শেষ বিকেলে তুমি আমি সিজন ২ পর্ব ৭

শেষ বিকেলে তুমি আমি সিজন ২ পর্ব ৭
আলিশা

— তুই কি জানিস দোস্ত?
কোল্ড কফির মগে মাত্র চুমুক দিতে যাচ্ছিলাম ঠিক এমন সময়ই ম*রা, প্রাণহীন, অত্যন্ত দুঃখে ভরা কন্ঠ হতে ধ্বনিত হলো উক্ত প্রশ্ন। আমি কপাল কুঁচকে চাইলাম। হালকা শোরগোলে মত্ত ক্যান্টিনের মাঝ বরাবর একটা ছয় চেয়ারের টেবিলে অবস্থান আমাদের পাঁচ জনের গড়ে ওঠা দোস্তি মহল।

প্রায় দশদিন পর আজ সকলের দেখা। এলামই আজ আমরা৷ গুমোট গরম বা অলস দিনের ছোঁয়াতে নড়তে, খেতে, গাইতে মোট কথা কিছুই করতে ভালো লাগে না। সকলে চেয়ারে ঠেস দিয়ে বসে দিক বিদিক দৃষ্টি ছোটাছুটি করছিলাম। প্রিয়া কফির মগ মুখের ঠিক সামনে রেখে টেবিলে ওপর হয়ে মাথা ঠেকিয়ে শুয়ে পরেছে। অতঃপর কিনা কি ভাবতে ভাবতে আমার দিকে ছুড়ে দিয়েছে এই প্রশ্ন।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

— কি দোস্ত?
ঠোঁট উল্টিয়ে আমি পাল্টা প্রশ্ন করলাম। শান্ত ফোন ঘাটতে ব্যাস্ত ছিলো। প্রিয়ার প্রশ্নে আড় চোখে তাকালো এদিকে। প্রিয়া হঠাৎ উৎফুল্ল মনা হয়ে উঠলো। কল্পনায় ডুবে গিয়ে ঠোঁটে হাসি টেনে বললো
— বড় হওয়ার পরও না কোলে ওঠার একটা অপশন থাকে জানিস? হাসবেন্ডরা কোলে নেয়। কোলে নিয়ে পৃথিবী ভ্রমণ করানোর মতো মহত কাজটা করতে পারে। কিন্তু দোস্ত?

আবারও মনের গভীর হতে ডেকে উঠলো প্রিয়া। আমি মোটামুটি কোমায় ছিলাম। এই আজব চিন্তাগুলো এই মেয়ে করে কিভাবে আজ অব্দি আমি ভেবে উত্তর কেন দিকদিশা পাইনি। গলায় আমার কফি আটকে ছিলো যেন। খুব জুলুম করে ঢোকটা গিলে আমিও গভীর করে বললাম
— হ্যা দোস্ত?
প্রিয়া ছলছল নয়নে না চাইলেও তেমনই মুখভঙ্গি করে চাইলো আমার দিকে। বলল

— ডাক্তার আমাকে কোলে তুলে পৃথিবী কেন ছোট ঘরটাই ঘোরায় না। সে তো পারে দোস্ত আমাকে কোলে তুলে নিয়ে পৃথিবী ভ্রমন করতে। আমার কত ইচ্ছে ছিলো বর পাঁজা কোলে নিয়ে বৃষ্টির মধ্যে হাঁটবে। আমার পা কেটে গেলে আমাকে কোলে তুলে নেবে। কিন্তু নেয় না মানুষটা।

প্রিয়ার কথা শুনে আমি অহেতুক, জোরাজুরি করে মুখে দুঃখী ভাব নিয়ে এলাম। আমি যে ওর কথায় ওর কষ্টে ভয়াবহ ধাপের দুঃখিনী হয়ে গেছি তা বোঝানোর সফল প্রচেষ্টা করলাম। এরই মাঝে শান্ত হঠাৎ টেবিলের নিচ হতে ওর শক্ত সু-র ছোট খাটো এক লাথি আমার পায়ের দিকে ছুড়ে দিলো। অতঃপর প্রিয়ার দিকে। বলে উঠলো
— চুপ কর। তোদের এই ঢং দেখে আমার বিয়ে করার সাধ নষ্ট হয় হা*রা*মি*র দল। এই ঢংগী মুখের ভাবসাব দেখলে এমনেই লাথি দিয়ে ভিনগ্রহে পাঠানোর ইচ্ছে হয়। নিব্বি’স কুইন।

