সায়েবা আসক্তি পর্ব ১৬

সায়েবা আসক্তি পর্ব ১৬
লেখিকা সানজিদা বিনতে সফি

বারান্দায় দাঁড়িয়ে নিজের রুমের দিকে তাকিয়ে আছে সায়েবা। এখান থেকেই ফারহান তার দিকে তাকিয়ে থাকতো। হ্যা,সায়েবা এখন ফারহানের রুমে।এ বাড়িতে আসা হলেও ফারহানের রুমে কখনো আসা হয় নি সায়েবার। প্রথম থেকেই তাদের মধ্যে একটা দূরত্ব কাজ করত।ফারহান সব সময় তাকে এড়িয়ে চলতো।কখনো সামনা সামনি দাঁড়িয়ে দুই একটা কথা বকেছে কি না মনে পরছে না।রাগী গম্ভীর মুখে ঘুরে বেরানো ছেলেটার প্রেমে পড়ে যাবে ভাবতেই পারে নি সায়েবা।ফারহানদের পরিবারের সবাই হাসি খুশি হলে ও ফারহান সব সময় গম্ভীর। সবার সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক হলেও ফারহানের সাথে কখনো স্বাভাবিক কথা ও বলা হয়ে উঠে নি।

ফারহানের এই গম্ভীরতা আরো বেশি আকৃষ্ট করেছে সায়েবা কে।ফারহান গম্ভীর চোখে যখন সায়েবার দিকে তাকাতো তখন মনের মধ্যে হাজার প্রজাতির ডানা মেলে উড়তে শুরু করতো।তাই একদিন সাহস করে ফারহান কে মনের কথা বলে দিয়েছিল সেদিন। ফারহান যখন ঠান্ডা মাথায় তাকে রিজেক্ট করে দিলো তখন সায়েবার অনেক কষ্ট হয়েছিল।রাগে অপমানে কয়েকদিন ভার্সিটি তেই যায় নি। ফারহানের ক্লাসমেট মিজান যখন তাকে নানা ভাবে অপমান করে তখন আর সায়েবা সহ্য করতে পারে নি। ফারহানের উপর সমস্ত ক্ষোভ ঢেলে দিয়েছে।তারপর থেকেই ফারহানের আচরণ বদলে গেছে।সে ও বুঝিয়েছে সে সায়েবা কে কতটা ভালোবাসে। লিজার সাথে হওয়া ঝামেলার পরে দুজনের মধ্যে দূরত্ব আসলেও ভালোবাসার কমতি ছিল না।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

কিন্তু আজ ফারহানের ব্যবহারে অনেক বেশি অবাক হয়েছে সায়েবা।ভিডিও কলে খুব সাধারণ ভাবেই উপস্থিত হয়েছিল ফারহান।তাকে দেখে মনে হয় নি আজ তার বিয়ে।অথচ সায়েবা পটের বিবি সেজে বসেছিলো। সবাই যেখানে সায়েবার রুপের প্রশংসায় পঞ্চমুখ সেখানে ফারহান তার দিকে একবার তাকিয়েও দেখেনি।কবুল বলার সময়ও সায়েবা ফারহানের দিকে তাকিয়ে ছিল।কিন্তু ফারহানের সেদিকে কোন খেয়াল নেই। সে মাথা নিচু করে বসে ছিল।ফারহানের ব্যবহারে সবাই অবাক হলেও কেউ কিছু বলে নি। সবাই ভেবেছে লজ্জায় হয়তো ফারহান এমন করছে। কিন্তু সায়েবা ঠিক ই।বুঝতে পেরেছে ফারহান তার উপর কোন কিছু নিয়ে রেগে আছে।বিয়ে শেষ হতে না হতেই ফারহান সবাই কে সাফ সাফ জানিয়ে দিয়েছে সায়েবা এখন থেকে তাদের বাসায় থাকবে।নিজেদের বাড়িতে সারাদিন আসা যাওয়া করলেও রাতে ও বাড়িতে ই থাকতে হবে। সাহেরা বেগম অসম্মতি জানালেও তাকে অনেক কষ্টে রাজি করিয়েছেন ফারহানা বেগম।

