প্রেমময়ী তুমি পর্ব ৫৫

প্রেমময়ী তুমি পর্ব ৫৫
নিশাত জাহান নিশি

“এদিকে যে আমি আম্মুকে বড়ো গলায় বলে এলাম আম্মুর ছোটো মেয়ের জামাই আপনি হতে চলেছেন এখন তার কী হবে?”

নূর যেনো তাজ্জব বনে গেল! ঢুলুঢুলু নয়ন তার আগ্রাসী হয়ে উঠল। হঠকারিতায় মাথা চুলকাতে বাধ্য হলো। চাঁদের লাগামহীন কথাবার্তায় তার পিলা চমকে গেল। কীভাবে সম্ভব বড়ো গলায় তার খালামনির কাছে বলা যে সে উনার ছোটো মেয়ের জামাই হতে চলেছে? যেখানে নূরেরই এই প্রস্তাবটা তার খালামনির কাছে রাখার কথা ছিল। সেখানে চাঁদ তার পূর্বেই প্রস্তাবটা রেখে দিলো? ভালোবাসা দেখো এই মেয়ের! কিঞ্চিৎ মুহূর্তের জন্য নিজেকে ধাতস্থ করল নূর। নির্বোধ গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“এই কী বললা তুমি?”
চাঁদ ভ্রু যুগল কুঁচকালো। দৃষ্টি জোড়ায় তীক্ষ্ণতা নিয়ে নূরের বোকা সোকা নির্বিকার মুখমণ্ডলের দিকে তাকালো। কোমরে দু’হাত গুজে সে রাগী ভাব নিয়ে এক কদম সামনে বাড়ল। যতটা সম্ভব নূরের মুখোমুখি এসে দাঁড়ালো। সন্দিহান গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,,

“কেন? ভয় পাচ্ছেন আপনি? বিয়ে করবেন না আমাকে?”
চাঁদের রুক্ষ মুখমণ্ডলের দিকে তাকিয়ে নূর বেশ তৎপর ভাব নিলো। বুকে যতখানি সম্ভব সাহস সঞ্চার করল। এই মুহূর্তে চাঁদের অহেতুক সন্দেহকে তিল পরিমাণ প্রশ্রয় দেওয়া যাবেনা। তাই সে দ্বিধাহীন গলায় জবাবে বলল,,

“আশ্চর্য! ভয় পাব কেন? অবশ্যই আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই। তবে এখনি তো তা সম্ভব নয়! আমি আপাতত বেকার। পড়াশোনায় রানিং। বেকার ছেলের কাছে তোমার পরিবার তোমাকে তুলে দিবে হ্যাঁ? বিয়ের পর আমি তোমাকে কী খাওয়াব বলো?”

চাঁদ একরোঁখা ভাব নিলো। একগুঁয়ে গলায় বলল,,
“দিবেনা কেন? আলবাত দিবে। ছেলেটা এখন বেকার হলেও কিছুবছর পর তো সে চাকরী পাবে। তখন তো আর কোনো আপত্তি থাকবেনা তাইনা? তাছাড়া আমি এত খাদকও নই যে খেয়েদেয়ে আপনাকে নিঃস্ব করে দিব। প্রয়োজনে সকালে খেলে দুপুরে খাব না, দুপুরে খেলে রাতে খাব না! এভাবেই কেটে যাবে দিন। আপনাকে পেলে আর অন্যকিছুর সুখ ম্যাটার করে না!”

নূর প্রশান্তিময় দৃষ্টিতে চাঁদের প্রেমময়ী মুখমণ্ডলে নিষ্পলক তাকিয়ে রইল৷ চাঁদের মহৎ চিন্তাধারায় মুগ্ধ হলো সে। মোহিত হলো চাঁদের নির্ভেজাল ভালোবাসায়। এটা ভেবেই খুব উচ্ছ্বাসিত হলো যে চাঁদও নূরকে তার মতো করেই ভালোবাসে৷ যে ভালোবাসায় কোনো ভেজাল নেই। একে-অপরকে ছেড়ে যাওয়ার কোনো আশঙ্কা নেই।

ভালোবাসায় কমতি থাকার সম্ভাবনা নেই। চাঁদের দিকে আরও এক পা এগিয়ে এলো নূর। আহ্লাদি হয়ে চাঁদের এক গাল টিপে দিলো! ব্রণযুক্ত মুখে উষ্ণ হাত বুলালো৷ আদুরে গলায় তৃপ্তিদায়ক হেসে বলল,,
“খুব ভালোবাসেন আমাকে না? আমার চেয়েও বেশি?”