শান্তর কথায় অশান্ত হলো প্রিয়া। আমিও প্রিয়াকে আস্কারা দিলাম। পাল্টা একটা কিক শান্তকে প্রিয়া দিয়ে দিয়েছে। ও আবার কারো পাওনা জিনিস বাকি রাখে না। বড্ড ভালো মেয়ে কিনা!
আড্ডা আর জমলো না। টুকটাক ঝগড়াতেই সমাপ্ত হলো। প্রিয়ার মন খারাপেরও উন্নতি অবনতি হলো না। আমি একা বসে ভাবতে লাগলাম স্মরণের কথা। কখনো অথৈয়ের কথা। আবার হঠাৎ ভাবনাতে নিয়ে এলাম প্রিয়া – অঙ্কনের সংসার জীবনের কথা। যদি সম্ভব হতো ওদের কাহিনী ডায়েরির পাতায় কেউ লিখে আমায় পাঠিয়ে দিতো। আমি চোখ মুখ ডুবে দিয়ে পড়তাম যেন। আমার চোখে আদর্শ এক দম্পতি ওরা।

— প্রিয়া, তোর ডাক্তার সাহেব কি সত্যিই অনেক বাজে? আনরোমান্টিক? ঠিক তোর সিগারেট খাওয়া দেখে ক্রাশ খাওয়া ক্রাশের মতো?
ভাবনার মাঝে মুখে দুষ্টু হাসি লুকিয়ে প্রিয়ার কানে ফিসফিস করে কথাটা বললাম। প্রিয়া চোখ তুলে চাইলো আমার দিকে। হাসলো নি:শব্দে। হঠাৎ তার মনের জোয়ারে মেঘের আড়াল হতে যেন কিরণ দিলো সূর্য।

— জানি না। তবে এটা জানি সে আমার মনের মতো।
— আমাকে কি তুই ক্ষমা করে দিয়েছিস প্রিয়া?
প্রিয়া যেন ঝট করে বুঝে ফেলল আমার কথার মর্মার্থ। কন্ঠ আমার চাইতেও খাদে নামিয়ে বলল
— পেরিয়ে যাওয়া দিনগুলোর খোঁজ পিছিয়ে গিয়ে রাখতে হয় না খেয়া। পেয়ে যাওয়া জিনিসগুলোর অতীত ঘেঁটে মন ভার না করে জিনিসটাকে মায়ার বাঁধনে বাঁধার চেষ্টা করতে হয়।
মুগ্ধ হলাম আমি প্রিয়ার কথায়। নির্নিমেষ তাকিয়ে দেখলাম উচ্ছল, চঞ্চল মেয়েটাকে। ওর ভাবনা গুলো গভীর!

— তুই কিন্তু তোদের রোমান্টিক মুহূর্তগুলোর কথা এখনো বলিসনি।
আমার আর প্রিয়ার নিস্তব্ধতার মাঝে হঠাৎ নীলিমা বলে উঠলো কথাট ফিসফিস করে। হেঁসে ফেললাম আমি। প্রিয়াও হাসলো। ফিসফিস করে নীলিমার কানে বলল
— বিয়ে করে নে। শাড়ি পড়ে দেওয়া, নুপুর পরে দেওয়া, হাত কেটে গেলে ভাত তুলে খাওয়ানো, খেয়ার জামাইয়ের মতো রাত বিরাতে ঘুম থেকে তুলে পড়তে বসানো, হাত ধরে বাচ্চাদের মতো রাস্তা পার করানোর মতো অনেক রোমান্স দেখতে পারবি। তারপর আরো গভীর রোমা…..

নীলিমা চেচিয়ে উঠলো। ‘থাম আপা’ বলে বিরক্তির এক চাহনি নিক্ষেপ করলো প্রিয়ার দিকে। ও যে খচ্চর এ কথা যেন নীলিমা ভুলেই গিয়েছিল। নাম মুখ কুঁচকে ও ব্যাগ কাঁধে নিয়ে হাটা দিলো বাসার দিকে। আজ নাকি ওর বাসায় পাত্রপক্ষ আসবে। আমাদের সমাবেশ ভঙ্গ হলো। আমি আর প্রিয়াও উঠে পরলাম রয়ে সয়ে। শান্ত আর সজীব বসে রইলো। থেকে গেলো ওরা ক্যান্টিনে।

