প্রেমময়ী তুমি পর্ব ৫২

প্রেমময়ী তুমি পর্ব ৫২
নিশাত জাহান নিশি

“ভাবতে চাইনা আমি! তবুও ভাবতে হচ্ছে। মানুষটা বোধ হয় জাদু টোনা জানে জানিস? জাদুর কাঠির মতো কেমন আমায় টানে! কী থেকে কী হয়ে গেলাম আমি? এমনটা তো হওয়ার কথা ছিলনা।”

জায়মা অকপট দৃষ্টিতে চাঁদের দিকে তাকালো। কিয়ৎক্ষণ তাকে একই দৃষ্টিতে নিরীক্ষণ করল। চাঁদের অনুভূতি এখন তার কাছে নিরর্থক ঠেকছে! থাকতে যখন মানুষ তার গুরুত্ব বুঝেনা তখন না থাকাতে কেন তার গুরুত্ব বুঝবে? জায়মা কঠিন ভাব নিলো। অতঃপর রূঢ় গলায় বলল,,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“এখন এসব বলেও লাভ নেই বুঝেছিস? কারণ, তুই নিজেই তখন পাষাণের মতো নূর ভাইয়াকে ফিরিয়ে দিয়েছিলি! আমি অনেক বলার পরেও ফেরানোর চেষ্টা করিসনি। জাস্ট ফরগেট ইট ওকে? নূর ভাইয়াকে নিয়ে এখন ভাবতেও ভুলে যা তুই। এটাই তোর জন্য বেটার হবে।”

মাথাটা নুইয়ে নিলো চাঁদ। কিঞ্চিৎ মুহূর্তের জন্য নীরবতায় নিজেকে ধাতস্থ করল। মনে মনে যোগ বিয়োগ কষতে লাগল। নিজেকে দোষারোপ করার পাশাপাশি অনুশোচনাও করতে লাগল। কিছু একটা ভেবে চাঁদ ঝট করে বসা থেকে ওঠে দাঁড়ালো। জায়মার দিকে শীতল দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। ভরাট গলায় বলল,,

“নূর ভাইয়ার সাথে আমি অন্য কাউকে মানতে পারবনা জায়মা! এই জীবন থাকতে না। অনেক ভেবে আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি। খুব কঠিন সেই সিদ্ধান্ত। হয়তো এই সিদ্ধান্তটি শোনার পর বাড়ির সবাই বজ্রপাতের মতো চমকে উঠবে! কেউ কেউ আমার সিদ্ধান্তকে মেনে নিবে নয়তো কেউ কেউ অস্বীকার করবে!

সম্পূর্ণ অনিশ্চিত একটা সিদ্ধান্ত৷ তবে যাই হয়ে যাক না কেন আমি আমার এই সিদ্ধান্তে অটল থাকব। আমি যেমন নূর ভাইয়াকে ফিরিয়ে দিয়েছিলাম ঠিক তেমনি আমিই নূর ভাইয়াকে আমার করে ছাড়ব! এবার তা যে করেই হোক।”

হনহনিয়ে জায়গা থেকে প্রস্থান নিলো চাঁদ। জায়মা নির্বোধ দৃষ্টিতে চাঁদের যাওয়ার পথে তাকিয়ে রইল। চাঁদের সেই কঠিন সিদ্ধান্তটি কী হতে পারে তাই ভেবে বের করার চেষ্টা করল। বারবার ভাবনাগুলো তার একটি সিদ্ধান্তে এসেই থেমে থেমে যাচ্ছিল। যে সিদ্ধান্তটির কথা জায়মা আঁচ করতে পারছে সেই সিদ্ধান্তটি আদোতে নূরের পছন্দ হবে কিনা তা ভেবেই সে হয়রান হয়ে উঠল! তখনকার বাড়ির পরিস্থিতি ঠিক কীরূপ হবে তা ভেবেই তার অন্তর্আত্তা কেঁপে উঠল।

আয়মন তার রুমে উদোম শরীরে উবুড় হয়ে শুয়ে আছে। ফোন ঘেঁটেঘুটে সে গ্যালারিতে তাশফিয়ার ছবি দেখছে! বড্ড মিস করছে সে তাশফিয়াকে। একটিবার তাশফিয়াকে কাছ থেকে দেখার জন্য মনটা তার আকুপাকু করছে! তবে এই মাঝরাতে তাশফিয়াকে ডাকাটা বা তার রুমে যাওয়াটা আয়মনের চোখে অশোভন দেখাচ্ছে।

তাই সে হাজার চেয়েও তাশফিয়াকে দেখতে পারছেনা, তাকে ছুঁতে পারছেনা, তার সাথে কথা বলতে পারছেনা। অশান্ত মনকে শান্ত করার জন্যই সে এখন তাশফিয়ার ছবি দেখে রাত্রি পাড় করবে ভাবছে। ইতোমধ্যেই দরজায় হঠাৎ সজোরে করাঘাত পড়ল। আয়মনের কল্পনায় ব্যাঘাত ঘটল!