“না! আপনার চেয়ে কম বাসতে চাই। বেশি ভালোবাসলে মানুষ হারিয়ে যায়! আমি বেশি ভালোবাসলে যদি আপনি হারিয়ে যান? তখন আমার কী হবে হ্যাঁ? এরচেয়ে বরং আপনি আমাকে বেশি ভালোবাসুন! কেননা আমি বেঁচে থাকতে আপনাকে হারাতে পারবনা।”

“তুমি হারিয়ে গেলে আমার কী হবে চাঁদপাখি?”
নূর থমথমে হয়ে গেল। মুখমণ্ডলে প্রবল অসহায়তা ফুটিয়ে তুলল। চাপা ভয় তাকে গ্রাস করতে লাগল। বিষাদ বিরাজ করতে লাগল তার নীল চোখের মণিতে।

বিষণ্ণতায় ঢেকে গেল মনের অলিগলি। অন্তঃস্থলে ছোটো খাটো একটা ঘূর্ণিঝড় বয়ে গেল। জীবনের মতো দামী জিনিসটাকে হারিয়ে ফেলার তীব্র আশঙ্কা কাজ করল। নূরের শঙ্কা চাঁদ বুঝতে পারল। পরিস্থিতি এড়ানোর যথেষ্ট চেষ্টা করল সে। মলিন হেসে খানিক উঁচু হয়ে নূরের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। দৃৃষ্টিতে স্থিবিরতা এনে শান্ত স্বরে বলল,,

“এত ভয় পাওয়ার কী আছে হ্যাঁ? কেউ কাউকে বেশি ভালোবাসতে হবেনা। আমরা দুজনই দুজনকে সমানভাবে ভালোবাসব! তাহলে আর কেউ কাউকে হারানোর ভয় থাকবেনা।”
এতেও নূরের আগ্রাসিত ভয় কাটল না। শুকনো ঢোঁক গিলে সে চাঁদের দিকে অস্থির দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। ভীরু গলায় বলল,,

“ভালো একটা চাকরী বাকরী পেলেই আমরা বিয়ে করে নিব চাঁদ।”
“উফফফ চাকরী পেতে হবে না তো। চাকরী পাওয়ার আগেই আমরা বিয়ে করব। একদিন না একদিন তো চাকরী হবেই তাইনা?”

“আমি তোমাকে একটা সুন্দর সংসার দিতে চাই চাঁদ। চাকরী ছাড়া তা কখনো সম্ভব হবে?”
“ঠিক আছে। চাকরী ছাড়া সম্ভব না তবে….
বাকি অংশটুকু বলার সুযোগ দেওয়া হলো না চাঁদকে। এর পূর্বেই নূর চাঁদকে থামিয়ে দিলো। চাঁদের ছেলেমানুষীকে গুরুত্ব দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করলনা। ব্যস্ত গলায় বলল,,

“হ্যাঁ। এই তো বুঝতে পেরেছ। যখনই আমার চাকরী হবে তখনই আমরা বিয়ে করব ওকে? এখন চলো। খাওয়াদাওয়া করে আমরা বের হই।”
চাঁদ কটমট দৃষ্টিতে নূরের দিকে তাকালো। বুঝতে পারল নূর প্রসঙ্গ পাল্টানোর চেষ্টা করছে। তবে চাঁদ এক্ষেত্রে আর কোনো খামখেয়ালী করতে চায়না। শুভ কাজ সে যত দ্রুত সম্ভব সেরে ফেলতে চায়!

এভাবে একটা নিরাশ সম্পর্কে ঝুলে থেকে সে তাদের ভালো সময়গুলো নষ্ট করতে চায়না। একেবারে বিয়ের পরই নূরের সাথে জমিয়ে প্রেম করবে বলে অনেক আগে থেকেই প্রবল ইচ্ছে তার। হালাল সস্পর্কে জোর বেশি থাকে। সেই হালাল সম্পর্কটাই সে চায় এখন।

তাছাড়া সাদমানকে নিয়েও সে বেশ ভয়ে আছে! কখন কোন দিক থেকে সাদমান তাদের ভালোবাসার পেছনে পড়ে যায় তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। তাই যতটা সম্ভব সাবধান থাকা উচিৎ।
নূর উদ্যমি হয়ে পেছনের দিকে ঘুরে দরজার চৌকাঠে পা বাড়াতেই চাঁদ পেছন থেকে নূরের হাতটা টেনে ধরল। নূর কৌতূহলী দৃষ্টিতে পিছু ফিরে তাকাতেই চাঁদ উদ্বিগ্ন গলায় বলল,,

