শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ৪৪

শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ৪৪
তানিয়া মাহি

দেখতে দেখতে কে*টে গিয়েছে বেশ কয়েকটা মাস। নিহান যদিও বলেছিল শুভ্রতাকে দুই মাস পর এসে নিয়ে যাবে কিন্তু বাড়ির সবার সিদ্ধান্তের কাছে নিজের সিদ্ধান্ত দমিয়ে রাখতে হয়েছিল তার। নিহান চলে যাওয়ার পরের সময়গুলো শুভ্রতাকে পড়াশোনায় খরচ করতে হয়েছে বেশি । ইনকোর্সের পরেই টেস্ট আর তারপরে তিনমাস পরেই ফাইনাল পরিক্ষা।

শুভ্রতার যাওয়ার ব্যাপারে ঘোর আপত্তি জানিয়েছিল শুভ্রতার বাবা শাহাদাত সাহেব। তিনি জানিয়েছিলেন মেয়ের ফাইনাল পরিক্ষার পরই মেয়েকে পাঠাবেন নিহানের কাছে। মেয়েকে নিয়ে তার অনেক স্বপ্ন। ছোটমেয়েটা ডিটেকটিভ হবে, ডিটেকটিভ হবে করে সারাক্ষণ চিল্লায়। বাবার ইচ্ছে দুইটা মেয়েই তাদের স্বপ্ন পূরণ করুক। শুভ্রতার অনেকদিনের ইচ্ছে আইন নিয়ে পড়াশোনা করে ভালো কিছু করার বাবার মতো। বাবা যেমন ন্যায়ের জন্য লড়াই করেন, ঠিক তেমন বাবার মতো ভালো কিছু করার ইচ্ছে তার।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

শুভ্রতার ফাইনাল পরিক্ষার শেষ দিন। শাকিরাকে অনেক আগেই রায়হান এসে নিয়ে গিয়েছে। শুভ্রতা, শাকিরা আর ফাউজিয়ার একসাথে আজকে ঘুরাঘুরির কথা ছিল। রায়হানের এদিকে কাজ থাকায় শাকিরাকে নিতে এসেছিল রায়হান।
শাকিরাকে বিদায় দিয়ে শুভ্রতা আর শাকিরা হাতের ডানদিকের রাস্তায় রওয়ানা দেয়। ওখানে নতুন রেস্টুরেন্ট হয়েছে। বন্ধুদের কাছে ভালো রিভিউও পেয়েছে তারা। পরিক্ষা ছাড়া ফাউজিয়া আর শুভ্রতার অনেকদিন দেখা হয় না।

পরিক্ষার মাঝে তেমন ছুটি না থাকায় তারা কোথাও বের ও হতে পারে নি। তাই দুজনে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল পরিক্ষার শেষের দিন অনেক ঘুরবে। রাস্তার পাশের মাঠটাতে আইসক্রিম দেখেই দুজন সেদিকে গিয়ে দাঁড়ায়।
দুজন দাঁড়িয়ে আইসক্রিম খাচ্ছিল এমন সময় শুভ্রতার নাম ধরে কেউ ডাকতেই পিছনে ফিরে তাকায়।

” আপনি!”
“তোমার সাথে কিছু কথা আছে আমার শুভ্রতা। আমি অনেক ভেবে তোমার কাছে এসেছি। ”
” আপনার সাথে আমার কোন কথা নেই। শেষ হয়ে যাওয়া অধ্যায়ে নতুন কোন শব্দ সংযোজন করতে চাই না আমি।”
” প্লিজ শুভ্রতা, পাঁচটা মিনিট সময় দাও আমাকে। ”
” আপনি এখান থেকে না গেলে আমি এক্ষুনি নিহানকে কল দিব ইমতিয়াজ! ”

শুভ্রতার মুখে ইমতিয়াজ নাম শুনেই লোকটা মাথা থেকে পা অবধি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে নেয় ফাউজিয়া। এই লোকটা ইমতিয়াজ! এই লোকটাই শুভ্রতার সাথে ছেড়ে যাওয়ার মতো অন্যা*য়টা করেছিল! কিন্তু শুভ্রতা তো এখন তাকে ছাড়াই ভালো আছে তাহলে এখন কেন এসেছে সে? ভালো থাকাকে খারাপ থাকায় পরিণত করতে!

