শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ৩৫

শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ৩৫
তানিয়া মাহি

রাত এগারোটা, ইরা বসে বসে কান্না করছিল। কিছুক্ষণ আগেই স্নিগ্ধার কল এসেছিল সেখানে থেকে জানতে পেরেছে শুভ্রতা আর নিহানের বিয়ের ব্যাপারে। তখনই স্নিগ্ধার সাথে কথা বলতে গলা ভারী হয়ে আসছিল তার। পছন্দের মানুষের বিয়ের খবর শুনলে কেমন অনুভূতি অনুভূত হওয়ার কথা!

বুকটা কেমন শূণ্য হয়ে যায়? মাথার সবকিছু এলোমেলো হয়ে যায়? ইরার এমনই লাগছে, তার ভীষণ কান্না পাচ্ছে। সে আলমারি থেকে একটা শাড়ি বের করে গায়ে জড়িয়ে মেঝেতে বসে পড়ে। নিহানের কথা মনে পড়তে থাকে। ইরা ফুপিয়ে ফুপিয়ে কান্না করছে। নিহানকে বলে দিতে ইচ্ছে করছে, ” প্লিজ আপনি বিয়েটা করবেন না, আপনি এই বিয়েটা কীভাবে করতে পারেন? আমি আপনাকে ভালোবাসি।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

ভালোবাসার মানুষকে কোন নারী অন্যকারো সাথে দেখতে পারে না সেটা বোন হলেও না।” ইরা কথাগুলো গিলে নিয়ে জোরে একটা চিৎকার দেয়। মেঝে থেকে উঠে শাড়িটা ছুড়ে ফেলে জিনিসপত্র ভাঙতে শুরু করে। প্রচন্ড আওয়াজে ইরার বাবা-মা চলে আসে। বাহিরে থেকে তারা দরজা ধাক্কাচ্ছে আর ইরা ভেতর থেকে জিনিসপত্র ভেঙেই চলেছে। কিছুক্ষণ পর ঘরের মধ্যকার শব্দ থেমে যায় স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে এরা চিৎকার করে করে কান্নাকাটি করছে। ইনার বাবা-মা বেশ চিন্তিত তারা দরজা ধাক্কাচ্ছে আর একে অপরকে দেখছে।

কিছুক্ষণ পর সবকিছু একদম নিরব হয়ে যায়। রুমে কোন সারাশব্দ নেই, আমজাদ সাহেব বলে ওঠেন, ” ইরা, মা কি হয়েছে? কাঁদছিস কেন? দরজা আটকেছিস কেন? দরজা খুলে দে নইলে আমি কিন্তু দরজা ভেঙে ফেলব।”
সাফিয়া বেগম রাগান্বিত স্বরে বলে ওঠেন, ” ইরা তুই কি দরজা খুলবি নাকি দরজা ভাঙবে। দরজা যদি ভাঙতেই হয় ভেতরে গিয়ে কিন্তু আমি তোকে আস্ত রাখব না বলে দিলাম। ভালোয় ভালোয় দরজা খুলে দে।”
সাফিয়া বেগমের কথায় ভেতর থেকে কোন কথা এলো না তবে দরজাটা ঠিকই খুলে গেল। ইরা বাহিরে এসে আমজাদ সাহেবকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না করছে৷ যদিও কান্নার বেগ এখন কমেছে।

সাফিয়া বেগম রুমে ঢুকে দেখেন রুমের ভেতরে যা তা অবস্থা। মেঝেতে জিনিস পড়ে আছে, ভেঙে গুড়ো গুড়ো হয়ে আছে কিছু জিনিস। তিনি ভেবেই পাচ্ছেন না কি এমন হলো যে ইরা এরকম করছে।
ইরা মাকে দেখে প্রচন্ড ভয় পায়। রুমের অবস্থা দেখে তিনি কি বলবেন সেটাই এখন দেখার বিষয়। তার মা কি তার কষ্টকে গুরুত্ব না দিয়ে রুমের এই অবস্থা নিয়ে পড়ে থাকবে?

