সায়েবা আসক্তি পর্ব ৩৫

সায়েবা আসক্তি পর্ব ৩৫
লেখিকা সানজিদা বিনতে সফি

সায়েবার উপর চরম ভাবে ক্ষেপে আছে ফারহান। নিজের রুমে ডিভানে বসে হাটুর উপর হাত রেখে হাতের আঙুল আর পা অনবরত নাড়িয়ে চলেছে সে।একটু পর পর নাক ঘসে রাগ কমানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে। এদিকে সায়েবার কোন খবর নেই।সে নিজের মতো রান্নাঘরে ব্যস্ত। ফায়জা কে হসপিটাল থেকে নিয়ে এসেছে আজ তিন দিন। ফারহান সায়েবার উপর রেগে আছে জেনেও সায়েবা একবার ও অনুতপ্ত হয় নি।এতো বড় একটা কথা লুকানোর জন্য সে ক্ষমা ও চায় নি।উল্টো ফারহানের উপর রাগ দেখাচ্ছে।

কিন্তু কিছুক্ষণ আগে ফারহান যখন সায়েবার ফোনে নিজেদের ভিডিও দেখছিলো তখন সেদিনের অডিও ক্লিপ চালু হয়ে যায়।সব কিছু শুনে ফারহানের রাগ আকাশ ছুয়েছে।সেদিন ই যদি সব কিছু সায়েবা তাকে খুলে বলতো তাহলে আজ এই দিন দেখতে হতো না। সায়েবার খামখেয়ালির জন্য আজ ফায়জা মারা ও যেতে পারতো। ফারহান আগে থেকে সব জানলে ফায়জা কে মেন্টাল সাপোর্ট করতে পারতো। এমন পরিস্থিতি তৈরি ই হতো না। সায়েবা এটা কিভাবে করতে পারলো ফারহানের মাথায় আসছে না!
রক্তিম চোখ নিয়ে বারবার দরজার দিকে তাকাচ্ছে ফারহান।আজ সায়েবা কে এর জবাব দিতে হবে। ভালোবাসে বলেই সব কিছুতে ছাড় দিবে এটা সায়েবার ভুল ধারণা। এটা যদি ফায়জার খামখেয়ালির জন্য সায়েবার সাথে হতো তাহলেও ফায়জা কে ও এর জবাব দিতে হতো।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

রুমে ঢুকে ফারহানের চেহারা দেখে থমকে গেলো সায়েবা। ফারহান রক্তিম চোখে তার দিকেই তাকিয়ে। হাত পায়ের অস্থিরতা বলে দিচ্ছে ফারহান বর্তমানে খুব বেশিই রেগে আছে। সায়েবা আতংকিত চোখে তাকিয়ে আছে ফারহানের দিকে। সায়েবা কে তাকিয়ে থাকতে দেখে ফারহান উঠে এসে সায়েবার মুখোমুখি দাড়ালো। সায়েবার চোখের দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বললো,
— সায়েবা,,, ফায়জার সাথে এর আগে এমন অপ্রিয়কর কিছু কি আরো হয়েছিল?
ফারহানের প্রশ্নে হচকচিয়ে গেলো সায়েবা। ভয়ার্ত চোখে ফারহানের দিকে তাকিয়ে শুকনো ঢোক গিললো। আমতা আমতা করে বললো,