গেইটের বাইরে এসে দাড়ালাম স্মরণের জন্য। সে আসার কথা। প্রিয়াও দাড়িয়ে রইলো অঙ্কনের জন্য। প্রায় পাঁচ মিনিট ওভাবে দাড়িয়ে থাকার পর হঠাৎ ঘটলো এক অবাক কান্ড। হঠাৎই প্রিয়া হুড়মুড় করে কোথাও যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো। আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না ওর হলোটা কি আচমকা! কয়েক কদম ওর পিছু হেঁটে যাওয়ার পরই নজরে এলো অঙ্কনকে। রাস্তার পাশে এক মেয়ের সাথে গালভরা হাসি নিয়ে কথা বলে যাচ্ছে। মেয়েটাও হাসিখুশি। প্রিয়া ঝড়ের বেগে গিয়ে অঙ্কনের পাশে দাঁড়ালো। আমার চোখ দেখলো প্রিয়ার ক্ষুব্ধ রূপ। আর কান শুনলো কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত কথা

— ইতর, বাদর, ছেতর, বেহায়া। নাইকি জুতো চেনো? দেবো একটা ওটা দিয়ে। কতবার বলেছি তোমাকে এই জিনিসটার দিকে নজর দেবে না। এই জিনিস ইজ বুকিং। ইট’স মাই জিনিস…..
হতভম্ব হলাম আমি। অঙ্কন চেপে ধরলো প্রিয়ার মুখ। রাস্তার গোটা দুয়েক মানুষ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে দেখলো ওদের। অঙ্কনকে বলতে শোনা গেলো

— ইশ! রাগ কেন জিহ্বার আগায় থাকে তোমার?
প্রিয়া অস্পষ্ট শব্দে অঙ্কনকে কিছু বলছে। মেয়েটা নেই ওদের কাছে। সে প্রস্থান পথ ধরেছে। আমি আরেক দফা হাসলাম। ওদের থেকে ক্রমশ পিছু সরছিলাম উল্টো পায়ে। ঠিক তখনই আমি ধাক্কা খেলাম কারো সাথে। বেশ খানিকটা ভয় মনে নিয়ে পেছন ফিরে চাইতেই দেখি আমার মানুষটার সাথেই ধাক্কা খেয়েছি। সে ভ্রুকুটি করে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। যেন জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে। আমি মাথা নড়চড় করে জানলাম ‘কিছু না’। স্মরণ আমাকে গাড়িতে উঠতে বলল। আমি আজ বলেই ফেললাম

— আজ একটু হেঁটে বাসায় ফেরা যায় না? বেশি দূরের পথ তো না।
অনেক দিনের ইচ্ছে আমার তার পাশাপাশি হাঁটবো। হঠাৎ খোলা চায়ের দোকান থেকে চা খাবো। সে রাস্তার পাশ থেকে বেলি ফুলের মালা কিনে আমার খোঁপায় পরিয়ে দেবে। হাতে দেবে একটা লাল গোলাপ।
স্মরণ আমার কথার কোনোরূপ প্রতিদ্বন্দ্বিতা না করে বলল

— চলো।
আমি বেজায় খুশি হলাম। তবে চিন্তা। গাড়িখানা সে কি করবে?
— কিন্তু গাড়িটা কি করবেন আপনি?
স্মরণ দুষ্টু হাসি ঠোঁটে রেখে বলল
— গাড়ি কোথায় দেখছো তুমি?
আমি অবাক হলাম। আশপাশে তাকালাম। স্মরণের গাড়ি নেই!

শেষ বিকেলে তুমি আমি সিজন ২ পর্ব ৬

— তাহলে কিসে উঠতে বললেন আপনি?
— রিকশায়। কিন্তু এখন উঠবো না। চলো হেঁটেই যাই।
আমি অবাক ভাবটা বিদায় করে তার অগোচরে লাজুক হাসলাম। সেও কি তবে চেয়েছে আজ পায়ে হেঁটে, পাশাপাশি পথ চলে বাসায় ফিরবে? একটা সুন্দর মুহূর্ত উপহার দেবে আমাকে? হ্যা চেয়েছে সে। আনুমানিক বিশ কদম চলার পর সামনে পরলো ফুলের বাজারের রাস্তা। সে মোর নিলো সেদিকে।

শেষ বিকেলে তুমি আমি সিজন ২ পর্ব ৮