শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ৪৩

শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ৪৩
তানিয়া মাহি

নিহান বাড়ি থেকে বের হতেই ইরার সাথে দেখা হয়ে যায়। নিহানদের বাড়ির পাশেই ইরাদের বাসা। মাঝেমাঝে গ্রামে আসলে তাদের বাড়িতে থাকে। এতরাতে বাড়ির বাহিরে একটা মেয়ের দাঁড়িয়ে থাকার বিষয়টা কেউই ভালো চোখে দেখবে না। ইরাকে দেখে নিহান এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করে, ” এতরাতে তুই এখানে কেন? এটা গ্রাম, শহর না। বাহিরে কী কাজ তোর?”

” বাসায় নেট পাচ্ছিল না, ট্রেনের টিকিট কা*টতে বাহিরে এসেছি।”
” কালকে কাটা যেত না? এতরাতে বাহিরে থাকা মোটেও ভালো দেখায় না ইরা। ভেতরে যা এখনই।”
” কাজ হয়ে গেছে প্রায়। আমার কথা বাদ দেন, আপনি নতুন বউকে রেখে বাহিরে কেন?”
” বউকে খুশি রাখার ব্যবস্থা করতেই এসেছি।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

” যদি আপনার বউ হতে পারতাম! আপনার বউ হলে নিশ্চয়ই আমাকেও খুশি করতে অনেককিছু করতেন?”
” থাপ্পড় খাবি ইরা। বেশি পেকে গেছিস তুই। ”
” মজা করলাম। কালকে এই বাড়ি আর আপনাদের জীবন থেকে একেবারে বিদায় হব।”
কথাটা বলেই ইরা বাড়ির মধ্যে চলে গেল। নিহান রাগান্বিত চোখে চেয়ে রইল৷ এই মেয়ে বড্ড বাড় বেড়েছে, যখন তখন যা-তা বলে ফেলছে।
নিহান সেখানে আর দেরি না করে রাস্তার দিকে এগিয়ে যায়।

পরদিন বিকেল চারটা, শুভ্রতা রান্নাঘরে নিহানের জন্য কিছু একটা রান্না করছে। বাসার সবাই নিজেদের রুমেই আছে। শুভ্রতার মুখে হাসি নেই। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই নিহান তার গন্তব্যের দিকে অগ্রসর হবে।
নিহান রান্নাঘরে ঢুকে বলল,” তোর হলো? একটু রুমে আসবি না?”
কড়াইয়ে কিছু নাড়তে নাড়তে বলল, ” আপনি যান, আমি দুই মিনিটের মধ্যে আসছি।”
” আমি কিন্তু রেডি, একটু আগেই যেতে হবে। ট্রেনের আসার কোন ঠিকঠিকানা নাই যখন তখন চলে আসতে পারে।”
” এই যে আমার হয়ে গেছে, আপনি যান আমি এক্ষুণি আসছি।”
” কিন্তু করছিস টা কি?”

নিহান শুভ্রতার দিকে এগিয়ে গিয়ে কড়াইয়ে শুকিয়ে কালো বানিয়ে ফেলা মাংস দেখে বলে ওঠে,” কালাভুনা!”
শুভ্রতা চুলা বন্ধ করে নিহানের জন্য প্লেটে রুটি আর মাংস বেড়ে নিতে নিতে বলে, ” আমি তো ওটা রান্না করতে পারি না, কীভাবে রান্না করে সেটাও জানি না তাই ভাবলাম এরকম করে দেই, এটাও বেশ ভালো লাগে।”
” দেখেই লোভ জাগছে, রুমে নিয়ে আয়। আমি যাচ্ছি তাহলে।”
নিহান রান্নাঘর থেকে চলে গেলে শুভ্রতাও রান্নাঘরের সবকিছু গুছিয়ে রেখে খাবারের প্লেটটা নিয়ে রুমের দিকে চলে যায়।

