প্রেমময়ী তুমি পর্ব ৫৬

প্রেমময়ী তুমি পর্ব ৫৬
নিশাত জাহান নিশি

“হসপিটালে চল। সাদমান সু’ই’সা’ই’ড করতে চেয়েছিল!”
মাথায় যেনো আকাশ ভেঙে পড়ল উপস্থিত সবার। কেউ যেনো ঘুনাক্ষরেও বিশ্বাস করতে পারছেনা আবেগের বসে সাদমান এতো বড়ো একটা ঘৃণিত পদক্ষেপ নিতে পারে। তৎক্ষনাৎ খাবার টেবিল ছেড়ে ওঠে দাঁড়ালো সবাই। নীড় তো কৌতূহল এবং উদ্বিগ্নতায় জর্জরিত হয়ে মাথায় হাত দিতে বাধ্য হলো।

সে আদোতেই জানেনা সাদমান কেন হঠাৎ এই মর্মান্তিক পদক্ষেপটা নিতে গেল। এর পেছনের আসল কারণটা কী। শুধু এতটুকুই জানে তাদের দুজনের মধ্যে কিছু একটা নিয়ে ঝগড়া হয়েছিল। বিয়ে বাড়ির কাজ নিয়ে অতিরিক্ত ব্যস্ত থাকার দরুন সে আশেপাশে খেয়াল রাখতে পারেনি। যতটা দেখেছে ততটাই ধারণা করেছে। কাউকে এই বিষয়ে কিছু জিজ্ঞেসও করেনি। উদগ্রীব হয়ে নূরের মুখোমুখি দাঁড়ালো নীড়। উত্তেজিত গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“এই কী হয়েছিল রে? সাদমান হঠাৎ সু’ই’সা’ইড করতে গিয়েছিল কেন?”
নীড়ের কঠিন প্রশ্নে নূর মাথা নুয়াতে বাধ্য হলো। বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। আপাতত নীড়কে যথেষ্ট এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল সে। এই বিষয় নিয়ে এখন আলোচনা করার উপযুক্ত সময় নয়। তাই মাহিন এবং আয়মনকে উদ্দেশ্য করে নূর ব্যস্ত গলায় বলল,,

“এই চল তোরা। আমাদের এক্ষণি বের হতে হবে।”
ব্যস্ত ভঙ্গিতে পেছনের দিকে মোড় নিলো নূর। কোনো দিকে কালক্ষেপণ না করে আয়মন এবং মাহিনও হুড়োহুড়ি করে নূরের পিছু পিছু ছুটল। সাদমানের জন্য সত্যিই তাদের মন কেঁদে উঠছে। সকাল থেকে এই পর্যন্ত সাদমানের কোনো খোঁজ-খবর নেয় নি তারা! সেক্ষেত্রে তারা নিজেদের-ই স্বার্থপর ভাবছে। চাঁদ হঠাৎ ভরাট গলায় পেছন থেকে নূরকে ডেকে উঠল। জায়মা এবং তিথীকে সামনে থেকে সরিয়ে সে দ্রুত পায়ে হেঁটে নূরের মুখোমুখি দাঁড়ালো। আগ্রাসিত দৃষ্টিতে নূরের দিকে তাকালো। অস্থির গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,,

“আপনাকে যেতেই হবে ওখানে? না গেলে হয়না?”
নূর গরম দৃষ্টিতে চাঁদের দিকে তাকালো। এই সংকটাপন্ন মুহূর্তে চাঁদের এসব নির্বোধ কথাবার্তায় সে প্রচণ্ড বিরক্ত হলো। শাণিত গলায় বলতে বাধ্য হলো,,

“তুমি এসব কী বলছ চাঁদ? হি ইজ মাই ফ্রেন্ড ওকে? মাই বেস্টফ্রেন্ড৷ তার এই দুঃসময়ে আমি তার পাশে দাঁড়াব না? তাকে দেখতে যাবনা? তাকে শান্তনা দিতে যাবনা? কীসব বোকা সোকা কথাবার্তা বলছ তুমি!”
“তাহলে আমাকেও সাথে করে নিয়ে যান!”

