শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ৩৪

শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ৩৪
তানিয়া মাহি

শুভ্রতার ফোন বাজছে আর শুভ্রতা পাশে বসে আছে কিন্তু ফোন ধরছে না। এটা প্রথমবার না সকাল থেকে পনেরো থেকে বিশবার কল এসেছে। রিসিভ করলে কথা বলছে না। খুব অসহ্য লাগছে তার। দুই ঘণ্টা ফোন অফ রেখেও কাজ হয়নি।
শুভ্রতা ফোনটা রিসিভ করে চুপ করে থাকে। ওপাশ থেকেও কেউ কিছু বলছে না। কেউ কথা বলছে না দেখে শুভ্রতা আবার কল কেটে দেয়। ফোন রেখেই বাহিরে চলে যায় সে।
বাহিরে এসে বসতেই স্নিগ্ধা এসে আবার ফোন এনে তার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে, ” তোমার ফোন বাজছে আর তুমি বাহিরে এসে বসে আছো?”

” তোকে ফোন নিয়ে আসতে বলল কে?”
” ওমা, এখন ফোন এনে দিয়েও দোষ করলাম?”
” যা এখান থেকে প্লিজ। বাবা কোথায়?”
স্নিগ্ধা মনে করতে পারছে না বাবা কোথায়! সে বাবা- মায়ের রুমের দিকে এগিয়ে গিয়ে দেখে এসে বলে, ” বাবা হয়তো নিহান ভাইদের বাড়ি, আম্মুও বাসায় নেই।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

” ওখানে কেন?”
স্নিগ্ধা একবার ভাবে খুশির খবর কি এমনি এমনিই বলে দেবে! এত সহজভাবে জানিয়ে দেওয়া কি উচিৎ হবে যে তার জীবনে সত্যিকারের ভালোবাসা নির্বিঘ্নে চলে আসছে! সে মুখটা হালকা গম্ভীর করে বলে, ” তোমাদের বিয়ের দিন ঠিক করতে। ভাইয়া তো বলেছে যাওয়ার আগে তোমাকে বিয়ে করে রেখে যাবে।”
” কি!”
” হ্যাঁ তাই তো শুনলাম।”
” আচ্ছা তুই যা।”

স্নিগ্ধা চলে গেলে শুভ্রতা নিহানের নম্বরে কল দেয়। নিহান এসব করছে তাকে বলে নি কেন! রিং হচ্ছে এমন সময় সেই অচেনা নম্বর থেকে আবার কল আসে। নিহান কল রিসিভ করে বলে, ” আমি বাড়ির সামনেই আছি, কিছু বলবি?”
শুভ্রতা আর ফোনে কথা বাড়াতে চায় না। সে নিহানকে বাড়িতেই আসতে বলে দেয়। ফোনে কথা বলার চেয়ে সরাসরি কথা বলাটা হয়তো সবচেয়ে ভালো হবে। শুভ্রতা ফোন রেখে নিহানের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। নিহান কিছুক্ষণের মধ্যে চলে আসে। এসে দেখে শুভ্রতা এদিক থেকে ওদিক হাটাহাটি করছে। সে শুভ্রতার দিকে এগিয়ে যায়।

” কি হয়েছে?”
শুভ্রতা হাটাহাটি থামিয়ে দাঁড়িয়ে যায়। নিহান তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। শুভ্রতার জন্য আগে থেকে কোন কথা বলার জন্য তার নিহানের ওপর রাগ হওয়া দরকার কিন্তু রাগ হচ্ছে না। কেমন অনুভূতি হচ্ছে সে নিজেও জানে না।
সে নির্জীবকন্ঠে বলে, ” আমাদের বিয়ের তারিখ ঠিক হচ্ছে আর আমি জানি না কেন? যদিও আমি আপনাকে সেদিন বলেছিলাম আমি তাড়াতাড়ি বিয়ে করতে চাই কিন্তু সেটা মানুষের কথা থেকে বাঁচতে। আমার মনে হয় বিয়েটা এত জলদি করলে লোকে আরও নানারকম কথা বলবে। ”
নিহান বুঝতে পারছে না শুভ্রতা কি বলতে চাইছে। সে কি মত পাল্টে ফেলেছে! সে বলে, ” তুই মানুষের কথা কবে থেকে শুনতে শুরু করলি?”