— ক কি ব বলছেন?আমি কিছু বুঝতে পারছি না।
ফারহানের চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো। দাতে দাত চেপে নিজের রাগ সংবরণ করার চেষ্টা করলো। চোখ বন্ধ করে জোরে কয়েক বার নিশ্বাস নিয়ে পুনরায় সায়েবরা দিকে তাকিয়ে বোঝানোর স্বরে বললো,
— দেখো সায়েবা,আমার কাছ থেকে কিছু লুকিয়ো না।আমরা একে অন্যের পরিপূরক। আমার কাছে তোমার গোপনীয়তা অত্যন্ত পীড়াদায়ক। আমি আবার জানতে চাইছি, প্লিজ সত্যি টা আমাকে বলো।তোমার কোন ভয় নেই।আমি এ বিষয় নিয়ে কাওকে কিছু বলবো না। আমি শুধু চাই তুমি নিজের মুখে আমাকে সব টা বলবে।
ফারহানের অনুরোধ শুনে সায়েবার চোখে অশ্রুরা ভীড় করলো।চেয়েও সে ফারহান কে কিছু বলতে পারছে না। ফায়জা কে ওয়াদা করেছে সে।এ বিষয় নিয়ে কারো সাথে কথা বলবে না। এমনকি ফারহানের সাথে ও না।সায়েবা নিশ্চিত ফারহান কিছু টের পেয়েছে।না হলে এভাবে জানতে চাইতো না।সায়েবা নিজেকে সামলে কাপা কাপা গলায় বললো,

— আমি কিছু বলতে পারবো না। আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করবেন না প্লিজ। এসব নিয়ে এখন কথা না বলা টাই সব চেয়ে উত্তম।
ফারহান এবার আর নিজের রাগ সংবরণ করতে পারলো না। টি টেবিলের উপর থেকে ফ্লাওয়ার ভাস টা নিয়ে ড্রেসিং টেবিলের উপর ছুরে মারলো। মুহুর্তে ই সমস্ত আয়না ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে গেলো। বিকট শব্দে কেপে উঠলো সায়েবা।ফারহান সায়েবার দিকে তাকিয়ে হুংকার দিয়ে বললো,
— তোমার এই বলতে না পারার কারণে আমার আপু জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে ছিলো। আচ্ছা বুঝলাম আগে কি হয়েছে তা তুমি কোন এক কারণে বলতে পারো নি। কিন্তু বিয়ের দিন যা হলো তা কেন জানালে না আমাকে?আমি তো তোমার সাথেই ছিলাম। কেন বললে না বলো?
ফারহানের চিৎকারে থরথর করে কাপছে সায়েবা।অশ্রুসিক্ত চোখে ফারহান কে বললো,
— আমার কথা টা একটু শুনুন! আমি বলতে চাইনি কারণ তাহলে সেই মুহুর্তে ই একটা সিনক্রিয়েট হয়ে যেতো। বাড়িতে তখন এতো মেহমান ছিলো,,

— চুপ,একদম চুপ।(হিসহিসিয়ে)। মেহমানের চিন্তা ছিলো কিন্তু আমার আপুর চিন্তা তোমার ছিলো না তাই না? আমার আপু যদি মরে যেতো ওইদিন? তখন তোমার মেহমানদের আপ্যায়ন আমার আপুকে ফিরিয়ে আনতে পারতো? বলো?(চিৎকার করে)
— আমি বুঝতে পারি নি আপু এমন কিছু করবে??(ফুপিয়ে)
এবার ফারহান কে অসহায় দেখালো।ছলছল চোখে সায়েবার দিকে তাকিয়ে অসহায় গলায় বললো,
— আসলেই তুমি এমন ভেবেছো সায়েবা!আচ্ছা,তোমাকে কেউ এই পরিস্থিতিতে এসব বললে তুমি কি করতে? পারতে নিজেকে ঠিক রাখতে? ভালো করে ভেবে বলো তো সায়েবা।

সায়েবা অশ্রুসিক্ত চোখে অবাক হয়ে তাকালো ফারহানের দিকে। আসলেই কি সে নিজেকে সামলে রাখতে পারতো! নাহ!কখনোই সে নিজেকে সামলে রাখতে পারতো না। সে ও এমন ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলতো।অপরাধবোধে ঘিরে ধরলো সায়েবা কে। ফারহানের দিকে চোখ তুলে তাকানোর মুখ নেই তার। এতো বড় ভুল সে কিভাবে করে ফেললো!
সায়েবার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো ফারহান।রাগ টা কে সামলে সায়েবার ফোন টা তার হাতে দিয়ে আক্ষেপ নিয়ে বললো,
— আমার ই ভুল সায়েবা।আমি ই এখনো তোমার ভরসায় জায়গা হয়ে উঠতে পারি নি। বাদ দাও। এসব নিয়ে আর চিন্তা করো না।
শান্ত গলায় কথা গুলো বলে তৎক্ষনাৎ রুম থেকে বেরিয়ে গেলো ফারহান। ফারহানের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে শব্দ করে কেদে উঠল সায়েবা।ফারহান খুব কষ্ট পেয়েছে আজ।সব চেয়ে বেশি কষ্ট দিয়েছে সায়েবার এই নির্বুদ্ধিতা।

