শেষ বিকেলে তুমি আমি সিজন ২ পর্ব ৫

শেষ বিকেলে তুমি আমি সিজন ২ পর্ব ৫
আলিশা

অনুষ্ঠান শুরু হতে হতে ঘড়ির কাটা ছুটে চলে গেলো দশটার ঘরে। আলোয়, প্রভায় ঝলমল করছিল অডিটোরিয়াম। আমরা মা মেয়ে বসে ছিলাম একটা তিন চেয়ারের টেবিল দখল করে। স্মরণ ব্যাস্ত ছিল এলোথেলো কাজে। কখনো তার বসের পাশে বসে আলাপে মগ্ন। কখনো কলিগদের সাথে টুকটাক কথায় ডুবন্ত। এরমাঝে সে একবার এসেছিল আমাদের কাছে। হালকা সমাগমের পাল্লা সরিয়ে আমার সাথে তার কথোপকথন হলো। জানতে পারলাম এই অনুষ্ঠান সিনিয়র এক অফিসার কে নিয়ে। তার রিটার্নমেন্টকে কেন্দ্র করে। এমনি করে খালি মুখে বসে থাকতে গিয়ে একটা সময় কিছুটা বিরক্ত হলাম আমি আর ছোঁয়া। ছোঁয়া বলেই বসলো

— মা কিছুই তো খেতে দেয় না। এরা এমন পঁচা কেন। দেখে না একটা পিচ্চি মেয়ে বসে আছে। ক্ষুধা পেয়েছে তার।
আমি জিভ কেটে ছোঁয়াকে টেনে কোলে বসিয়ে নিলাম। ওর ছোট নাকটার ওপর ঈষৎ অত্যাচার করে টেনে বললাম
— এই বুড়ি, আস্তে বলো। কেউ শুনলে আমাদের পেটুক বলবে।
— বলুক। আমার তো ক্ষুধাই পেয়েছে।
— তোমাকে যে এখানে আসার আগে খাইয়ে দিতে চাইলাম খেলে না কেন? এখন বোঝো? মায়েদের কথা না শুনলে কেমন ক্ষুধা ক্ষুধা লাগে।
ছোঁয়া মুখ কুঁচকে রইলো। তার বাবার মতো একটা ক্ষুব্ধ ক্ষুব্ধ চাহনি আমাকে দেখিয়ে বসে রইলো আমার কোলে। আমি হাসলাম ওর কান্ডে।
— হেই ছোঁয়া? বেবি হাউ আর ইউ?

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

হাসি মুখে বসে ছোঁয়ার অভিমানের মাত্রা মাপিলাম। ঠিক এমন সময়ই আমার আশপাশ হতে ভেসে এলো তীব্র ন্যাকা সুরের ডাক। ডানে চাইলাম, বামে চাইলাম সামনে তাকালাম। উক্ত ন্যাকা সুরের মেয়েকে খুঁজে পেলাম না। অতঃপর আমরা মা মেয়ে উপরের দিকে চাইতেই চোখে ভেসে উঠলো কড়া লিপস্টিক দেওয়া ঠোঁট। ছোঁয়া আমাকে কোলে নড়েচড়ে বসে গম্ভীর কন্ঠে বলল

— আসসালামু আলাইকুম আন্টি। আমি এখন বড় হয়ে গেছি। বেবি বলবা না আমাকে। দেখো আমার একটা দাঁত পরেছে পরশুদিন। তাই আমি এখন বড়।
কাটাকাটা কথা ছোঁয়ার। কড়া লিপস্টিক দিয়ে নিজেকে অপ্সরা ভাবা মেয়েটা আমার পাশের ফাঁকা চেয়ারে বসে পরলো। হাতের পার্স টেবিলে রেখে টেনে নিলো খয়েরী রঙের শারির আঁচল। অতঃপর ছোঁয়ার দিকে নজর দিয়ে বলল

— এবাবা তাই তো? ছোঁয়া মণি না বড় হয়ে গেছে। কিন্তু তুমি তে পানি খেতে পারবে না ছোঁয়া।
কথা বলতে বলতে মেয়েটা ছোঁয়াকে নিজের কোলে টেনে নিলো। আমি কিছুটা হতভম্ব হলাম। সে যেন আমাকে পাত্তাই দিলো না। বেশ খনিকটা ইগনোর করার মতো ব্যাপার ঘটালো। ছোঁয়া কাচুমাচু হয়ে বসে রইলো মেয়েটার কোলে। আমার সময় কাটলো গোমড়া হয়ে। মুহূর্তেই ঝাঁকে ঝাঁকে বিরক্তি এসে মনে স্থান করে নিলো। ক্ষোভের আন্দোলন উঠলো অচেনা মেয়েটার নামে।

