সায়েবা আসক্তি পর্ব ৮

সায়েবা আসক্তি পর্ব ৮
লেখিকা সানজিদা বিনতে সফি

টুংটাং চামচের শব্দ ব্যতীত অন্য কোনো শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। সবাই খাওয়ায় ব্যস্ত হলেও ফারহান এক মনে সায়েবার দিকে তাকিয়ে আছে। কয়েক বার সায়েবার সাথে চোখাচোখি হলে ও ফারহান দৃষ্টি সরায় নি।সায়েবা কয়েক বার মনে মনে নির্লজ্জ বলে গালি দিয়ে নিজের কাজে মন দিলো।
খাওয়ার মাঝেই ফরহাদের চোখ ফারহানের দিকে গেলো। ফারহান কে একদৃষ্টি তে তাকিয়ে থাকতে দেখে গলা খাকারি দিয়ে দৃষ্টি আকর্ষনের চেষ্টা করলো।কিন্তু ফারহান আগের মতোই সায়েবার দিকে তাকিয়ে আছে। ফরহাদ ফারহানের ধ্যান ভাঙাতে কনুই দিয়ে খোচা মেরে বললো,,

— এভাবে কি দেখিস ভাই আমার।খাবার তো সামনে। শুধু তাকিয়ে থাকলেই পেট ভরবে!নিজেও খা অন্য কেও খেতে দে।আন্টি যদি এসে দেখে তুই তার বানানো খাবার রেখে তার মেয়ে কে চোখ দিয়ে গিলছিস তাহলে ব্যাপারটা খুব একটা ভালো হবে না। (শয়তানি হেসে)
ফরহাদের বিদ্রুপ করা কথা শুনে বিরক্তিকর চোখে তাকালো ফারহান। তাকে খোচা মেরে এখন নিজ মনে খাবার খাচ্ছে। সেও কিছু কম যায় না। তাই ভাইয়ের কানের কাছে ফিসফিস করে বললো,
— আমি শুধু পেট ভরাতে আসি নি।মন ও ভরাতে এসেছি।তাই আগে মনের ক্ষুধা টাই আগে মিটাই।বড় ভাই হয়ে ছোট ভাইয়ের প্রেমের দৃষ্টির দিকে নজর দিতে লজ্জা করে না?তুমি নিজের পেট ভরাও আর আমাকে আমার মন ভরাতে দাও।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

ফারহানের কথা শুনে গলায় খাবার আটকে গেলো ফরহাদের।খুক খুক করে কেশে উঠতেই তড়িঘড়ি করে পানি এগিয়ে দিলো সায়েবা।সায়েবার মা খাবার পরিবেশন করে রুমে গেছে ফ্রেশ হতে। ওরা ওনার জন্য দেড়ি করতে চেয়েছিলো কিন্তু সে নিষেধ করে।
— কি হলো ভাইয়া।বিষম খেলেন কেন?(অস্থির হয়ে)
ফরহাদ কোন রকম পানিটুকু গিলে হাসার চেষ্টা করে বললো,,
— ও কিছু না। মাঝে মাঝে এমন হুটহাট বিষম লেগে যায় আমার।তুমি খাও।আমি ঠিক আছি এখন।
ফারহান এখানো সায়েবার দিকে তাকিয়ে আছে। যেন চোখের পলক ফেলতেই ভুলে গেছে।সায়েবা সেদিকে তাকিয়ে বিরবির করে বললো ‘অসভ্য’
আর কেউ না শুনলে ও ফারহান ঠিকই শুনেছে রানী সাহেবা তাকে অসভ্য বলেছে।
— ধুলোর রানী কি আমাকে অসভ্য বললেন?(বাকা হেসে)
— হ্যা বলেছি।আপনি একটা অসভ্য। সস্তা টাইপের অসভ্য লোক।(ক্রুর গলায়)
সায়েবার কথা শুনে ফারহান চেহারা গম্ভীর করে ফেললো।চোখে মুখে গাম্ভীর্য ভাব ফুটিয়ে বললো,
— কেন?আমি কি আপনাকে চুমু খেয়েছি?