অস্থির হয়ে চাঁদ আয়মনকে ডাকতে শুরু করল। তড়িঘড়ি করে আয়মন হাত থেকে ফোনটা রেখে শোয়া থেকে ওঠে দাঁড়ালো। চাঁদের হয়তো কিছু একটা হয়েছে ভেবে সে উৎকণ্ঠিত হয়ে উঠল। সত্যিই কিছু না হলে নিশ্চয়ই এতরাতে চাঁদ রুমের দরজা ধাক্কাত না!

চট জলদি আয়মন ভেতর থেকে দরজার খিলটা খুলে দিলো। অমনি চাঁদ আয়মনকে উপেক্ষা করে হুড়মুড়িয়ে রুমের ভেতর প্রবেশ করল। বেশ ভাব নিয়ে বিছানার উপর পায়ের উপর পা তুলে বসল। শূণ্য গলায় আট পাঁচ না ভেবেই আয়মনকে লক্ষ্য করে বলল,,

“ভাইয়া। আমি বিয়ে করতে চাই!”
৪৪০ ভোল্টের ঝটকা খেলো আয়মন! মাথায় হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল সে। তার থেকে তিন বছরের ছোটো বোন কিনা তার সামনেই বিয়ের কথা বলছে? ভাবা যায় এসব? লাজ শরম কী দুনিয়া থেকে ওঠে গেল? চট করে ঘুরে এলো আয়মনের। চাঁদের দিকে হঠকারি দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। কঠিন গলায় শুধালো,,

“এই কী বললি তুই?”
চাঁদ এখনো তার জেদে অনড় রইল। স্পষ্ট গলায় বলল,,
“যা শুনেছ একদম ঠিক শুনেছ ভাইয়া। আমি সত্যি সত্যি বিয়ে করতে চাই! পাত্র ও একদম রেডি। এবার শুধু তোমার কাজ হলো পাত্রের পরিবারকে রাজি করানো আর চাইলে পাত্রীর পরিবারকেও রাজি করানো। যদি বাবা-মা রাজি না হয় তো!”

পুনরায় ঝটকা খেয়ে আয়মন মাথা ঝাঁকালো। ঘোর থেকে বেরিয়ে আসার শতভাগ চেষ্টা করল। চ্যালচ্যালিয়ে হেঁটে এসে চাঁদের পাশাপাশি বসল। উদ্বিগ্ন হয়ে চাঁদের কপালে হাত রাখল! কপালের উষ্ণতা পরিমাপ করে বলল,,

“এই তোর আবার জ্বর টর হলো নাকি? শরীর টরীর খারাপ লাগছে? নাকি মাথাব্যথা করছে? কোনটা?”
আয়মনের এহেন হেয়ালিপূর্ণ আচরণে চাঁদ বিরক্তবোধ করল। রুষ্ট হয়ে সে আয়মনের দিকে ঘুরে বসল। তিক্ত গলায় বলল,,

“আমি যা বলছি সত্যি বলছি ভাইয়া। আমি সত্যিই বিয়ে করতে চাই। যাকে আমি ভালোবাসি তাকেই বিয়ে করতে চাই। নিজের চোখের সামনে আমি তাকে অন্য কারো হতে দেখতে পারবনা ভাইয়া। সত্যি বলছি ম’রে যাব আমি। প্লিজ তুমি কিছু একটা করো। আমার হয়ে কিছু একটা করো।”

চাঁদের আহাজারি আয়মনের কাছে এবার সিরিয়াস ঠেকলো! আয়মন নিজেও এবার সিরিয়াস হতে বাধ্য হলো। ঝেড়ে কেশে সে তৎপর গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,,

“পাত্রটা কে হ্যাঁ?”
“নূর ভাইয়া!”