ইমতিয়াজ আরও কিছুক্ষণ কথা বলার চেষ্টা করল কিন্তু পারল না৷ শুভ্রতা আইসক্রিমের বিল দিয়ে ফাউজিয়াকে নিয়ে হাটা ধরল। ফাউজিয়া হতবিহ্বল হয়ে একবার শুভ্রতাকে দেখছে আর একবার ইমতিয়াজকে। শুভ্রতার মুখে মেঘ জমেছে, নিকষ কালো মেঘ। ফাউজিয়া অনুভব করতে পারল শুভ্রতা কি পরিমাণ কষ্ট সহ্য করেছে আড়াই, তিনবছর! ফাউজিয়া শুভ্রতার থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে পিছনে ইমতিয়াজের দিকে যেতে থাকলে শুভ্রতা সেদিকে তাকিয়ে থাকে।

” এই যে আপনি, এর আগেও আমি আপনাকে ডিপার্টমেন্টের আশেপাশে দেখেছি তখনই সন্দেহজনক লেগেছিল, আর কখনো যদি আপনাকে শুভ্রতার আশেপাশে দেখেছি তাহলে একদম হাত-পা ভেঙে রাস্তায় ফেলে রাখব বলে দিলাম। তিন তিনটা বছর মেয়েটাকে কষ্টে রেখেছিলেন, যেই না দেখেছেন মেয়েটা একটু ভালো আছে আর ওমনি চলে এসেছেন গন্ডগোল পাকাতে তাই না? মেয়েদের অতি সভ্য ভাববেন না। সময়মত ধ্বং*স করে দিতে দুইবার ভাববো না বলে দিলাম। ”

কথাগুলো এক নাগাড়ে বলে ইমতিয়াজের সামনে থেকে চলে যেতে থাকে ফাউজিয়া। শুভ্রতার কাছে গিয়ে তার হাত ধরতেই দুজন এগুতে থাকে। ইমতিয়াজ ফাউজিয়ার কথায় পাত্তা না দিয়ে শুভ্রতাকে আবার ডেকে বলে, ” প্লিজ শুভ্রতা একটাবার আমার কথা শুনো। অনেক কথা বলার আছে তোমাকে।”

অক্টোবর মাস শেষের দিকে,তৃতীয় সপ্তাহ চলছে। বাড়িতে সকাল থেকে রান্নাবান্নার কাজ চলছে। আয়েশা বেগম এবং রাবেয়া বেগম একের পর এক পদ রান্না করেই যাচ্ছে। স্নিগ্ধা আর নেহা দুজন ড্রয়িংরুম থেকে শুরু করে সবগুলো রুম বারান্দা পরিস্কার করছে বাড়ির দুজন কাজের মহিলার সাথে। বাড়ি পরিস্কারের কাজ শেষ করে মায়েদের সাথে রান্নাঘরে সাহায্য করছে। নিহানের বাবা আমির সাহেব বসে কারো সাথে ফোনে কথা বলছিলেন। তিনি এসেছেন বেশ কিছুদিন হয়েছে। তিনি আসার পর মেয়ের বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন তাই আজ অভীকের বাড়ি থেকে সবাই এখানে আসবে।

অন্যদিকে শুভ্রতা আবিরাকে রেডি করতে ব্যস্ত। বিছানায় শুভ্রতার সবগুলো শাড়ি ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা হয়েছে। আবিরা কিছুতেই শাড়ি সিলেক্ট করতে পারছে না। শুভ্রতা নিজেও কিছু বলছে না কারণ সে চাইছে আবিরা নিজেই শাড়ি পছন্দ করুক। শাড়ি নাড়াচাড়া করে অনেকটা সময় পেরিয়ে গিয়েছে। শুভ্রতা বুঝতে পারল আবিরার ওপর এই বিষয়টা ছেড়ে দিলে তার আর শাড়ি পছন্দ করা হবে না তাই সে গাঢ় খয়েরী রঙের শাড়ি আবিরাকে পরার কথা বলল। বিছানায় রাখা সবগুলো শাড়ি অত্যাধিক সুন্দর হওয়ায় সে দোটানায় পড়ে গিয়েছিল। যাক শেষ পর্যন্ত একটা শাড়ি সিলেক্ট করা গেল এটা ভেবেই সে শান্ত হলো।

শাড়ি পরানো শুরু হলে দরজার বাহিরে নক করার শব্দ শোনা যায়। আবিরার শাড়ির কুচিগুলো ঠিক করেই শুভ্রতা গিয়ে দরজাটা খুলে দেয়। নেহা আর স্নিগ্ধা বাহিরে দাঁড়িয়ে আছে। স্নিগ্ধা ভেতরে একটা উঁকি দিয়েই বলল, ” আপু, উনারা সবাই চলে এসেছে। আপুকে নিয়ে যেতে বলেছে।”
” আচ্ছা তোরা যা আমি আপুকে নিয়ে পাঁচ মিনিটের মধ্যে আসছি। অভীক ভাইয়াও এসেছে?”
” কে? বর! হ্যাঁ এসেছে তো। দারুণ দেখতে।”
” হয়েছে হয়েছে এখন যা।”