— নাউজুবিল্লাহ। এসব কি বলিস ভাই।বড় ভাই হই তোর।একটু তো সম্মান দে!কি লজ্জা কি লজ্জা!আমার সামনে এসব অস্তাগফিরুল্লাহ কথা বলতে ভয় করলো না তোর?
— না।(ভাবলেশহীন গলায়)
সায়েবা এতক্ষণ হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকলেও এখন অসহায় চোখে তাকিয়ে আছে ফারহানের দিকে। লজ্জায় ফরহাদের দিকে তাকানোর সাহস পাচ্ছে না।শোয়েব মিটমিট করে হেসে যাচ্ছে তখন থেকে। এবার হাসি থামিয়ে সিরিয়াস গলায়,
— আপনার কপাল খারাপ ভাইয়া।নাহলে এমন ধুলো যুক্ত মেয়ে মনে ধরে বলেন?(আফসোস করে)। দেখা গেলো রাস্তার মাথার পাগলা মন্টু কে সে মন দিয়ে বসে আছে। সারাদিন ধূলোর মধ্যে গড়াগড়ি খায় কি না!ধুলোর রানী বলে কথা! আপনার মতো নিট এন্ড ক্লিন মানুষকে মনে হয় না তার মনে ধরবে।
শোয়েবের দিকে কটমট করে তাকালো সায়েবা।চোখ দিয়ে শাসিয়ে বললো, একবার তোকে হাতের কাছে পেয়ে নেই?।

ওদের কথার মাঝেই সায়েবার মা এসে উপস্থিত হলো। সবার খাওয়া মোটামুটি প্রায় শেষ। শুধু ফারহান না খেয়ে খালি প্লেট নিয়ে বসে আছে।
— কি হলো বাবা!তুমি খাচ্ছো না কেন ?(আর্তনাদ করে)
সায়েবার মায়ের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো ফারহান।শান্ত গলায় বললো,
— আপনার জন্য অপেক্ষা করছিলাম আন্টি।আমরা সবাই খেয়ে ফেললে আপনার একা একা খেতে হবে। তাই আপনার জন্য বসে আছি।অনেক সময় হয়ে গেছে আসুন তারাতাড়ি খেয়ে নেই।(তাড়া দিয়ে)
ফারহানের কথা শুনে প্রচন্ড খুশি হলেন সায়েবার মা।ছেলেটা তার জন্য অপেক্ষা করে বসে ভাবতেই চোখে পানি চলে এলো তার।তারাতাড়ি করে খাবার বেরে ফারহানের সাথে খেয়ে নিলো সে।
সায়েবা,ফরহাদ আর শোয়েব এতক্ষণ দাঁড়িয়ে ফারহানের কথা শুনছিল।ফারহানের কথা শুনে নিজের অজান্তেই সায়েবার মুখে হাসি ফুটে উঠল।

ফারহানরা চলে গেছে অনেকক্ষণ। সায়েবা নিজের রুমের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। দৃষ্টি ফারহানের বারান্দার দিকে। ফারহান ও তার দিকে তাকিয়ে আছে। ফারহানের নেশালো চোখের চাহনি দেখে সায়েবার সর্বাঙ্গে কাপন ধরে গেলো। এর আগে কখনো ফারহান তার দিকে এমন ঘোর লাগা নজরে তাকায়নি। কয়েক দিনের মধ্যে ফারহানের দৃষ্টিতে অমূল পরিবর্তন এসেছে।ফারহানের চোখ তাকে বার বার বুঝিয়ে দিচ্ছে সে তাকে কতটা ভালোবাসে।কতটা আকুল হয়ে তাকে নিজের করে পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করে আছে।
সায়েবা লজ্জায় নিজেকে নিজের মধ্যে গুটিয়ে নিলো।সায়েবার লজ্জা রাঙা মুখ দেখে ফারহান ঘোরের মধ্যে চলে গেলো। আজকাল নিজেকে সামলানো দায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।মেয়েটাকে দেখলেই নিজের বুকের ভেতর লুকিয়ে রাখতে ইচ্ছে করে। মেয়েটা যে বড্ড অবাধ্য। অভিমানী চোখে তার দিকে তাকালে তার মনের তৃষ্ণা আরো বেড়ে যায়।আহ!এ এক মিষ্টি যন্ত্রণা। অভিমানী কে আর বেশিদিন নিজের থেকে দূরে সরিয়ে রাখা যাবে না।