আয়মন চিন্তায় পড়ে গেল! দুঃশ্চিন্তায় কপাল ঘঁষতে লাগল৷ নূর এবং সাদমানের মধ্যে যে চাঁদকে নিয়ে মহাবিবাদ চলছে সে সম্পর্কে সে ভালোভাবে অবগত। তবে একটা দিক ভেবে আয়মন বেশ খুশি হলো। চাঁদ সাদমানকে নয় নূরকে চায়! নূরের ভালোবাসা শেষমেশ স্বার্থকতা পেল। কথাটা শুনলে নূর যে কী পরিমান খুশি হবে তা ভেবেই সে মনে মনে হাসছিল। আয়মনের মৌনতা দেখে চাঁদ কপাল কুঁচকালো৷ ভাবনায় অস্থির হয়ে উঠল। অধৈর্য্য গলায় শুধালো,,

“কী হয়েছে ভাইয়া? কিছু তো একটা বলো?”
আয়মন ফিচেল হাসল। চাঁদের দিকে সন্তোষজনক দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। চাঁদকে অভয় যুগালো। হাসি মুখে বলল,
“এখন রুমে যা তুই। কাল সকালে এই বিষয় নিয়ে কথা হবে।”

আয়মনের সিদ্ধান্তকে সম্মান জানালো চাঁদ। বসা থেকে ওঠে দাঁড়ালো সে। একগুঁয়ে গলায় বলল,,
“ওকে গেলাম। তবে কাল সকালে কিন্তু সত্যি সত্যিই এই বিষয় নিয়ে কথা বলবে তুমি। আমি কিন্তু খুব সিরিয়াস। সত্যিই খুব সিরিয়াস।”

গটগট করে হেঁটে চাঁদ আয়মনের রুম পরিত্যাগ করল। চাঁদের যাওয়ার পথে তাকিয়ে আয়মন সুখের হাসি হাসল। সঙ্গে সঙ্গেই রুমের দরজাটা আটকে দিলো আয়মন। উৎফুল্ল মনে সে ফোনটা হাতে তুলে নিলো। উত্তেজিত হয়ে নূরের নাম্বারে ডায়াল করল। তবে শেষ পর্যন্ত কলটা নূরের নাম্বার অবধি ঢুকল না! ব্যালেন্স শেষ হয়ে গেল ফোনের। ইমার্জেন্সি ব্যালেন্সও তোলা হয়ে গেছে অনেক আগে। হায় হুতাশ করল আয়মন। কপাল চাপড়ে বলল,,

“শিট। শুভ কাজটাতেও এভাবে বাঁধা পড়ল?”
বুকভরা আক্ষেপ নিয়ে আয়মন ঘুমিয়ে পড়ল। মনে মনে স্থির করে নিলো সকালে উঠেই সে নূরের সাথে দেখা করতে যাবে। চাঁদের মনের কথা প্রথমে নূরকে জানাবে! বহুদিন পর নূরের হাসি মুখটা দেখবে। এরপর যা হওয়ার হবে।

আজ সকাল থেকেই সাদমান বেশ খোশমেজাজে আছে! কালো রঙের শার্টের সঙ্গে কালো রঙের প্যান্ট। চোখে কালো চশমা, হাতে ব্র্যান্ডের কালো ঘড়ি। মুখে শেভ টেভ করে হুলুস্থুল এক কাণ্ড। ভীষণ রকমের হ্যান্ডসাম দেখাচ্ছে তাকে! চাঁদকে কীভাবে ইমপ্রেস করতে হবে সে চিন্তায় ভীষণ চিন্তিত সে।

মনে মনে নানারকম জল্পনা কল্পনা করছে সে চাঁদকে নিয়ে। তার অবাধ্য ভাবনা চিন্তা গুলোর যেনো কোনো অন্ত নেই। সকাল দশটা বাজার সাথে সাথেই সে উড়ুউড়ু মনে বাইকের চাবি নিয়ে রুম থেকে বের হয়ে গেল। তড়িঘড়ি করে বাইক নিয়ে ছুটল হলের উদ্দেশ্যে!

চাঁদকে একটু আগে টেক্সট করেছে সে হলের ছাদে আসার জন্য! কিছু জরুরি কথা আছে তাই। মূলত আজ সে চাঁদকে তার মনের কথা সব জানাতে চাইছে। চাঁদকে মনের মতো করে প্রপোজ করতে চাইছে। যদি চাঁদের সম্মতি থাকে তো সে খুব শীঘ্রই চাঁদকে বিয়ে করতে চায়! তার বাবা-মায়ের টাকার কোনো কমতি নেই।

ঢাকায় মেইন মেইন সেক্টর গুলোতে তার বাবার তিন তিনটি বাড়ি আছে। সুতরাং সে বেকার হলেও চাঁদের ভরণ-পোষনের কোনো সমস্যা হবেনা! তাছাড়া অনার্স কমপ্লিটের পর সে নিজেও তার বাবার বিজনেস দেখাশোনা করবে। যেকোনো পরিবার তার মেয়েকে এমনি এমনিই সাদমানের হাতে তুলে দিতে রাজি হয়ে যাবে।

