শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ৫

শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ৫
তানিয়া মাহি

শুভ্রতা অন্ধকারে ছাদে একপাশে বসে চোখের পানি ফেলছে। পুরুষ মানুষের ভালোবাসা নাকি ভয়ং*কর হয়! ইমতিয়াজের এই ভালোবাসা হয়তো আসলেই ভয়ং*কর ছিল। সে সব দুঃখ বুকে চেপে গুণগুণ করে গেয়ে ওঠে…..

ওরা মনের গোপন চেনেনা,
ওরা হৃদয়ের রং জানেনা।
প্রজাপতি ডানা ছুলো বিবাহ বাসরে,
কেন সারা রাত জেগে বাড়ি ফিরি ভোরে!!
ওরা মনের গোপন চেনে না,
ওরা হৃদয়ের রং জানে না।
তুমি চিরদিন ভীষণ কঠিন
তোমার ঘর ভেসে যায় ওরা মুখ দেখে বুঝতে পারেনা।
তুমি চিরদিন ভীষণ কঠিন
তোমার ঘর ভেসে যায় ওরা মুখ দেখে বুঝতে পারেনা।
ওরা এ মন কেমন বোঝে না
ওরা আসল কারণ বোঝেনা।
তুমি চিরকাল স্বপ্নে মাতাল
খেটে সারা জীবন ধরে ঝড় বৃষ্টি মাথায় করে।
তুমি চিরকাল স্বপ্নে মাতাল
খেতে সারা জীবন ধরে ঝড় বৃষ্টি মাথায় করে।
ওরা মনের গোপন চেনে না,
ওরা হৃদয়ের রং জানে না।
প্রজাপতি ডানা ছুলো বিবাহ বাসরে
কেন সারা রাত জেগে বাড়ি ফিরি ভোরে….
ওরা মনের গোপন চেনে না
ওরা হৃদয়ের রং জানেনা।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

কান্না করছে আর বারবার চোখ মুছছে শুভ্রতা। আকাশের দিকে তাকিয়ে সব কষ্টগুলো বাতাসের সাথে সবটা উড়িয়ে দিতে হবে তার। কেউ যদি তাকে ছাড়া ভালো থাকে তাহলে সে কেন পারবে না!
হঠাৎ সিঁড়ি দিয়ে ছাদের দিকে উঠে আসার পায়ের শব্দ শোনা যায়। শুভ্রতা তাড়াহুড়ো করে চোখের পানি মুছে স্বাভাবিক হওয়ার বৃথা চেষ্টা করে।

শুভ্রতা পিছনে তাকিয়ে দেখে তার বাবা ফোনে লাইট জ্বা*লিয়ে তার দিকেই আসছে। গালে গড়িয়ে পড়া চোখের বাকি পানিটুকু মুছে নেয় সন্তর্পণে। শাহাদাত সাহেব এসে মেয়ের পাশে বসেন। তিনি জানেন শুভ্রতা একা একা এখানে বসে কান্না করছিল। রায়হান নিজেই তাকে পাঠিয়েছে এখানে। তিনি শুভ্রতার কষ্টটা একটু হালকা করার জন্য এসেছেন কারণ বাবা যদি মিশুক হয় তাহলে একটা মেয়ের সবচেয়ে কাছের বন্ধুটি হয় তার বাবা। তিনি গলায় হালকা আওয়াজ করে বলেন,

” কি ব্যাপার এখানে কি করা হচ্ছে শুনি? একা একা আমার মা আকাশ দেখছে আর আমাকে ডাকে নি?”
শুভ্রতা চুপচাপ আছে,মুখে কোন কথা নেই। সে জানে তার বাবা বুঝেছে যে তার মন খারাপ। কারণ বাড়ির সবাই জানে শুভ্রতার মন খারাপ হলে সে একা একা ছাদে বসে আকাশ দেখে আর কান্না করে। এসবের মাঝে তার বাবা যদি জানতে পারে শুভ্রতার মন খারাপ তাহলে তিনি মেয়ের মন ভালো করতে কতকিছু যে করে তার কোন ইয়ত্তা/পরিসীমা নেই। শুভ্রতা অভিমানী গলায় বলে ওঠে,

” বাবা আজই আমার মন খারাপের শেষ দিন। কাল থেকে আমার জীবনের চৌকাঠে মন খারাপ বা কষ্ট এসে টোকা দেবে না। আমি আজ তোমায় বলব না যে বাবা আমার মন খারাপ, মন ভালো করে দাও। আজ আমি অনেক কান্না করব আর তারপর সবকিছু ভুলে যাব। তুমি আমার মন ভালো করে দিও না এখন, আমার এই মন খারাপ আজ আমাকে উপভোগ করতে দাও। ”

মেয়ের কথা শুনে আশ্চর্য হন শাহাদাত সাহেব। মেয়ে কি না মন খারাপ উপভোগ করবে! এটা কোন কথা? তিনি মুখে রাগীভাব নিয়ে এসে কিছু বলবেন ঠিক তখনই শুভ্রতা আবার বলে ওঠে,
” বাবা, আমার বিয়ের সময় তুমি জানতে যে ইমতিয়াজ আমার জন্য ঠিক না?”

