সায়েবা আসক্তি পর্ব ২৯

সায়েবা আসক্তি পর্ব ২৯
লেখিকা সানজিদা বিনতে সফি

এতক্ষণ দুশ্চিন্তায় থাকা মহল এখন বিষাদের রুপ নিয়েছে।রুমের ভিতরে থাকা রমনীর আত্মচিৎকার
সবাইকে স্তব্ধ করে দিয়েছে।ফায়জার কান্নার শব্দে দৌড়ে এসেছে ফারহান। চেঞ্জ করে সে এদিকেই আসছিলো। মাঝ পথে ফায়জার চিৎকার করে কান্না কর্ণগোচর হতেই ছুটে এসেছে সে।আদিব,ফরহাদ,সাবা আর নীতি বিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ফারহান সেদিকে ধ্যান না দিয়ে তারাতাড়ি দরজায় কড়া নাড়তে লাগলো,
— আপু,আপু দড়জা খোলো।

ফারহানের বার বার কড়া নাড়ায় ধ্যান ভাংলো সবার।ফরহাদ অস্থির হয়ে ফায়জা কে ডাকতে লাগলো। তার চোখে জলেরা ভীড় করেছে। একমাত্র ছোট বোনের কান্না হৃদয় ছিন্ন ভিন্ন করে দিচ্ছে।
আদিব অনুভূতি হীনের মতো করে দাঁড়িয়ে আছে। ভালোবাসার মানুষের কান্নায় হৃদয় পুড়ে।কিন্তু তার চেয়ে ও বেশি কষ্ট তখন হয় যখন সেই কান্না অন্য কোন পুরুষের জন্য হয়।
রুম থেকে এখন আর কান্নার শব্দ আসছে না। এবার সবাই ভয় পেয়ে গেলো। ফারহান অস্থির হয়ে সায়েবা কে ডাকতে লাগলো।ডাইনিং রুমে খাবার সাজাচ্ছিল সায়েবা।ফারহানের ডাক শুনে একপ্রকার দৌড়ে এসেছে সে।এতোক্ষণ সবার ডাক শুনেও আসতে পারে নি। ফারহান এদিকে আসতে নিষেধ করেছিলো তাই।এতক্ষণ ফারহানের ডাকের ই অপেক্ষা করছিলো ও।
— কি হয়েছে? আপু দরজা খুলছে না কেন?
— আম্মুর রুম থেকে ডুপ্লিকেট চাবি নিয়ে এসো।কুইক। (অস্থির হয়ে)

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

আদিব এখনো নির্বিকার হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। শান্ত ভঙ্গিতে থাকলেও চোখ মুখ থেকে যেন আগুন বেরুচ্ছে।
আদিবের শক্ত মুখের দিকে তাকিয়ে হচকচিয়ে গেলো সাবা।পাশে দাঁড়িয়ে থাকা নীতিকে খোচা দিয়ে ইশারা করতেই সাবার দিকে বিরক্তির চোখে তাকালো নীতি। সাবার দৃষ্টি অনুসরণ করে সামনে তাকাতেই আদিবের কঠিন চেহারা দেখে অবাক হলো। আদিব ওদের দৃষ্টি উপেক্ষা করে পকেট থেকে ডুপ্লিকেট চাবি বের করলো। কাল রাতেই বাণিয়ে এনেছে এটা।আজকে কাজে লাগবে এটা ও আগে থেকেই জানতো।ফরহাদ কে সরিয়ে চাবি দিয়ে দরজা খুলে ভিতরে ঢুকে ওদের মুখের উপরেই দরজা বন্ধ করে দিলো আদিব।
এর মধ্যেই রুমের সামনে সবাই এসে ভীড় করবছে।লিজার মুখের বাকা হাসি কারো চোখে না পড়লেও সায়েবার চোখে ঠিকই পড়েছে। নিচ থেকে ফারহানা বেগম উঠে এসেছেন।সানোয়ার সাহেব প্রেসারের মেডিসিন নিয়ে গভীর ঘুমে।তাই এতো চিৎকার শুনেও তার ঘুম ভাঙে নি।ফায়জার রুমের সামনে আসতেই বুক কামড়ে উঠলো তার।কাপা কাপা গলায় ছেলেদের বললো,