আমজাদ সাহেব মেয়েকে ছাড়িয়ে নিয়ে প্রশ্ন করলেন, ” কি হয়েছে তোমার?”
ইরা চুপ করে আছে, মুখে কোন কথা নেই। সে পূর্বের মতোই বাবার বুকে মাথা রেখে দাঁড়ায়। সাফিয়া বেগম এসে মেয়েকে হাত ধরে টেনে নিয়ে এসে ড্রয়িংরুমের সোফায় বসায়। আমজাদ সাহেব ও এসে পাশেই বসেন।
সাফিয়া বেগম ঠান্ডাস্বরে মেয়েকে জিজ্ঞেস করেন, ” ইরা, কি হয়েছে তোমার?”
ইরা তখনও চুপ করেই আছে।আমজাদ সাহেব মেয়েটার মাথায় হাত দিয়ে ভয় না পেয়ে সবকিছু বলতে বলেন। ইরা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে, ” বাবা আমার বাহিরে যাওয়া কতদিনে?”

” কাজ চলছে, খুব বেশি দেরি হবে না হয়তো।”
সাফিয়া বেগম নিম্নস্বরে বলেন, ” তোমার কি হয়েছে সেটা বলো? ঠিকই তো ছিলে এখন কি এমন হলো যে ভাঙচুর করছো চিৎকার করে কান্নাকাটি করছো? আলমারি থেকে অন্য কিছু বের করোনি কিন্তু নিহানের দেয়া শাড়িটা কেন বাহিরে? আমি যেটা সন্দেহ করছি সেটাই কি আজকের এই পরিস্থিতির কারণ? তোমাকে আমি এ ব্যাপারে ভাবতে নিষেধ করেছিলাম ইরা।”

” সবকিছু নিজের ইচ্ছেতে চলে না আম্মু, আমি ওকে ভালোবাসি। আমি তো তোমাকে বলেছিলাম বড়আম্মুর সাথে কথা বলতে, বলোনি কেন তুমি? তুমি নিজের মেয়ের খারাপ কি করে চাইতে পারো?”
ইরার কথায় অবাক হয়ে যায় আমজাদ সাহেব। ইরা নিহানকে পছন্দ করে! মেয়েটা এত কথা শেয়ার করে আর এই কথাটা বলেনি তাকে!

সাফিয়া বেগম রেগে উঠে বলেন, ” চড় দিয়ে গাল ফাটিয়ে দেব আমি তোমার। এটুকু বয়সে খুব পেকে গেছো তাই না? আমি কখনোই আত্মীয়দের সাথে নতুন কোন সম্পর্কে যাব না। এমনিতেই ভালো সম্পর্ক, মেয়ে বিয়ে দিয়ে বিপক্ষ হতে চাই না। আর তুমি আগে থেকে জানো নিহান শুভ্রতাকে পছন্দ করে। শুভ্রতাকে তো তুমি বড়বোনের মতোই দেখো তবে এই ব্যাপারে স্বার্থপর হতে একবারও বাধছে না?
ইরা কিছু বলছে না চুপচাপ কিছুক্ষণ বসে থেকে নিজের রুমে চলে যায়। আমজাদ সাহেব মেয়ের চলে যাওয়া দেখে আবার স্ত্রীর দিকে তাকায়।

” কি হয়েছে বলো তো?”
” কি হবে? তুমি তোমার মেয়েকে স্পর্ধা দিয়ে দিয়ে মাথায় তুলেছ, নামাতে তো আর পারবে না। ওকে বাহিরে পাঠিয়ে দাও। মেয়েটার নতুন সংসারে যেন কোন ঝামেলা করতে না পারে বলে দিলাম।” কথাগুলো বলেই সাফিয়া বেগম জায়গা ছেড়ে উঠে রুমে চলে যান। আমজাদ সাহেব কিছুতেই বুঝতে পারছেন না যে এসব এতদূর গড়ালো কীভাবে?
সকালে খাবার টেবিলে বসে আছেন শাহাদাত সাহেব। রান্নাঘরে আয়েশা বেগম রুটির সাথে ডিম ভেজে দিচ্ছেন শাহাদাত সাহেবের জন্য। শুভ্রতা গিয়ে সামনেই চেয়ারের পাশে দাঁড়ালো। শাহাদাত সাহেব মেয়েকে দেখে হাত বাড়িয়ে কাছে ডাকলেন৷ শুভ্রতা গিয়ে পাশের চেয়ারে বসলো। শাহাদাত সাহেব খবরের কাগজটা রেখে জিজ্ঞেস করলেন, ” কিছু বলবি মা?”