“আমাদের মাঝখানে তুমি গিয়ে কী করবে হ্যাঁ? তোমার কাজ কী ওখানে? তাছাড়া ওটা একটা হসপিটাল। বাড়ি নয় যে ভীড় জমিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে। রাতও প্রায় অনেকটা হয়ে গেছে। তুমি পারলে নীড় ভাইয়ার সাথে বাড়ি ফিরে যাও ওকে?”

“না আমি বাড়ি ফিরবনা! আপনার সাথেই যাব! আমি না গেলে দেখা যাবে আপনি আপনার ফ্রেন্ডের কথায় ইমোশনাল হয়ে আমাকেই তার হাতে তুলে দিলেন! বিশ্বাস নেই কিন্তু আপনার সাথে। বেস্টফ্রেন্ড তো আপনার কাছে অনেক বড়ো।”

নূর থমকালো চাঁদের কথায়। অসহায় দৃষ্টিতে চাঁদ তার দিকে তাকিয়ে রইল৷ চোখের কোণে জমে রইল বিষাদের কালো মেঘ। বিশ্বাসহীনতায় ভুগছে সে। নূরের ভালোবাসায় সন্দেহ প্রকাশ করছে! নূরের সিদ্ধান্তে হীনমন্যতা প্রকাশ করছে। অবশ্য করার-ই কথা। নূর তো কেবল সেক্রিফাইজই করতে জানে! নিজেকে কষ্টে রেখে, যন্ত্রণায় রেখে সে অন্যের মুখে হাসি ফোটাতে জানে। চাঁদের ভয়কে এই মুহূর্তে উপেক্ষা করল নূর! পাশ কাটিয়ে চাঁদের সামনে থেকে প্রস্থান নিলো। যেতে যেতে নিবিড় গলায় বলল,,

“বাড়ি ফিরে যাও তুমি। পরে এই বিষয় নিয়ে তোমার সাথে আমার কথা হবে।”
চাপা কান্নায় ভেঙে পড়ল চাঁদ! আয়মন এবং মাহিনও নূরের পিছু পিছু হন্তদন্ত হয়ে ছুটল। চাঁদ পেছন থেকে আয়মনের হাতটা টেনে ধরল। আয়মন ঘাড় বাকিয়ে পেছনে তাকালো। অমনি চাঁদ বেদনাতুর দৃষ্টিতে আয়মনকে প্রদর্শণ করল। কান্নাজড়িত গলায় বলল,,

“তুমি দেখো ভাইয়া। নূর ভাইয়া যেনো সত্যি সত্যিই কোনো ভুল না করে বসে।”
চাঁদকে অভয় দিলো আয়মন। চাঁদের হাতে ভরসার হাত রাখল৷ শান্তনার স্বরে বলল,,
“চিন্তা করিস না। যা হবে ভালো হবে।”

আয়মনও এবার ছুটল নূর এবং মাহিনের পিছু পিছু। নীড় এবং সোহানী ছুটে এসে চাঁদের কাছে জানতে চাইল এখানে আসলে হচ্ছেটা কী? আগা মাথা কিছুই বুঝে উঠতে পারছেনা তারা। চাঁদ হেচকি তুলে কেঁদে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত তাদের সব খুলে বলল। বৃত্তান্ত শোনার পর তারা দুজনই চমকে গেল! যা যা হলো সব তাদের ভাবনার অতীত ছিল। সবার মধ্যে বেশ থমথমে ভাব বিরাজ করতে লাগল।

ক্ষণিকের মধ্যেই অর্ডার করা খাবারগুলো পার্সেল করে নীড় সবাইকে নিয়ে রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে গেল। এই দুর্ঘটনার পর কারো মুখেই খাবার রুচ্ছিল না। এতো এতো খাবার নষ্ট হবে ভেবে নীড় খাবারগুলো পার্সেল করে নিলো। বাসায় যাওয়ার পর অ্যানি টাইম খাওয়া যাবে। চাঁদ, সোহানী, জায়মা, তিথী এবং তাশফিয়াকে হলে পৌঁছে দিয়ে নীড় হসপিটালের উদ্দেশ্যে রওনা হলো! ওখানের কী অবস্থা জানার জন্য। বড়ো হিসেবে তারও তো একটা দায়িত্ব আছে।