শাহাদাত সাহেব কি বলবেন কিছু বুঝতে পারছেন না। তিনি জানতেন যে ইমতিয়াজ সেই সময়ের কিছু বছর আগেও নে*শা করত। কেউ বলেছিল তারপর বাদ দিয়ে দিয়েছিল। শুধুমাত্র মেয়ের কথা ভেবে তিনি মেয়েকে বিয়ে দিতে রাজি হয়েছিলেন। তাছাড়া চারপাশের পরিবেশ খুব খারাপ ছিল। কমবয়সী ছেলেমেয়ে সম্পর্কে জড়াবে বিয়ে করতে চাইবে বাড়ি থেকে রাজি না হলেই একটার পর আরেকটা আত্ম*হ*ত্মা। মেয়েকে একেবারে হারিয়ে ফেলার ভয়েই তিনি রাজি হয়েছিলেন। শাহাদাত সাহেবের নিরবতা কা*টাতে শুভ্রতা আবার বলে ওঠে,

” কি হলো বাবা?”
শাহাদাত সাহেব এবার বলেন, ” হ্যাঁ জানতাম।”
” তাহলে আমার বিয়ে কেন দিয়েছিলে? তুমি একটু জোর করে রাজি না হলেই বিয়েটা হতো না।”
” হ্যাঁ এটা সত্যি যে আমি এককথায় রাজি হয়ে গিয়েছিলাম। না হয়েও তো উপায় ছিল না যদি তার সাথে বিয়ে না দেওয়াতে তুই সুইসা*ইড করতি তাহলে আমার আর তোর মায়ের কি হতো বল তো?”

” আমি কোনদিন ওসব করতাম না। ও নিজেই তো সুইসা*ইডের ভয় দেখিয়েছিল যে আমি যদি বিয়ে না করি তাহলে আমাকে ছাড়া বাঁচবে না।”
” ওসব ছেলেমানুষী। যা হওয়ার তা হয়ে গেছে, এখন ওসব অতীত। অতীত থেকে বেরিয়ে আয় মা। আমার সেই তিনবছর আগের মেয়েটাকে ফিরে পেতে চাই, দিবি?”
শুভ্রতা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকেই বাবার কাধে মাথা রেখে বলে ওঠে, ” হ্যাঁ কাল সকাল থেকেই পাবে। এখন যাও আমি আধাঘন্টা পর নিচে আসছি।”

শাহাদাত সাহেব এবার মেয়েকে মজার ছলে বলেন,
” আবার কি কান্না করতে হবে তোর?”
” বাবা…….”
” আচ্ছা আচ্ছা যাচ্ছি। আর শোন মা তোর মায়ের কাছে টাকা রাখা আছে সকালে গিয়ে তোর ক্লাশের বই খাতা যা লাগে কিনে আনবি আর একটা ফোন কিনবি। প্রয়োজনে ফোন কেনার সময় আমাকে কল দিবি আমি এসে কিনে দেব। এই সপ্তাহের মাঝে ক্লাশ শুরু করবি।”

” হ্যাঁ বাবা এখন আমি আমার ক্যারিয়ারে ফোকাস করব।”
” এই না হলে আমার মেয়ে! আচ্ছা আমি যাই তুই আধাঘণ্টার মধ্যে নিচে চলে আসবি কিন্তু আর অবশ্যই তিনবছর আগের শুভ্রতা হয়ে যার মাঝে কোন নিরবতা থাকবে না।”
” ঠিক আছে মনে থাকবে। এবার যাও।”

শাহাদাত সাহেব মেয়েকে একা কিছু সময় কাটানোর জন্য রেখে নিচে চলে যান। শুভ্রতা আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। কেন যেন তার আর কান্না করতে ইচ্ছে করছে না। মানুষটাকে আর পেতে ইচ্ছে করছে না। তার সাথে থাকতেই তো প্রতিদিন নামাজে বসে আল্লাহর কাছে চাইতো, ইমতিয়াজ যেন ভালো একটা মানুষ হয়ে যায় আর নইলে যেন এই মানুষটার সাথে তার আর থাকতে না হয়। সৃষ্টিকর্তা তার দোয়া কবুল করে নিয়েছে।

প্রায় সপ্তাহখানেক ধরে শুভ্রতা ক্লাস করা শুরু করেছে। শাকিরা আর শুভ্রতা দুজন একই ডিপার্টমেন্টে, একইসাথে পড়াশোনা করে। শাকিরা খুব একটা ভালো স্টুডেন্ট না হওয়ায় শুভ্রতা খুব একটা সুবিধা করতে পারছে না। আগের ক্লাশগুলোর নোট দরকার ছিল যা শাকিরার কাছে নেই। ক্লাসের আরেকটা মেয়ে ফাউজিয়া সে ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট। যার যা প্রয়োজন সবকিছু সেই মেয়ের কাছেই পায় সবাই।