শুভ্রতা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে, ” বাবা এখনই বিয়ে না করলে হয় না?”
শাহাদাত সাহেব মেয়ের কথায় বেশ অবাক হন। আজকের দিন আর রাতটা পার হলেই যার বিয়ে সে কী না এখন এসব বলছে!

” নিহানকে তোর অপছন্দ?”
” না না বাবা সেটা না। আমার কেমন যেন মনে হচ্ছে এখন বিয়ে করা ঠিক হচ্ছে না। চারপাশের মানুষ নানারকম কথা বলবে। আমি ওদের কথা সহ্য করতে পারি না। তারা সবাই কোন বিষয়ে না জেনেই কথা শোনায়। সব জায়গাতেই যেন মেয়েদের দোষ। আমার সংসার ভাঙায় নাকি আমার দোষ আবার কয়েকদিন ওই সমস্যাটার কারণে সাথে সাথে ছিল এটা দেখে সবাই ভাবছে হয়তো তার জন্যই আমি সংসার ভেঙে চলে এসেছি।”

” মানুষ তোকে মানসিকভাবে আ*ঘাত করলে প্রয়োজনে তুই শারীরিক আ*ঘাত করবি তবু ক্ষ*তবিক্ষ*ত হয়ে কাঁদবি না। মানুষ আঘা*ত করে সফল হলে চাহিদা আরও বেড়ে যায়, সফল হতে না দিলে চেষ্টা অবধিই চলে, আঘা*ত করে উঠতে পারে না। আঘা*তের পরিবর্তে আঘা*ত করবি চোখের পানি ফেলবি না। লোকে বলে না ব্যথার ওপর ব্যথা দিলে ব্যথা কমে যায়? তুই আঘা*ত পেলে পাল্টা আঘা*ত করে প্রতিপক্ষকে বুঝিয়ে দিবি তুই অবলা নারী না, তোকে চাইলেই ভেঙে গুড়িয়ে দেওয়া যায় না।”

” কিন্তু বাবা সবসময় নিজেকে শক্ত রাখা যায় না তো।”
” সবসমই শক্ত থাকতে হবে। কিছু সময় শক্ত আর কিছু সময় নরম হলে মানুষ সময় বুঝে আঘা*তটা করবে। সবসময় পাথরের মতো কঠিন থাকবি যেন যারা আঘা*ত করতে আসবে তারা নিজেরাই যেন আহ*ত হয়। তুই মানুষকে আর তাদের কথাকে যত গুরুত্ব দিবি তত বেশি আঘা*ত পাবি রে মা। ভালো থাকার জন্য নিজের মন যা বলে তাই করবি, তোর মন কখনো ভুল বলবে না ইন শা আল্লাহ। অন্যা*য়ের সাথে কখনো আপোষ করবি না। প্রথম আঘা*তেই বুঝিয়ে দিবি তুই সহ্য করার মেয়ে না।”

শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ৩৪

শুভ্রতা ওপর নিচ মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দেয়। এটাই তার বাবা, মন খারাপে যে মানুষটা সবসময় সঙ্গ দিয়েছে, আঘা*তে আঘা*তে ক্ষ*তবিক্ষ*ত হয়ে যাওয়ার পথে এভাবেই সাহস হয়ে দেখা দিয়েছে, দুঃখ নামক বৃষ্টির ফোঁটা পড়ার আগে ছাতা হয়ে দেখা দিয়েছে।

শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ৩৬