হলে পৌঁছেই চাঁদ রুমের দরজাটা ভেতর থেকে আটকে দিলো! বিছানায় গোল হয়ে বসে সে মরা কান্না জুড়ে দিলো! মনটা তার বড্ড ভীতু হয়ে আছে। চিন্তাভাবনারা বেসামাল হয়ে আছে। নূরের প্রতি একরত্তিও বিশ্বাস নেই তার! সাদমান অ্যানি টাইম তাকে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করতে পারে। নূরের যা দয়ালু স্বভাব কখন সে সাদমানের পাতা ফাঁদে পা দিয়ে বড়ো সড়ো একটা সর্বনাশ করে বসে তা নিয়েই ভীষণ চিন্তিত চাঁদ! শঙ্কায় সে জড়সড় হয়ে যাচ্ছে। কোনোকিছুর বিনিময়েই চাঁদ নূরকে হারাতে পারবেনা। নূর ছাড়া তার জীবন সত্যিই অন্ধকার। নূরের আলো ছাড়া চাঁদ তার নিজের আলো বিলাতে ভুলে যাবে!

একই সময়ে প্রায় বারোটি স্লিপিং পিল খাওয়ার দরুন সাদমানের অবস্থা প্রায় সূচনীয়। যদিও খারাপ কিছু ঘটে যাওয়ার আশঙ্কা তেমন নেই তবে ঔষধগুলো খালি পেটে খাওয়ার দরুন তার ভেতরকার অবস্থা খুবই করুন। ডক্টররা তাদের যথাসম্ভব চিকিৎসা চালিয়ে যাচ্ছেন৷ সাদমানকে সুস্থ করে তোলাই তাদের লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছি।

সাদমানের পরিবারের আহাজারি চোখে দেখা যাচ্ছেনা। তারা সবাই ভীড় করে দাঁড়িয়ে আছে কেবিনের সামনে। সাদমানের মা কিছুক্ষণ পর পর হু হু করে কেঁদে উঠছেন! ছেলের ভুল সিদ্ধান্তে খুব কষ্ট পাচ্ছেন তিনি। ভেতরে ভেতরে যন্ত্রণা ভোগ করছেন।

সাদমানের বাবা চেষ্টা করছেন উনার ওয়াইফকে সামলাতে। সাদমানের বড়ো বোন এবং জিজু মাথায় হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। সাদমানের এহেন বিবেকহীনতা বড্ড ভাবাচ্ছে তাদের। অন্তত সাদমানের থেকে এটা আশা করেন নি তারা। নূর, নীড়, আয়মন এবং মাহিন হসপিটালের এক কর্ণারে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। প্রখর দুঃশ্চিন্তার ছাপ ফুটে আছে তাদের কপালের ভাজে। কিয়ৎক্ষণ পর পর সবাই অস্থির হয়ে উঠছে।

করিডর জুড়ে কেবল পায়চারী করছে। তবে এখানে সবার চেয়ে নূর অত্যধিক চিন্তিত। কেন জানিনা তার খুব অপরাধবোধ কাজ করছে। সাদমানের এই অবস্থার জন্য নিজেকেই শতভাগ দোষী ভাবছে! এই অপরাধবোধ খুবই ভয়ঙ্কর৷ ভেতর থেকে মানুষকে চি’বি’য়ে খাওয়ার জন্য যথেষ্ট!

রাত প্রায় পৌণে দুইটা। অপেক্ষা, উদ্বিগ্নতা এবং দুঃশ্চিন্তা কাটিয়ে সাদমানের জ্ঞান ফিরেছে কিঞ্চিৎ পূর্বে! তার মা-বাবা-বোন এবং জিজু তার সাথে দেখা করতে কেবিনের ভেতর গেছে প্রায় কিছুক্ষণ হলো। তবে সাদমান কারো সাথে কোনো কথা বলছিল না! নিশ্চুপ হয়ে কাটিয়ে দিয়েছে গোটা প্রহর।

চোখ বুজে কেবল বিষাদের জল ফেলেছে! নির্বাক মূর্তিতে পরিণত হয়েছে প্রায়। দিন-দুনিয়া যেনো সে ভুলতে বসেছে। এমতাবস্থায় সাদমানের পরিবার আরও ঘাবড়ে উঠেছে৷ সাদমানের মৌনতা তাদের অধিক দুঃশ্চিতায় জর্জরিত করে তুলছে। চট করে কেবিন থেকে সবাই বের হয়ে গেল। নূরকে একা কেবিনের ভেতর পাঠাল! হয়তো নূরই পারবে সাদমানের মৌনতা ভাঙাতে। নূরের উপর অগাধ বিশ্বাস তাদের। তবে উনারা এখনো এইটা জানেন না, সাদমান কেবল নূরের কারণেই এত বড়ো একটা ভয়ঙ্কর পদক্ষেপ নিয়েছিল!