নিজের বারান্দার আর্টিফিশিয়াল ঘাসের উপর বসে আছে ফায়জা।আজ তিন দিন আদিব কে দেখে না সে।আদিব তার কথা রেখেছে।সে আসে নি ফায়জার সামনে। সেদিন তাদের মধ্যে কি কথা হয়েছে তা কেউ জানে না। ফরহাদ থেকে শুনেছে আদিব বর্তমানে চট্টগ্রাম আছে।ব্যবসায়ী কাজে ওখানেই থাকবে কিছুদিন।তারপর কোম্পানির কিছু প্রোডাক্ট লঞ্চের জন্য কানাডা যাবে।ফায়জা জানে এই সব ব্যস্ততা শুধু তার থেকে দূরে থাকার জন্য। ক্লান্ত চোখে তাকিয়ে রইলো দূর আকাশের দিকে। সে তো নিজেই চেয়েছিল আদিব তার থেকে দূরে থাকুক। তাহলে এখন কেন এই শূন্যতা ঘিরে ধরেছে তাকে।বুকের ভিতর অসহ্য যন্ত্রণা হাসফাস করছে। মনে হচ্ছে আদিব কে ছাড়া বেচে থাকা যন্ত্রণার।মারাত্মক যন্ত্রণার।আদিবের দুষ্টু হাসি,কথা,ভালোবাসা সব চাই তার।পুরো আদিবটা কেই চাই।পাশে বসিয়ে কাধে মাথা রেখে অন্ধকার আকাশের রহস্য খুজতে আদিব কে চাই।নিজের ভাবনায় বিরক্তির হলো ফায়জা।কি সব উল্টো পালটা ভাবছে সে!এসব জীবনে ও সম্ভব নয়।

এদিকে সিগারেটের আগুনে নিজের হৃদপিণ্ড পোড়াতে ব্যস্ত আদিব।এই চট্টগ্রাম শহর তার মোটেও পছন্দ ছিলো না। এই শহর তার ভালোবাসার মানুষের সাথে দূরত্ব সৃষ্টি করে দিতো। তাই বাবার বার বার বলার পরেও সে চট্টগ্রাম আসতো না। অথচ আজ সেই মানুষের থেকে দূরে থাকার জন্য জ এই শহরে আশ্রয় নিতে হয়েছে। তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে সিগারেটে শেষ টান দিয়ে পা দিয়ে আগুন নিভিয়ে ফেললো সে। অবশিষ্ট ধোয়া উড়াতে উড়তে ছাদের রেলিঙে ঠেস দিয়ে দাড়ালো। অন্ধকার আকাশের দিকে তাকিয়ে বিরবির করলো,

সায়েবা আসক্তি পর্ব ৩৪

‘আমি জানি, আমার প্রিয়তমা নিষ্ঠুর,
তবুও আমি তাকেই ভালোবেসেছি।
তার নিষ্ঠুরতা কে ছাপিয়ে আমার ভালোবাসা তার মনে পৌঁছে দেয়ার চেষ্টা করেছি।
তবে এই আঘাত কেন?
কেন এতো অবহেলা!
আমার ভালোবাসা কি তবে তার নিষ্ঠুরতার কাছে হেরে গেলো!
অথচ আমি তার জন্য এক মহাকাশ সমান ভালোবাসার আঙিনা সাজিয়ে বসে ছিলাম!
আমার প্রেয়সীকেই কেন এতো নিষ্ঠুর হতে হলো!

সায়েবা আসক্তি পর্ব ৩৬

2 COMMENTS

Comments are closed.