নিহান শক্ত করে শুভ্রতাকে জড়িয়ে ধরে আছে। শুভ্রতা সকাল থেকে মন খারাপ করে ছিল। যদিও নিহানের সামনে তাকে দেখাতে হাসিহাসি মুখ করে থেকেছে তবে নিহান বেশ বুঝতে পেরেছিল শুভ্রতার মন খারাপ। রাতের মতো পছন্দের উপহার দিয়ে শুভ্রতার মন আর ভালো করতে চায় নি নিহান। নিহানের প্রস্থান উপলক্ষে শুভ্রতার মন খারাপ তাকে স্বস্তি দিয়েছে। নিহান বুঝতে পেরেছে সে তার প্রিয় মানুষের মনে জায়গায় করে নিতে পেরেছে। সেই জায়গাটা দখল করে নিয়েছে যে জায়গার মানুষের উপস্থিতি মানুষকে আনন্দ দেয় আর অনুপস্থিতি দেয় বিরহ। অতঃপর নিহান ও তার প্রিয় মানুষের প্রিয় হতে শুরু করেছে। সম্পর্কে জোর না করে সময় দিলেই সেটা সুন্দর একটা আকার ধারণ করে।

শুভ্রতা নিহানের বুক থেকে মাথা তুলতেই নিহান বলে, ” বাহিরে সবাই অপেক্ষা করে শুভ্রা, আমাদের যেতে হবে তো নাকি?”
শুভ্রতা হালকা নাক টেনে জবাব দেয়, ” হুম।”
” চোখে পানি কেন শুনি?”
” আমার না কেমন খালি খালি লাগছে। আপনি চলে গেলে আমি এই বাড়িতে থাকতে পারব না আমি আমাদের বাড়ি গিয়ে থাকব।”

” যেখানে ইচ্ছে সেখানে থেকো, শুধু মানুষটা আমার নামে থাকলেই চলবে।”
” অন্যকারো হওয়ার সুযোগ আছে নাকি এখনো?”
” খু*ন করে ফেলব।”
” কি? কাকে?”
” তোকে।”
” পারবেন?”
” অন্যকারো হয়ে দেখ, বুঝতে পারবি আমি কতটা ভয়ং*কর। ”
” আপনার কথা খুব মনে পড়বে।”

নিহান আবার শুভ্রতাকে নিজের বুকে টেনে নেয়। দুইদিনেই এত ভালোবাসা! এত ভালোবাসা কপালে সহ্য হবে তো! নিহান এটা ভেবে খুশি হয় যে মন থেকে চাইলে আর মানুষটা সঠিক হলে হয়তো সবকিছু পূর্ণতা পায়। নিহান ভাবতে পারেনি শুভ্রতার মনে এত তাড়াতাড়ি এত ভালোবাসা সৃষ্টি হবে। গ্রীষ্মকালে কাঠফাটা রোদে কয়েকফোঁটা বৃষ্টি যেমন পরিবেশে শীতলতা ছড়ায় নিহান বুঝতে পারে শুভ্রতার ব্যাপারটাও ঠিক ওই কয়েক ফোঁটা বৃষ্টির মতো।

শুভ্রতাকে একহাতে জড়িয়ে রেখে অন্য হাত দিয়ে শুভ্রতার মাথা হাত বুলাতে বুলাতে বলে, ” আমি খুব তাড়াতাড়ি চলে আসব শুভ্রা, খুব তাড়াতাড়ি চলে আসব। যখন আসব তখন তোকে নিয়ে যাব। এতগুলো বছর তোকে ছেড়ে থাকা সম্ভব হলে এই দুইমাস আমার কাছে দুই যুগ মনে হবে। আমি খুব তাড়াতাড়ি এসে তোকে আমার কাছে নিয়ে যাব দেখিস।”
চোখের পানি মুছে শুভ্রতা নিহানের সাথে নিচে আসে। বাড়ির সবাই তাদের জন্য অপেক্ষা করছিল। নিহান শুভ্রতাকে একপাশে বাহু ধরে আলিঙ্গন করেই সিড়ি দিয়ে নিচে নামছিল। শুভ্রতা নিচে অনেক মানুষকে দেখে নিজেকে নিহানের থেকে ছাড়িয়ে নেয়। নিহান দাঁড়িয়ে যায়, ” কি হলো।”

” কিছু না।”
” ছাড়িয়ে নিলি যে?”
” নিচে বড়রা সবাই আছে তো।”
” তাতে কি হয়েছে? আমি কি অন্যকাউকে ধরেছি নাকি? আমি নিজের নামে করে নেওয়া বউকে জড়িয়ে ধরেছিলাম।”
শুভ্রতা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল ” আমাদের সম্পর্ক আমাদের মধ্যেই মিষ্টতায় থাকুক, কারো নজর লাগিয়ে এই সম্পর্কে তিক্ততা আনতে চাই না।”
” ভালোবাসি শুভ্রা।”