“আমি সাদমান ভাইয়াকে অনেক কষ্টে ফিরিয়েছি নূর ভাইয়া! আমি চাইনা উনি আবারও আমাদের মাঝখানে ফিরে আসুক। আমাদের এই সুন্দর সম্পর্কে বিঘ্ন ঘটাক৷ দেখুন আমাদের বিয়েটা হয়ে গেলে উনি আমাদের আর আলাদা করতে পারবেন না। তখন আমরা একটা পবিত্র সম্পর্কে জড়িয়ে যাব। যার জোর উপর ওয়ালা অবধি। তখন উনি চাইলেও আমাদের মধ্যে কোনো ভুল বুঝাবুঝি সৃষ্টি করতে পারবে না নূর ভাইয়া।”

চাঁদের তৎপরতা দেখে নূর বেশ বুঝতে পারল চাঁদ তাদের সম্পর্কটা নিয়ে বেশ ভয়ে আছে। যা এই মুহূর্তে চাঁদকে মাত্রাতিরিক্ত দুঃশ্চিতার মধ্যে ডুবিয়ে রেখেছে। চাঁদের ভয় কাটানোর জন্য নূর ঝট করে চাঁদকে জড়িয়ে ধরল! চাঁদের মাথায় উষ্ণ ঠোঁট ছুঁইয়ে চাঁদকে সাহস যুগিয়ে বলল,,

“তুমি আমি এক থাকলে পৃথিবীর তৃতীয় কোনো শক্তি নেই আমাদের আলাদা করার! আর এতদিন আমি সাদমানকে প্রশ্রয় দিয়েছিলাম কারণ আমি ভাবতাম তুমি আমাকে পছন্দ করো না! এখন যখন জানতে পারলাম তুমি আমাকে শুধু পছন্দ নয়, প্রচণ্ড রকমের ভালোও বাসো। তো সেক্ষেত্রে আমি আমি জান প্রাণ লাগিয়ে দিব। সাদমানের একরত্তি প্রশ্রয় নেই সেখানে। তুমি শুধু শুধু ভয় পাচ্ছ চাঁদ। এসব দুঃশ্চিন্তা থেকে প্লিজ বের হয়ে এসো। এই সময়টাকে এঞ্জয় করো। ফাইনালটা ঠাণ্ডা মাথায় দিই আমি। চাকরী বাকরী পাই এরপর আমরা বিয়ে করব প্রমিস।”

চাঁদ আর কোনো কথা বাড়ালোনা। নূরের সিদ্ধান্তকেই ইচ্ছের বিরুদ্ধে মেনে নিলো! দুজন দুজনকে ছেড়ে রুম থেকে বের হয়ে গেল। চাঁদ খাবারের থালাটা হাতে নিয়ে ড্রয়িংরুমে চলে এলো। নূরকে ডাইনিং টেবিলে বসিয়ে সে খেতে দিলো। নূরের পাশে চাঁদও চুপটি করে বসল।

আর কী কী লাগবে নূরের থেকে জানতে চাইল। কোনো কিছুই খাচ্ছেনা নূর। শুধু ডাল দিয়ে ভাত চটকে খাচ্ছে। মুখে কোনো স্বাদই যেনো খুঁজে পাচ্ছেনা সে। গোটা একটা দিন অনাহারে থাকার দরুন কিছুই তার রুচিতে কুলুচ্ছেনা। তবুও চাঁদের মুখের দিকে চেয়ে যতটা সম্ভব জোর করে খাবারটা গিলছে। এরমধ্যেই হঠাৎ সামিয়া আহমেদ কোথা থেকে যেনো ছুটে এলেন! নূরের অন্যপাশের চেয়ারটা টেনে তিনি ধপ করে বসলেন। খাবার চিবুতে থাকা নূরের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন। তৎপর গলায় শুধালেন,,

“এই নূর? তুই নাকি আমার ছোটো মেয়ের জামাই হতে চলেছিস?”
সঙ্গে সঙ্গেই বিষম খেলো নূর। নাকেমুখে ওঠে হুলুস্থুল কাণ্ড বেঁধে গেল! চাঁদ ব্যস্ত হয়ে চেয়ার ছেড়ে ওঠে দাঁড়ালো। তার মায়ের দিকে খড়তড় দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। খরখরে গলায় শুধালো,,
“এসব কথা বলার তুমি আর সময় পেলে না মা? দেখছ না মানুষটা খাচ্ছে? এরমধ্যেই তোমার এই উদ্ভট প্রশ্নগুলো করতে হবে?”