সাদমানের মেসেজ পাওয়া মাত্রই চাঁদের ঘুম ভেঙেছিল। ঘুম থেকে ওঠেই সে ফ্রেশ হয়ে নিলো। আজ তার একটা এসপারওসপার করতেই হবে! কারণ, চাঁদ জানে সাদমান কেন আজ চাঁদের সাথে দেখা করতে চাইছে! কোন সে বিশেষ প্রয়োজন। সকালের ব্রেকফাস্ট সারতেই সাদমানের আবির্ভাব ঘটল হলে।

বাড়ির সবার সাথে দেখা সাক্ষাৎ করে সে কথামতো সোজা ছাদের উপর ওঠে গেল। হাতে রয়েছে তার একটি শপিং ব্যাগ৷ ব্যাগটিতে রযেছে দুটো ফুটন্ত গোলাপ। লাল, নীল এবং কালো রঙের রেশমি চুড়ি। একজোড়া সাদা পাথরের নূপুর এবং চকলেট বক্সসহ দুটো ডেইরি মিল্ক সিল্ক! চাঁদকে প্রপোজ করার সমস্ত প্রস্তুতি নিয়ে এসেছে সে। আজ তার সমস্ত মনের কথা চাঁদকে খুলে বলবেই বলবে। এ ও বলবে চাঁদকে ছাড়া সে কতটা অসহায়!

আয়মন এখনো গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। অনেক রাত করে ঘুমিয়েছে সে। তাই সাদমানের আসার খবরটা সে টের পেলনা। তবে চাঁদ আজ সমস্ত প্রিপারেশন নিয়ে এলো সাদমানকে ফেরানোর! মাথায় বড়ো করে ঘোমটা টেনে সে হাঁটি হাঁটি পায়ে ছাদে চলে এলো। সাদমানের মুখোমুখি হতে। দ্রুত পা ফেলে চাঁদ সাদমানের সম্মুখীন হতেই সাদমান জায়গা থেকে কিঞ্চিৎ নড়েচড়ে দাঁড়ালো৷ শার্টের কলারটা ঝাকিয়ে মাথাটা নুইয়ে নিলো৷ কয়েকদফা রুদ্ধশ্বাস ছেড়ে সে আনমনে হাসল! একরাশ আশা নিয়ে চাঁদকে বলল,,

“আমি তোমাকে কিছু বলতে চাই চাঁদ।”
ঝেড়ে কাশলো চাঁদ। আর বেশি সময় ব্যয় করতে চাইলনা। কোনোরকম ভনিতা ছাড়াই সে জবাবে সাদমানকে বলল,,

“আমিও আপনাকে কিছু বলতে চাই সাদমান ভাইয়া!”
সাদমান মাথা উঁচিয়ে চাঁদের দিকে তাকালো। কৌতূহলী দৃষ্টিতে চাঁদকে কিয়ৎক্ষণ পর্যবেক্ষণ করল। মনে মনে অভিসন্ধি কষিয়ে বলল,,

“আচ্ছা আমি যা বলতে চাইছি চাঁদ ও কি আমাকে তাই বলতে চায়?”
ভাবতেই মনে মনে ব্যাপক খুশি হলো সাদমান! নিজের ভাবনা চিন্তাগুলোকে সে বিশ্বাস করতে পারলনা। তবুও প্রফুল্ল হেসে চাঁদকে বলল,,
“আগে তুমি বলো। কী বলতে চাও?”

চাঁদ দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। সাদমানের থেকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে শূণ্যে দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। উদাসীন ভাব মুখশ্রীতে ফুটিয়ে তুলল। কোনোদিকে কালক্ষেপণ না করেই সে স্বাভাবিক গলায় সাদমানকে বলল,,
“আমি আপনাকে নয়, নূর ভাইয়াকে ভালোবাসি সাদমান ভাইয়া!”

সাদমান প্রায় নিশ্বাস নিতে ভুলে গেল! রক্তমাখা চক্ষুতে চাঁদকে নিরীক্ষণ করল! মাথাটা তার ঘুরে এলো। জায়গা থেকে একটুখানি সরে দাঁড়ালো। হাত থেকে শপিং ব্যাগটা আপনাআপনি পড়ে গেল! চোখের কোণে অশ্রকণারা জমাট বাঁধল। চাঁদের মুখ থেকে এই হৃদয়নাশক কথাটা শোনার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলনা সে। সাদমানের বর্তমান পরিস্থিতি চাঁদ বুঝতে পারল৷ তাই সে দৃষ্টি ঘুরিয়ে তৎক্ষনাৎ সাদমানের দিকে উদ্বিগ্ন দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। সহানুভূতি ছাড়াই গড়গড় করে বলল,,

“আমি সত্যি বলছি সাদমান ভাইয়া। নূর ভাইয়াকে ভীষণ ভালোবেসে ফেলেছি আমি। আর গতকালই আমি তার অনুভূতি পেয়েছি৷ আসলেই ভালোবাসার মানুষকে অন্য কারো সাথে সহ্য করা যায়না। আমিও সহ্য করতে পারিনি৷ বাধ্য হয়েছি আজ আমি মনের কথাগুলো মুখে স্বীকার করতে। এতে নূর ভাইয়ার বিন্দুমাত্র দোষ নেই বিশ্বাস করুন!

