প্রেমময়ী তুমি পর্ব ৫৩

প্রেমময়ী তুমি পর্ব ৫৩
নিশাত জাহান নিশি

“এই? তুমি এখানে?”
এক ঝলকের মধ্যেই চাঁদ নূরের অদ্ভুত দৃষ্টি থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো। ঘাড়টা বাঁকিয়ে পেছনের দিকে ঘুরিয়ে নিলো। সুতির ওড়না দ্বারা চোখের অবাধ্য অশ্রুকণা গুলো মুছে নিলো!

নিজেকে ধাতস্থ করার চেষ্টায় কিয়ৎক্ষণ নিষ্ক্রিয় রইল। চাঁদ কেঁদেছে তা নূরকে এক্কেবারে বুঝানো যাবেনা। নয়তো সে ব্যাকুল হয়ে উঠবে। চাঁদ কেন কেঁদেছে তা জানার জন্য মরিয়া হয়ে উঠবে। অসুস্থ শরীর আরও অসুস্থ হযে উঠবে। খানিকটা স্বাভাবিক হওয়ার পর চাঁদ শুষ্ক হেসে নূরের দিকে তাকালো। মলিন গলায় শুধালো,,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“কেন? আমাকে দেখে এত অবাক হচ্ছেন কেন হ্যাঁ? আমি যখন তখন আপনাদের বাসায় আসতে পারিনা?”
চাঁদের দিকে সরু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল নূর। অদ্ভুত এক ঘোরে তলিয়ে গেল সে। চাঁদের মায়াবি মুখের গড়ন ক্রমাগত তাকে মাতাল করে তুলছিল। বুকে আবারও না পাওয়ার যন্ত্রণাটা ভর করল তার!

নিরুপায় হয়ে সে বুকে হাত চেপে ধরল। বিরহ এবং যন্ত্রণা নিবারণের জন্য বড়ো বড়ো কয়েক দফা রুদ্ধশ্বাস ছাড়ল। এতেও যেনো কোনো কাজ হচ্ছিলনা। তাই সে আস্তে করে বুকটা পুশ করতে লাগল। কী অদ্ভুত ভারী হয়ে আছে বুকটা! কিছুতেই যেনো সেই অসহ্যকর ব্যথাটা সরছেনা।

চাঁদের আকস্মিক আগমনে যেনো যন্ত্রণাটা আরও দ্বিগুন, তিনগুন, চারগুন হারে বৃদ্ধি পেল। মানুষ কিছু ভুলতে চাইলেই প্রাকৃতিক নিয়মেই তা যেনো মানুষ তা ভুলতে পারেনা! বরং তা আরও বেশি করে মনে পড়ে যায়। সর্বত্র তার উপস্থিতি অনুভব করিয়ে দেয়। নিষিদ্ধ মানুষটাই বারবার চোখের সামনে পড়ে যায়।

নূরের না বলা যন্ত্রণাটা চাঁদ বুঝতে পারল। তবে নূরের সেই যন্ত্রণা ভোলানোর সময় বা সুযোগটা সে খুঁজে পাচ্ছেনা। কারণ, সাবরিনা আবরার এখনও একই জায়গায় বসে আছেন! চাঁদের ইতস্ততবোধ দেখে বিষয়টা তিনি আঁচ করতে পারলেন! মৃদু হেসে তিনি বসা থেকে ওঠে দাঁড়ালেন। নূর এবং চাঁদকে আলাদা কথা বলার জন্য সুযোগ দিলেন। হেয়ালি গলায় বললেন,,

“আচ্ছা তোরা কথা বল। আমি আসছি।”
কারো উত্তরের অপেক্ষা করলেন না তিনি। মিটিমিটি হেসে রুম থেকে প্রস্থান নিলেন! বাইরে থেকে দরজাটা আটকে তিনি চৌকাঠ পেরিয়ে সামনে পা বাড়াতেই অমনি মাহিনের সম্মুখস্থ হয়ে গেলেন! চোখ কচলাতে কচলাতে মাহিন নূরের রুমের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল।