এই অহেতুক ক্ষোভের সময় সীমা রইলো পকরায় পনেরো মিনিট। খাবারের আয়োজন শুরু হলো। স্মরণ এলো টেবিলে। দ্রুত চলন শুরু হলো ওয়েটার মতোন কিছু ছেলে মেয়েদের। হাফ ছাড়লাম আমি। ভাবলাম এবার বুঝি মেয়েটা উঠবে। কিন্তু দূর্ভাগ্য আমার। মেয়েটা উঠলো না। বরং আসন পেতে নিলো আঁটসাঁট করে। অন্য টেবিল হতে চেয়ার ধার করে এনে পাশে বসলো স্মরণের। আমি রীতিমতো হা হয়ে গেলাম। স্মরণ বেশ স্বাভাবিক। সে সাবলীল ভাবে কথোপকথন শুরু করলো।

— হায় স্যার।
— আরে, তাহিয়্যাহ আপনি?
— হ্যা। কখন এসেছেন স্যার?
— আটটায়। আপনি কি এখন?

বেশ খেয়াল করলাম তাহিয়্যাহ মেয়েটা স্মরণের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে স্ট্রবেরি হয়ে যাচ্ছে। ভয়াবহ লজ্জায় চোখ যেন বুঁজে আসছে তার। আমার ভ্রু জোরা কুঁচকে গেলো। তৎক্ষনাৎ আমার স্ত্রী মন বুঝে গেলো সমস্যা আছে কোথাও। তাহিয়্যাহর থেকে সিন্থাইকারীর গন্ধ বেরোচ্ছে। আমি ভালোভাবে নজর দিলাম। ও যেন স্মরণের গা ঘেঁষে বসেছে। খাবারের প্লেটে অনবরত হাত ঘুরিয়ে যাচ্ছে। খেতে পারছে না যেন। কোণাকুণি দৃষ্টিতে বারংবার তাকাচ্ছে স্মারণের দিকে৷ আত্নাটা আমার ছ্যাৎ করে উঠলো। এই মেয়ে তো মহা বেয়াদব। ভয়ঙ্কর ছ্যাচড়া। আমার ভাবনার মাঝেই ন্যাকার ড্রামটা স্মরণ কে ন্যাকা সুরে বলে উঠলো

— স্যার, পানির বোতলটা একটু খুলে দেবেন?
মেজাজটা পুরোই হট হয়ে গেলো আমার। আমি বউ হয়ে কখনো এক গ্লাস পানি চাইনি তার কাছে। আর এই মেয়ে কিনা আস্ত বোতল তিন চার প্যাচ ছাড়িয়ে খুলে দেওয়ার কথা বলছে? আমি স্মরণের দিকে চাইলাম। বেশ গরম চোখে। স্মরণ আমারই পানে তাকিয়ে ছিলো অবলা এক চাহনি নিয়ে। ভালো লাগলো। বউকে তাহলে একটু আধটু ভয় পায়। আমি স্বইচ্ছায় হঠাৎই কাশতে শুরু করলাম। যে সে কাশি নয়। তোলপাড় করা কাশি। ভয়াবহ, দূর্বিষহ অবস্থা আমার এমন কাশি দিতে লাগলাম। দাপিয়ে ওঠার অভিনয় করে গলায় হাত দিলাম। স্মরণ তড়াক করে উঠে দাড়ালো। তড়িৎ গতিতে সে এসে হাজির আমার নিকট। চেয়ার টেনে এনে আমার গা ঘেঁসে বসে হাতে ধরিয়ে দিলো পানির বোতল। তাহিয়্যাহ গোমড়া হয়ে গেলো। কুটিল হাসলাম আমি। পানির বোতলে মুখ লাগিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম নিষ্পলক। চোখের দৃষ্টিতে বোঝাতে চাইলাম

” এই হ্যান্ডসাম আমার। নজর দিবা না একদম। তুমি কি মনে করেছো সে বউয়ের দুই নাম্বার আসন পূরণ করেছে, এখনো তো তিন আর চার নাম্বার আসন ফাঁকা। তাই তুমি এডমিশন নেওয়া চেষ্টা চালিয়ে যাবে? বেয়াদ্দপ। থাপড়িয়ে গাল লাল করে দেবো। এখানে সিট ফাঁকা থাকলেও ভর্তি নিষিদ্ধ। ”

