সংকটময় প্রেম পর্ব ৭

সংকটময় প্রেম পর্ব ৭
সুরাইয়া সাত্তার ঊর্মি

ইউসুফ ভাইয়ের এমন রূপ আর চাহনিতে সেখানেই হুঁশ হারাই।
ঘন কালো মেঘের ন্যায় আকাশে, ঘুর ঘুর করা পাখিরা হঠাৎ যেমন করে, ঝড়ের কবলে পড়ে যায়? এখন আমার ঠিক সেই হাল। থমথমে পরিবেশ। রাতের আঁধারে ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক ভেসে আসছে বাগানের ঝোপটা থেকে। কিছুক্ষণের মাঝেই হয়তো নেমে আসবে হুড়মুড় করে বৃষ্টি। বাজ পড়লো হঠাৎ। গগনবিদারী আর্তনাদ আকাশের বুকে।

স্বশব্দে হুঁশ ফিরে এলো আমার। নিজেকে ঘরের মাঝে দেখে কিছুটা স্বস্তি বোধ করলাম। এক পর্যায় মনে হলে খুব খারাপ একটা স্বপ্ন দেখেছি, কি বাজে সেই স্বপ্ন। একদল গুন্ডা ধাওয়া করছে আমাকে। আমি দৌঁড়ে যাচ্ছি, প্রাণ পন বাচার চেষ্টা করছি। বেচারা আয়দাও ছিলো সেই স্বপ্নে ঘিরে, বাদ যায়নি রগচটা ইউসুফ ভাইয়ো রণমুর্তি ধারন করে ঠাটিয়ে বসিয়েছিলো এক চর। আমি সপ্তপর্ণে শ্বাস লুকিয়ে ফেললাম।গলাটা যেন এখনো জ্বালা করছে টন টন করে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

আমি পিটপিট চেখে আশে পাশে দেখতেই ভ্রু-জোড়া কুঞ্চিত হলো। আমার ঘরে নিয়ন আলো জ্বলছে। বাহিরের ঝুমঝুম বৃষ্টির শব্দ কর্ণপাত হচ্ছে। বন্ধ জানালার স্বচ্ছ কাচ ভেদ করে ভেসে আসছে থেকে থেকে বিদুৎ চমকানোর আলো। আমার মাথায় চিন্তার ভাজ পড়লো। আমার ঘরের ছোট সোফাটায় বসে আছেন কেউ যার পড়নে সাদা পাঞ্জাবি। কে এই ব্যক্তি, পায়ের উপর পা তুলে বসে আছেন তিনি, যেন কোথাকার কোন লাটসাহেব ।

লম্বা হাত পা গুলো ছাড়া দৃশ্যমান শুধু হাতের লিক লিকে সিগারেটের আগুন। এই রাতে মধ্যহ্নে কে হতে পারে? ভেবেই আমার বুক দুরুদুরু করতে লাগলো। চোর, টোর নই তো? অথবা জ্বিন ভুতের কাহিনি? মনোরমা এখানে আসার পর থেকেই আমাকে অনেক জ্বিন-ভুতের গল্প বলেছে। আমি শুকনো ঢুক গিললাম, ভয়ে জর্জরিত কন্ঠে বললাম,

” কে… কে আপনি? এই রাতের বেলায়, কোনো মেয়ের রুমে আসতে লজ্জা করলো না?”
লোকটি এবার হেলেদুলে বসলো। হাতের সিগারেটা ফেলে দিলো মাটিতে। লম্বা পা দ্বারা পিশে ফেললো মাটিতে। আমি কিছুতেই বুঝতে পাড়লাম না এই অবয়বের হাবভাব। আমি গলা চওড়া করে বললাম, ” কথা বলছেন না কেন? বোবা? ”
লোকটি এবার উঠে এলো। নিয়ন আলো মুখে পড়তেই আমি আত্মকে উঠলাম। মৃদু চিৎকার করে বললাম, ” ইউসুফ ভাই?”

উনি উত্তর দিলেন না। তার ভাবমূর্তি ইতিবাচক মনে হচ্ছে না। এই মুহূর্তে তাকে রাক্ষুসে রক্ত চোষা রাজা মনে হচ্ছে। তার রক্তিম বিলাই চোখ জোড়া জ্বলজ্বল করছে। উনার ঠান্ডা চাহনি আমার ভিতরের উঞ্চতা শীতল করে দিচ্ছে। তিনি দৈবাৎ মুখোমুখি হতেই আমি ভয়ে একদম ছিটকে সরে গেলাম। ইউসুফ ভাই খেঁকিয়ে উঠলেন,” ব্যাঙের মতো লাফালাফি করছিস কেন?”