এটাই যেনো তার প্রতিদিনকার রুটিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঘুম ভেঙে ওঠে প্রথমেই নূরের রুমে আসা। নূরের সাথে কিছুক্ষণ আড্ডা দেওয়া, সকালের নাশতা সেরে গলাগলি করে বাড়ি থেকে বের হয়ে যাওয়া৷ তৎক্ষণাৎ সাবরিনা আবরার হাত দ্বারা ঠেলে মাহিনকে থামিয়ে দিলেন! কড়া গলায় বললেন,,

“এই থাম থাম। আজ তোর নূরের রুমে যাওয়া চলবেনা!”
ঝট করে চোখ থেকে হাত দুখানা নামিয়ে নিলো মাহিন। বিস্মিত দৃষ্টিতে সাবরিনা আবরারের দিকে তাকালো। ভ্রু যুগল কুঁচকে আচম্বিত গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,,
“মানে? কী বলো এসব?”

সাবরিনা আবরার হেঁতো হাসলেন! চোখ টিপে দিলেন তিনি মাহিনকে! জবাবে রসালো গলায় বললেন,,
“মানে? তোর ভাই প্রেম করছে!”
দম ফাটা হাসিতে মত্ত হয়ে সাবরিনা আবরার জায়গা পরিত্যাগ করলেন! মাহিন তাজ্জব দৃষ্টিতে সাবরিনা আবরারের যাওয়ার পথে তাকিয়ে রইল। নির্বোধ ভঙ্গিতে সে মাথা ঝাঁকালো। সাবরিনা আবরারের কাণ্ডকারখানা তার মাথার উপর দিয়ে গেল। বোকা গলায় নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করল,,

“মা এসব কী বলে গেল? নূর প্রেম করছে?”
ঘুমের রেশ এখনো তার চোখে ছিনিমিনি করছে! চোখে সর্বনাশা ঘুম ছাড়া কিছুই দেখছেনা সে। তাই বিষয়টাতে বেশি গুরুত্বারোপ করতে পারলনা সে। মায়ের এক কথাই নিঃসংকোচে মেনে নিলো। মাথা চুলকাতে চুলকাতে উল্টোদিকে ঘুরল। পুনরায় তার রুমের দিকে হাঁটা ধরল। বিকট হামি তুলে অবুঝ গলায় বলল,,

“আচ্ছা নূর কি সত্যিই প্রেম করছে? কার সাথে প্রেমটা করছে হ্যাঁ? নায়লা আপু নাকি সত্যি সত্যিই অন্য কেউ?”
নাক-মুখ খিঁচে কপাল চাপড়ালো মাহিন। নিজের প্রতি ভীষণ রাগ হলো তার। হতাশাজনক গলায় বলল,,

“ধ্যাত! আমি যে কবে প্রেম করব। তিথীটা তো আমার মনের কথা বুঝতেই চাইছে না! বারবার আমাকে এভোয়েড করছে। আমার মতো হ্যান্ডু একটা ছেলেকে পায়ে ঠেলে দিচ্ছে! আজ তো এর একটা বিহিত করতেই হবে! তিথীকে বুঝিয়ে দিতে হবে মাহিন কী জিনিস! তবে এর আগে লম্বা একটা ঘুম দিতে হবে। মাথামুথা ঠাণ্ডা করতে হবে। এরপর না হয় আটঘাট বেঁধে মাঠে নামা যাবে।”

রুমে ফিরে এসে মাহিন চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ল। চোখে অবশিষ্ট ঘুম নিয়ে গভীর নিদ্রায় ডুব দিলো। মনের মাঝে তিথী যেনো ঘণ্টা বাজাতে লাগল! আহ্ শান্তি! তিথী যেনো তার পাশেই ঘুমিয়ে আছে। কল্পনাকে কে-ই বা আটকাতে পারে?