‘আমি বিয়ে করতে চাই আব্বু’
ফারহানের কথায় ড্রয়িং রুমে বাজ পড়ার মতো অবস্থা হলো। সবাই বজ্র চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে। ফারহানের তাতে কোন মাথা ব্যাথা নেই। সে কথাটা বলে আবার ফোনের মধ্যে মুখ গুজে বসে আছে। সানোয়ার সাহেব অবাক চোখে তাকিয়ে আছে ছেলের দিকে।
— আমি কি কিছু ভুল শুনলাম ফারহানা!
— না।তুমি ঠিকই শুনেছো।

ফারহানা বেগমের কথা শুনে নড়েচরে বসলেন সানোয়ার সাহেব। ফারহানের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন,
— তা বাবা বললেই তো আর বিয়ে করানো যাবে না। তার জন্য একটা মেয়ে চাই।আর তোমার বড় ভাই এখনো বিয়ে করে নি।আগে তাকে বিয়ে করাই।তারপর তোমার ব্যাপারটা দেখছি।ফাইজা কিছুদিনের মধ্যেই দেশে আসছে।ততদিনে নিজের পড়ালেখা শেষ করে বিজনেস জয়েন করো।আমরা ও তোমাদের জন্য মানানসই মেয়ে খুজি তোমাদের জন্য। দু ভাইকে নাহয় এক সাথেই বিয়ে করিয়ে দিলাম।
— আমার জন্য মেয়ে খুজতে হবে না আব্বু।মেয়ে আমার পছন্দ করাই আছে।তুমি বরং ভাইয়ার জন্য মেয়ে খোজো।আর বিয়ে না করলেও আকদ অথবা এনগেজমেন্ট করে রাখতে চাই আমি।
সানোয়ার সাহেবের চোখ কোটর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার অবস্থা। স্ত্রী আর ছেলেদের দিকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। ফারহান সবার মাঝে বোমা মেরে চুপচাপ বসে ফোন স্ক্রোল করছে।
ফারহানা বেগম আর ফরহাদ সানোয়ার সাহেবের অবস্থা দেখে মিটমিটিয়ে হাসছে।সানোয়ার সাহেব অস্থির হয়ে ফারাহানা বেগম কে প্রশ্ন করলেন,

— এসব কি হচ্ছে ফারু।ফারহান এসব কি বলছে?বিয়ে করবে বলছে!আর এখন মেয়ে ও নাকি পছন্দ করা আছে বলছে!আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। কেউ আমাকে খোলাসা করে বলবে?
সানোয়ার সাহেবের অবস্থা দেখে এবার উচ্চস্বরে হেসে উঠলো সবাই।ফারহান ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে উঠে চলে গেলো।
— আরে আরে কোথায় যাচ্ছো তুমি।আমার প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যাও।ফারহান!
ফারহানা বেগম নিজের হাসি থামিয়ে বললো,
— আমি তোমার সমস্ত প্রশ্নের জবাব দিচ্ছি। তোমার ছেলে প্রেমে পরেছে।আর তাকেই বিয়ে করতে চাইছে।
— কিন্তু মেয়েটা কে?
— মেয়েটা আর কেউ না, সায়েবা।
— আমাদের সায়েবা!

সায়েবা আসক্তি পর্ব ৭

সানোয়ার সাহেব অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে ফারহানা বেগমের দিকে।
— হুম।কেন?সায়েবাকে পছন্দ না তোমার?
সানোয়ার সাহেব নিজের মুখটা গম্ভীর করে ফেললো। তাকে দেখে মনে হচ্ছে খুব দুশ্চিন্তায় আছে সে।স্বামীর অবস্থা দেখে ফারহানা বেগমের হাসি হাসি মুখটা মলিন হয়ে গেলো। তাহলে কি কোন ঝড় আসতে চলেছে!

সায়েবা আসক্তি পর্ব ৯