কুমিল্লা থেকে ফেরার সময় নূর ভাইয়া আমাকে বলেছিলেন আপনিও নাকি আমাকে ভালোবাসেন? আর আমি আপনাকেই যেনো মন থেকে মেনে নিই। কিন্তু আমি পারিনি সাদমান ভাইয়া৷ বিশ্বাস করুন আমি পারিনি! দূরে সরে যাওয়ার পর আমি নূর ভাইয়ার সুগভীর ভালোবাসা টের পেয়েছি।

উনার ভালোবাসা যে আমার জীবনে কতটা জরুরি তা বুঝতে শিখেছি। তবে এরমধ্যেও কতোগুলো সত্যি কথা লুকিয়ে আছে সাদমান ভাইয়া! আজ আমি আপনাকে সব গোপন কথা বলতে চাই। যা আমি কখনো কাউকে মুখ খুলে বলতে পারিনি। আসলে, আমি সেই প্রথম থেকেই নূর ভাইয়াকে খুব চাইতাম! প্রথম দেখাতেই ভালো লেগেছিল নূর ভাইয়াকে।

খুব সাংঘাতিক ভাবে ক্রাশ খেয়ে বসেছিলাম নূর ভাইয়ার প্রতি! উনার নীলাভ চোখ দুটো প্রথম থেকেই আমাকে বেশ টানত। তাই আমি প্রথম থেকেই নূর ভাইয়াকে প্রচুর খোঁচাতাম! খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জানতে চাইতাম আদোতে উনার কোন গার্লফ্রেন্ড আছে কিনা! তখন আমার এই খোঁচানোটাই নূর ভাইয়ার বাড়াবাড়ি বলে মনে হতো। আমি নিজেও জানতাম আমি বাড়াবাড়ি করছি।

তবে কিছু করার ছিলনা তখন। সত্যিটা আমার জানতেই হতো। এরপর যখন একদিন জানতে পারলাম নূর ভাইয়ার সত্যি সত্যিই গার্লফ্রেন্ড আছে তখনও আমি বিষয়টা পুরোপুরি বিশ্বাস করছিলাম না। স্বচক্ষে রোজ আপুকে দেখার পর বিশ্বাস করেছিলাম হ্যাঁ নূর ভাইয়ার রিলেশান আছে। খুব আঘাত পেয়েছিলাম সেদিন আমি। খুব খুব খুব আঘাত পেয়েছিলাম। নিজের সীমা বুঝে তখন বাড়াবাড়ি করাটাও বন্ধ করে দিয়েছিলাম।

নূর ভাইয়াকে কাজিন হিসেবেই ভাবতে শুরু করেছিলাম। তারপর যখন রোজ আপুর সাথে নূর ভাইয়ার ব্রেকাপ হয়ে যায় তখন মনে মনে যে আমি খুব খুশি হয়েছিলাম বিষয়টা কিন্তু এমন নয়। সামান্য আঘাত আমিও পেয়েছিলাম। তবে তা বুঝতে দিইনি। নূর ভাইয়াকে প্রথম থেকেই খুব সাপোর্ট করে আসছিলাম। উনার ভালোবাসার পাগলামি দেখে বুঝতে শুরু করেছিলাম রোজ আপুকে ছাড়া নূর ভাইয়া কতটা নিঃস্ব।

আর আমার অনুভূতি সেখানে তুচ্ছ। নূর ভাইয়ার তখনকার কষ্টটা আমি চোখে দেখতে পারছিলাম না। খুব কষ্ট হতো আমার। ভেতরে ভেতরে জ্বলন হতো। তাই আমি আমার তরফ থেকে ছোট্টো একটি চেষ্টা করেছিলাম তাদের দুজনকে এক করে দেওয়ার জন্য। তবে ভাগ্য তাদের এক হওয়া মেনে নিতে পারলনা। রোজ আপুকে ফিরিয়ে নিয়েছিল। কষ্টে কষ্টে মরে যাচ্ছিল নূর ভাইয়া। ভেতরে ভেতরে আমিও জ্বলছিলাম।