সামিয়া আহমেদ জিভ কাটলেন। ইশারায় বললেন নূরকে পানি দিতে। গ্লাসভর্তি পানি চাঁদ নূরের দিকে এগিয়ে দিলো। উদ্বিগ্ন হয়ে চাঁদ উভয় হাত দ্বারা নূরের মাথায় হালকা হাত বুলাতে লাগল। নূরের কষ্ট ভুলাতে অস্থিরমণা হয়ে উঠল। গড়গড় করে নূর গ্লাসভর্তি পানিটা খেয়ে নিলো। বিব্রতকর দৃষ্টিতে পাশ ফিরে সামিয়া আহমেদের দিকে তাকালো। সামিয়া আহমেদ ভ্রু উঁচিয়ে উত্তরের অপেক্ষায় নূরের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। বিষয়টা বুঝতে পেরে নূর আবারও দৃষ্টি নামিয়ে নিলো। জবাবে সোজাসাপটা গলায় সামিয়া আহমেদকে বলল,,

“দেখো খালামনি আগে আমি একটা ভালো চাকরী বাকরী পাই। এরপর তোমার মেয়েকে ঘরে তুলব।”
সামিয়া আহমেদ স্বস্তির শ্বাস ফেললেন। নূরের উপর খুশি হয়ে সন্তুষ্ট গলায় বললেন,,
“যাক বুঝতে পেরেছিস! এবার আমার মেয়েকে শোকেসে সাজিয়ে রাখলেও কোনো সমস্যা নেই আমার! তোর জন্যই আমানত করে রাখব!”

শপিংমলে নীড় সোহানীর জন্য শাড়ি পছন্দ করছে কম তবে সোহানীকে দেখছে বেশি! বেহায়ার মতো সে সোহানীকে কেবল সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে দেখছে। পলক যেনো পড়ছেই না তার। দোকানদাররাও আড়চোখে নীড়ের বেহায়াপনা দেখছে! তারাও কেমন যেনো মিটিমিটি হাসছে সোহানীকে দেখে।

সোহানী অতিষ্ট নীড়ের এহেন নির্লজ্জতায়। নীড়ের জন্যই সবার সামনে তাকে এতটা লজ্জা পেতে হচ্ছে। ইচ্ছে করছে নীড়কে এখনি দু’একটা কটু কথা শুনিয়ে দিতে। জোর করে এখান থেকে তাড়িয়ে দিতে। তবে পরিস্থিতির চাপে পড়ে সে কিছুই করতে পারছেনা। যথেষ্ট অস্বস্তি থাকার কারণে সে পছন্দসই একটা শাড়িও পছন্দ করতে পারছেনা৷ দেড় ঘণ্টা হলো শপিংমলে আসার। তবে কাজের কাজ কিছুই হলোনা! এই কারণেই মেজাজ তার প্রচণ্ড রকম বিগড়ে আছে। কেন সে ননাই করে নীড়কে তার সাথে শপিংয়ে আসতে বলল? এরজন্য এখন তার বড্ড অনুতাপ হচ্ছে!

চাঁদ, জায়মা, তাশফিয়া এবং তিথী প্রতিটি শপ ঘুরে ঘুরে তাদের হলুদের শাড়ি বাছাই করছে। তবে পছন্দসই একটাও হলুদ শাড়ি খুঁজে পাচ্ছে না তারা। শাড়ি পছন্দ হলে দামে মিলছেনা। আবার দামে মিললেও শাড়ি পছন্দ হচ্ছেনা! উভয় সংকটে পড়েছে তারা।

তবে বাকিদের নজর হলুদ শাড়ির দিকে থাকলেও চাঁদের একার নজর পড়ল হলুদ লেহেঙ্গার দিকে! সামনেই একটা শাড়ির দোকানে হলুদ রঙের একটিনলেহেঙ্গা হ্যাঙ্গারে ঝুলে আছে। হালকা সাদা স্টোনের কাজ আছে লেহেঙ্গাটিতে। তবে এই হালকা কাজেই লেহেঙ্গাটিকে আকর্ষণীয় দেখাচ্ছে। দূর থেকেও চোখ ধাঁধিয়ে আসছে। আর এক মুহূর্তও বিলম্ব করলনা চাঁদ। দ্রুত পায়ে হেঁটে সে পাশের দোকানে সোহানীর কাছে গেল। নীড়কে উপেক্ষা করে সোহানীর কাছে আবদার করল। কানে ফিসফিসিয়ে বলল,,