শুভ্রতার পা থেমে যায়। নিহানের এই দুটি শব্দ তার হৃৎস্পন্দনের সাথে শরীর আর পায়ের গতিও যেন থামিয়ে দিয়েছে। ট্রাফিক সিগন্যালে রেডলাইট জ্ব*লে উঠলে যেমন সব যানবাহন একসাথে থেমে যায় শুভ্রতাও ঠিক সেভাবেই থেমে নিহানের দিকে তাকিয়ে থাকে। নিহান শুভ্রতাকে দেখে মুচকি হেসে নিজেই নিচের দিকে চলে আসতে থাকলে শুভ্রতা নিজের কান্ড বুঝতে পেরে নিজেউ নিজের মাথায় একটা বারি দিয়ে নিজেও চলে আসে।

নিহানের মায়ের সাথে সাথে শুভ্রতার মাও এটা ওটা বানিয়ে নিহানের জন্য ব্যাগ ভর্তি করে রেখেছে। সবাই বসে কথাবার্তা বলছিল। ইরা, ইরার বাবা-মাও আছে। তারা সবাইকে জানায় তারাও রাতের ট্রেনে ঢাকা ফিরে যাবে৷ আবিরা, নেহা আর স্নিগ্ধা পাশে দাঁড়িয়ে কোন একটা বিষয় নিয়ে কথা বলছে। রাবেয়া বেগম আর শুভ্রতার মা আয়েশা বেগম এক সোফায় পাশাপাশি বসে আছে, ইরার মা-বাবার সাথে কথা বলছে।

ইরা এগিয়ে গিয়ে তিন চাচাতো বোনের সাথে যোগ দেয়। শুভ্রতার বাবা গাড়ি ডেকে নিয়ে আসলে নিহান বসা থেকে দাঁড়িয়ে যায়। আমজাদ, শাহাদাত সাহেব আর নিহান মিলে ব্যাগগুলো বাহিরে নিয়ে গিয়ে গাড়িতে রাখে। সবাই বাহিরে এসে গাড়ির কাছে দাঁড়িয়েছে নিহান খেয়াল করে শুভ্রতা টলমল চোখে তার দিকে এক পলকে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ সে প্যান্টের পকেটে হাত দিয়ে কিছু একটা খুঁজে শুভ্রতাকে বলে, ” আমি হয়তো ওয়ালেটটা আনতে ভুলে গেছি, নিয়ে আসবি একটু?”

শুভ্রতা হ্যাঁসূচক মাথা ঝাঁকিয়ে বাড়ির মধ্যে চলে যায়। দুই, তিনমিনিট চলে গেলেও শুভ্রতাকে ফিরতে না দেখে নিহান নিজেই ওয়ালেটের কথা বলে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে। রুমে গিয়ে দেখে শুভ্রতা এখানে ওখানে ওয়ালেট খুঁজছে। নিহান শুভ্রতাকে ডাকতেই শুভ্রতা দরজার দিকে তাকিয়ে বলে, ” কোথায় রেখেছেন ওয়ালেট? আমি পাচ্ছি না কিছুতেই।”
” ওটা আমার কাছেই আছে। তুই আরেকবার আমার বুকে আসবি? গাড়িতে উঠে খুব খারাপ লাগছিল, মনে হচ্ছিল আরেকটাবার তোকে কাছে টেনে নিই।”

শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ৪২

শুভ্রতা মুহুর্তের মধ্যে দৌড়ে গিয়ে নিহানের বুকে মাথা রাখে। নিহানও পরম যত্নে শুভ্রতাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। শুভ্রতাকে জড়িয়ে রেখেই বলে, ” রাতে যে চুড়ি জোড়া দিলাম ওটা সবসময় পরে থাকবি। চুড়ি জোড়া আমার খুব পছন্দের, দুই বছর লেগেছিল টাকা জমিয়ে ওটা বানাতে। রাতে আমার এক বন্ধু ওটা দিয়ে গিয়েছে। ও দিতে চেয়েছিল না রাতে ওর আসতে কষ্ট হবে ভেবে। আমি অনেক রিকুয়েষ্ট করে ওটা আনিয়েছি ওকে দিয়ে। সবসময় এটা সঙ্গে রাখবি আমার চিহ্ন হিসেবে নয় আমার ভালোবাসার অংশ এটা।”

শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ৪৪