শেষ বিকেলে তুমি আমি সিজন ২ পর্ব ৪

শেষ বিকেলে তুমি আমি সিজন ২ পর্ব ৪
আলিশা

ঘরে ফিরলাম শূন্য হাতে। কাপড়গুলো হয়তো দুলে দুলে হয়রান হয়ে পরাজিত বাতাসের কাছে। আমি যেমন করে প্রতিনিয়ত পরাজিত হই স্মরণের কাছে। ধরা খেয়ে যাই কথার ভাজে। ভেজা শাড়িতে আমাকে অবলোকন করে ছোঁয়া ভীষণ অবাক হলো। অতঃপর আর কি! কৈফিয়ত চাইলো তার বাবার কাছে। এখন সামলাও মেয়েকে! আমি তো চলে গেলাম ওয়াশরুমে।

রাতে আবারও পড়ালেখা। দিনে ফের পড়ালেখা। এই ‘পড়ালেখার’ মধ্যেই ঘুরপাক খাচ্ছি। ভার্সিটিতে খুব একটা যাওয়া হচ্ছে না। স্মরণ ব্যাস্ত তার কর্ম নিয়ে। কখনো ব্যাবসার কাজে অফিসে। আবার কখনো কেইসের কাজে ঢাকা টু চট্টগ্রাম দৌড়ের মাঝে। বলেছিলাম
“এতো ঝুঁকির কাজ যেহেতু ছাড়লে হয় না? ”
সে অনেকটা গম্ভীর আর বেশ খানিকটা ভার কন্ঠে বলেছিল
” এটা শুধু আমার পেশা নয়। এটা আমার প্যাশন।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

ব্যাস! কিছুটা ভয় পেয়ে গেছিলাম। অতঃপর আর কিছু বলে ওঠার সাহস পাইনি। তবে মনে সর্বদা ভয় নিয়ে বসে থাকি। মোনাজাতে অর্ধেক কথা তাকে নিয়েই বলি।
দেখতে দেখতে পরীক্ষা চলে এলো। গাড়িতে করে দিয়ে আসে সে। হাজার ব্যাস্ততা ফেলে এসে যেন উল্কার বেগে আমাকে ভার্সিটি থেকে নিয়েও আসে। কি মিষ্টি বিষয় না? ভালোবাসার মানুষের এমন যত্নগুলো ভীষণ আকুল করে আমায়। আমার যে এক ঝাঁক বন্ধুগুলো আছে ওদের ভালোবাসা, আর স্মরণের ভালোবাসার কারণে এখন নিজেকে লাগে পরিপূর্ণ! বারংবার বলতে ইচ্ছে করে, জীবন সুন্দর। একটু কষ্ট করে কিছু সময় পার করলে নতুন এক অধ্যায় আসে জীবনে। কষ্টের পর আসে সুখ।

আজ খতম পরীক্ষা। আনন্দে আনন্দে যেন পরীক্ষাটাই ভালোভাবে দিতে পারলাম না। ক্যান্টিনে এসে প্রিয়া গলা ছেড়ে কথোপকথন শুরু করলো। নীলিমাও কম যায় না। শান্ত তো সর্বক্ষণই অশান্ত। সজীব ভীষণ চিন্তায় পরেছে। পাশ করতে পারবে তো? এতো এতো মুখের অভিব্যাক্তি আমি টেবিলে মাথা রেখে বন্ধ চোখে অনুভব করতে লাগালাম। কিছুসময় পর ওরা অফ হলো। ক্লান্ত হয়ে চুপচাপ বসে রইলো বিচ্ছিন্ন ভাবে। হঠাৎ একটা সুন্দর কন্ঠ কানে এসে ধাক্কা খেলো আমার। আগন্তুকের কন্ঠস্বর আমার চেনা।

— আপনি এখানে? কেন? কিছু হয়েছে?
প্রিয়ার উত্তেজিত কন্ঠস্বর। সামনে দাড়িয়ে অঙ্কন। আমি সোজা হয়ে বসলাম। ওরা সকলে কুশল বিনিময় করলো। শান্ত ঠাট্টার সুরে বলে উঠলো
— ডাক্তার সাহেব মে বি মন নিতে এসেছে। প্রিয়ার কাছে মন দিয়ে উনি পেশেন্টের ট্রিটমেন্ট করতে পারছে না।
অঙ্কনও কম গেলো না। ঠাট্টা-তামাশার চূড়ায় গিয়ে বলল

— পুরো বউটাই নিতে এসেছি। সুন্দরী অবুঝ বউ। কেউ তুলে নিয়ে গেলে তো আমার সর্বনাশ হয়ে যাবে।
হাসির রোল পরলো। সকলে একযোগে হাসলেও আমি পরলাম বেজায় অস্তিত্বতে। আমি খেয়াল করলাম অঙ্কন একবারের জন্যও তাকালো না আমার পানে। মিনিট পাঁচেক দাড়িয়েই গালগল্প করে প্রিয়াকে উঠালো। অতঃপর রওনা হলো দু’জনে কোনো এক গন্তব্যে। হাতে সাদা অ্যাপ্রন ঝুলছে। রোদে কুঁচকে আছে ভ্রু যুগল।