অপরাধী ভাব নিয়ে নূর চেয়ার টেনে সাদমানের পাশে বসল। সাদমান এখনও নিজের খেয়ালে ব্যস্ত। চোখ বন্ধ করে সে তিক্ত বিষাদে নিমগ্ন। চাঁদকে যেনো দু’চোখে হারাচ্ছে সে! নূরকে ঘিরে চাঁদের প্রতিটি ব্যক্ত ভালোবাসাময় অনুভূতি তার কর্ণতলে এখনো তীক্ষ্ণভাবে বেজে যাচ্ছে!

সাদমান যে ভালোবাসাটা চাঁদকে নিয়ে ফিল করত, সেই ভালোবাসা-ই চাঁদ এখন নূরকে নিয়ে ফিল করে। ভাবলেই তার ম’রে যেতে ইচ্ছে করে! তার সীমাহীন ভালোবাসায় কোথায় কোন দোষ ছিল তাই তাকে বড্ড ভাবাচ্ছিল। ভেতর থেকে তাকে ভীষণ পোঁড়াচ্ছিল।

সাদমানের এই বেহাল দশা দেখে নূর ঝট করে সাদমানের ডান হাতটা আঁকড়ে ধরল। সঙ্গে সঙ্গেই সাদমান কেঁপে উঠল৷ গোলন্দাজ দৃষ্টিতে পাশ ফিরে তাকালো। ব্যথীত নূরকে দেখামাত্রই সে রাগী ভাবমূর্তি পাল্টিয়ে হেয় হাসল! অকপট গলায় বলল,,

“আরে। তুই এখানে কী করছিস? তোর তো এখন চাঁদের কাছে থাকার কথা ছিল।”
নূর মাথা নুইয়ে নিলো। সাদমানের টিটকারিপূর্ণ কথাকে বিন্দুমাত্র প্রশ্রয় দিলোনা সে। প্রসঙ্গ পাল্টে নিচু গলায় বলল,,

“এখন কেমন আছিস তুই?”
“খুব ভালো আছি। দিব্যি আছি। দেখছিস না কতটা সুস্থ আছি? হসপিটালের কেবিনে শুয়ে আছি। সুস্থ মানুষরাই তো হসপিটালে শুয়ে থাকে তাইনা?”
নূর এবার ঘেটে গেল। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সাদমানের দিকে তাকালো। রুক্ষ গলায় বলল,,

“ফর দ্যা গড সেইক সাদমান। আমার সাথে ঠিকভাবে কথা বল। এভাবে পিঞ্চ করে কথা বলার কোনো মানে হয়না। আমি জোর করে চাঁদকে কেড়ে নিই নি ওকে? চাঁদ ভালোবেসে আমার কাছে এসেছে।”
উত্তেজিত হয়ে উঠল সাদমান! ঘাড়ের রগ টান টান। গভীর ক্ষোভ ফুটে উঠল তার সমগ্র মুখমণ্ডলে। মৃদু চিৎকার করে বলল,,

“তো থাক না তোরা তোদের ভালোবাসা নিয়ে। কে বাঁধা দিচ্ছে তোদের হ্যাঁ? কেন ছুটে এলি আমার কাছে বল? আমি কি বলেছিলাম আমার কাছে আসতে? কল করে ইনভাইট করেছিলাম তোকে? তোরা যে যেভাবে পারিস হ্যাপি লাইফ লিড কর ওকে? আমার কোনো আপত্তি নেই এতে। অবশ্য আপত্তি থাকার কথাও না। কারণ আমি খুব দ্রুত এদেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছি! তোদের সবাইকে ছেড়ে চলে যাচ্ছি!”