নেহা আর স্নিগ্ধাকে তাড়িয়ে দিয়ে শুভ্রতা আবিরার বাকি সাজটুকু শেষ করে। আবিরাকে অভীকের বাড়ির সবার সামনে নিয়ে যাওয়া হলে অভীকের মা ইশারায় আবিরাকে ডেকে পাশে বসান। পাশের সোফায় অভীক এবং বন্ধু সিয়াম বসে আছে।
নানারকম কথা আর আলাপ আলোচনা চলতে থাকে। সবাই তাকে নির্দ্বিধায় পছন্দ করে নেয়। অভীকের মা নিজের আঙুল থেকে পছন্দের রিংটাও খুলে আবিরাকে পরিয়ে দেয়। অভীকের বাবা এবং আবিরার বাবার কথামতো নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে বিয়ে ঠিক হয়।

খাওয়া দাওয়া শেষ করে সবাই বসে গল্প করছে এমন সময় সিয়াম অভীককে ইশারা করে জানায় সে ওয়াশরুমে যাবে। অভীক কাউকে জিজ্ঞেস করতে বললে সিয়াম শুভ্রতার দিকে তাকিয়ে ইশারা করতেই শুভ্রতা এগিয়ে আসে।
” জি ভাইয়া?”
” ভাবি, ওয়াশরুমটা……”

” আচ্ছা আচ্ছা দাঁড়ান আমি কাউকে সাথে পাঠিয়ে দিচ্ছি। এই নেহা…..” নেহাকে ডাকতেই নেহা এগিয়ে আসলে সিয়ামের ব্যাপারটা জানায়। সিয়ামের ওয়াশরুমের কথা শুনে ফিক করে হেসে ফেলে। শুভ্রতা মুখ বেজার করে বলে, ” একদম হাসবি না, যা ওয়াশরুম দেখিয়ে দে। ”
নেহা হাসতে হাসতেই সিয়ামকে বলে, ” আসুন আমার সাথে।”

সিয়াম উঠে নেহার পিছুপিছু যেতে থাকে। ওয়াশরুমের কাছাকাছি গেলে নেহা বলে, ” আমি কি চলে যাব? আপনি একা আসতে পারবেন তো তাই না?”
সিয়াম সে কথার উত্তর না দিয়ে বলে, ” এলার্জির কোন ওষুধ হবে কি বাসায়? ওষুধ হলে খুব উপকার হতো।”
নেহা সিয়ামের মুখের দিকে খেয়াল করে দেখে সিয়ামকে দেখতে অন্যরকম লাগছে। নেহা এগিয়ে গিয়ে বলে, ” আপনার কি খুব খারাপ লাগছে?

সিয়াম দেয়াল ধরে দাঁড়ায়, নিজের ভর সহ্য করে দাঁড়িয়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছিল তার। জোরে জোরে শ্বাস নিতে নিতে বলে , ” আসলে আমার চিংড়ি মাছে এলার্জি, মাঝে ওষুধ খেয়ে ঠিক হয়ে গিয়েছিল। এখন হয়তো আবার সমস্যাটা হচ্ছে।”
” আমি কাউকে ডাকব? আপনার কি খুব খারাপ লাগছে?”
” না, কাউকে জানাব না জন্যই এখানে আসলাম। আপনি শুধু দেখুন এলার্জির ওষুধ দিতে পারবেন কি না। কাউকে জানানোর প্রয়োজন নেই।”

শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ৪৩

” আচ্ছা আপনি আমার হাত ধরুন, সামনের রুমটায় একটু বসুন আমি ওষুধ এনে দিচ্ছি।”
নেহা হাত বাড়িয়ে দিতেই সিয়াম নেহার হাত ধরে নেয়। নেহা সিয়ামকে নিয়ে পাশের রুমটায় বসিয়ে দেয়। তাড়াহুড়ো করে নিজের রুমে গিয়ে ওষুধের কৌটায় ওষুধ খুঁজে না পেয়ে দৌঁড়ে মায়ের রুমে যায়।
মায়ের রুমে ওষুধের কৌটায় ওষুধ পেয়ে নেহার মুখে হাসি ফুটে যায়। সিয়ামের কাছে যাওয়ার সময় ওষুধ আর ফ্রিজ থেকে পানির বোতলটা নিয়ে যায়।

শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ৪৫