“আপু। আমার না একটা লেহেঙ্গা পছন্দ হয়েছে!”
সোহানী ভ্রু যুগল কুঁচকে চাঁদের দিকে তাকালো। খরখরে গলায় বলল,,
“বাজেটের দিকে খেয়াল আছে তোর? নীড় খুশি হয়ে তোদের জন্য হলুদের শাড়ি কিনে দিচ্ছে। সেই জায়গায় আমি কীভাবে বলি বল? তোর লেহেঙ্গা পছন্দ? বাজেট বেশি বেড়ে গেলনা? কী ভাববে বল তো?”
চাঁদ মুখটা কালো করে নিলো! গম্ভীর গলায় বলল,,

“আচ্ছা থাক লাগবেনা।”
রাগে গটগট করে মল থেকে বের হয়ে গেল চাঁদ। পাশ থেকে নীড় উজবুক দৃষ্টিতে চাঁদের যাওয়ার পথে তাকিয়ে রইল। সন্দিহান গলায় সোহানীর দিকে প্রশ্ন ছুড়ল,,
“কী হলো? চাঁদ রাগ করল কেন? কী বলছ তাকে?”

সোহানীর মনটাও বেশ খারাপ হয়ে গেল! নীড়ের কথায় মনোযোগ না দিয়ে সে পার্স ঘাটতে লাগল। হিসাবের বাইরেও আলাদা কোনো টাকা আছে কিনা খুঁজতে লাগল। একটা মাত্র ছোটো বোন তার। কীভাবে তার আবদার অপূর্ণ রাখে? এদিকে নীড়ের কাছে চাঁদের আবদারের কথা বলতেও তার অস্বস্তি হচ্ছে! যদিও নীড় কিছু বলবে না তবুও তার বিবেকে বাঁধছে।

শপিংমলের এক কর্ণারে দাঁড়িয়ে নূর দোকানের ভেতরকার সব দেখছিল। মাহিন এবং আয়মনের সাথে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে আড্ডা দিলেও চাঁদের দিকে ছিল তার তীক্ষ্ণ নজর! চাঁদের গতিবিধি সব দেখছিল সে। বিষণ্ণ চাঁদকে দেখে তার ভেতরটা অস্থির হয়ে উঠল। কিছু একটা হয়েছে বুঝতে পারল। দ্রুত পায়ে হেঁটে সে আড্ডার মহল থেকে বের হয়ে এলো। হম্বিতম্বি হয়ে পাশের দোকান থেকে চাঁদকে টেনে এনে তাকে এক সাইডে এনে দাঁড় করালো। চাঁদের ডান হাতটা টেনে ধরে উদগ্রীব গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,

“কী লাগবে বলো? মুখ ফুলাইছ কেন?”
মাথাটা নুইয়ে নিলো চাঁদ। রাশভারী গলায় বলল,,
“আমি যা চাই। তা আপনি এখন কিনে দিতে পারবেন না নূর ভাইয়া!”
“কী চাও বলবে তো?”
“আমার একটা হলুদ লেহেঙ্গা চাই!”
ফিক করে হেসে দিলো নূর! বিদ্রুপাত্নক গলায় বলল,,

“সামান্য একটা লেহেঙ্গার জন্য আমার কাছে কোনো বাজেট থাকবেনা চাঁদ? তোমার নূরকে তোমার এতটাই হেল্পলেস মনে হয়? হ্যাঁ, হয়তো এরচেয়ে বড়ো কোনো চাওয়া এখন আমি তোমার পূরণ করতে পারবনা। তবে লেহেঙ্গা কিনে দেওয়ার মতো সামর্থ্য আমার আছে। তোমাকে এসব নিয়ে ভাবতে হবেনা।”
চাঁদকে টেনে এনে নূর সামনের ঐ দোকানটিতে দাঁড় করিয়ে দিলো। সমস্ত দোকানে চোখ বুলিয়ে সে চাঁদকে বলল,,