ফাউজিয়া মেয়েটা একদমই মিশুক না, কেউ তার সাথে কথা বললে সেও বলে কিন্তু নিজে থেকে কথা এগোতে পারে না কিন্তু শুভ্রতা পুরোই উল্টো। সে খুব সহজেই কাউকে বন্ধু বানিয়ে নিতে পারে। শাকিরা যেহেতু বাসায় একা একা তেমন পড়াশোনা করে না তাই সে ব্যাচে পড়ে। সব বন্ধুরা মিলে পড়ে আর আড্ডা দেয়। শুভ্রতা আবার এর বিপরীত। অনেকের মাঝে পড়াশোনা হয়ে ওঠে না।

শুভ্রতার আজ ক্লাসে যেতে দেরি হয়ে গেছে। হয়তো এতক্ষণে ক্লাশ শুরুও হয়ে গেছে। টানা পায়ে দোতলায় উঠে যায় সে। গত দুইদিন সে ক্লাশ করতে পারে নি। বাসায় তার নানাবাড়ি থেকে আত্মীয় এসেছিল। মায়ের সাথে কাজ করতে হয়েছে সবাইকে সময় দিতে হয়েছে।

ক্লাশের দরজায় দাঁড়াতেই দেখে ডিপার্টমেন্টের হেড দাঁড়িয়ে আছে পাশেই একজন লোক। লোক বলা যায় না বয়স হয়তো ত্রিশ হবে, লোক বলা যেতেও পারে। ক্লাশ টিচার হিসেবে তো অন্যকারো থাকার কথা ছিল। ভেতরে যাওয়ার অনুমতি চাইবে কি না সেটা ভাবছে শুভ্রতা। এমন সময় স্যার নিজেই তাকে ভেতরে যেতে বলে। কোণার সারিতে তৃতীয় বেঞ্চে বসে আছে ফাউজিয়া একা, কালো হিজাব আর মাস্ক পরে। সে ভালো ছাত্রী হওয়ায় কেউ তার আশেপাশে কেমন ঘেষতে চায় না। যারা নিয়মিত ক্লাসে আসে তাদেরও অন্যকোন উদ্দেশ্য থাকে।শুভ্রতা গিয়ে ফাউজিয়ার পাশে বসে। হালকা ধাক্কা দিয়ে জানতে চায় স্যারের পাশে দাঁড়িয়ে আছে ওটা কে!

” নতুন স্যার” জবাবটা দিয়ে ফাউজিয়া ইশারায় মনোযোগী হতে বলে নিজেও সামনের দিকে তাকায়।
শুভ্রতা আগ্রহ দমাতে না পেরে বলে ওঠে, ” ইনি আমাদের টিচার!”
ফাউজিয়া সেদিকে তাকিয়েই বলে, ” হ্যাঁ ইনি।”
” স্যার কিন্তু দেখতে মাশাআল্লাহ।”
” থামবি তুই! চুপচাপ কথা শোন।”

শুভ্রতা আর কিছু বলে না। চারপাশে একটু তাকিয়ে দেখে মেয়েগুলো স্যারকে দেখছে আর কি সব বলাবলি করছে ফিসফিস করে। হয়তো কমবয়সী স্যারকে সবার মনে ধরেছে।
ডিপার্টমেন্টের হেড ক্লাশ থেকে চলে গেলেন। এবার নিশ্চয়ই পরিচয় পর্ব শুরু হবে তার জন্য সবাই অপেক্ষা করছে। যদিও স্যার নতুন স্যারের পরিচয় দিয়ে গেলেন তবুও নতুন স্যার সবার উদ্দেশ্যে বললেন,

” আমি সাহিল শেখ, আপনাদের ক্লাশ টিচার আজ থেকে আমিই। আমি আমার পড়া শেষ করেই এখানে জয়েন করেছি। আশা করছি আপনারা সবাই আমাকে ক্লাশে সহযোগিতা করবেন। আজ যেহেতু আমি আপনাদের কাছে নতুন আর আপনারাও আমার কাছে নতুন তাই আজ আমরা সবাই পরিচিত হয়ে নেব। আমি তো আমার পরিচয় দিয়েই দিলাম এবার আপনারা আপনাদের পরিচয় দিবেন। আমার বিষয়ে আর কোন প্রশ্ন আছে আপনাদের?”

শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ৪

ক্লাশের লাস্ট বেঞ্চ থেকে একটা ছেলে প্রশ্ন করল, ” স্যার আপনি কি ম্যারিড? না মানে আমার আশেপাশের মেয়েগুলোর এই একটাই প্রশ্ন কিন্তু প্রশ্নটা করতে কেউ সাহস পাচ্ছে না। যদি বলতেন তাহলে সবার উপকার হতো।
” না, আমি অবিবাহিত। আর কোন প্রশ্ন?”
সবাই একযোগে মাথা ঝাঁকিয়ে না বলল। সাহিল শেখ এবার একে একে সবার পরিচয় নেওয়া শুরু করলেন।

শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ৬