সাবরিনা আবরার রুম থেকে বের হওয়ার সাথে সাথেই চাঁদ বসা থেকে ওঠে দাঁড়ালো। দ্রুত পায়ে হেঁটে গিয়ে রুমের দরজাটা ভেতর থেকে লক করে দিলো। চাঁদের এহেন অদ্ভুত কাণ্ডকীর্তি দেখে নূর তাজ্জব বনে গেল। ভীরু গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,,

“এই কী করছ তুমি?”
রাগান্বিত দৃষ্টিতে চাঁদ পিছু ঘুরে তাকালো। দরজার খিল থেকে হাতটা নামিয়ে সে তেজী রূপ ধারণ করে নূরের দিকে তেড়ে এলো! জবাবে খরখরে গলায় বলল,,
“দেখতে পারছেন না কী করছি?”

“আরে কী আজব! তোমার তো এই সময় এখানে থাকার কথা ছিলনা। সাদমানের কাছে থাকার কথা ছিল! তো তুমি সাদমানকে ছেড়ে এই সময় এই অধমের কাছে কী করছ?”

অনর্গল কথাগুলো বলে নূর নিঃশ্বাস নেওয়ার সুযোগটাও বোধ হয় পেলনা। এর পূর্বেই ঠাস করে গরম এক চড় পড়ল তার গালে! নূর বেকুব হয়ে গালে হাত দিয়ে বসে রইল। চাঁদের দিকে নিষ্প্রাণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। আকাশ থেকে টুপ করে মাটিতে পড়ার মতো অনুভূতি হলো তার।

বাস্তবে আছে নাকি কল্পনায় হারিয়েছে কিছুই বুঝতে পারলনা সে। শুধু এটুকু বুঝতে পারল নরম হাতের চড় খুবই গরম! লালসিটে দাগ পড়ে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট। চাঁদ রাগে ফোঁসফোঁস করছিল। শুধু এক চড়েই যেনো তার রাগ ক্ষান্ত হচ্ছিলনা! তাই সে ক্রোধের অনলে দ্বগ্ধ হয়ে নূরের গলা টি’পে ধরল! চোখ-মুখ গরম করে শাণিত গলায় শুধালো,,

“এই? আমাকে প্রো’ডা’ক্ট পাইছস তুই হ্যাঁ? কম দামী প্রো’ডা’ক্ট পাইছস? যখন যাকে খুশি তাকে দিয়ে দিবি? আমার কি কোনো অনুভূতি নাই? ভালোলাগা, ভালোবাসা নাই? আমার কখনো মনে হতে পারেনা আমিও কাউকে চাই, যাকে চাই তাকেই যেনো পাই? তুই আমার হয়ে ঠিক করে দিবি আমি কাকে চাই বা কার সাথে থাকতে চাই?

তুই কে হ্যাঁ? আমাকে অন্যের হাতে তুলে দেওয়ার তুই কে? কীসের এতো অধিকার খাটাতে আসিস তুই? এখনো তো জোর খাটিয়ে বলতে পারলি না ভালোবাসিস আমাকে। তোর বন্ধুর চেয়েও বেশি ভালোবাসিস! আস্তা একটা জা’নো’য়া’র তুই বুঝেছিস? নির্ম’ম, পা’ষ’ণ্ড, জা’লি’য়া’ত একটা!”

নূরের সাথে আচমকা এসব কী ঘটছে নূর ভেবে পাচ্ছিলনা। অনেকক্ষণ যাবত টু’টি চে’পে ধরে রাখার দরুন নূরের শ্বাস নিতে বেশ কষ্ট হচ্ছিল। খুশখুশে কাশের মাত্রাটা আবারও বেড়ে গেল৷ চোখ-মুখ লাল হয়ে পানি চলে আসছিল। এতোটা কষ্ট হওয়ার পরেও নূর চাঁদের হাতটা ঠেলে দূরে সরাচ্ছিল না!