কেউ দেখিনি তখন আমার সেই জ্বলন! আমি নিজেই একা সব ভোগ করছিলাম। পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হওয়ার পর নূর ভাইয়া যখন আমাকে মুখের উপর বলে দেয় আমি কারো লাইফেই পার্ফেক্ট নই। আমি কারো গার্লফ্রেন্ড হওয়ার যোগ্যতা রাখিনা। তখন থেকেই আমি ভাবতে শুরু করি নূর ভাইয়া আমাকে অপছন্দ করেন। আমাদের প্রণয় কখনই সম্ভব নয়! আবারও বড়ো সড়ো একটা আঘাত পাই আমি৷

এরপর নিজেকে সম্পূর্ণ গুটিয়ে নিই! আমি নিজেও ফিল করতে থাকি, আসলেই আমি কারো গার্লফ্রেন্ড হওয়ার যোগ্য নই! তবে আমি বুঝতে পারিনি জানেন? মাঝখানে অতিবাহিত হয়ে যাওয়া এই কয়েকমাসের ব্যবধানেই নূর ভাইয়া আমার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়বে! রোজ আপুকে ভুলে আমাকে ভালোবাসতে শুরু করবে।

ভেবেছিলাম এসব নাটক! সম্ভব নাকি এত দ্রুত একজনকে ভুলে আমাকে আপন করে নেওয়া? যেখানে রোজ আপু উনার জান প্রাণ ছিল। তাই আমি ইচ্ছে করে নূর ভাইয়াকে হার্ট করেছিলাম! দেখতে চেয়েছিলাম আঘাত পাওয়ার পরেও উনি আমার কাছে ফিরে আসেন কিনা! ভালোবাসা পেতে উনি ঠিক কতখানি বেপরোয়া হতে পারেন। আমাকে মন থেকে ঠিক কতখানি চান।

এসব পরীক্ষা নিরীক্ষার মধ্যেই জানতে পারলাম আপনিও নাকি আমাকে ভালোবাসেন! নূর ভাইয়াও খুব চেয়েছিলেন, আমিও যেনো আপনাকে ভালোবেসে দুজন এক হয়ে যাই। সেদিনই আমি চূড়ান্ত আঘাতটা পেয়েছিলাম! কেন লোকটা নিজের ভালোবাসাকে এভাবে অন্যের হাতে তুলে দিবে হ্যাঁ? কেন বারবার তাকে এতো সেক্রিফাইজ করতে হবে? কীসের ঠেকা পড়েছে তার?

বন্ধুত্ব কী ভালোবাসার চেয়েও উর্ধ্বে? আমার ফিলিংসের কি কোনো দাম নেই? যে যেভাবে পারবে সেভাবে নিজের বলে আমাকে দাবী করবে? আমার নিজস্ব কোনো চাওয়া পাওয়া নেই? উনাকে ফিরিয়ে দেওয়ার পর মাঝখানের কয়েকটা দিন আমার কাছে বিভীষিকার মতো কেটেছিল! দিন/রাত যে কীভাবে কেটে গেল হিসেবই রাখা হয়নি।

কী যে জ্বালায় মরেছি তা একমাত্র আমি জানি। কত রাত যে চোখের জলে নিজেকে ভাসিয়েছি কেবলমাত্র আমি জানি। তবে এবার যখন খুব আশা নিয়ে ঢাকায় এলাম তখনই বুঝতে পারলাম নূর ভাইয়া আমাকে এভোয়েড করতে শুরু করেছে। তার পিছনের কারণটা হলেন একমাত্র আপনি!

আপনি নূর ভাইয়াকে বাধ্য করছেন আমাকে ইগনোর করতে, আমাকে ভুলে যেতে, আমার থেকে দূরে সরে থাকতে। যদিও লোকটা মুখ ফুটে আমাকে কিচ্ছুটি বলেনি তবে আমি বেশ বুঝতে পারছিলাম। ভালোবাসি আমি লোকটাকে। লোকটার মনের কথা বুঝতে পারবনা বলুন? অনেক তো হয়েছে এসব ভুল বুঝাবুঝি।

অনেক হয়েছে এসব রাগ অভিমানের পালা। এবার ভুলটাকে শুধরে এক হয়ে যাওয়ার পালা। আমি এখন বেশ বুঝতে পারছি জানেন? লোকটাকে ছাড়া আমি বাঁচতে পারবনা। বেঁচে থাকতে হলে লোকটাকে আমার চাই-ই চাই! এবার যেকোনো মূল্যেই হোক। দয়া করে আপনি আমাদের মাঝখানে আর আসবেন না সাদমান ভাইয়া! নূর ভাইয়াকেও আমার থেকে আলাদা করার চেষ্টা করবেন না। যদি আপনি আমাদের আলাদা করতে আসেন না? তবে কিন্তু আমি সুই’সা’ইড করব সাদমান ভাইয়া। সত্যি সত্যি আমি সু’ই’সা’ইড করব।”

