সেদিন তুমি প্রেম নিয়ে এসেছিলে পর্ব ৩

সেদিন তুমি প্রেম নিয়ে এসেছিলে পর্ব ৩
ফারজানা আফরোজ 

বিয়ের আসর থেকে বউ পালিয়ে যাওয়া সমাজের চোখে মোটেও ভালো লক্ষণ নয়। প্রতিটি মুহূর্তে চো’খে আঙ্গুল দিয়ে দে’খিয়ে দিবে পুরনো মুহূর্ত। স্পন্দন চুপচাপ এখনো ড্রয়িং রুমে বসে আছে। সাদিফ চৌধুরী ছেলেকে চুপচাপ দেখতে পেয়ে নিজের ঠোঁট জোড়া জিহ্বা দিয়ে ভিজিয়ে স্পন্দনের পাশে বসে ভীত কণ্ঠে বললেন,

– বাবা বাসায় যেতে হবে আমাদের।
স্পন্দন না তাকিয়ে উত্তর দিল,
– বউ নিয়ে যেতে হবে না? শুভ্রতা কোথায়?

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

সাদিফ চৌধুরী ছেলের প্রশ্নে আঁ’তকে উঠলেন। তিনি স্পন্দনকে আগাগোড়া এক পলক দেখে উঠে দাঁড়ালেন। ভয়ে তটস্থ হয়ে আর একটি বাক্য ব্যায় না করে শুভ্রতার বাবার কাছে গিয়ে রাগী কণ্ঠে বললেন,

– এভাবে অসম্মান না করলেও পারতেন জনাব আজিদ হাওলাদার। মেয়েকে ঠিকমত তৈরি করতে পারেননি। যে মেয়ে বিয়ের আসর থেকে পালিয়ে যায়,নিজ পরিবারের কথা দু’বার ভাবে না সে মেয়েকে পুত্রবধূ করে আমার বাসায় নিলে দেখা যাবে সংসারে শান্তি না এসে অ’শান্তিতে ভরে যাবে। ভাগ্য ভালো বলতে হয় আমার। শুরু হবার আগেই ইতি টানতে পেরেছি।

শুভ্রতার বাবা মাথা নিচু করে কথাগুলো শুনলেন। আপাতত কোনো কিছু বলার মুখ তার নেই। মনে মনে শুভ্রতার প্রতি তৈরি হলো রাগ, অভিমান, জমলো বরফের মত কোমল হৃদয়, যেখানে এতদিনের তোলে রাখা শুভ্রতার প্রতি অগাধ বিশ্বাস, ভালোবাসা।

সাদিফ চৌধুরী কথা না বাড়িয়ে বেরিয়ে আসলেন। স্পন্দনের বন্ধুদের ইশারায় বুঝলেন স্পন্দনকে নিয়ে আসতে। ছেলেকে এইভাবে বসে থাকতে দেখে বড্ড কষ্ট হচ্ছে উনার। বাবা মায়েরা ছেলে মেয়েদের কষ্ট এক বিন্দুও সহ্য করতে পারে না।

গ্রীষ্মের খরতাপে অতিষ্ট হয়ে মানুষ যখন ক্লান্ত প্রায় তখনই আবির্ভাব ঘটে বর্ষার। আষাঢ়ের প্রথম দিন আজ। পুষ্প-বৃক্ষে, পত্রপল্লবে, নতুন প্রাণের সঞ্চার করে নতুন সুরের বার্তা নিয়ে সবুজের সমারোহে এসেছে বর্ষা। মেঘের ভেলায় ভেসে প্রকৃতিতে ঘটেছে বর্ষার আগমন। তাই তো আকাশে মেঘের ঘনঘটা।

চারদিকে ছন্নছাড়া বৃষ্টির জল। ক্লান্ত মনে আনন্দের রেশ। মনের সাথে তালমিলিয়ে নূপুরের ছন্দের প্রেয়সীকে কাছে পাবার আশা আর বৃষ্টির রিমঝিম ছন্দের সঙ্গে শুরু হয়েছে আলাপন। বর্ষার সতেজ বাতাসে জুঁই, কামিনি, বেলি, রজনীগন্ধা, দোলনচাঁপা আরও কত ফুলের সুবাস ছড়িয়ে বেড়ায় শুভ্রতার বারান্দায়।

লেবু পাতার সুবাসে যেন অন্য আয়োজন থাকে। উপচে পড়া পদ্মপুকুর টইটুম্বুর রঙিন হয়ে ফোঁটে বর্ষাকে পাওয়ার জন্য। কেয়ার বনেও কেতকীর মাতামাতি চলে। শুভ্রতা তার কোমল দু’টো হাত জানালা দিয়ে বৃষ্টির জল স্পর্শ করতে ব্যাস্ত তখনই পিছন থেকে নেহা এসে বলল,