এই যন্ত্রণাটাই যেনো তার দারুন ভাল্লাগছিল। চাঁদকে খুব কাছ থেকে অনুভব করতে পারছিল, দু-চোখ ভরে তাকে দেখতে পারছিল, নাক-মুখ থেকে নির্গত তপ্ত শ্বাস তার মুখমণ্ডলের উপচে পড়ছিল। এই যেনো স্বর্গের সুখ। মৃত্যুর যন্ত্রণা সেখানে আরামদায়ক! নূরের বিমূর্ষ অবস্থা দেখে চাঁদ তার ক্রোধ শান্ত করল।

তাড়াহুড়ো করে নূরের গলাটা ছেড়ে দিলো। ভয়ার্ত ঢোঁক গিলে সে নূরের সামনে হাঁটু গেড়ে বসল। অগোছালো চুলগুলো কানের পিছনে গুজে দিলো। নূরের নুইয়ে পড়া মুখের দিকে খানিক ঝুঁকে তাকালো। ভয়ে সিঁটিয়ে ওঠা গলায় কেঁপে কেঁপে শুধালো,,
“ঠিক আছেন আপনি?”

নূরের চোখ থেকে টপটপ করে পানি ঝড়তে লাগল! গলার ব্যথায় সে নাজেহাল হয়ে উঠল। অতিরিক্ত কাশির প্রভাবে তার শ্বাসকষ্ট হতে শুরু করল! বড়ো বড়ো নিশ্বাস ফেলতে লাগল। মাথাটাও কেমন যেনো ঘুরে এলো। দিন দুনিয়া বিষাক্ত হয়ে উঠল। সবকিছু ঝাপসা হতে লাগল। নূরের এই মুমূর্ষু অবস্থা দেখে চাঁদ সাংঘাতিক ভয় পেয়ে গেল। নূরের মুখটা উঁচিয়ে ধরে সে আর্তনাদ করে বলল,,

“এই বলুন না কী হয়েছে আপনার? শরীর কি বেশি খারাপ লাগছে?”
রুদ্ধশ্বাস ফেলে নূর ফুপিয়ে কেঁদে উঠল! যন্ত্রণায় কাতর দু’চোখে চাঁদের দিকে তাকালো। চাঁদকে সম্পূর্ণ অবাক করে দিয়ে সে শরীরের সর্বস্ব শক্তি কাজে লাগিয়ে চাঁদকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরল! গোঙাতে গোঙাতে বলল,,

“আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি চাঁদ! বাড়াবাড়ি রকমের ভালোবাসি। আমার শরীরে এভাবে বাড়তে থাকা তোমাকে না পাওয়ার অসুখটা দূর করে দাও চাঁদ! যতো দ্রুত সম্ভব পারো দূর করে দাও। আমি আর পারছিনা এই অসুখটাকে বয়ে নিয়ে বেড়াতে। মুত্যুর মতো যন্ত্রণা হচ্ছে আমার। সে যন্ত্রণায় আমি ধুঁকে ধুঁকে মরছি।

অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে রেখেছি। তোমাকে ভুলে যাওয়ার মতো কঠিন কাজ পৃথিবীতে আর দুটো নেই চাঁদ। চেষ্টা করে দেখেছি আমি তবে হয়নি। আমি বরাবরই কঠিন কাজটাকে বেশ অপছন্দ করি চাঁদ। যদি আমাকে ভালোবাসতেই না পারো তবে মৃত্যু দাও! সেই অগত্যা মৃত্যু আমি মাথা পেতে নিব।”

শান্ত হয়ে এলো নূর! শরীরের সমস্ত ভার চাঁদের শরীরের উপর ছেড়ে দিলো। পূর্বের তুলনায় আরও ঘাবড়ে উঠল চাঁদ। শুকনো ঢোঁক গিলে সে আড়চোখে নূরের দিকে তাকালো। চোখ বুজে শুয়ে আছে নূর! মনে হচ্ছে যেনো গভীর ঘুমে তলিয়ে আছে। কতকাল যে এভাবে ঘুমোয় না তারই প্রতিফলন ঘটছে। ক্রমশ শ্বাস প্রশ্বাস ছোটো হয়ে আসছে তার! নির্মম আকুতিও বন্ধ হয়ে আসছে। তীব্র আতঙ্কগ্রস্থ হয়ে উঠল চাঁদ। বুকফাটা চিৎকার করে বলল,,