অশ্রুসিক্ত চোখে চাঁদ দৌঁড়ে সাদমানের সামনে থেকে প্রস্থান নিলো! আর এক সেকেন্ডও সাদমানের মুখোমুখি দাঁড়ানোর সাহস পেলনা।সাদমানের চোখ থেকে গড়গড়িয়ে পানি ঝড়তে শুরু করল! হতবাক, হতবিহ্বল, বাকশক্তি হারানো নির্বাক মানবমূর্তিতে রূপান্তর হলো সে।

এখনো চাঁদের কোনো কথা বিশ্বাস করতে পারছেনা সে। মনে হচ্ছে যেনো কোনো দুঃস্বপ্নে ডুবে আছে সে। চাঁদ চোখের জল মুছতে মুছতে তার রুমের ভেতর প্রবেশ করল। পার্স থেকে একশ টাকার একটি নোট বের করে হম্বিতম্বি হয়ে রুম থেকে বের হয়ে গেল। দৌঁড়ে সোজা রাস্তায় ওঠে এলো। রিকশায় করে নূরের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলো! নূরের জন্য মনটা তার আনচান করছে! এই মুহূর্তে এক পলক নূরকে দেখতে পেলেই তার শান্তি।

প্রায় পনেরো মিনিটের রাস্তা পাড়ি দিয়ে চাঁদ অবশেষে নূরের বাড়ি এসে পৌঁছালো। বিয়ে বাড়ির সমস্ত আয়োজন তুমুলে চলছে। গেইট সাজানো থেকে শুরু করে স্টেজ সাজানো, প্যান্ডেল লাগানো সব। পুরো বাড়ি জুড়ে লোকজনের মহা হইচই পড়ে গেছে। আত্নীয়-স্বজনের অভাব নেই। চারিদিকে জাঁকজমক পরিবেশ বিরাজ করছে। কারণ, কালই নীড়ের গাঁয়ে হলুদ। শুভদিন হাওয়ার বেগে উড়ে উড়ে আসছে।

চাঁদ কোনোদিকে না তাকিয়ে সোজা সিঁড়ি বেয়ে উপর তলায় ওঠে এলো। হাঁপাতে হাঁপাতে নূরের রুমের দরজাটা খুলল। অমনি সে দেখতে পেল সাবরিনা আবরারের কোলে মাথা রেখে নূর চুপটি করে ঘুমিয়ে আছে! কিছুক্ষণ পর পর নাক টানছে তো হাচ্চি কাশিতে অতিষ্ট হয়ে উঠছে।

মুখটা শুকিয়ে একটুখানি হয়ে গেছে তার। দেখতে বড্ড নিষ্প্রাণ দেখাচ্ছে। বিরাগ, বিষণ্ণ, বিমূর্ত। সাবরিনা আবরার খুব মনোযোগ সহকারে উনার ছেলের মাথায় তেল পানি মাসাজ করে দিচ্ছেন। বুকটা বারবার ঘঁষে দিচ্ছেন। কাশের মাত্রাটা যেনো কমে যায় তাই। নূরের এই অবস্থা দেখে চাঁদের ব্যথীত মন আরও ব্যথীত হয়ে উঠল! ভেতরটা হু হু করে কেঁদে উঠল। পা টিপে টিপে হেঁটে সে বিছানার উপর বসল। আর তখনই চাঁদের অস্তিত্ব সাবরিনা আবরার টের পেলেন! চোখ তুলে উনি চাঁদের দিকে তাকালেন৷ মৃদু হেসে বিস্মিত গলায় চাঁদকে শুধালেন,,

“কী রে? তুই হঠাৎ?”
“কেন? আমি হঠাৎ আসতে পারিনা?”
“পারবিনা কেন? অবশ্যই পারবি। ভাবলাম কোনো দরকারে এসেছিস।”
“দরকারেই এসেছি খালামনি। তোমার কাছে খুব দামী একটা জিনিস চাইতে এসেছি! যদি তুমি দাও তো জিনিসটা আমি খুব যত্নে আগলে রাখব। তুমি এখন যেভাবে তাকে আগলে রেখেছ!’
“কী জিনিস রে চাঁদ?”