“দেখো কোনটা পছন্দ হয়। বিল আমি পে করব।”
“কিন্তু….
“কিন্তু কী? আমার সব তো তোমারই চাঁদ। কোনো রকম হিজিটেড ফিল করবেনা। যা পছন্দ হয় তাই নিবে।”
চাঁদ অবাক দৃষ্টিতে নূরের দিকে তাকিয়ে রইল। তার ইচ্ছের গুরুত্ব নূরের কাছে এতটা দামী ভাবতেই সে মৃদু হাসল। অদ্ভুত এক ভালো লাগা কাজ করতে লাগল মনজুড়ে। নূরের প্রতি ভালোবাসা আরও বাড়তে লাগল। চাঁদের ড্যাব ড্যাব চাহনি দেখে নূর ভ্রু কুঁচকালো। শক্ত গলায় বলল,,

“আরে আমাকে পরেও দেখতে পারবে। এখন লেহেঙ্গাটা আগে চুজ করো।”
চাঁদ দেঁতো হাসল। নূরের হাতটা ছেড়ে সে উল্লাসিত গলায় দোকানীকে বলল হলুদ লেহেঙ্গাটা দেখাতে। চাঁদের কথামতো দোকানী হলুদ লেহেঙ্গাটা চাঁদকে খুলে দেখালো। বিকাশ থেকে টাকা ক্যাশ আউট করার জন্য নূর শপিংমলের বাইরের দোকান গুলোতে গেল। মাহিন এবং আয়মন হতবিহ্বল দৃষ্টিতে নূরের কর্মকাণ্ড দেখতে লাগল। চোখদুটো তাদের কপালে যেনো ওঠে গেল! আক্ষেপভরা গলায় মাহিন বলল,,

“ধ্যাত চু’ল! আমি কেন নূরের মতো হতে পারছিনা। কেন তিথীকে এখনও পটাতে পারছিনা। যাই চু’ল আমিও ট্রিকটা এপ্লাই করে আসি!”
আয়মন কপাল চাপড়ালো। পাশ ফিরে মাহিনের দিকে তাকিয়ে বলল,,
“তুই না হয় এই ট্রিক এপ্লাই করলি। আমি কোন ট্রিক এপ্লাই করব ভাই?”

সন্দেহজনক দৃষ্টিতে মাহিন আগাগোড়া আয়মনকে পরখ করে দেখল। সন্দিহান গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,,
“তুই এপ্লাই করবি মানে? এই তোর আবার কে আছে? কাকে আবার জুটিয়েছিস তুই?”
হেঁতো হেসে আয়মন মাথা চুলকালো! রহস্যময় গলায় বলল,,

“আছে একজন!”
“কে সে?”
“তাশফিয়া!”
কপালে হাত দিয়ে ফেলল মাহিন। উত্তেজিত গলায় বলল,,

“মানে কী করে ভাই? তুইও কি আমার মতোই ঐ তাশফিয়ার হাতের চড় খেয়ে তার প্রেমে পড়েছিস? ঐ দুই বোনের হাতেই কী জাদু আছে রে ভাই?”
“তাশফিয়া কী হ্যাঁ? তাশফিয়া কী? ভাবি ডাকবি ভাবি!”

জায়মা পেছন থেকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দুজনের সব গোপন কথাবার্তা শুনছিল! মুখে হাত দিয়ে সে বেকুব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। কী চলছে কী এই দুজনের মধ্যে? তারা দুজনই কী তবে তার দুই ফ্রেন্ডকে মন দিয়ে বসে আছে? জায়মা এই সুযোগটার সদ্ব্যবহার করল! দুজনকেই ব্ল্যাকমেইল করে বিয়ের জন্য নতুন একটা ড্রেস কেনার ফন্দি আটল! ব্যগ্র হেসে পেছন থেকে সে গলা ঝাড়ল। বুকের পাঁজরে দু’হাত গুজে বেশ ভাব নিলো। দুজনকে উদ্দেশ্য করে হুমকিমূলক গলায় বলল,,

“আমি কিন্তু শুনে ফেলেছি সব। বলব তিথী আর তাশফিয়াকে সব? তোমরা যে দুজনকে লাইন মারছ?”
তাজ্জব বনে গেল দুজন। হুড়মুড় করে পিছু ঘুরে তাকালো। জায়মাকে দেখামাত্রই দুজন শুকনো ঢোঁক গিলল। একে-অপরের দিকে অস্থির দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। জায়মা মিটিমিটি হেসে ঝেড়ে কাশলো। উগ্র গলায় বলল,,