পাশে যেন রাঙা বউ তার রাগে গাল ফুলিয়ে কচ্ছপের মতো থপ থপ করে হাঁটছে। কোনো পাত্তা দিচ্ছে না অঙ্কন। প্রিয়া হাটায় পিছিয়ে পরলে অঙ্কন এক হাতে প্রিয়ার হাতটা ধরে পাশাপাশি দাড় করিয়ে দিয়ে চলতে শুরু করলো। তবে হাতটা ছাড়লো না। আমি অনিমেষ তাকিয়ে দেখলাম এই দৃশ্য। মনটা অনেক বেশি প্রশান্তি খুঁজে পেলো। ক্যাম্পাসের ঠা ঠা রোদ্দুরের মাঠে হঠাৎ অঙ্কন হাতের অ্যাপ্রোনটা প্রিয়ার মাথার ওপর দিয়ে বসলো। প্রিয়া রেগে গেলো ভীষণ। বোকা মেয়ে বুঝলো না তার প্রিয় তাকে রোদের তেজে পুড়তে দিতে রাজি নয়। সে তো রেগে অ্যাপ্রোন মাথা থেকে নামাতে চাইলো। তখনই আবার অঙ্কন প্রিয়ার দু’হাত তার এক হাতে বন্দি করে নিয়ে হাঁটা শুরু করলো।

গুমোট গরম, অলস দুপুর আর ঘুম ঘুম চোখ নিয়ে ড্রইং রুমে বসে ছোঁয়ার সাথে কার্টুন দেখছিলাম। এক ভাল্লুক আকৃতির অবয়ব এক হৃষ্টপুষ্ট কুকুরকে তাড়া করেছে। অনুভূতি শূন্য হয়ে তাকিয়ে দেখলাম। কি আছে এই কার্টুনে? কিছুই নেই। তবুও আমরা সবাই ছোট বেলায় এগুলোই দেখি। টিভির পর্দায় তাকিয়ে থাকার মুহুর্তে হঠাৎ আমার ফোন বেজে উঠলো। হাতে নিয়ে চোখ বুলাতেই দেখলাম ” ছোঁয়ার বাবা ” লেখাটা ফোনের স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করছে। কিছুটা অবাক হয়ে ফোন রিসিভ করলাম। সে তো সচরাচর আমাকে ফোন করে না?

— খেয়া? তুমি কি সন্ধের পর ছোয়াকে নিয়ে একটু তৈরি হয়ে থাকতে পারবে?
ফোন রিসিভ করতেই ওপাশ হতে স্মরণ প্রশ্ন ছুড়ে দিলো আমাকে। কন্ঠে তার জড়িমা। আমি থতমত খেয়ে গেলাম। হঠাৎ কেন তৈরি হওয়ার কথা?
— হ্যা পারবো।
— ওকে। সাতটায় তাহলে আমি বাসায় আসবো।
কথাটা বলেই স্মরণ ফোন কেটে দিলো। আমি যেন প্রশ্ন করার সুযোগ পেলাম না। কোথায় যাবো শোনা হলো না।

একটা ছোট কাজের আদেশ দেওয়া হলেও আমার বুক ধড়ফড় ধড়ফড় করে। যেন দিশা হারিয়ে ফেলি আমি। স্মরণ বলেছে তৈরি হয়ে থাকতে। কিন্তু আমি কি পরে তৈরি হবো? কিভাবে তৈরি হবো? আলমারি ভর্তি শাড়ির কোনটা হাতে নেবো? কল্পনা জল্পনার শেষ অন্ত সীমানা খুঁজে পাচ্ছি না। ছোঁয়াকে তৈরি করে দিয়েছি। অনেক খুঁজে কালো রঙের এক গাউন পরিয়ে পরি সাজিয়েছি। অতঃপর আমার তৈরি হওয়ার পালা। হঠাৎ ভাবলাম, মা মেয়ে একই রঙের পোষাক পরলে মন্দ হবে না নিশ্চয়ই! যেই ভাবা সেই কাজ। বিন্দুমাত্র সময় নষ্ট না করে তখনই আমার কালো রঙের শাড়িটা হাতে তুলে নিলাম।

আমরা মা মেয়ে তৈরি হয়ে ছিলাম সন্ধে ছয়টার দিকে। স্মরণ এলো সাড়ে ছয়টাতে। সে প্রথমেই এক নজর দেখে নিলো আমাদের। অতঃপর বিনাবাক্যে চলে গেলো আলমারির নিকট। যদিও সে ফিটফাট, গোছালো ছিলো। তবুও তৈরি হলো পুনরায়। কালো রঙের শার্ট, প্যান্টে। মাথার চুলগুলো পরিপাটি করতে করতে সে আমার উদ্দেশ্যে বলল
— গাড়িতে গিয়ে বসো।