“এই নূর ভাইয়া উঠুন। কী হয়েছে আপনার?”
রেসপন্স করলনা নূর! শান্তিতে ঘুমিয়ে রইল! নড়াচড়া সবকিছু বন্ধ। নিঃশ্বাস ফেলছে কিনা তাতেও সন্দেহ। গলা কাটা মুরগির মতো ভেতরে ভেতরে ছটফট করছিল। ফট করে চাঁদের মাথাটা ধরে এলো। বিক্ষিপ্ত হয়ে সে নূরকে ছেড়ে ওঠে দাঁড়ালো।

বিছানায় সোজা করে নূরকে শুইয়ে দিলো। শরীরের দিকে কোনোরূপ খেয়াল না করেই সে ওড়না ছাড়া পাগলের মতো দিক-বিদিক ভুলে রুম থেকে বের হয়ে গেল! সাবরিনা আবরারের রুমের দিকে অগ্রস হয়ে চাপা চিৎকার করে বলল,,

“খালামনি? কোথায় তুমি? দেখে যাও তোমার ছেলে চোখ খুলছেনা। আমি বোধ হয় তাকে এবার মে’রে’ই ফেলেছি খালামনি!”

চাঁদের মৃদু আর্তনাদ পেয়ে সাবরিনা আবরার রান্নাঘর থেকে ছুটে এলেন। হাবিব আবরার এবং নীড় সব কাজ ছেড়ে ছুটে এলো। আর মাহিন তো ঘুম ভেঙেই ওঠে এসেছে! সবাই প্রাণপনে দৌঁড়ে এসে চাঁদের মুখোমুখি দাঁড়ালো। চাঁদকে চারপাশ থেকে জেরা করল। অতিরিক্ত হেচকির কারণে চাঁদ কথা বলতে পারছিল না।

কথা তার ভেঙে ভেঙে অস্পষ্টভাবে আসছিল। চারদিক থেকে সবাই উত্তেজিত হয়ে চাঁদকে প্রশ্ন ছুড়তে লাগল। কী হয়েছে জানতে চাইল। কারো কোনো প্রশ্নই যেনো চাঁদের কর্ণতলে ঢুকছিল না! কানে শুধু একটা ভনভন করে আওয়াজ হচ্ছিল। সেই বিরক্তিকর আওয়াজটা চাঁদকে অতিষ্ট করে তুলছিল। সঙ্গে সঙ্গেই সে কান দুটো চেপে ধরল। চোখ বুজে সজোরে চিৎকার করে বলল,,

“নূর ভাইয়াকে আমি মে’রে ফেলেছি! তোমরা প্লিজ নূরকে বাঁচাও! আমার নূরকে বাঁচাও।”
কথাটা শ্রবণমাত্রই সাবরিনা আবরারের মাথাটা ঘুরে এলো! কপালে হাত ঠেকিয়ে তিনি টালমাটাল ভাবে ঢুলতে লাগলেন। নীড়, মাহিন এবং হাবিব আবরার আর এক সেকেন্ডও ব্যয় করলেন না।

হন্ন হয়ে নূরের রুমের উদ্দেশ্যে ছুটে গেলেন। রুমে ঢুকেই সবাই নূরকে অবচেতন অবস্থায় বিছানায় পড়ে থাকতে দেখলেন। তবে হার্ট খুব জোরে বিট করছিল তার! অতিরিক্ত শ্বাসকষ্টের কারণে ফুসফুসে বিরাট সমস্যা দেখা দিয়েছে। যা তারা তিনজনই বেশ টের পাচ্ছে। বেশি কিছু হয়নি ভেবে হাবিব আবরার স্বস্তির শ্বাস ফেললেন। নীড়ের কাঁধে হাত রেখে বললেন,,