আমি হতভম্ব, এই লোক এমন লুক নিয়ে দেখছে, যেন এই বুঝি টুপ করে পানি ছাড়াই গিলে খাবে, আর বলছে লাফালাফি কেন করছি? তাউ ব্যাঙের মতো? আমি গোল গোল চোখে তাকিয়ে রইলাম। বললাম, ” আপনি আমার ঘরে কি করেন? একজন মেয়ের ঘরে পরপুরুষ দেখলে মানুষ কি বলবে?”

উনি পাত্তা দিলেন না। উল্টো আমার বাহু জোড়া চেপে ধরে তার মুখোমুখি করে দাঁতে দাঁত চেপে জিজ্ঞেস করলেন, ” কোন নাগর ছিলো তোর? যে এভাবে সকলের সামনে তোকে তুলে নিতে সাহস করছে, তাউ আবার আমার শহরে?”
আমি স্তম্ভিত হলাম, কি বলছেন এই তার ছিড়া লোকটা? আমার নাগর? আমিতো কখনো প্রেম পর্যন্ত করিনি, নাগর আসবে কোন থেকে? আমি ভাবনায় বুঁদ । ইউসুফ ভাইয়ের কথা তীরের মতো বিঁধছে আমার শরীরে। তার মানে, যা আমি স্বপ্ন ভাবছি তা সত্যি ছিলো? আমার চোখ জোড়া এবার বড় বড় হয়ে গেলো, আমি ইউসুফ ভাইকে হাত থেকে রেহাই পেতে ছটফট করতে লাগলাম, ” আপনি কি যাতা বলে যাচ্ছেন? ”

ইউসুফ ভাই আমার বাহু আরো শক্ত করে চেপে ধরলেন, “তোর কুকীর্তি কেন আমার বোন ফেইস করবে, তুমি রঙলিলা করবা, আর আমার বোন হাত ভেঙে বসে থাকবে? আজ এর থেকে বেশি কিছু হলে? আমার বোনটার কি হতো?”
ইউসুফ ভাইয়ের তীক্ষ্ণ কথা গুলো, বুক চিড়ে গেলো আমার।আমি কাঁপা কন্ঠে বললাম,

” আমার এখানে কি দোষ? তাদের আমি চিনি পর্যন্ত না? আমি অবশ্যই বলবো না, সেঁধে এসে আমাকে তুলে নিয়ে যাও?”
ইউসুফ ভাই আরো গম্ভীর কন্ঠে বললেন, ” হতেও পারে, যে মেয়ে পর পর ১৩ বার বিয়ের পিরি থেকে পালাতে পারে, সে অবশ্যই এখান থেকে পালাতে চেষ্টা করতে লোক ভাড়াও করতে পারে!”
হঠাৎ এক ঝাঁক কষ্ট উড়ে এসে বসলো আমার বুকে, আমাকে আজ ওই লোকগুলো তুলে নিলে, আমার জীবনটা শেষ হয়ে যেত। আর উনি বলছে, এসব আমি করিয়েছি? আমার চোখের কোনে জল চলে গেলো। জড়িয়ে আসা কন্ঠে বললাম, “আমি এতটাও নিচু মস্তিষ্কের নই।”

ইউসুফ ভাই আমাকে ঝাপটা মেরে সরিয়ে দিলেন। আমি মুখ থুবড়ে পড়লাম বিছানায়। তার দিকে অশ্রুসিক্ত চোখে তাকাতেই আঙ্গুল তুলে শাসিয়ে বললেন,
” তুই এখানে যত দিন আছিস আমার পুরো পরিবার থেকে দূরে থাকবি, তোর জন্য কারো কোনো ক্ষতি হলে আমার থেকে কেউ খারাপ হবে না তোর জন্য।”

আমি অবাক হয়ে গেলাম। এত বড় একটি ঘটনার পুরো দোষটাই আমার উপর চাপিয়ে দিলেন এই লোক। কেন? কেন এমন করেন প্রতিবার? তার কথাতে আমার জন্য তীব্র ঘৃণা প্রকাশ পায়, কেনো? আমি কি করেছি তাকে? কেনোই বা এত তিক্ততা? আমি মুখ চেপে কেঁদে উঠলাম। মা-বাবার কথা মনে পড়ছে প্রচুর। আয়দা কি খুব বেশি ব্যথা পেয়েছে? আচ্ছা আমি বুঝি এতো খারাপ? যে আমার মা-বাবা আমাকে বিয়ে করিয়ে বিয়ে বিদায় করতে চায়? এমন কি নিজ বাড়ি আমার জায়গা নেই? আর নিজ নানা বাড়িতেও শান্তি নেই।