নূর অবাক হলো। উদ্ভট দৃষ্টিতে সাদমানের দিকে তাকিয়ে রইল। আশ্চর্যিত গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,,
“মানে? কী বললি তুই?”
বিশৃঙ্খল শ্বাস ছাড়ল সাদমান। দৃষ্টিতে তীক্ষ্ণতা আনল। ঝাঁঝালো গলায় বলল,,

“আগামী মাসেই আমি জিজুর সাথে জর্ডান চলে যাচ্ছি! তোকে ছেড়ে। তোদের সবাইকে ছেড়ে!”
চেয়ার ছেড়ে ওঠে দাঁড়ালো নূর। মুখমণ্ডলে প্রখর অস্থিরতা ফুটিয়ে তুলল। বড়ো বড়ো দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বিশ্বাস করতে পারছিলনা সাদমান রাগের বশে এত বড়ো একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলতে পারে। অসুস্থ সাদমানকে ঝাঁকি দিলো নূর। লোহিত গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,,

“এসব তুই কী বলছিস সাদমান? মাথা ঠিক আছে তো তোর?”
“মাথা আমার সম্পূর্ণ ঠিক আছে নূর। তুই প্লিজ এখান থেকে যা। বিলিভ মি, তোকে আমি সহ্য করতে পারছিনা! অসহ্য লাগছে আমার।”

“আমি তোর বেস্টফ্রেন্ড হই সাদমান৷ কীভাবে পারছিস তুই আমার সাথে অভিমান করে এত বড়ো একটা সিদ্ধান্ত নিতে? আমাকে এভাবে ধুর ধুর করে তাড়িয়ে দিতে?”
সাদমান তাচ্ছিল্যের হাসি হাসল! শ্লেষাত্মক গলায় বলল,,
“বেস্টফ্রেন্ড ছিলি এক সময়। এখন আর নেই!”

নূর নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। সাদমানের হিংস্রতা দু-চোখ ভরে দেখতে বাধ্য হলো। বন্ধুত্বহীনতা তাকে গ্রাস করছিল! সাদমানের চোখের অদম্য ঘৃণা সে আর সহ্য করতে পারছিলনা। অনুতাপের আগুনে জ্বলে পুড়ে ছারখার হচ্ছিল। আর ধৈর্য্য কুলালো না তার! এত ঘৃণা নিয়ে এই একই জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকতে।

চোখের কোণে লাঞ্চনার টইটম্বুর জল নিয়ে সে একছুটে জায়গা ত্যাগ করল! কেবিনের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা সবাইকে উপেক্ষা করে যত দ্রুত সম্ভব হসপিটাল থেকে প্রস্থান নিলো। পেছন থেকে নীড়, আয়মন এবং মাহিন তাকে হাজার ডেকেও থামাতে পারলনা। কারো কোনো কথাই যেনো তার কানে ঢুকছিল না।

হসপিটাল থেকে বের হয়ে তড়িঘড়ি করে সে বাইকে ওঠে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলো। ফুলস্পীডে গাড়ি ছেড়ে সে রাগে-দুঃখে, যন্ত্রণায় কাতরাতে লাগল! গাড়িতে থাকা সবটুকু সময় সে চোখের জল ফেলল। সাদমানের রুড ব্যবহারে সত্যিই সে ভীষণ আঘাত পেয়েছে। বিশেষ করে সাদমানের চলে যাওয়া সে কিছুতেই মেনে নিতে পারছেনা। এই যন্ত্রণাটা যেনো ভেতর থেকে তাকে নিঃশেষ করে দিচ্ছে!

রাতের কালচে আবরণ ভেদ করে ধরণীতে আরও একটি নব প্রভাতের উৎপত্তি ঘটল। প্রাকৃতিক নিয়মেই মিহি আলোর ছিটিফোঁটা বিরাজ করতে লাগল প্রকৃতিতে। পূব আকাশে সূর্য উঠিউঠি করছে। যেকোনো মুহূর্তেই ধরণীতে সূর্য্যের প্রখরতা ছড়িয়ে পড়বে। অস্থির হয়ে উঠবে প্রাণীকুল। বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আকাশে সূর্য ওঠা দেখছিল চাঁদ। বাড়ি জুড়ে রমরমা পরিবেশ। হলুদের অনুষ্ঠানে সকাল থেকেই মেতে উঠেছে সবাই।