এসব কিছু ভাবতে ভাবতেই সায়েবা ফারহানের বেডের মাঝ বরাবর শুয়ে পরলো। এখানে আসার পরেও ফারহান সায়েবার সাথে কথা বলে নি।সবার কাছে কল করলে ও সায়েবার কাছে ফারহান এখনো একটা এস এম এস ও করে নি। এর জন্য সায়েবার মন টা ভার হয়ে আছে।সায়েবা মনে মনে ভেবে নিয়েছে ফারহান হয়তো রাতে তাকে কল করবে।কিন্তু মাঝ রাত হয়ে যাওয়ার পরেও যখন ফারহান কল করলো না তখন সায়েবার মন খারাপের মেঘলা আকাশ বৃষ্টি হয়ে ঝরতে শুরু করলো।

বিছানার উপর সায়েবার শরীরের হালকা কাপুনি দেখে ফারহান বুঝতে পারছে সায়েবা কাদছে।ল্যাপটপের স্ক্রিনে প্রেয়সীর কান্নারত আদুরে মুখের উপর হালকা স্পর্শ করলো ফারহান। সায়েবার মোহনীয় রুপে ফারহানের পাগল হওয়ার অবস্থা। বধুবেশে সায়েবা কে কল্পনার থেকে ও বেশি সুন্দর লাগছিলো।ফায়জার পাঠানো প্রত্যেকটা ছবি এ পর্যন্ত হাজার বার দেখে ফেলেছে ফারহান। সায়েবার উপর রাগ করে এখনো সায়েবার সাথে কথা বলে নি ফারহান।তাই বলে বউ কে তো আর না দেখে থাকা যায় না। তাই বেডরুমে আদিব কে দিয়ে আজকেই ক্যামেরা লাগিয়েছে ফারহান।সায়েবা যখন বেডরুমে প্রবেশ করে তখন ফারহানের হৃদয়ে যেন এক শীতল হাওয়া বয়ে গেলো। মনের প্রশান্তি বলে দিচ্ছিলো এই রমনী আজ থেকে একান্ত তোমার ব্যক্তিগত মানুষ। যার উপর সব চেয়ে বেশি অধিকার একমাত্র তার নিজের।ল্যাপটপের দিকে তাকিয়েই ফোন হাতে নিলো ফারহান। শাস্তি পরেও দেয়া যাবে। তবে আজকের এই স্পেশাল রাতে শাস্তি একটু শিথিল করা হলো। স্ক্রিনে চোখ রেখেই মুচকি হেসে সায়েবার নাম্বারে কল দিল ফারহান।

ফোনের শব্দে ধ্যান ভাংলো সায়েবার।কান্না করতে করতে ফোন হাতে নিয়ে নাম্বার দেখেই হুড়মুড়িয়ে উঠে বসলো সায়েবা।হুট করেই কান্না থেকে গিয়ে হিচকি উঠে গেলো। ফোনের স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করছে hubby নামটা।ফায়জা ই যে এই নামে নাম্বার সেভ করে দিয়েছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। এতক্ষণ পরে পিটে কান্না করলেও এখন মনের মধ্যে একরাশ লজ্জা এসে ভর করেছে সায়েবার।অজানা ভয়ে বুকের ভেতর ধুকপুক করছে।সায়েবার ভয় হচ্ছে, কল রিসিভ করলে ফারহান তার বুকের ধুকপুকানি শুনে না নেয়!
এদিকে সায়েবার লজ্জা রাঙা মুখ দেখে ফারহানের বুকের অস্থিরতা বেড়ে যাচ্ছে। এমন একটা লাল টুকটুকে বউ রেখে এখানে আরো দেড় বছর কাটাতে হবে ভাবতেই তো দম বন্ধ হয়ে আসছে!চট করেই চোখ সরিয়ে নিলো ফারহান।ধুপধাপ পা ফেলে জানালার গ্লাস খুলে দিলো। বউ কে দেখেই অক্সিজেনের ঘাটতি তে মরে যাচ্ছে সে।সামনে পেলে না জানি কি হবে।

স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই কল কেটে গেছে। সায়েবার এখন আফসোস হচ্ছে কেন তখন কল রিসিভ করলো না। লজ্জা তো পরে একা একাও পাওয়া যেত!ধ্যাৎ! প্রায় দশ মিনিট পরে আবার কল এলো সায়েবার মোবাইলে। এবার আর দেরি করলো না সায়েবা। ঝটপট কল রিসিভ করে ফেললো। কিন্তু মুখ দিয়ে তো কথাই বের হচ্ছে না। ওদিকে ফারহান ও চুপ করে আছে।ফারহানের ঘন নিশ্বাস সায়েবার কথা গলায় ই আটকে দিয়েছে।আনমনে এক হাত গালে চলে গেছে খেয়াল হতেই থতমত খেয়ে হাত নামিয়ে নিলো সায়েবা।সায়েবার অবস্থা দেখে মুচকি হাসলো ফারহান।বউ কি তাকে ভয় পাচ্ছে? তাহলে আরেকটু ভয় দেখানো যাক!