“কী বলব তিথী আর তাশফিয়াকে সব?”
আয়মন ভীষণ ভয় পেয়ে গেল৷ ঝটপটে গলায় বলল,,
“এই না না। প্লিজ এখনি কিছু বলিস না তাশফিয়াকে। তুই ভালো করে ওকে কিছু বুঝিয়ে বলতে পারবিনা। দেখা গেল তুই উল্টোপাল্টা বুঝিয়ে বলে আমাকে ভুল বুঝাতে বাধ্য করলি!”
মাহিন ও আয়মনের কথায় সায় জানালো। থমথমে গলায় বলল,,

“হ্যাঁ জায়মা প্লিজ। এখনি তুমি তিথীকে কিছু বলোনা। আমি তো এখনো তাকে ভালো করে লাইনই মারতে পারলামনা! আরও কত কত লাইন মারার বাকি আছে।”
জায়মা মনে মনে বাঁকা হাসল। উদ্দেশ্য তার সফল হতে চলল। এবার সোজা পয়েন্টে আসা যাক। আটঘাট বেঁধে স্বার্থ উদ্ধারে নেমে পড়া যাক! পুনরায় গলা ঝাড়লো জায়মা। অবুঝ ভাব নিয়ে বলল,,

“ওকে ফাইন। তোমাদের সব কথা মেনে নিলাম। তবে এবার আমারও একটা শর্ত আছে!”
দুই ভুক্তভোগী এবার সতেজ হয়ে উঠল। আশার আলো যেনো খুঁজে পেল তার। নতুন করে নিষ্ক্রিয় প্রাণ উজ্জীবিত হয়ে উঠল। উত্তেজিত গলায় শুধালো,,
“কী শর্ত?”

জায়মা দাঁত কপাটি দেখিয়ে হাসল। ঝড়ঝড়া গলায় ফুড়ফুড়ে মেজাজে বলল,,
“আমাকে একটা সুন্দর দেখে ড্রেস কিনে দিতে হবে তোমরা দুজনে মিলে!”
বিপদে ফেসে যাওয়া দুই তরুন প্রেমিকই এবার কপাল চাপড়ালো! অপারগ হয়ে জায়মার সিদ্ধান্ত মেনে নিতে তারা বাধ্য হলো! চুম্বকীয় আকর্ষণে ছুটে চলল জায়মার পিছু পিছু। কোথায় তাদের প্রেয়সীদের জন্য ড্রেস কিনে দেওয়ার কথা ছিল। আর কোথায় তারা এখানে এই চুকলির ড্রেস কিনে দেওয়ার পেছনে পড়ে গেল!

বিকাশ থেকে ক্যাশ আউট করে নূর দৌঁড়ে এলো শপিংমলে। কাটায় কাটায় পাঁচহাজার টাকা ধরিয়ে দিলো দোকানীর হাতে। চাঁদ তার পছন্দসই লেহেঙ্গা কিনতে পেরে ভীষণ খুশি হলো! নূরের হাতটা সে কিছুতেই ছাড়তে চাইলনা। আহ্লাদে প্রায় আটখানা হয়ে উঠল! খুশিতে তার মনে লাড্ডু ফুটতে শুরু করল। চাঁদকে হাসি-খুশি দেখে নূরও বেশ খুশি হলো। মাথা নুইয়ে চাঁদের কর্ণতলে গহীন গুঞ্জন তুলে বলল,,

“কাল আমার হলদে পাখিটাকে দেখব! আ’ম সো এক্সাইটেড চাঁদপাখি। এখনি আমার চোখের সামনে তোমার হলদেটে রূপটা ভেসে উঠছে! আহা দেখে দেখেই মন ভরে যাচ্ছে। কল্পনায় যে এতটা সুন্দর হতে পারে বাস্তবে যে সে ঠিক কতখানি সুন্দর হবে তা ভেবে ভেবেই আমি তোমার নামের জল আরও এক গ্লাস খাচ্ছি!”
চাঁদ লজ্জা পেল! লজ্জায় একপ্রকার কুঁকিয়ে উঠল। নূরের বাহু আঁকড়ে ধরে মাথা নুয়ালো। অনুরাগ মেশানো গলায় বলল,,

“আমিও কাল আমার নূরকে হলুদ পাঞ্জাবীতে দেখব। আবারও নতুনভাবে, নতুন করে, নুতন অনুভূতি নিয়ে তার প্রেমে পড়ব। এক পুরুষের প্রেমে আমি কোটি কোটি বার পড়ব! আর এই অনুভূতিটাই আসলে অদ্ভুত সুন্দর হয় নূর।”