চারিদিকে আয়োজনের কোনো কমতি নেই। হইচই ছড়িয়ে পড়েছে বাড়ির প্রতিটা কোণায় কোণায়। নিরিবিলি দাঁড়িয়ে থাকার জোঁ নেই কোথাও। কাল সারারাত চাঁদ ঘুমোয়নি। নূরের চিন্তায় অস্থির ছিল। কোনোরকম যোগাযোগ করতে পারছেনা সে নূরের সাথে।

কাল ওখানে কী কী ঘটেছিল কিছুই জানতে পারলনা। মাহিন, আয়মন, নীড়ও তাদের ফোন তুলছেনা। তাই মনটা আরও বেশি অস্থির হয়ে আছে তার। ছটফট ছটফট করছে। এসব ভাবতে ভাবতে সবশেষে সে সিদ্ধান্ত নিলো এক্ষণি নূরের সাথে দেখা করতে যাবে। কেন নূর তার সাথে এমন খামখেয়ালি করছে জানতে হবে তাকে। যদি তার আশঙ্কা ঠিক হয় তো আজ নূরের জান নিবে সে!

বাড়ির জামা-কাপড় পড়েই সে পাগলের মতো ছুটে চলল নূরদের বাড়ির উদ্দেশ্যে। পেটে দানা পানি কিছুই পড়লনা তার। যেখানে মনমানসিকতা ঠিক নেই সেখানে খাওয়াদাওয়ার প্রতি অনীহা থাকাটা নিতান্তই স্বাভাবিক। রিকশা করে প্রায় পনেরো মিনিটের মধ্যে চাঁদ নূরদের বাড়ির সামনে এসে পৌঁছে গেল। ভাড়া চুকিয়ে একছুটে বাড়ির ভেতর ঢুকে গেল। বিয়ে বাড়ির সর্বত্র জাঁকজমকপূর্ণ পরিবেশ বিরাজ করছে। ব্যস্ততায় ঘাম মুছছে নীড়।

কোনোদিকে ঠিকভাবে মনোযোগ দিতে পারছেনা সে। শুধু এদিক থেকে ওদিক ছুটোছুটি করছে। সব কাজেই তাকে দরকার লাগছে। গতকাল রাতে নূরকে এই বেসামাল অবস্থায় রেখে আয়মন বাড়ি ফিরতে পারেনি। সারারাত নূরের আশেপাশেই থেকেছে।

নূরের সাথে সাথে মাহিন এবং আয়মনও দু’চোখ এক করতে পারেনি। সারারাত নির্ঘুম কাটিয়ে দিয়েছে তারা। সকালের দিকেই তাদের উভয়ের চোখ লেগেছে। তবে নূর এখনো একদণ্ডের জন্যও চোখ লাগাতে পারেনি। সাদমানের ঘৃণাধরা চোখ দুটো কেবল তার চোখের সামনে ভেসে উঠছে! অনুতাপের আগুনে সে জ্বলছে, পুড়ছে, দ্বগ্ধ হচ্ছে।

বাড়ির কারো সাথে দেখা না করেই চাঁদ প্রথমে হন্ন হয়ে ছুটে গেল নূরের রুমের দিকে। কয়েকদফা রাগান্বিত শ্বাস ছেড়ে সে দরজায় সশব্দে কড়া নাড়ল। দাঁতে দাঁত চেপে চ্যাচিয়ে বলল,,
“এই নূর দরজা খোল। না হয় দরজা ভাঙতে বাধ্য হব!”

ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে মাত্র বের হয়েছিল নূর। চাঁদের উত্তেজিত গলার স্বর শুনে সে থতমত খেয়ে উঠল। চাঁদের হুমকি ধামকি যেনো ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছিল! হতবাক না হয়ে পারছিলনা নূর। তৎক্ষণাৎ মুখ মোছার টাওয়ালটা সে উন্মুক্ত শরীরে প্যাঁচিয়ে নিলো।

ঘুমে আবিষ্ট ভারী চোখ জোড়া নিয়ে সে দ্রুত পায়ে হেঁটে দরজার খিলটা খুলে দিলো। অমনি নরম হাতের চড় পড়ল তার গালে! বিস্ফোরক দৃষ্টিতে নূর চাঁদের দিকে তাকাতেই চাঁদ তেড়ে এসে নূরের গলা চেপে ধরল। চোয়াল শক্ত করে প্রশ্ন ছুড়ল,,

