে দিই। স্নিগ্ধা নাকি ওর ফোন নিয়ে গেছে। বেচারির জ্বর এসেছে ঠিকমতো হাটতে পারছে না। কাল ওর পরিক্ষা, কী যে করবে!”
আবিরা কথাটা বলেই শুভ্রতার থেকে হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে ওখান থেকে চলে যায়। হুট করে আবিরা চলে যাওয়ায় শুভ্রতা পড়ে যেতে লাগলে নিহান এসে হাতটা ধরে নেয়।

শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ২২