এখন মনে হচ্ছে লোক গুলো তুলে নিয়ে গেলেই ভালো হতো। বেঁচে যেতাম। আমি বালিশে মুখ গুঁজে কাঁদতে লাগলাম। ঘুমন্ত পুরিতে একলা আমার খোলা চোখ আর নোনা জল ছাড়া সঙ্গী কেউ নেই। আমি ফোনটা হাত তুলে নিলাম। আমার লুকাইত অনুভূতি গুলো লিখে পাঠিয়ে দিলাম একটি মেইলে। অজানা অচেনা এই মানুষটি এক মাত্র কথা বলার সঙ্গী। আমি ধীরে ধীরে ঘুমি পড়লাম। সকালে ঘুম ভাঙ্গলো হৈচৈ শোনে।

রাতের কান্নার ফলে আমার চোখ ফোলা। হাতের কব্জিতে এখনো গুন্ডাদের হাতে ছাপ। যা এখনো শিউরে তুলছে আমার রূহ। তার উপর ইউসুফ ভাইয়ের তীক্ষ্ণ বান মনে পড়তেই কষ্ট লাগছে, খুব কষ্ট। তার সাথে উনি আমাকে অবিশ্বাস করাতে বুকে চিন চিন ব্যথা করছে। হঠাৎ এই ব্যথার কারণ ধরতে পারছি না। নিজেকে সামলে ওয়াশরুমে চলে গেলাম। কালকের ঘটনা হয়তো সবাই আমাকেই দোষারোপ করবে? আমি ধীরে পায়ে তৈরি হয়ে নিচে গেলাম। শেষ সিঁড়ি কোঠায় পা দিতেই আমার মায়ের হাসি মুখটি দেখে দৌড়ে ঝাপটে ধরে বললাম, ” আম্মু আমাকে নিয়ে চলো আমি থাকবো না এখানে।”

আম্মু কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে গেলেন। কোনো রকম আমাকে সামলে বললেন, ” মা সব ঠিক আছে, দেখো কে এসেছে?”
আমি চোখ মুছে সামনে তাকাতেই বাজ পড়লো আমার মাথায়। আমি তীব্র দুঃখ তীব্রত্তর হয়ে গেলো। মা আসার খুশিটা নিমিষেই মুছে গেলো। কোনো রকম নিজেকে সামলে বললাম, ” আম্মু আমি বিয়ে করবো না, করবো না।”
মা ধমকে উঠলেন, চাপা কন্ঠে বললেন, ” কুহু, এইসব কেমন ব্যবহার। আন্টি আঙ্কেলকে সালাম দাও। অভদ্রতা করো না।আমি চাই না আরো কোনো ঝামেলা হোক।”

আমার চোখ দিয়ে নোনাজল গড়িয়ে পড়লো। আজ বুঝি সবার কাছে বোঝা হয়ে গেছি? আমার এই মুহূর্তে সকলের উপর বিতৃষ্ণা প্রকাশ পায়। এক ছুটে উপরে যেতেই আয়দার রুমে চোখ পড়ে বেচারির হাতটা ভেঙে গেছে। প্লাস্টার করা। আমি সেখানে যেতে নিতেই একটি হাত বাঁধ সাধলো। কিছু বুঝে উঠার আগেই ইউসুফ ভাইয়ের ঝংকার তোলা তেতো গলা ভেসে এলো, ” বলেছি না, দূরে থাকতে আমার বোনের থেকে, এখানে কেনো এসেছিস তুই? কোন সাহসে?”

আমি ঘাবড়ে গিয়ে বললাম, ” আমি শুধু আয়দাকে দেখতে এসেছিলাম। ”
” দেখতে হবে না তোর। নিচে তোর বাপ-মা এসেছে বিয়ের ঘর নিয়ে, এবার বিয়ে কর আর রেহাই দে আমাদের সবাইকে। ”

সংকটময় প্রেম পর্ব ৬

আমি আর কান্না ধরে রাখতে পারলাম না। হাউমাউ করে কেঁদে নিজের ঘরে চলে গেলাম। এতসব অপবাদ ভালো লাগছে না আমার। মরে যেতে ইচ্ছে করছে। সকলের সমস্যা আমার সাথেই নিয়ে চলে যেতে ইচ্ছে করছে পৃথিবী থেকে। ভাবতে ভাবতেই চলতি ফেনের দিকে নজর গেলো আমার…..

সংকটময় প্রেম পর্ব ৮