সায়েবা আসক্তি পর্ব ২

সায়েবা আসক্তি পর্ব ২
লেখিকা সানজিদা বিনতে সফি

সাত তলার বারান্দার দিকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে সায়েবা।ফারহান বারান্দার ডিভানে আধসোয়া হয়ে ঘুমাচ্ছে। বুকের উপর বই দেখে বোঝা যাচ্ছে পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে গেছে।ফারহানের স্টাডির সমস্ত কিছু বারান্দায় সেট করা।বুকসেল্ফ থেকে শুরু করে স্টাডি টেবিল সব কিছু সুন্দর করে সাজানো গোছানো। দেখলেই চোখ জুড়িয়ে যায়।

মধ্যে রাতের দিকে ঘুম না আসায় ছাদে এসেছিল সায়েবা।এসেই এমন একটা দৃশ্য চোখে পড়বে ভাবতে পারে নি সে।ফারহানের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো সায়েবা।এই ছেলের দিকে তাকিয়ে মায়া বাড়িয়ে লাভ নেই।তবু্ও বেহায়া চোখ কিছুতেই কথা শুনতে চায় না। বার বার তার দিকেই চলে যায়।নিজের সাথে যুদ্ধ করেই সায়েবা ছাদের অন্য পাশে চলে গেলো। আজকের আবহাওয়া টা দারুণ। বৃষ্টি না হলেও দমকা হাওয়া প্রকোপ খুব বেশি। অদূরেই হয়তো কোথাও কোন অনুষ্ঠান হচ্ছে। ওখান থেকে গানের শব্দ ভেসে আসছে।
সায়েবা কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে গান শুনলো।কণার গান বাজতেই সায়েবার মন ভালো হয়ে গেলো। গানের সাথে তাল মেলাতে শুরু করলো,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

যাও বলো তারে,
মেঘের ওপারে,
বৃষ্টি বন্দনা জুড়ে ধরণীতল,
যাও বলো, শ্রাবণ আষাঢ়ে,
মেঘের শতদলে ছুঁয়েছ ভেজাজ ।
মাতাল হাওয়ার ধ্বণী বৃষ্টি কি শোনে
না,
ময়ূর পেখম তোলে ধিমতানা দেরে না,
ধিমতানা বাজে ধিমতানা…
বাজে ধিমতানা, দে রে না
ভেজাজল টলমল, অপেক্ষার জানালা
ছুঁয়ে,
দু’হাতে নিয়ে জল, ভেজাবো সুখের
কপল,
সন্ধ্যে এলো, ঝলোমলো বৃষ্টি তবু এলো
না ।
মাতাল হাওয়ার ধ্বণী বৃষ্টি কি শোনে
না
ময়ূর পেখম তোলে ধিমতানা দেরে
না…
স্বাগতম সম্ভাষণ অপেক্ষার হলো
অবসান,
প্রকৃতির আভরণে মন্ত্র তালের
উচ্চারণ,
রাত্রি এলো জলছল বৃষ্টি সুরের
মূর্ছনা,
মাতাল হাওয়ার ধ্বণী বৃষ্টি কি শোনে
না
ময়ূর পেখম তোলে ধিমতানা দেরে না
ধিমতানা বাজে ধিমতানা…বাজে
ধিমতানা, দে রে না..

দমকা বাতাসে এক তরুণীর মন মাতানো নাচের দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে ফারহান। কিছুক্ষন আগেই ঘুম ভেঙেছে তার।ঘুম ভাঙতেই এমন মন মুগ্ধকর দৃশ্য দেখবে ভাভতেই পারেনি সে।সাদা গ্রাউনে ঠিক জেন এক অপ্সরি লাগছে সায়েবা কে।বারান্দার লাইট টা অফ করে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলো সেদিকে।