চাঁদ দৃষ্টি ঘুরিয়ে ঘুমন্ত নূরের মুখপানে তাকালো। শুভ্র মুখমণ্ডল তার উষ্ণতায় জড়ানো। জ্বরের তাণ্ডবে লাল বর্ণ ধারণ করেছে শুভ্র মুখশ্রীটি। ভেতরের নিগূঢ় কষ্টের ছাপ প্রগাঢ়ভাবে বাইরেও প্রতিফলিত হলো। একবার নিষ্প্রাণ নূরকে ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে করল তার! তবে সামনে থাকা সাবরিনা আবরারের কারণে সম্ভব হচ্ছিলনা। মাথা নুইয়ে নিলো চাঁদ। মোদ্দা কথায় এলো। জবাবে সাবরিনা আবরারকে বলল,,

“তোমার ছেলে কি ঘুমুচ্ছে খালামনি?”
“হ্যাঁ রে। আর বলিসনা ছেলেটার কথা। কুমিল্লা থেকে ফেরার পর থেকেই ছেলেটা অসুখ বাঁধিয়ে রেখেছে। একদম আঠার মতো লেগে আছে অসুখটা। জ্বর, সর্দি-কাশি কিছুতেই সারছেনা তার। ভালো ডক্টর দেখাতে বলছি তাও করছেনা। আমি পড়েছি এক জ্বালায় বুঝলি? আমার হিরার টুকরো ছেলেটা দিন দিন কয়লা হয়ে যাচ্ছে। সহ্য হয় এসব বল?”

মুখ্যম সুযোগ খুঁজে পেল চাঁদ৷ সময়ের অপচয় না করে সে সোজা পয়েন্টে এলো। জড়তাশূণ্য গলায় বলল,,
“তোমার ছেলের অসুখ তো আমি খালামনি! আমার অসুখটা তার সারছেই না! তোমার এই হিরের টুকরো ছেলেটাকে আমাকে দিবে খালামনি? খুব যত্নে আগলে রাখব তাকে! কোনো অযত্ন হতে দিবনা। ভালোবেসে যতখানি আগলে রাখা যায় ঠিক ততখানিই আগলে রাখব। কথার হেরফের হবেনা। আমি যখন তোমার ছেলের জীবনে আসবনা? তখন আর কোনো অসুখ তোমার ছেলেকে ছুঁতে পারবেনা। মা হয়ে নিশ্চয়ই এই লোভ তুমি সামলাতে পারবেনা?”

সাবরিনা আবরার সচকিত দৃষ্টিতে চাঁদের দিকে তাকিয়ে রইলেন। উনার ফাঁকা মস্তিষ্কে কুলালো না চাঁদ উনার ছেলেকে এতোটা মন দিয়ে বসে আছেন? এতদিন শুধু জানতেন নূর-ই চাঁদকে একতরফা ভালোবাসে! এখন তো এটাও জেনে গেলেন চাঁদ ও নূরকে সমানভাবে ভালোবাসে!

সাবরিনা আবরারের মুখের দিকে চাঁদ চাতক পাখির ন্যায় তাকিয়ে রইল! মুখ থেকে শুধু।একটুখানি হ্যাঁ শোনার আশায়। খুশিতে সাবরিনা আবরারের চোখের কোণ চিকচিক করে উঠল! দৃষ্টি ঘুরিয়ে উনি নূরের ঘুমন্ত মুখপানে তাকালেন। চাঁদকে লক্ষ্য করে প্রশ্ন ছুড়লেন,,

“আমার ছেলে কী জানে? তার চাঁদপাখি যে তাকে এতটা মন দিয়ে বসে আছে? জানিয়েছিস তাকে কিছু?”
মাথা নুইয়ে অকাতরে চোখের জল ছেড়ে দিলো চাঁদ! সাবরিনা আবরারের মনের ভাব সে বুঝতে পারল৷ খুশির জল ঝড়ছিল তার চোখের কোণ থেকে। ভারী বুকটা আস্তে করে হালকা হয়ে এলো। খুশিতে সে ছটফট করছিল। অস্ফুটে গলায় বলল,,

“জানানোর সৌভাগ্যটা হলো কই খালামনি! তোমার ছেলে তো এখনো ঘুমুচ্ছে!”
“জাগিয়ে দিই তাকে?”

ইতোমধ্যেই নূর খকখক করে কেশে উঠল। কাশতে কাশতে দলামোচড়া হয়ে গেল। শ্বাস নিতে বড্ড কষ্ট হচ্ছিল। সারারাত সিগারেট ফুঁকেছে সে! যার দরুন ফুসফুসে সমস্যা বেঁধেছে। কাশির মাত্রাটাও ব্যাপক হারে বেড়ে গেছে।

প্রেমময়ী তুমি পর্ব ৫১

চাঁদ এবং সাবরিনা আবরার উদ্বিগ্ন হয়ে উঠল নূরের এই করুন অবস্থা দেখে। সঙ্গে সঙ্গেই নূর লাফিয়ে শোয়া থেকে ওঠে বসল। হুট করেই তার অসুস্থ দৃষ্টি পড়ল চাঁদের দিকে। চাঁদকে দেখে অবাক হলো সে। খুকখুক করে কেশে বলল,,
“এই? তুমি এখানে?”

প্রেমময়ী তুমি পর্ব ৫৩