ছোঁয়া কে নিয়ে হাঁটা শুরু করলাম। গাড়ি পার্ক করা ছিলো গেটের পাশে। জিজ্ঞাসু মন নিয়ে গাড়িতে উঠে বসলাম। স্মরণ এলো মিনিট পাচেক পর। ছোঁয়াকে কোলের রেখে ড্রাইভিং সিটের পাশে বসে তাকিয়ে ছিলাম অজানা দিকে। যখন গাড়ি কেঁপে উঠলো তখন যেন হুঁশ ফিরলো আমার। গাড়ি চলতে শুরু করেছে প্রশস্ত রাস্তায়। আমি মিহি সুরে বললাম
— কোথায় যাচ্ছি আমরা?
স্মরণ জবাব দিলো
— গেলেই দেখবে।

বাঁকা মতন জবাব তার। কিছুটা মনঃক্ষুণ্ন হয়ে গাড়ির কাঁচে দৃষ্টি ফেলে রাখলাম অবলীলায়। রাতের প্রহর শুরু হয়ে গেছে। রাস্তায় ল্যাম্পপোস্ট জ্বলে উঠেছে। ব্যাস্ত শরকে দৃষ্টি রাখার ভান করে আড়ালে তাকে দেখতে আমার ভালোই লাগছে।
গন্তব্যে পৌঁছাতে সময় লাগলো আনুমানিক আধঘন্টা। বিশাল অডিটোরিয়ামের সামনে এসে পথের সমাপ্তি ঘটলো। গাড়ি থেকে নেমে পরলাম স্মরণের সাথে। সাজসজ্জায় দারুণ ঔজ্জ্বল্য। অডিটোরিয়ামের মাঝে দেখা যায় অনেক পরিপাটি সাজসজ্জার মানুষ। অজানা কারণেই বুকের মাঝে ধুকপুক ধুকপুক শুরু হলো। কে যেন হঠাৎ এসে হ্যালো বলে হাত মেলালো স্মরণের সাথে। তারপর আমার দিকে তার দৃষ্টি পরলো। হাত বাড়িয়ে দিয়ে লোকটা বলল

— হায়! আপনি নিশ্চয়ই স্মরণের মিসেস?
আমি অস্বস্তিতে পরে গেলাম আচমকা। লোকটা করমর্দন করতে চাইছে। আমার কি ভদ্রতাসূচক হাত বাড়িয়ে দেওয়া উচিত? ভাবছিলাম ঠাঁই দাড়িয়ে। এমন সময় স্মরণ নিজে হাত বাড়িয়ে দিয়ে লোকটাকে ঘুরে নিলো সামনের দিকে। টেনে ধরেই যেন চলতে শুরু করল। খামোখা যেন জিজ্ঞেস করে বসল
— আপনার কেইসের খবর কি তন্ময় বাবু? কতদূর এগোলেন?

তন্ময় বাবু হতবিহ্বল হয়ে গেছেন। আমি মুখ টিপে হাসলাম। মনের মাঝে বয়ে গেলো ভালোলাগার এক অনুভূতি। ছোঁয়ার হাত ধরে সামনে এগিয়ে যেতে শুরু করলাম। এমন সময় হঠাৎ পাশ থেকে কেউ বলে উঠলো
— ছোঁয়া নাকি? কেমন আছো? ইনি কে?

প্রশ্ন করতে করতে লোকটা আমার পাশাপাশি হাঁটতে শুরু করলো। এবার আমার অস্বস্তির মাত্রাটা ততটা ছিলো না। তবে স্মরণ বেচারা বিদ্যুৎ গতিতে এসে আমার পাশ ঘেঁসে দাঁড়িয়ে গেলো। মুখে ধরে রাখলো হীম হীম অভিব্যাক্তি। আমার ঠোঁট জোরা আপনা আপনি প্রসারিত হলো। হাঁটতে লাগলাম মুখে মুচকি হাসি নিয়ে। আমার মাথায় এমন সময় খেলে গেলো দুষ্টু বুদ্ধি।

শেষ বিকেলে তুমি আমি সিজন ২ পর্ব ৩

স্বইচ্ছায় তার থেকে একটু সরে দাড়িয়ে হাঁটতে শুরু করলাম। সে পাশের লোকটার সাথে কথার মাঝে আমার কাছাকাছি এসে পথ চলে। তার এমন আচরণে আমি বিমোহিত। ভালো লেগেছে। ভালোবাসা বেড়ে গেছে। মন প্রাণ আজ বলছে আমার ফিরে আসা সার্থক। তার মতোন কাউকে ভালোবেসে আমি জিতে গেছি।

শেষ বিকেলে তুমি আমি সিজন ২ পর্ব ৫