“এক্ষণি নূরকে নেবুলাইজার দিতে হবে। ডক্টরকে ডাক কুইকলি।”
“ডাকছি বাবা।”
নীড় ব্যস্ত হয়ে পড়ল ডক্টরকে কল করতে। মাহিন অশ্রুসিক্ত চোখে নূরের পাশে এসে বসল। নূরের তীব্র কম্পায়মান বুকে হাত বুলাতে লাগল। চোখের সামনে জমজের এই যন্ত্রণা সহ্য করতে পারছেনা সে। মনে মনে চাঁদকে ভীষণ দোষারোপ করতে লাগল! এরমধ্যেই সাবরিনা আবরার এবং চাঁদ এসে রুমে হাজির হলো। সাবরিনা আবরার কাঁদতে কাঁদতে সবাইকে ঠেলে নূরের পাশে এসে বসলেন। একটানে নূরকে বুকের ভেতর জড়িয়ে ধরলেন। কাঁদতে কাঁদতে বললেন,,

“চাঁদ আমাকে কথা দিয়েছে নূর। চাঁদ তোর পাশে থাকতে তুই আর কখনো অসুস্থ হবিনা! মেয়েটাকে একটু সুযোগ দে না বাবা! তোর সুস্থ হওয়ার কারণ হয়ে থাকতে।”

দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়ালো চাঁদ! মুখে ওড়না চেপে ফুপিয়ে কাঁদতে লাগল। কষ্টের তাড়নায় ভেতরটা তার ফেটে যাচ্ছিল। নূরকে এই মুমূর্ষু রূপে দেখতে পারছেনা সে। অনুভূতিরা বারবার তাকে আঘাত করছে। নূরের এই অবস্থার জন্য তার দিকেই কেবল আঙুল তুলছে। জ্বালাচ্ছে, পোড়াচ্ছে, দহনে তাকে ক্ষত-বিক্ষত করে তুলছে। যা সে কাউকে বিশ্লেষণ করে বুঝাতে পারছেনা। বড়ো নিষ্ঠুর এই যন্ত্রণা। মাহিন চোখ উঠিয়ে এক পলক চাঁদের দিকে তাকালো। আহত গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,,

“সত্যিই কি তুমি নূরের সুস্থ হওয়ার দায়িত্ব নিবে চাঁদ?”
চাঁদ মুখ থেকে ওড়নার কাপড়টা সরিয়ে নিলো। গোঙাতে গোঙাতে মাথা দুলিয়ে বলল,,
“হ্যাঁহ্যাঁহ্যাঁ।”
“সত্যি তো? নাকি কোনা দোটানা আছে?”

চাঁদ আত্নবিশ্বাসী হলো। দৃঢ়প্রতিজ্ঞ গলায় বলল,,
“না নেই।”
মাহিন ঈষৎ হাসল। ভেতর থেকে স্বস্তির শ্বাস ফেলে বলল,,
“নিশ্চিন্ত হলাম! এবার নূরের ভালো থাকার সময় এলো বলে।”

হাবিব আবরার কিছু না বুঝে নির্বোধের মতো একবার সাবরিনা আবরারের দিকে তাকালেন তো একবার মাহিনের দিকে তাকালেন। ঘটনার কালচক্র কিছুই বুঝতে পারছেন না তিনি। পরিস্থিতিও এমন অসহায় যে কাউকে এই বিষয়ে তিনি কিছু জিজ্ঞাসাও করতে পারছেন না। কেবল ভেতরে ভেতরে বিষয়টা নিয়ে ভাবছেন। এরমধ্যেই নীড় হম্বিতম্বি হয়ে রুমে ছুটে এলো। কপালে থাকা বিন্দু বিন্দু ঘামগুলো মুছে বলল,,

“ডক্টর আসছে বাবা। তোমরা নূরকে ছেড়ে দাঁড়াও।”
সবাই নূরের আশপাশ থেকে সরে দাঁড়ালো। পনেরো থেকে বিশ মিনিটের মাথায় নূরদের বাড়ির ফ্যামিলি ডক্টর এলেন নূরের চিকিৎসা করতে। নেবুলাইজারের সাথে সাথে নূরের শরীরে স্যালাইনও ফিট করা হলো! দুর্বলতা কাটানোর জন্য। অসুস্থ শরীরটাকে ফিট রাখার জন্য।