” সমাজে থাকতে গেলে, একসাথে বাঁচতে গেলে শুনতে হয়।”
” কথা খারাপ লাগলে সেটার জবাবও দেয়া যায়। পৃথিবীর সবাই সবকিছু মুখবুজে সহ্য করে না শুভ্রা। তুই অনেক ভাগ্য করে জন্মেছিস, তোর ভাগ্য এত ভালো না হলে তোর বাবা এত ভালো হতো না। আবার এ বাড়ির মানুষকে দেখ, তোকে নিয়ে কেউ কোনদিক বাজে মন্তব্য করেনি। তারা তোকে বোঝে, এমন ভাগ্য কতজনের হয় বল তো!”
শুভ্রতা নিহানের কথা শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে ওঠে, ” আমি এটা মানি আমি খুব ভাগ্যবতী। আমি যাদের নিজের মানুষ বলে জানি তারা সবাই আমাকে ভালোবাসে, আর একজন তো সবকিছুর বিরুদ্ধে গিয়ে আমাকে পেতে চায়। তাকে আর অপেক্ষা করাতে চাই না আমি। ”

শুভ্রতা কিচ্ছুক্ষণ থেমে আবার বলে, ” আচ্ছা এক হওয়া যদি আমাদের ভাগ্যে না থাকে তবে?”
কথাটা শোনামাত্র নিহানের বুকের ভেতর কেমন একটা করে ওঠে। সম্ভবত চিনচিন ব্যথা অনুভূত হয়। যাকে পাওয়ার জন্য এত আয়োজন, এত ত্যাগ, এত অপেক্ষা আর সে কী না ভাগ্যে থাকবে না! নিহান বেশ অন্য মনস্ক হয়েই বলে, ” তুই আমার ভাগ্যে না থাকলেও মনে থাকবি। ভাগ্য আর মন দুটোই সৃষ্টিকর্তা বানিয়েছে। তিনি তোকে কোথায় রেখেছে আমি জানি না ভাগ্যে থাকলে আমি বুঝিয়ে দেব ভালোবাসা কাকে বলে! আর যদি ভাগ্যে না থাকিস তবুও মন থেকে সরাতে পারব না। ভালোবাসি আমি তোকে। তুই আমার ব্যক্তিগত মানুষ, তুই আমার শুভ্র ভালোবাসা।”

নিহান আর শুভ্রতার বিয়ের তারিখ ঠিক হয় আর সেটা একদিন পরই। যেহেতু হাতে বেশি সময় নেই তাই বেশি দেরিও করা উচিৎ হবে না বলে মনে করেছে সবাই।
শুভ্রতা ফাউজিয়াকে কল দিয়ে জানিয়ে দিয়েছে। তার একটাই কথা ফাউজিয়াকে এবার আসতেই হবে। অনুষ্ঠান যেহেতু হবে না তাই বাহিরের কেউ থাকবে না কিন্তু ফাউজিয়াকে আসতেই হবে তাও আবার আজকেই। ফাউজিয়া কল কেটে ধীরপায়ে মায়ের রুমের দিকে যাচ্ছে। মা কি যেতে দেবে সেটা ভাবছে।
ফাউজিয়া গিয়ে মায়ের পাশে বসে। তিনি বসে বসে গল্পের বই পড়ছিলেন। পাশে ফাউজিয়াকে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে বলেন, ” কি হয়েছে, কিছু বলবি?”

” মা চা খাবে? এক কাপ গরম গরম চা করে দিই?”
ফাউজিয়ার মা বইটা বন্ধ করে চশমাটা খুলে পাশে রেখে বলেন, ” চা গরমই হয় ফাউজিয়া। ”
ফাউজিয়া ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। সাহসের অভাবে কি উল্টাপাল্টা কথা বলছে সে! চা তো আসলেই গরম হয় এখানে আবার গরম গরম চা খাওয়ানোর অফার করার কি আছে!
” কি হলো কিছু বলছিস না কেন?”

” মা শুভ্রতার কালকের দিন পর বিয়ে। ও আমাকে আজকেই যেতে বলছে। আমি এখনো কিছু বলিনি, আমি ওকে বলেছি তোমাকে আগে বলব তারপর তুমি যেতে বললে আমি যাব তুমি যদি নিষেধ কর তাহলে আমি যেতে পারব না।”
” শুভ্রতা কে? ওই মাস চারেক আগে ডিভোর্স হলো ওই মেয়েটা? এখনই বিয়ে আবার? এবারের ছেলে ভালো তো? বাবা-মা দেখেশুনে বিয়ে দিচ্ছে তো? বিয়েতে এত তাড়াহুড়ো না করলেও পারত।”
” হ্যাঁ মা ওটাই। ছেলে ভালো, ওর কাজিন।”
” ওহ আচ্ছা। এখন যদি না যাস তাহলে ভাববে আমি নিষেধ করেছি তাই তো?”
” আসলে….”

” আজ যেতে হবে না কাল বিকেলে সাহিল দিয়ে আসবে। একা একা যেতে হবে না ওতদূর। রাস্তা তো আর কম না, ঘণ্টাখানেকের পথ। তুই একা কোথাও যাস না যেতেও হবে না। আর তাছাড়া বাড়িও তো চিনিস না।”
মায়ের কথা ফাউজিয়াকে বেশ অবাক করে দেয়। সাহিল শেখ কেন যাবে তার সাথে? সে বলেই বসে, ” আমার সাথে স্যার কেন যাবে মা?”