— কি হয়েছে আব্বু।ফায়জার কি হয়েছে?
— কিছু হয়নি আম্মু।আমরা একসাথে খাওয়ার জন্য আপু কে ডাকতে এসেছি।আপু রাগ করে দরজা খুলছে না তাই এভাবে ধাক্কা দিচ্ছি।তুমি নিচে যাও।আমি আপুকে নিয়ে আসছি।সায়েবা,আম্মু কে নিয়ে নিচে যাও।
— আমি কোথাও যাবো না।আমার মেয়ে দরজা খুলছে না কেন?ফায়জা,আম্মু দরজা খোলো।আমার মন কেমন করছে ফারহান।আমার মেয়ের কিছু হয়েছে।দরজা ভেঙে ফেলো আব্বু।আমার আম্মু ভালো নেই।তোমারা দরজা ভেঙে ফেলো।
ফারহানা বেগম কান্না করতে করতে ফায়জার দরজার সামনেই বসে পরেছে।সাহেরা বেগম তাকে সামলানোর চেষ্টা করছে।
— চিন্তা করবেন না আপা।আদিব আছে ভিতরে।ফায়জার কিছু হয় নি।একটু রাগ করে আছে।সব ঠিক হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ।
রাগে ফারহানের চোয়াল শক্ত হয়ে আছে।এই মুহুর্তে আদিব কে পেলে হয়তো খু*ন করে ফেলবে ও।নিজের চুল টেনে ছিরে ফেলার অবস্থা। চোখ লাল হয়ে ভয়ংকর দেখাচ্ছে।

— ভাই ওকে দরজা খুলতে বলো।আমার মাথা খারাপ হলে আমি উল্টো পালটা কিছু করে ফেলবো।দরজা খোল আদিব।
দরজায় দুটো লাথি মারতেই ফরহাদ টেনে দূরে সরিয়ে নিলো ফারহান কে।
— মাথা ঠান্ডা কর ভাই।আদিব আছে তো।একটু ঠান্ডা হয়ে বোস।আপনারা নিজেদের রুমে চলে যান।অনেক রাত হয়েছে।সবাই ঘুমিয়ে পরুন।
— আমার ছেলে বের হওয়ার আগে আমি কোথাও যাবো না।
আদিবের মা মুখ বাকিয়ে বলতেই ধমকে উঠলো আদিবের বাবা।
— এখানে সার্কাস চলছে?নাকি তোমার ছেলে বাঘের খাচায় ঢুকেছে? নাটক না করে রুমে যাও।
আদিবের মা আর কিছু না বলে কটমট চোখে তাকিয়ে রুমে চলে গেলো। এর শোধ সে সময় মতো নিয়ে নিবে।

অন্ধকার রুমে দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আদিব।সোডিয়ামের হালকা আলো তে ফায়জা কে দেখে যাচ্ছে সে।খাটের উপর টান টান হয়ে শুয়ে আছে। মাথা কিছুটা খাটের বাইরে থাকায় লম্বা চুল গুলো ফ্লোরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। কি নিষ্পাপ মুখ!বাইরের চেচামেচি তার কান পর্যন্ত আসছে না। সে তার প্রেয়সীকে দেখায় বিভোর। দরজার পাশের সুইচবোর্ডের মাঝের সুইচে চাপ দিতেই আবছা হলদেটে আলোয় সব কিছু হালকা পরিস্কার হলো। একটু সামনে এগুতেই পা দুটো আপনা আপনি স্থির হয়ে গেলো। ফ্লোরের লোহিত ধারার দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে রইলো কয়েক পল।মস্তিষ্ক সচল হতেই দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেলো ফায়জার দিকে। পাগলের ন্যায় নিস্তেজ শরীর টাকে আগলে নিলো নিজের বুকে। কান্নার আর্তনাদ আটকে বললো,
— এই এটা কি করেছো তুমি?বার বার কেন আমার থেকে দূরে যেতে চাইছো? আমি কিন্তু মে*রে ফেলবো তোমাকে। চোখ খোলো জান।প্লিজ চোখ খোলো।চুপ করে থেকো না সোনা।আমি আর বিরক্ত করবো না তোমায়।তবুও আমাকে এভাবে ছেড়ে যেও না।আমি ম*রে যাবো।

আদিবের আর্তনাদ রুমের বাইরে যেতেই ফারহান পাগলের মতো দরজা ধাক্কাতে লাগলো। ফরহাদ ও ফারহানের সাথে যোগ দিলো। এতক্ষণ নিশ্বব্দে কাদলেও এবার শব্দ করে কেদে উঠলো সায়েবা।
সাবা নীতি ও কেদে যাচ্ছে নিশ্বব্দে।
— আল্লাহর দোহায় লাগে আদিব দরজা খোল ভাই। আমার বোনের কি হয়েছে আদিব?ফায়জা ঠিক আছে তো?আল্লাহ!
— সায়েবা দ্রুত চাবি নিয়ে এসো।
সায়েবা চাবির জন্য যাতে নিতেই ভিতর থেকে দরজা খুলে গেলো। দরজা খুলেই আদিব আবার দৌড়ে ফায়জার কাছে চলে গিয়েছে।ফায়জার হাত থেকে টপটপ করে রক্ত ঝরছে। রুমে ঢুকে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে গেলো দুই ভাই।সামনেই ফায়জার নিস্তেজ দেহ।আদিব পকেট থেকে রুমাল বের করে হাত বেধে কোলে তুলে নিলো ফায়জা কে।চিৎকার করে ফারহান কে বললো,
— তারাতাড়ি গাড়ি বের কর ফারহান।

