শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ৪৬

শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ৪৬
তানিয়া মাহি

নেহা আবিরার আশেপাশে ঘুরছে অনেকক্ষণ হলো। বাড়ির সবাই কাজে ব্যস্ত থাকলেও বিয়ের কনে রূপচর্চার কাজে মনোনিবেশ করেছে। নেহার এমন ঘুরাঘুরি করা দেখে আবিরা বলে ওঠে, ” কিছু বলবি? এমন পায়চারি করছিস কেন?”
” আপু কাল বরপক্ষ কখন আসবে?”
” বিকেলের দিকে হয়তো, কেন?”
” না এমনি।”

নেহা আর কোন কথা না বলে রুম থেকে বেরিয়ে আসে। জোরে জোরে ধাপ ফেলে নিজের রুমে চলে যায়। বিছানায় বসে ভাবছে এই সময়ে রেস্টুরেন্টে যাওয়া ঠিক হবে কি না? ফোনটা নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে বান্ধবীর কথা মনে পড়ে, যার বাড়ি সিয়ামের রেস্টুরেন্টের আশেপাশেই। নেহা তাড়াতাড়ি নম্বরটা বের করে কল দেয়। ওপাশের মানুষটা কল রিসিভ করে না।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

নেহা ফোনটা বিছানার ওপর প্রান্তে ছুড়ে ফেলে। কোন একটা মানুষের সাথে যোগাযোগ করার সকল উপায় অবলম্বন করার পরও যদি তাকে কোনভাবে পাওয়া না যায় তখন কোনকিছু ভালো লাগে না। নেহা আবিরাদের সাথে বিয়ের শপিং শেষ করে বাসায় আসার পর থেকে সিয়ামের সাথে যোগাযোগ করার জন্য উতলা হয়ে আছে। দিনকে দিন কথা বলার আগ্রহটা কেমন বেড়ে চলেছে।

সেদিন রেস্টুরেন্টে বসে যখন তিনজন কথা বলছিল তখন অভীক এসে আবিরার পাশে বসে। সিয়াম সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলে, ” কি খাবেন বলেন, আজ আমার পক্ষ থেকে ট্রিট। ”
নেহা বলে ওঠে, ” আপনি কীসের ট্রিট দিবেন?”
সিয়াম মুচকি হেসে নেহার দিকে তাকিয়ে বলে, ” আমার বন্ধু বিয়ে করতে যাচ্ছে, সেই উপলক্ষেই দিচ্ছি ভেবে নিন।”
সিয়াম আর কোন কথা না বলে ওয়েটারকে ডাকে। ওয়েটার এসে সবার অর্ডার নিয়ে চলে যাওয়ার সময় জানিয়ে যায় বিশ মিনিট লাগবে খাবার রেডি হতে।

ওয়েটার যেতেই নেহা বলে ওঠে,” আপু, পাশেই দেখলাম কসমেটিকসের দোকান। আমি গিয়ে দেখে আসি যে রঙের লিপস্টিক খুঁজছি সেটা আছে কি না?”
আবিরার আগেই অভীক বলে ওঠে,” সেটা তো রোড ক্রস করে যেতে হবে ওপাশে, এপশে দোকান নেই। খাওয়া দাওয়া করেই যাওয়া যেত সবাই মিলে।”

” সামান্য একটা লিপস্টিকের জন্য আপনাদের আর যেতে হবে না আমিই গিয়ে দেখে আসছি। ”
আবিরা সম্মতি দিলে নেহা চেয়ার ছেড়ে উঠে ব্যাগটা নিয়ে বেরিয়ে যায়। রাস্তার পাশ দিয়ে কিছুক্ষণ হেটে রাস্তা পার হওয়ার জন্য পা বাড়াতেই কেউ এসে খপ করে নেহার হাত ধরে ফেলে। নেহা পিছনে তাকাতেই দেখে সিয়াম।

” আপনি?”
” দুইপাশে গাড়ি দেখে পার হবেন না? আসুন আমার সাথে।”
সিয়াম হাত ধরে নেহাকে রাস্তার এপাশে নিয়ে আসে। নেহা বলে,” আপনি আসতে গেলেন কেন?”
” আপনার মতো পথচারীকে রাস্তা পার করে দিতে।”
“আমি রাস্তা পার হতে পারি। ঠিক চলে আসতাম, আপনি শুধু শুধু…”