– যা বৃষ্টি শুরু হয়েছে আজ আর কলেজ যেতে হবে না।
শুভ্রতা ঠোঁটের মাঝে হাসি রেখে বলল,

– আব্বুর সাথে কথা হয়েছে তোর? জানিস বৃষ্টি আসলেই আমি যখন ভিজে কাকভেজা হয়ে জ্বর, সর্দি কাশিতে বিছানায় শুয়ে থাকতাম তখন আব্বু মাথায় জলপট্টি থেকে শুরু করে গরম চা সবকিছুই নিজের হাতে একা করতেন। আম্মুকে বলতো আমার মেয়েকে বকা দিবে না। ওর সেবা যত্নের জন্য আমি আছি।

কিন্তু আজ কতগুলো মাস ধরে আব্বু আমার সাথে কথা বলে না। আব্বুর অবহেলা সহ্য করতে না পেরে চলে আসলাম সিলেটে। রুম ভাড়া নিয়ে একা একা থাকতে শুরু করলাম। আমার একা থাকতে সমস্যা হবে সেজন্য তোকেও পাঠিয়ে দিল আমার কাছে। বাবারা বুঝি এমন হয়? রেগে থাকবে ঠিকই কিন্তু ভালোবাসার সামান্যতম অংশ কমবে না। ভুল করেছিলাম সেদিন ,বিয়ের আসর থেকে পালানো ঠিক হয়নি।

নেহা চুপচাপ শুনল শুভ্রতার কথা। সত্যি বলতে স্বান্তনা দেবার ভাষা খোঁজে পাচ্ছে না সে। সেদিন বিয়ের আসর থেকে পালানোর পাচঁ দিন পর শুভ্রতা বাসায় ফিরে। শুভ্রতার মা প্রথমে মেয়েকে বকাঝকা করলেও পরে অবশ্য ঠিক মেনে নেয় কিন্তু শুভ্রতার বাবা কিছুতেই স্পন্দনের বাবার কথাগুলো মন থেকে মুছতে পারে না সেকারণে উনি অনেক চেষ্টার পরেও শুভ্রতার সাথে আগের মত হতে পারলেন না।

শুভ্রতার ইন্টারমিডিয়েট রেজাল্ট দেওয়ার পর শুভ্রতা সিলেট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে অ্যাডমিশন নেয়। শুভ্রতার সাথে নেহাকেও সেখানে পাঠানো হয়। বর্তমানে শুভ্রতা ও নেহা ভাড়া বাসায় থাকে এবং তাদের সাথে মিষ্টি নামের একজন মেয়েও যোগ দিয়েছে।

– তোর থুতমাডা এরহম হুগাইয়া গ্যাছে কা?
মিষ্টির কথায় নেহা এবং শুভ্রতা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থেকে হেসে দিল। নেহা উত্তর দিলো,
– কই গেছিলি বৃষ্টির মধ্যে? ভিজে তো একেকার হয়ে গেছিস।
– এ্যাতো প্যাচাল পোডো কা আয়?

শুভ্রতা এখন কিছু বুঝতে না পেরে শান্ত গলায় বলল,
– বোন প্লিজ বাংলায় বল। তোর বরিশালের কথা বুঝতে বুঝতে অর্ধেক সময় ফুরিয়ে যায়। বাংলায় বললে মেল্লা খুশি হমু।
মিষ্টি জোরে জোরে হাসতে লাগল। হাসা বাদ দিয়ে বলল,

– আরেহ অনিক ফোন দিছিল সেজন্য বেড়িয়েছিলাম। তিশান স্যার নাকি দু’দিনের জন্য প্রাইভেট বন্ধ রেখেছে এ ব্যাপারে বলতেই এসেছিল।
নেহা গাল ফুলিয়ে জবাব দিল,
– ফোনে বললে কী হতো? ডেকে নেওয়ার মানে হয়।

মিষ্টি এবং শুভ্রতা হাসলো। অনিক যে নেহাকে পছন্দ করে সেটা তাদের কারোরই অজানা নয় কিন্তু নেহা যতদিন না পর্যন্ত অনিক নিজের ক্যারিয়ার না গড়বে ততদিন সে ‘ ভালোবাসি ‘ শব্দটি উচ্চারণ করবে না।

সারারাত বৃষ্টির পর সকালে তেজহীন সূর্য মামা বৃহৎ আকাশে উঁকি দিয়েছে। নরম রোদের সোনালী ছোঁয়া শুভ্রতার মুখে এসে পড়তেই ঘুমঘুম দু’টো চোখ জেগে উঠল। নেহা এবং মিষ্টি দুজনেই ঘুমিয়ে আছে এখনও। ছোট্ট নিঃশ্বাস ছেড়ে দেওয়াল ঘড়িটির দিকে তাকাতেই চোখ জোড়া চড়ক গাছ হয়ে উঠল।