ফারহানের সেদিকে কোন হুস নেই।সে এখনো ফায়জার রঞ্জিত হাতের দিকে তাকিয়ে আছে। ফারহানা বেগম দরজায়ই জ্ঞান হারিয়েছে।ফরহাদ দৌড়ে বেরিয়ে গেছে গাড়ি বের করতে।আদিব টলমলে পায়ে অশ্রুসিক্ত চোখে ফারহান কে বললো,
— একটু আমার সাথে ধর ভাই।আমি ঠিক ভাবে দাড়াতে পারছি না। আমার ওকে এতো ভাড়ি কেন লাগছে!
সায়েবা ফারহান কে ধাক্কা দিয়ে বললো চিৎকার করে বললো,
— এভাবে দাঁড়িয়ে আছেন কেন আপনি।আপুর অবস্থা ভালো না ফারহান। আপুকে তারাতাড়ি হসপিটালে নিয়ে যেতে হবে।
সায়েবার কথায় হুস ফিরলো ফারহানের।আদিবের কোল থেকে একপ্রকার ছিনিয়ে নিলো ফায়জা কে।
— কিছু হবে না তোমার আপু।আল্লাহ! সাহায্য করো।কেন এমন ভুল করলে আপু!এত বড় ভুল কিভবে করতে পারলে?
শব্দ করে কান্না করছে ফারহান।এক প্রকার দৌড়ে ফায়জা কে নিয়ে বাসা থেকে বেরিয়েছে সে।আদিব লিফটের বাটন চাপতেই দরজা খুলে গেলো।ফরহাদ ওদের দেরি দেখে আবার উপরে এসেছে।

— তারাতাড়ি আয় ভাই।আমার ফায়জু কথা বলছে না কেন?আল্লাহ, একটু রহম করো আমাদের উপর।
তিনজন যুবকের বোবা কান্নায় পরিবেশ ভারী হয়ে উঠেছে।আদিব লিফটের মধ্যেই হাটু গেরে বসে পরলো। মাথার চুল টেনে ডুকরে কেঁদে উঠতেই ফরহাদ জাপটে ধরলো ওকে।
— আল্লাহ কে ডাক ভাই।
হাসপাতালে পৌঁছাতে দশ মিনিট লেগেছে।ফরহাদ ফোন করে সব কিছু আগেই রেডি করে রেখেছে।নিজেদের হসপিটাল হওয়ায় পুলিশের ঝামেলা করতে হয় নি। আসার সাথে সাথেই অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে গেছে ফায়জা কে।
— ও কেন এমন করলো ভাই?আমরা কি ওর কেউ না? সারাজীবন আমাদের সাথেই না হয় থেকে যেতো।আমরা কলিজার ভিতর ঢুকিয়ে রাখতাম ওকে। এতো বড় স্টেপ ও কিভাবে নিলো!তা ও ওই লোভী ছেলেটার জন্য!

সায়েবা আসক্তি পর্ব ২৮

ফারহান ফ্লোরে এক পা ছড়িয়ে বসে আছে। গায়ের গেঞ্জি রক্তে লাল বর্ণ ধারণ করেছে। এক দৃষ্টিতে সেদিকেই তাকিয়ে আছে সে।ফরহাদের কথার জবাব না দিয়ে চোখ বন্ধ করে ওভাবেই বসে রইলো।
আদিব অপারেশন থিয়েটারের সামনে অস্থির ভাবে পায়চারি করে যাচ্ছে। আল্লাহর কাছে দোয়া করে যাচ্ছে বারবার, একবার ফায়জা সুস্থ হয়ে গেলে আর কখনো যাবে না ফায়জার সামনে।আগে জানলে জাবের কে কখনো টাকা দিয়ে সরিয়ে দিতো না। বুকের মধ্যে অসহ্য যন্ত্রণা শুরু হয়েছে। এই যন্ত্রণার শেষ কোথায়!

সায়েবা আসক্তি পর্ব ৩০

1 COMMENT

Comments are closed.