” সেদিনের জন্য ধন্যবাদ নেহা। সৃষ্টিকর্তা আমাকে সাহায্য করার জন্য আপনাকে অন্তত না পাঠালে কি যে হতো!”
নেহা আর সিয়াম পাশাপাশি হাটতে হাটতে কথা বলতে থাকে। এক পর্যায়ে সিয়াম নিজের কার্ডটা নেহাকে দেয়, কোন প্রয়োজন হলে তাকে কল দিতে বলে। নেহা কার্ডটা নিয়ে হাসিমুখে নিজের ব্যাগে রাখে।
নেহা সেদিন শপিং করে এসে খুব ক্লান্ত থাকায় বাসায় আর না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়ে৷ পরদিন সিয়ামের কথা মনে হতেই কল করার জন্য ব্যাগে রাখা কার্ডটা খোঁজে কিন্তু কিছুতেই পায় না। নেহার মনটা যেন কালোমেঘে ঢেকে যায়৷ নেহা ভাবতে থাকে তাহলে কি ওটা কোনভাবে ব্যাগ থেকে পড়ে গেল?

শুভ্রতা ছাদে বসে ছিল। অন্ধকার রাত, আকাশে দুই একটা তারা জ্বলজ্বল করছে। শুভ্রতা ছাদের রেলিংয়ে হেলান দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিল। এশার নামাজটা আদায় করে ভালো লাগছিল না বিধায় ছাদে এসে দাঁড়িয়েছে সে। হঠাৎ চিলেকোঠার দরজায় শব্দ হতেই শুভ্রতা সেদিকে তাকায়। স্নিগ্ধা তার দিকেই এগিয়ে আসছে দেখে আগের মতোই দাঁড়িয়ে থাকে শুভ্রতা।

” আপু তোর মন খারাপ? ভাইয়া আসতে পারবে না তাই এখানে মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে আছিস?”
শুভ্রতা কোন কথা বলে না। যেভাবে দাঁড়িয়ে ছিল সেভাবেই দাঁড়িয়ে থাকে। স্নিগ্ধা বুঝে যায় শুভ্রতার মন ভীষণ খারাপ। স্নিগ্ধাও শুভ্রতার পাশে রেলিংয়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে বলে, ” আম্মু তোর জন্য পায়েস পাঠিয়েছিল। তোকে দিতে এসে দেখি বিছানার ওপর ফোন বাজছে। স্ক্রিনে বড় বড় অক্ষরে লেখে ” জামাইজান”

শুভ্রতা চোখ বড় বড় করে বলে, ” আমার ফোনে এই নামে কারো নম্বর সেভ করা নেই একদম উল্টাপাল্টা কথা বলবি না। ”
” তুই এই নামে নম্বর সেভ করতে ভুল করেছিস জন্য কি আমি বলতে ভুল করব? তোর বর তোকে ফোনের ওপর ফোন দিয়েই যাচ্ছে আর তুই ছাদে দাঁড়িয়ে দুঃখবিলাস করছিস! কাল বিয়ে আর তুই এখানে এভাবে থাকলে আবিরা আপু, বড়আম্মু মন খারাপ করবে না? আর ওদিকে নেহার কথা আর কি বলব! যা তাড়াতাড়ি বরকে বাঁচা আগে। ”

শুভ্রতা আর কোন কথা না বলে দৌঁড়ে নিচে চলে আসে। নিজের রুমে ঢুকে দেখে তখনও ফোন বাজছে। শুভ্রতা তাড়াতাড়ি করে কলটা রিসিভ করলে ওপাশ থেকে নিহান বলে ওঠে, ” আমি কখন থেকে কল দিচ্ছি, কি করছিলি তুই?”
শুভ্রতা নীরবস্বরে বলে, ” ভালো লাগছিল না তাই ছাদে দাঁড়িয়ে ছিলাম৷ স্নিগ্ধা বলল ফোন বাজছে তাই দৌঁড়ে আসলাম। আপনি কি আসছেন?”

” না, আমার আসা হবে না সেটা জানাতেই কল দিলাম তোকে। বাড়ির সবাই কি করছে?”
” আপনার আসা হবে না?”
” না।”
শেষ পর্যন্ত যে আশা বুকে জিইয়ে রেখেছিল শুভ্রতা সেটাও শেষ হয়ে গেল। ছাদ থেকে রুমে আসা পর্যন্ত তার মনে হয়েছিল নিহান তাকে বলবে, ” শুভ্রতা আমি বাসায় ফিরছি, তুই মন খারাপ করে থাকিস না। ” কিন্তু তা আর হলো না। শুভ্রতাকে চুপচাপ থাকতে দেখে নিহান আবার বলে ওঠে, ” কি হলো চুপ করে আছিস কেন?”