চট জলদি নেহা এবং মিষ্টিকে তাড়া দিয়ে ঘুম থেকে উঠিয়ে ফ্রেশ হয়ে চলল কলেজের উদ্দেশ্য। ক্যান্টিনে গিয়ে সকালের নাস্তা সেরে ক্লাসের ভিতরে চলে গেল। হাতে গোনা কয়েকজন স্টুডেন্ট। টিচাররা এসে বেশ কিছুক্ষণ লেকচার দিয়ে বিদায় নিচ্ছে। মিষ্টি ভ’য়ে তটস্থ কণ্ঠে বলল,

– শুভ্রু আমি আজ প্রেজেন্টেশনের ‘প’ পর্যন্ত পারি না। তিশান স্যার আজ আমায় খু’ন করে ফেলবে।
মিষ্টির কথা শোনে অনিক অবাক হলো। প্রেজেন্টেশন করার জন্য স্যার প্রত্যেক জনকে নিয়ে একটি একটি দল তৈরি করেছে। অনিক, শুভ্রতা, নেহা এবং মিষ্টি চারজন একদলে।
অনিক বলল,

– কি বলছিস তুই? শুরুতেই মান সম্মান ডুবিয়ে দিবি নাকি? আচ্ছা বাদ দে, শুরুটা ভালো মত করিস বাকি কাজ আমরা তিনজন সামলে নিবো। শুরুটা মনে আছে তো নাকি ভুলে গেছিস? Hello everyone. Before starting, let me introduce myself briefly……
অনিককে থামিয়ে দিয়ে মিষ্টি বলল,

– আমার মনে আছে কিন্তু স্যারকে দেখলে ভুলে যাবার একশো পার্সেন্ট চান্স আছে।
মিষ্টির কথায় বাকি তিনজন দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। মিষ্টির ভার্সিটি লাইফের প্রথম ক্রাশ তিশান স্যার তবে বিরাট এক ভুল করার জন্য স্যার তাকে ভ’য়ানক এক শা’স্তি দিয়েছিল সে থেকে স্যারকে মিষ্টি ভ’য়ানক রকমের ভ’য় পায়। স্যার সামনে আসলেই কণ্ঠস্বর থেকে একটি শব্দও বের হয় না।

কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে বসে আছে চারজন। চারদিকে লাল রঙের ফুল ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। অনিক গিটার হাতে নিতে সুরের মূর্ছনায় ডুব দিল।
আমার ধূলোবালি জমা বই
আমার বন্ধুরা সব কই
আমার ভাল্লাগেনা এই মিথ্যে শহর
রাতের আড়ালে রই।

সুরের ছন্দ হৃদয়ের গভীরের চিনচিন ব্যাথা শুরু করল। আর কিছু বছর পর বন্ধুমহল আলাদা হবার সময়। সংসার, চাকরি, পরিবারকে সময় দেওয়ার পর বন্ধুমহলে সময় দেওয়ার উপায় থাকবে না। বন্ধুমহলের ছন্দের তাল মিলিয়ে যাবে অন্ধকারে।

– এই অনিকের বাচ্চা স্যাড সুর বাজাচ্ছিস কেন? মনটা খারাপ হয়ে যাচ্ছে আমার।
মিষ্টির কথায় অনিক সুরের তাল বন্ধ করে নেহার দিকে তাকালো। নেহা অচেতন মনে কিছু নিয়ে ভাবছে। শুভ্রতা লক্ষ্য করে বলল,

– নেহা কী ভাবছিস?
নেহা তাকালো। থমথমে মুখ নিয়ে বলল,
– অনিক তুই মিউজিক নিয়ে ভাবতে পারিস। তাহলে তোর ক্যারিয়ার খুব তাড়াতাড়ি এগিয়ে যাবার সম্ভাবনা আছে।
– আচ্ছা দেখা যাক।

সেদিন তুমি প্রেম নিয়ে এসেছিলে পর্ব ২

অনিকের লাপাত্তা কথা শোনে তেলে বেগুনে জ্ব’লে উঠল নেহার মন। মাঠ থেকে উঠে উল্টো ঘুরে চলে যেতে নিলো তারই পিছনে হাঁটতে লাগলো শুভ্রতা। নেহাকে না থামালে বাসায় আজ একটা জিনিসও আস্ত থাকবে না। নেহার পিছু যেতে যেতে এক আ’গুন্তকের কণ্ঠ কুর্ণকুহুরে আসা মাত্রই থেমে গেল। পাশ ফিরে আ’গন্তকের মুখ দেখতে পেয়ে, আমতা আমতা সুরে বলল,
– স্পন্দন! উনি এখানে?

সেদিন তুমি প্রেম নিয়ে এসেছিলে পর্ব ৪