— সায়েবায়ায়ায়ায়া,,,,
ফারহানের গম্ভীর গলা শুনে কেপে উঠল সায়েবা।কম্পিত গলায় বললো,
— জ জ্বি।
— এখনো ফ্রেশ হও নি কেন?
সায়েবার মুখটা এবার কাদো কাদো হয়ে গেলো। সে তো ফারহানের জন্যই এতক্ষণ এভাবে বসে ছিলো। তার সমস্ত সাজ সজ্জা ফারহান না দেখলে সব বৃথা তার কাছে।কিন্তু মুখে বললো,
— এমনি।
সায়েবার অভিমানী মুখের দিকে ঘোর নয়নে তাকিয়ে রইলো ফারহান।সায়েবা কে এখন আদুরে বিড়াল ছানার মতো লাগছে।এই মেয়েটা কি জানে? তার এই এলোমেলো বধুবেশ কতটা মোহনীয় করে তুলেছে তাকে?
— আমার জন্য অপেক্ষা করছিলে সায়েবা?
সায়েবা অভিমানী গলায় বললো,
— নাহ।
— তাই বুঝি?তাহলে এতো অভিমান কেন?
সায়েবা কিছু না বলে ঝরঝর করে কেদে উঠল।এদিকে ফারহান প্রেয়সীর কান্না থামানোর বিন্দুমাত্র আগ্রহ দেখখালো না।উল্টো মনোযোগ দিয়ে সায়েবার কান্না মাখা গলার অভিযোগ শুনতে লাগলো।

ছাদের এক কোনায় দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছে আদিব।বন্ধুদের মধ্যে সেই একমাত্র সিগারেট খায়।ফারহানের হাতে কয়েক দফা উত্তম মধ্যম খেয়ে ও সিগারেট ছারতে পারে নি সে।কারোর পায়ের শব্দ শুনে সিগারেট পা দিয়ে পিশে নিভিয়ে ফেললো সে।
— তুমি এখানে কি করছো আদিব?
ফায়জার গলা শুনে হাসি হাসি মুখ করে ঘুরে তাকালো ফায়জার দিকে।ফায়জার পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে নিয়ে দুষ্টু হাসলো আদিব।ন্যাকামি গলায় বললো,
— তোমার জন্য অপেক্ষা করছিলাম সোনা।আসো একসাথে চাঁদ দেখি। আহ দাঁড়িয়ে রইলে কেন?আসো আসো।
আদিবের কথা শুনে দাত কিড়মিড় করে তাকালো ফায়জা।মুখে বললো,
— অসভ্য।
— তুমি আমার ভালোবাসা বুঝলা না!(অসহায় গলায়)
— চুপ করো বেয়াদব ছেলে।আমি ফারহানের বড় বোন সে খায়াল আছে তোমার?আজ থেকে আমাকে আপু বলে ডাকবে। আর একবার যদি আমার সাথে এসব উল্টো পালটা কথা বলতে শুনেছি তাহলে থাপ্পড় দিয়ে দাত ফেলে দিবো।

সায়েবা আসক্তি পর্ব ১৫

ফায়জার রাগী গলা শুনে ও কোন ভাবাবেগ হলো না আদিবের। চেহারার দুঃখী দুঃখী ভাব এনে বললো,
— দাত ফেল বা হাত পা ভাঙো আমি তোমার পিছু ছাড়ছি না। বিয়ে তো আমি তোমাকেই করবো। সবার কপালে তো আর শান্ত ভদ্র বউ থাকে না!আমার কপালে না হয় জামাই পেটানো বউ থাকলো। বিয়ের পর তার হাতে মার খেয়ে তার হাসপাতালেই ভর্তি হবো।তার সেবা যত্নে সুস্থ হয়ে আবার মার খাওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে বাসায় যাবো। সবার কপালে তো আর বউয়ের আদর জোট না বলো?
আদিবের দুঃখ দুঃখ গলায় বলা কথা শুনে চোয়াল ঝুলে গেলো ফায়জার।মনে মনে সেও দুঃখ করে বললো,
— আহা আদিবের বউটা আসলেই ভভয়ংকর!

সায়েবা আসক্তি পর্ব ১৭

2 COMMENTS

Comments are closed.