সকাল থেকে বিকেল অবধি নূর এভাবেই ঘুমে ঘুমে কাটিয়ে দিলো! বিকেলে নূরের ঘুম ভাঙার আগ অবধিও চাঁদ নূরের বাড়িতেই ছিলো। সারাটা ক্ষণ নূরের পাশেই ছিল। তবে হলুদের শপিংয়ের জন্য ঐ বাড়ি থেকে তার জরুরি তলব এলো। চাঁদকে ছাড়া ঐ বাড়ির কেউ শপিংয়ে যেতেই চাইছিলনা। তাই বাধ্য হয়ে চাঁদকে ক্ষুণ্ণ মন নিয়ে হলে ফিরতে হলো।

চাঁদ হলে ফেরার প্রায় আধঘণ্টার মাথাতেই নূরের ঘুম ভাঙল। ঘুম থেকে ওঠেই সে পাগলের মতো করছিল। অসহ্য পাগলামি করতে করতে পাশে থাকা সাবরিনা আবরারকে অতিষ্ট করে তুলছিল। খাওয়াদাওয়া না করে ফ্রেশ ট্রেশ না হয়েই সে চাঁদকে খুঁজছিল! কিছুতেই যেনো তাকে সামলানো যাচ্ছিলনা! উদ্বিগ্ন হয়ে সাবরিনা আবরার নূরের মাথা মুছতে লাগলেন। অস্থির গলায় বললেন,,

“শান্ত হ বাবা। চাঁদ আছে। একটু আগেই সে এখান থেকে বের হয়েছে৷ তুই ঘুমুচ্ছিলি বলে!”
রক্তিম চক্ষুজোড়া নূরের শান্ত হয়ে এলো। মাথায় হাত দিয়ে ধপ করে বসে পড়ল সে। শরীরের ছটফট কমে এলো তার। চোখের জল সংবরণ হয়ে এলো৷ চোখজোড়া বুজে সে বিড়বিড় করে বলল,,

“তার মানে সত্যিই চাঁদ এখানে ছিল! কিছুই আমার মনের ভ্রম ছিলনা। সত্যিই কি চাঁদ আমাকে ভালোবাসে?”
নূরকে আর কে সামলায়? হুড়োহুড়ি করে সে বিছানা ছেড়ে ওঠে দাঁড়ালো। গাঁয়ে পাতলা টি-শার্ট জড়িয়ে ব্যস্ত হয়ে ছুটল দরজার দিকে! অসুস্থ শরীর নিয়েই সে মনোস্থির করল হলে যাওয়ার! সাবরিনা আবরার পেছন থেকে নূরকে ডাকলেন। উত্তেজিত গলায় বললেন,,

“চাঁদকে তুই এখন হলে পাবিনা নূর। চাঁদ শপিংয়ে গেছে। প্লিজ শান্ত হয়ে বস এখন। খাওয়াদাওয়া করে রেস্ট করে এরপর চাঁদের কাছে যা।”
“প্লিজ মা তুমি পিছু ডেকো না। এক্ষণি আমাকে চাঁদের কাছে যেতে হবে।”
বদ্ধ উন্মাদের মতো ছুটল নূর। তাড়াহুড়োর চোটে সে বাইকের চাবি নিতে ভুলে গিয়েছিল। সাবরিনা আবরার দ্রুত পায়ে হেঁটে এসে চাবিটা নূরের হাতে দিয়ে দিলেন। চিন্তিত সুরে বললেন,,

“শান্ত হ না বাবা। এই অসুস্থ শরীর নিয়ে তুই বাইক চালাবি কী করে বল? আমার কথাটা একটিবার শোন প্লিজ। এখন একটু রেস্ট নে। পরে যাস চাঁদের কাছে। আমি তখন তোকে বাঁধা দিবনা।”
“মা প্লিজ। আমাকে আর থামতে বলোনা। অনেক থেমেছি আর নয়। আর একটিবারের জন্য থেমে যাওয়া মানে আমার মনের অসুখটাকে আরও গাঢ় করে তোলা। দেখলে তো কী সাংঘাতিক অবস্থা হয়েছিল আমার? আমি আর এই অসুখে ভুগতে চাইনা মা।”