আজ সকালে ঘুম থেকে উঠতে দেড়ি হয়ে গেছে সায়েবার। কাল অত রাত অব্দি ছাদে নাচানাচি কারার ফল হাতেনাতে পেলো সে।ইসস এখন ক্লাস মিস না হলেই হলো। মাকে বলে বাসা থেকে বেরিয়ে তারাতাড়ি হাটতে লাগলো সায়েবা।আরেকটু দূরে গেলেই বাসস্ট্যান্ড।স্কুটি টাও আজকেই খারাপ হতে হলো! বিরক্তি তে কপাল কুচকে বিরবির করে নিজেকেই গালি দিতে লাগলো। আচমকা কারোর সাথে ধাক্কা খেতেই তার জায়গা হলো রাস্তার পাশের কাদামাটি তে।হতভম্ব হয়ে আর্তনাদ করতেই ভুলে গেলো সে।ক্ষীনসময় বাদে কোমরে ও হাতে ব্যথার অস্তিত্ব অনুভব করতেই মুখ থেকে অস্পষ্ট স্বরে ‘আহ’ বেড়িয়ে গেলো।

— রাস্তার মধ্যে শুয়ে আছো কেন?
ফারহান অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো সায়েবা কে।
ফারহানের কথা শুনে ব্যাথা ভুলে রাগ মাথায় চেপে বসলো সায়েবার।দাতে দাত চেপে বললো,
— আমি ধুলার রানী। তাই রাস্তায় রাস্তায় গড়াগড়ি খেয়ে গায়ে ধূলা মাখছি।এখানেই নিজের রাজপ্রাসাদ বানিয়ে রাজত্ব শুরু করবো। প্রশিক্ষণ দিয়ে সৈন্য সামন্ত বানিয়ে ধূলোর মহারানী হয়ে যাবো।তারপর যারা আমার সামনে এসে বেহুদা কথা বলবে তাদের ধরে ধূলোয় গড়াগড়ি খাওয়াবো।

সায়েবার কথা শুনে খুকখুক করে কেশে উঠলো ফারহান। মেয়েটা অসম্ভব রেগে গেছে বুঝতে পেরে আর কোন কথা বাড়ালো না।ফোন টা পকেটে ভরে সায়েবার দিকে এগিয়ে গেলো। আচমকা সায়েবার হাত ধরে টেনে তুলতেই সায়েবা আর্তনাদ করে উঠলো। ঠোঁট কামড়ে ধরে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করলো।চোখ থেকে দু ফোটা পানি বেরিয়ে যেতেই ফারহান নিজের খোলস থেকে বেরিয়ে এলো। অস্থির হয়ে সায়েবার হাত পা চেক করতে লাগলো।
— কোথায় লেগেছে তোমার?কোথায় ব্যাথা পেয়েছো?(অস্থির হয়ে)। রাস্তার মধ্যে পরে গেলে কি করে! চোখ কান খোলা রেখে হাটা যায় না!অপদার্থ মেয়ে।
শেষের কথা গুলো ধমকে বলতেই কেপে উঠল সায়েবা।
সায়েবার উত্তরের অপেক্ষা না করেই সায়েবা কে কোলে তুলে নিল ফারহান। সায়েবা চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে ফারহানের দিকে। সম্ভতি ফিরে পেতেই চেচিয়ে উঠলো।

— আরে কি করছেন?নামান আমাকে।মানুষ তাকিয়ে আছে ফারহান ভাইয়া।
সায়েবার দিকে বিরক্তিকর দৃষ্টি দিতেই সায়েবা চুপ হয়ে গেলো। সায়েবা কে গাড়ি তে বসিয়ে ড্রাইভিং সিটে বসে গাড়ি স্টার্ট করলো ফারহান।
— আমাকে নামিয়ে দিন।আমি বাসায় চলে যাবো। আপনার গাড়ি নোংরা হয়ে যাচ্ছে। আমার গায়ে কাদা লেগে আছে।শুনতে পাচ্ছেন আপনি?
সায়েবার কথা হাওয়ায় উড়িয়ে দিয়ে ফারহান গাড়ি হসপিটালের দিকে ছোটালো।
দিশ মিনিটে হসপিটাল পৌঁছে সায়েবাকে আবার কোলে তুলে নিলো ফারহান। সায়েবা কাচুমাচু করে আশপাশে তাকাচ্ছে। সবাই ভুত দেখার মতো করে তাকিয়ে আছে ওদের দিকে।
ডাক্তারের কেবিনে ঢুকে সায়েবা কে চেয়ারে বসিয়ে দিলো ফারহান। ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে শান্ত অথচ শক্ত গলায় বললো,