“এই তুই আমার কল তুলছিলি না কেন হ্যাঁ? কল তুলছিলি না কেন?”
নূর ভড়কে উঠল! তাজ্জব দৃষ্টিতে চাঁদের দিকে তাকিয়ে রইল। কী বলবে না বলবে ভেবে পাচ্ছিলনা সে৷ নূরের এই হ্যাবলামি দেখে চাঁদের রাগটা যেনো তড়তড় করে আরও বেড়ে গেল! পূর্বের তুলনায় সে আরও কঠিন হয়ে উঠল। জোরে চিৎকার করে বলল,,

“ফ্রেন্ডের হাতে আমাকে তুলে দিয়ে এসেছিস না? তাই তোর মুখ থেকে কোনো কথা বের হচ্ছেনা? এভোয়েড করছিস আমাকে?”
নূর এবার বেশ চটে গেল! এক ঝটকায় চাঁদের হাতটা তার গলা থেকে নামিয়ে নিলো। চক্ষুশূল দৃষ্টিতে চাঁদের দিকে তাকালো। রাগে গজগজ করে বলল,,

“আমার ফ্রেন্ড আমারে ছাইড়া চইলা যাইতাছে বুঝছ? আমাকে, তোমাকে সবাইকে ছাইড়া চইলা যাইতাছে। তুমি কী বুঝবা হ্যাঁ? বন্ধু হারানোর কষ্ট তুমি কী বুঝবা? কখনো নিজের ভুলের কারণে কোনো বন্ধুকে হারাইছ? যে বুঝবা!”
চাঁদ তব্দা লেগে দাঁড়িয়ে পড়ল! নূরের থেকে এই রিয়েকশান সে আশা করেনি। হীমশীতল হয়ে দাঁড়িয়ে রইল সে। বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে নূরের দিকে তাকিয়ে রইল। থমথমে গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,,

“কী বললেন আপনি? আপনার ভুলের কারণে সাদমান ভাই চলে যাচ্ছে? মানে আমাকে ভালোবাসাটা আপনার ভুল?”
নূর রাগে ফোঁস করে উল্টোদিকে ঘুরে নিলো। জোরে জোরে রুদ্ধশ্বাস ছাড়তে লাগল। মাথায় হাত রেখে নিজেকে স্থির করার চেষ্টা করল। চাঁদ তার জেদ থেকে চুল পরিমাণ হটল না। একরোঁখা হয়ে পুনরায় নূরের মুখোমুখি দাঁড়ালো। ক্ষোভে রক্তিম বর্ণ ধারণ করা চোখ দুটো নিয়ে নূরের দিকে তাকালো। শক্ত গলায় বলল,,

“আজ, এক্ষণি, এই মুহূর্তে আপনার একটা সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আপনি আমাকে চান না আপনার ফ্রেন্ডকে চান কোনটা? যেকোনো একটা বেছে নিতে হবে।”

জবাবে নূর মৌন রইল। চাঁদের করা প্রশ্ন তার একদমই পছন্দ হলো না। মাথা নুইয়ে সে রাগে ফোঁস ফোঁস করতে লাগল। সামনের পেছনের চুলগুলো টানতে লাগল। হাত দুটো মুষ্টিযুদ্ধ করে রাগ ঝাড়তে লাগল। নূরের প্রতিক্রিয়া দেখে চাঁদ যা বুঝার বুঝে নিলো! তড়িৎ বেগে সে নূরের সামনে থেকে সরে দাঁড়ালো। জায়গা থেকে প্রস্থান নিয়ে হিংস্র গলায় বলল,,

প্রেমময়ী তুমি পর্ব ৫৫

“আজ থেকে আমাদের রাস্তা আলাদা! আর কখনো না আমাদের কথা হবে না দেখা হবে।”
হনহন করে চাঁদ রুম থেকে বের হয়ে গেল। নূরের টনক এতক্ষণে নড়ল! বদ্ধ উন্মাদের মতো সে ছুটে গেল চাঁদের পিছুপিছু। তড়িঘড়ি করে চাঁদের পথ আটকে দাঁড়ালো সে। ডান হাত দ্বারা চাঁদের কোমর আঁকড়ে ধরল। সূচালো চাহনিতে নিমগ্ন গলায় বলল,,
“আমার তোমাকে চাই! আর কাউকে না!”

প্রেমময়ী তুমি পর্ব ৫৭