এরমধ্যেই নীড় এবং সোহানী দ্রুত পায়ে হেঁটে এসে চাঁদ এবং নূরের মুখোমুখি দাঁড়ালো। সোহানীর চোখে-মুখে হাসি খুশির ঝলক খেলে উঠল। ছটফটে গলায় সে চাঁদকে বলল,,
“এই চাঁদ। লেহেঙ্গাটা কোথায়? নীড় পেমেন্ট করবে বলেছে।”
নীড়ও সোহানীর কথায় কথা টেনে বলল,,

“চাঁদ তুমি কী বলো তো? তোমার কী লাগবে না লাগবে আমাকে বলবেনা একবার? আমি কি শুধুই তোমার জিজু? কাজিন নই?”
নূর ঈষৎ হেসে নীড়ের কাঁধে হাত রাখল। বিষয়টা বুঝতে পেরে সে স্থির গলায় বলল,,
“ইট’স ওকে ভাইয়া। আমি লেহেঙ্গাটা চাঁদকে গিফট করেছি। পেমেন্টও করে দিয়েছি। প্লিজ তুমি এত হাইপার হয়ো না।”

তৎক্ষনাৎ সোহানী এবং নীড় সন্দেহজনক দৃষ্টি নিক্ষেপ করল নূরের দিকে! সঙ্গে সঙ্গেই নূর দৃষ্টি জোড়া নামিয়ে নিলো। লজ্জাবোধ কাজ করতে লাগল তার। চাঁদ ভ্রু কুঁচকে নীড় এবং সোহানীর দিকে তাকালো। রুক্ষ গলায় বলল,,

“তোমরা এমন একটা ভাব করছ মনে হচ্ছে যেনো তোমরা কিছুই জানো না। আমরা দুজন দুজনকে ভালোবাসি ওকে? কিছুদিন পর আমরাও বিয়ে করব। তোমাদের চেয়েও বড়ো অনুষ্ঠান করে বিয়ে করব বুঝছ? তখন তোমরা সবাই তাক লেগে থাকবে।”

উপস্থিত তিনজন তাজ্জব দৃষ্টিতে চাঁদের দিকে তাকালো। নূরও প্রায় ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল! কিছুই যেনো আটকাচ্ছেনা তার মুখে। মাইকের মতো শুধু পাবলিসিটি করেই চলছে! গোলা বারুদের ন্যায় মুখ থেকে বারুদ উড়ছে।

আর কিছুক্ষণ এখানে দাঁড়িয়ে থাকলে চাঁদ হয়তো মুখটা আরও চালাবে। যা নূরকে তীব্র লজ্জার মুখোমুখি ফেলে দিবে। চাঁদের ডান হাতটা শক্ত করে ধরে নূর লেজ গুটিয়ে জায়গা থেকে পালালো। দ্রুত গলায় চাঁদকে বলল,,
“আরে চলো চলো কসমেটিকস কর্ণারে যাই! কত শপিং বাকি আছে বলো তো।”

রাত প্রায় পৌনে দশটা বাজতে চলল ঘড়িতে। বিয়ের সমস্ত শপিং শেষ হতে হতে রাত অনেকটা বেড়ে গেল। ক্লান্তি, অবসন্নতা, ক্ষুধা সব এক সঙ্গেই তাদের দেহে গজিয়ে উঠল। তাকানো যাচ্ছেনা ঠিক কারো দিকে। একেকজন ত্যাড়া ব্যাকা হয়ে যাচ্ছে।

তাই দায়িত্ব নিয়ে নীড় আশে পাশের একটি রেস্টুরেন্টে সবাইকে নিয়ে খেতে বসল। যে যার মতো অর্ডার করতে লাগল। নূর গেল ওয়াশরুমে। কাজ শেষ করে নূর ফোন হাতে নিয়ে দৌঁড়ে ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে এলো।

প্রেমময়ী তুমি পর্ব ৫৪

টেবিলে বসে থাকা মাহিন এবং আয়মনকে ধরে দাঁড় করিয়ে দিলো! চোখে-মুখে ঘোর আতঙ্ক ফুটিয়ে তুলল। সামনের চুল পেছনে টেনে ধরে উত্তেজিত গলায় বলল,,
“হসপিটালে চল। সাদমান সু’ই’সা’ই’ড করতে চেয়েছিল!”

প্রেমময়ী তুমি পর্ব ৫৬