” আপনার জানা উচিৎ আপনাকে কেউ ভালোবাসে, আপনার জানা উচিৎ আপনার অনুপস্থিতি কাউকে আকাশসম দুঃখ দেয়, আপনার জানা উচিৎ আপনার অনুপস্থিতিতে কোন আনন্দঘন উৎসবমুখর পরিবেশটাও বিষাদে ছেয়ে যায়।”
” কি করব বল? আমার হাতে যে কিছুই নেই।”
” আপনি তো বড় অফিসার হয়েছেন, তবু নিজের প্রয়োজনে বাড়ি আসতে পারবেন না? কি লাভ হলো তাহলে মেজর হয়ে?”
শুভ্রতা আর নিহানের আরও কিছুক্ষণ কথা চলে। কথার মাঝে নেহা এসে দরজায় নক দিয়ে বলে, ” কথা শেষ করে একটু আমার রুমে এসো প্লিজ একটু দরকার আছে। ” শুভ্রতা মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি জানাতেই নেহা সেখান থেকে চলে যায়। শুভ্রতাও নিহানের সাথে কথা শেষ করে রুম থেকে বের হয়।

সকাল সকাল সিয়াম এসে অভীকের পিছনে ঘুরঘুর করছে নেহার নম্বরের জন্য। অভীক যেন কোনভাবেই সিয়ামকে পাত্তা দিচ্ছে না। সিয়াম অভীকের ফোনটা কোনভাবে নিয়ে নিলেও সে অভীকের ফোনের লক খুলতে পারছে না। অভীক বসে হো হো করে হাসছে আর বলছে, ” আমি যখন আবিরার প্রেমে পড়েছিলাম তখন তো খুব মজা করেছিলি। কত কথা বলেছিলি আর আজ নিজের দিকে তাকিয়ে দেখ একবার।”
সিয়াম ফোনটা আবার অভীকের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে, ” লাগবে না নম্বর, আমি নিজেই নেব আজ তোর শালিকার কাছে থেকে।”

” যদি নেহার বয়ফ্রেন্ড থাকে তাহলে? অনার্সে পড়া মেয়েকে তুই সিঙ্গেল পাবি?”
” ওর চালচলন কথাবার্তায় আমার মনে হয়েছে নেহার প্রেমিক নেই।”
” দোয়া করি শালিকা যেন একা না থাকে।”
সিয়াম ভ্রু কুচকে অভীকের দিকে তাকিয়ে বলে, ” বন্ধু হয়ে শ*ত্রুর মতো দোয়া করতে লজ্জা করছে না তোর? ”
” একদম লজ্জা করছে না, লজ্জা করারও কথা না। ”
অভীকের কথা শুনে অসহায়ের মতো তার দিকে তাকিয়ে থাকে সিয়াম। অভীকের হাসি দেখে সিয়ামের একটা কথাই মাথায় আসছে, ” হাতি কাদায় পড়লে চামচিকাতেও লা*থি মা*রে।”

সকাল সকাল আবিরা নেহা আর স্নিগ্ধাকে নিয়ে পার্লারে গিয়েছে। শুভ্রতাকে অনেকবার যেতে বলায়ও সে যায় নি। শুভ্রতা নিজের মন খারাপ কিছুতেই কাটিয়ে উঠতে পারছে না। সবার সাথে হাসিখুশি মুখে কথা বললেও মন থেকে কালো মেঘ কিছুতেই সরছে না।

শুভ্রতা বাড়ির বড়দের সাথে রান্নাঘরে কাজ করছিল। প্রায় দুপুর হয়ে যাচ্ছে দেখে রাবেয়া বেগম শুভ্রতাকে রেডি হতে ঠেলেঠুলে পাঠিয়ে দেয়। শুভ্রতাও আর দেরি না করে রুমে চলে যায়। ঘড়িতে একটা বাজতে চলেছে অর্থাৎ পার্লার থেকে সবাই খুব তাড়াতাড়ি চলে আসবে। শুভ্রতা তাড়াতাড়ি তোয়ালে আর আপাতত পরার মতো কিছু নিয়ে ওয়াশরুমে চলে যায়। গোসল শেষ করে মাথা মুছতে মুছতে রুমে এসে দেখে রুম ভেতর থেকে লক করা।

শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ৪৫

শুভ্রতার যতটুকু মনে পড়ে সে দরজা খোলা রেখেছিল। দরজার দিকে এগিয়ে যেতেই টেবিলে রাখা ফোনটা বেজে ওঠে। শুভ্রতার পা থেমে যায়। সামনের দিকে না এগিয়ে এবার টেবিলের কাছে গিয়ে ফোনটা হাতে নিতেই পিছন থেকে কেউ এসে তার কোমর চেপে ধরে। শুভ্রতা চিৎকার দিতেই উক্ত ব্যক্তি কোমর ছেড়ে সামনে এসে শুভ্রতার সামনে দাঁড়ায়।
শুভ্রতা বলে ওঠে, ” ক কে আ আপনি?”

শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ৪৭