তার মা বেশ স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই বলে, ” কারণ খুব তাড়াতাড়ি তোমাদের বিয়ে হবে।”
মায়ের কথা শুনে যেন আকাশ থেকে পড়ল ফাউজিয়া। বিয়ে মানে! তাও আবার তার ভার্সিটির প্রফেসরের সাথে! এটা কীভাবে সম্ভব হতে পারে? সে তো স্যারকে শুধু স্যারের নজরেই দেখে তার মা এসব কি বলছে!
নিজেকে সামলে নিয়ে মাকে জিজ্ঞেস করে,” এসব কি বলছো মা? দুনিয়াতে কি ছেলের অভাব পড়েছে যে এখন নিজের স্যারকে বিয়ে করতে হবে? এসব ভুলেও মাথায় নিয়ে আসবে না। উনি আমার স্যার হয়, স্যার মানে স্যার। বাড়ি কাছাকাছি তাই হয়তো একটু যাতায়াত হয় তাও তোমার সূত্রে। তুমি খবরদার এসব ভাববে না।”

ফাউজিয়াকে চুপ করিয়ে দিয়ে বলে ওঠেন, ” আমি সাহিলকে তোমার জন্য ঠিক করেছি। সাহিলের মা-ও তোমাকে বেশ পছন্দ করেছে। ”
বিষয়টা ফাউজিয়ার মোটেও ভালো লাগে নি। সে সাহিলকে শিক্ষক হিসেবেই পছন্দ করে। সাহিলের সাথে বিয়ের ব্যাপারে কখনো মাথায় আসতে দেয় নি সে অথচ তার মা কি না! ফাউজিয়া কিছু না বলেই রুম থেকে বেরিয়ে যায় কারণ সাহিলের সাথে যেতে না চাইলে হয়তো শুভ্রতার বিয়েতেই তার যাওয়া হবে না।

রাত আটটা বাইকের তেল ফুরিয়ে যাওয়ায় বাইক থামিয়ে দাঁড়িয়ে আছে রায়হান আর শাকিরা। তারা মূলত শুভ্রতার বিয়ের জন্য আসছিল। বাইকে যতটুকু তেল ছিল রায়হান ভেবেছিল বাড়ি পৌঁছে যাবে কিন্তু বিপত্তি ঘটল কিছুদূর এসেই। শাকিরা আবদার করল সোজা রাস্তা দিয়ে নয় সে ভেতরের রাস্তা দিয়ে যাবে তাহলে অনেকক্ষণ একটু ঘুরাঘুরি হবে। রায়হান ভাবে ভেতর দিয়ে গিয়ে যেখানে তেল ওঠানো যায় ওই অবধি গেলেই হবে তাহলে আর অসুবিধা হবে না।

অথচ এখনো পাঁচ মিনিটের রাস্তা। পাঁচ মিনিট বাইক নিয়ে হেটে যেতে হবে। শাকিরাকে বলতেই শাকিরাও রাজি হয়ে যায়। শাকিরা বলে, ” চলো তো পাঁচ মিনিট লাগবে। ব্যাপার‍টা কিন্তু দারুণ! এই রাতে আমি আর তুমি হেটে যাব, আমাদের সাথে সাথে যাবে মাথার ওপরেই ওই চাঁদটা। আচ্ছা তুমি কি খেয়াল করে দেখেছ আমরা যেখানে যেখানে যাই চাঁদ ও সেখানেই যায়?”

” তুমি পাগল হলে? এই সময়ে তোমার এসব মাথায় আসছে? পাঁচ ছয় মিনিটের রাস্তা বাইক নিয়ে হেটে যেতে হবে এখন আমার।”
” এমন ভাব করছো যেন আমাকেও বাইকের ওপর বসিয়ে নিয়ে যেতে হচ্ছে তোমার। বাইক নিয়ে যাওয়া কোন ব্যাপারই না। চলো তাড়াতাড়ি, এখানে দাঁড়িয়ে থাকলে কিছুই হবে না।”

রায়হান আর শাকিরা দুজন হাটা শুরু করে। শাকিরা রায়হানের অবস্থা দেখে মুখ টিপে হাসছে। দুজন হাটছে প্রতি সেকেন্ডে রাস্তা কমছে মাথার ওপরের চাঁদটা তাদের সঙ্গ দিচ্ছে। যদিও শাকিরার বাড়ি ফেরার তাড়া আছে তবুও তার মন গেয়ে উঠতে চাইছে, ” এই পথ যদি না শেষ হয়, তবে কেমন হতো তুমি বলো তো। যদি পৃথিবীটা স্বপ্নের দেশ হয় তবে কেমন হতো তুমি বলো তো…….”

শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ৩৩

পরের পর্ব হয়তো আবার দুই একদিন পর পাবেন। ৬,৭,৮ তারিখ আমার পরিক্ষা। একদিনে দুইটা করে। ৯ তারিখ থেকে ইন শা আল্লাহ আবার রেগুলার পাবেন।

শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ৩৫