এক বুক জ্বালাপোড়া তালাবদ্ধ রেখে মুখে শুকনো হাসি ঝুলিয়ে বসে থাকতে হলো আমার। খাবারের পর্ব শেষ হতেই স্মারণ কে আবারও যেতে হলো মিটিংয়ে উপস্থিত থাকার জন্য। নিজস্ব এক মিটিং হলো তাদের। কে জানে আবার কোন কেসের জটিলতা তাদের মাথায় এঁটে থাকবে। হুটহাট দিন দুনিয়া ভুলে ঘন্টাখানেকের জন্য রুদ্ধ দ্বারের ওপারে একা বসে রইবে। স্মরণ প্রায়ই এমন করে। গভীর রজনিতে আমার ঘুম পালিয়ে গেলে ছোঁয়াকে ডিঙিয়ে ওপাশে দৃষ্টি রাখলে দেখবো শূন্য বালিশ।

প্রথম যেদিন এমন দেখেছিলাম ভরকে গিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম প্রথম দিনের কথাগুলো। আবারও কি সে চলে গেছে অথৈয়ের কবরের নিকট? ভাবনা নিয়ে ঘর ছেড়ে বাইরে পা রাখতেই পাশের রুমের দীপ্ত আলোকচ্ছটা চোখে পরে। দরজায় করাঘাত করেছিলাম ভীতি লুকিয়ে। সে আলগোছে দরজা খুলেছিল। সেদিন ওঘরে প্রবেশ করেই হা করে তাকিয়ে গিলেছিলাম এলোমেলো দৃশ্য। সে কি হাট বসেছিল! খাতা, কলম, পেন্সিল, আর্ট পেপারের ছড়ানো ছেটানো বেহাল দশা। তার ইয়া বড় এক টেবিল। পুরোটা জুরে বিরাজ করছিলো শুধুই কলম, পেন্সিল, ডায়েরি আর আর্ট পেপার। সঙ্গে কিছু ইংলিশ বই।

— ছোঁয়া কি ঘুমিয়ে গেছে?
সে আমার কল্পনায় থাকা কালেই হুট করে বাস্তবে এসে হাজির। ভাবনা ছেড়ে প্রথমেই চাইলাম ছোঁয়ার মুখপানে। ঘুমে কপোকাত সে আমার কোলে।
— হুম।
— আমার কাছে দাও। তোমার কাশি কমেছে?
স্মরণ কাশির কথা তুলতেই আমার রাগ দপ করে জ্বলে উঠলো। ইচ্ছে হলো বেশ ত্যাড়া করে স্মারণের কথার জবাব দিতে। কিন্তু পারবো না আমি৷ এখনো তাকে ভয় পাই। তাই মনের রাগ দমে রেখে কেবল বললাম

— তাহিয়্যাআহহ কি আপনার কলিগ?
ছোঁয়াকে আমার কোল থেকে নিয়ে স্মরণ হাঁটছিলো সামনের পথে। সকলে বিদায় নিচ্ছে। আমারাও গাড়ির নিকট যাচ্ছিলাম। রাগ পুরোপুরি তো দমাতে পারলাম না। ছিটেফোঁটা উঁকি দিয়েই বসলো। স্মারণ আমার মুখপানে ভ্রু কুঁচকে তাকালো একবার। চলতি দশাতেই বলল
— কারো নাম বিকৃত করতে নেই। ভালো করে উচ্চারণ করো। নাকি উচ্চারণের নিয়ম আবার শেখাতে হবে?
আমি তার পিঠ পিছে চলতে চলতে চোখ উল্টিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করলাম তার ওপর। অতঃপর আবারও ভদ্র সুরে বললাম

— বললেন না?
সে সেকেন্ড খানেক পর জবাব দিলো
— হুম। একই টিমে কাজ করা হয়৷
আমি অভিব্যাক্তি প্রকাশ করলাম লম্বা সুর ‘ওহ’ বলে। তারপর আবারও শুধালাম

শেষ বিকেলে তুমি আমি সিজন ২ পর্ব ৪

— সে কি জানে আমি আপনার দূরসম্পর্কের বউ? নাকি তাকেও বলেছেন আমি আপনার দুঃসম্পর্কের বো…..
— খেয়া….
চাপা গর্জন ছুড়ে দেওয়া হলো আমার দিকে। আমি এবার ভয় না পেলেও চুপ হলাম। পাশ দিয়ে হেঁটে আসছিলো এক ভাবি। ভাবির স্বামী আমার স্বামী কে কি যেন শুধালো। অতঃপর বাঁধা পরলো আমার ঝগড়াতে।

শেষ বিকেলে তুমি আমি সিজন ২ পর্ব ৬