— দশ মিনিটের মধ্যে ফুল বডি চেকআপ করুন। কোথাও একটা স্ক্রেচ থাকলে ও আমাকে জানাবেন। আমি বাইরে আছি।
দ্রুত পায়ে কেবিন থেকে বেরিয়ে গেলো ফারহান। সায়েবা আহাম্মক হয়ে তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। এটা কি হলো???!
?
— হ্যালো।
— সায়েবার বাসার পাশে বাস স্ট্যন্ডের আসেপাশের সিসিটিভি ফুটেজ চেক কর।সায়েবা কে কে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছে তার খবর আমার চাই।
— ঠিক আছে ভাই।আমি এখনই আপনাকে জানাচ্ছি। আমাকে কয়েক মিনিট সময় দিন।
— শুধু খবর দিলে চলবে না। তাকে বিকেলের মধ্যে আমার সামনে হাজির চাই।
— আচ্ছা ভাই।চিন্তা করবেন না। আমি দেখছি।
ফোন কেটে রাগে চোয়াল শক্ত করে দাঁড়িয়ে রইলো ফারহান। রাগে গা থেকে গরম ধোঁয়া বেরুচ্ছে তার।

–আরে আরে কি করছেন? আমি তো বললাম আমি কোমড়ে আর হাতে ব্যাথা পেয়েছি।এতো টেস্ট করার দরকার নেই।
— প্লিজ ম্যাডাম আমাদের কে আমাদের কাজ করতে দিন।নাহলে স্যার খুব রেগে যাবেন।
নার্সটির অসহায় গলা শুনে সায়েবা ভ্রু কুচকে তাকাল তার দিকে। সসন্দিহান গলায় জানতে চাইল,,
— ফারহান ভাইয়াকে এতো ভয় কেন পাচ্ছেন আপনি?
— হস্পিটালের মালিকের ছেলে কে ভয় পাবো না!(অবাক হয়ে)
— এই হসপিটাল ওনাদের কবে থেকে হলো? (ভ্রু কুচকে)
— আরো এক বছর আগে থেকে। স্যারের মেয়ে তো কয়েকদিন পরেই ডক্টর হয়ে ফিরবেন।তখন তিনিই এই হসপিটালের দায়িত্ব নিবেন।

— ওহহহহ।
— আর না করবেন না ম্যাডাম। প্লিজ কোঅপরেট করুন।
— কি আর করার। নিন করেন যা খুশি।
সমস্ত টেস্ট করিয়ে রিপোর্ট পেতে দুই ঘন্টা সময় লেগে গেলো। সায়েবা এখন একটি লাক্সারি কেবিনে বসে আছে। একেই বলে বড়লোকের বড়লোকি কারবার। মশা মারতে কামান দাগা।হুহ।মনে মনে ফারহানের গুষ্টি শুদ্ধো উদ্ধার করে ফেলছে সে।
আরো আধঘন্টা পরে ফারহান আসলো। দেখে মনে হচ্ছে সায়েবার বড় কোন রোগ ধরা পরেছে। চেহারা পেচার মতো করে এসে সায়েবার সামনে দাড়ালো।
— কি হয়েছে?

সায়েবা আসক্তি পর্ব ১

— তেমন কিছু না। কোমড়ে একটু ব্যাথা পেয়েছ।হাত আর পায়ে কিছুটা ব্যাথা হবে। রাতে জ্বর আসতে পারে।কয়েকদিন ফুল বেড রেষ্টে থাকবে।বেশি নড়াচড়া করবে না। তকোমড়ের সমস্যা বাড়তে পারে। তাহলে আর তোমার ধূলোর রানী হওয়া হবে না।
ফারহানের কথা শুনে সায়েবা কটমট করে তার দিকে তাকালো। সায়েবাকে এভাবে তাকাতে দেখে ফারহান মুচকি হেসে ওর গাল টেনে দিলো।
সায়েবা চোখ বড় বড় তাকালো ফারহানের দিকে। এই ছেলের হঠাৎ করে কি হলো! এতো দিন তো পাত্তাই দিতো না।এখন এতো দয়া দেখাচ্ছে কেন। মোটা টাকা হসপিটালের বিল ধরিয়ে দেয়ার ধান্দা না তো!আল্লাহ! কি ধান্দা বাজ লোক।নাউজুবিল্লাহ!

সায়েবা আসক্তি পর্ব ৩

1 COMMENT

Comments are closed.