প্রতিউত্তরের আশা করলনা নূর। হাতে চাবি নিয়ে ছুটে চলল বাইকের দিকে। নিচতলার পার্কিং এরিয়া থেকে বাইক নিয়ে দ্রুতগতিতে ছুটে চলল হলের উদ্দেশ্যে। লাগামহীন ঘোড়ার মতো তার চরাচর। অসুস্থ শরীর বেশি চাপ নিতে পারছিলনা সে। তবুও নিজের সবটুকু দিয়ে অন্তঃপ্রাণ চেষ্টা করছিল যত দ্রুত সম্ভব চাঁদের কাছে পৌঁছানোর।

পনেরো মিনিটের রাস্তা সে দশমিনিটেই অতিক্রম করে এলো। হলগেইটে বাইকটা সাইড করে সে রোগা শরীর নিয়ে ছুটল চাঁদের রুমের উদ্দেশ্যে। এরমধ্যেই আয়মন এবং মাহিনের সাথেও দেখা হয়ে গেল তার! তারা দুজনই উদগ্রীব দৃষ্টিতে নূরের দিকে তাকিয়ে রইল।

এই সময় এই অবস্থায় নূরকে এখানে তারা একদমই আশা করছিলনা! নূর তাদের দুজনকে উপেক্ষা করে সিঁড়ি বেয়ে সোজা উপর তলায় ওঠে গেল। দৌঁড়ে চাঁদের রুমের দরজা খুলতেই দেখতে পেল চাঁদ রেডি হচ্ছে শপিংয়ে যাওয়ার জন্য। আশেপাশে তিথী, জায়মা এবং তাশফিয়া ভীড় করে দাঁড়িয়ে আছে। নূরকে এই বিধ্বস্ত অবস্থায় দেখামাত্রই চাঁদ চোখে কাজল পড়া থামিয়ে দিলো!

নির্বাক দৃষ্টিতে পিছু ঘুরে নূরের দিকে তাকিয়ে রইল। তিথী, জায়মা এবং তাশফিয়া মাথা নুইয়ে রুম থেকে বের হয়ে গেল। এই মুহূর্তে এখানে থাকাটা তাদের বেমানান লাগল!
নূর হাঁপাতে হাঁপাতে চাঁদের দিকে এগিয়ে গেল। চোখজোড়া তার আপনাআপনি শিথীল হয়ে এলো। মুগ্ধতা ছড়িয়ে পড়ছিল সর্বত্র।

প্রশান্তিতে ভরপুর হয়ে উঠল বুকের ভেতরটা। ক্রমশ বুকে বাঁধা অসুখটা সারতে লাগল তার! দেহ-মন প্রাণ খুঁজে পেল। যন্ত্রণারা ধুঁয়ে মুছে সাফ হতে লাগল। চাঁদ বাকরুদ্ধ হয়ে কাজলটা ড্রেসিং টেবিলের উপর রাখল। নূরের দিকে টলমল দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। খুশিতে বলিয়ান তার অনুভূতিরা। নূর ছুটে এসে চাঁদকে হঠাৎ শক্ত বাহুডোরে আঁকড়ে ধরল! চাঁদকে একদম তার বুকের ভেতর ঢুকিয়ে নেওয়ার পায়তারা করল! চাঁদ হাঁসফাঁস করে উঠল। রুদ্ধশ্বাস ছেড়ে বলল,,

“আরে আরে করছেনটা কী? আমাকে মে’রে ফেলবেন নাকি?”
একইভাবে নূর চাঁদকে পরম আবেশে জড়িয়ে ধরে রাখল। চাঁদের কর্ণতলে হিমশীতল গুঞ্জন তুলে বলল,,

প্রেমময়ী তুমি পর্ব ৫২

“আমার মাঝেই তোমার ম’র’ণ লিখা আছে চাঁদ! বিশ্বাস না হয় তো তোমার বুকে হাত রেখে দেখো। বুকের ছাতিটা কতোখানি ফুলে আছে! এভাবে ফুলতে থাকলে তো নিশ্চিত আমার মাঝেই তোমার ম’র’ণ হবে তাইনা?”

প্রেমময়ী তুমি পর্ব ৫৪