সেদিন তুমি প্রেম নিয়ে এসেছিলে পর্ব ৪

সেদিন তুমি প্রেম নিয়ে এসেছিলে পর্ব ৪
ফারজানা আফরোজ 

স্পন্দন নামটি শোনে থেমে গেল নেহা। শুভ্রতার দৃষ্টি যেদিকে তাকিয়ে আছে সেদিকে দৃষ্টি জোড়া নিক্ষেপ করে স্পন্দনকে দেখে ভড়কে গিয়ে শুভ্রতার পাশে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করল,

– উনি এখানে কেন এসেছেন?
– জানি না। আচ্ছা আমার জন্যই কি এসেছেন? উনাকে বিয়ে করলে আব্বুর অভিমান জমানো বরফ গলে যাবে?
নেহা আপাতত চুপ করে রইল। স্পন্দন এদিক সেদিক তাকিয়ে মুঠোফোন হাতে নিয়ে ফোন দিয়ে আবারও চোখজোড়া চারদিকে বুলিয়ে নিয়ে সামনে এগিয়ে গেল। মিষ্টি এবং অনিক সামনে এসে দাঁড়ালো। মিষ্টি জিজ্ঞাসা করল,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

– কি হয়েছে? হা করে ওই লোকটার দিকে তাকিয়ে আছিস কেন? প্রেমে ট্রেমে পড়ে যাসনি তো? দেখতে অবশ্য ভালো আছে।
শুভ্রতা বিরক্তি নিয়ে তাকালো মিষ্টির পানে। নেহা শুভ্রতাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
– এখন কি করবি শুভ্রু?
শুভ্রতা হতাশ হয়ে বলল,

– ভাগ্যের উপর ছেড়ে দেওয়া ছাড়া আর কোন উপায় নেই। দেখি কপালে কী আছে।
বর্ষা মৌসুমে আকাশে কালো মেঘের ভেলা কিঞ্চিৎ পরিমাণে দেখা যাওয়া মাত্রই বৃষ্টির তাণ্ডব শুরু হয়। অনেকক্ষণ ধরে বৃষ্টি শুরু হয়েছে শেষ হবার নাম গন্ধ নেই।

নেহা, মিষ্টি ও শুভ্রতা তিনজনই করুণ চোখে বৃষ্টি দেখছে আর দু’আ করছে কিছুক্ষণের জন্য বৃষ্টিটা থেমে যাক তা’নাহলে আজ না খেয়েই থাকতে হবে। ফ্রীজ না থাকায় কম বাজার কিনে এনে দুই থেকে তিনদিন পার করে দেয় কিন্তু আজ বৃষ্টির কারণে বাজার নেই বাসায়। শুভ্রতা পেটে ওড়না বেঁ’ধে বসে আছে। শুভ্রতার দেখাদেখি মিষ্টিও ওড়না বাঁ’ধলো কোমড়ে। নেহা মুখ ভেংচি কেটে উত্তর দিল,

– এভাবে বসে থাকলে ক্ষিধে পাবে না? মাত্র বিকেল এখনই এই অবস্থা তাহলে সারারাত থাকব কীভাবে? সকালে ক্যান্টিন থেকে দুটো রুটি খেয়েছিলাম এখন তো পেটে ইদুর দৌড়াদৌড়ি শুরু করে দিয়েছে।
নেহার কথায় ওড়না কোমড় থেকে সরিয়ে দাঁড়ালো শুভ্রতা। বাজারের ব্যাগ হাতে নিয়ে দরজার কাছে গিয়ে প্রশ্ন করল ,

– আসছিস না কেন? আমি একা বাজারে যাব না।
মিষ্টি মুখ কুঁচকে জবাব দিল,
– বৃষ্টির মধ্যে বাজারে যাব মানে? সবজির যে দাম সেজন্য ফ্রী’তে সর্দি কাশি নিয়ে বাসায় ফিরব নাকি?
শুভ্রতা বলল,
– কিছু হবে না। আমার পক্ষে না খেয়ে থাকা আর সম্ভম হচ্ছে না। যেতে না চাইলে না যা আমি রেস্টুরেন্ট থেকে খেয়ে আসব।

নেহা কথা বাড়ালো না। তিনটা ছাতা নিয়ে বের হলো তিনজন। বৃষ্টি কমেছে কিছুটা। সবজি মামাকে দুই কেজি আলুর দাম জিজ্ঞাসা করতেই দাম শোনে চমকে উঠল তিনজন। এইতো কদিন আগে দুই কেজি আলু ত্রিশ টাকা ছিল এখন ষাট টাকা। করুণ আতংক নিয়ে নেহা বলল,
– মামা, চল্লিশ টাকা দিবেন?

– হবে না মা। কিনেই আনছি পঞ্চাশ টাকা দিয়ে। আচ্ছা তোমরা পঞ্চাশ টাকা দিয়ে নিয়ে যাও। বাচ্চা মেয়েদের সাথে আর দামাদামি করলাম না। সত্তর টাকার নিচে আলু এখনও বেছি নাই। তোমরা বাচ্চা মানুষ তাই কিনা দামে দিয়া দিলাম।
সবজি মামার কথায় মিষ্টি ফিসফিসিয়ে বলল,
– একসের ডাহা মিছা কথা।

শুভ্রতা চোখ পাকিয়ে তাকালো মিষ্টির দিকে। নেহা নতুন শিম দেখে জিজ্ঞেস করল,
– মামা শিম কত কেজি?
– দুইশ ত্রিশ টাকা কেজি মা। তোমরা নিলে দুইশ দশ টাকা কেজি রাখমু।
শিমের দাম শোনে তিনজনের মুখ চুপছে গেল। নেহা অতি দ্রুত শিমের কাছ থেকে দূরে সরে ছোট্ট ফুলকপির দাম জিজ্ঞেস করতেই মামা বললেন,

– এইটার দাম আশি টাকা।
সবজি বাজার দামের আগুন। ফায়ার সার্ভিস দিয়েও এ আগুন নিভানোর উপায় নেই। তিনজন বেশ কয়েকটি দোকান ঘুরে অল্প সল্প বাজার নিয়ে মুরগির দোকানে গিয়ে দাঁড়ালো। এক কেজি মুরগির দাম জিজ্ঞাসা করতেই দোকানদার বলল,
– আফা একদম একশো আশি টাকা কেজি। এর কম হইবো না।

হাতে মাত্র দেড়শো টাকা এ কারণে মুরগির দোকান থেকে চলে আসল। ব্যাচেলর জীবন বড়ই কষ্টের জীবন। ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও পছন্দের জিনিস কিনে খাওয়া দুষ্কর। মন খারাপের ভান্ডারে যখন শত শত দুঃখ তখনই একজনের কণ্ঠে টনক নড়ে উঠল সবার।

– মুরগি না নিয়ে কোথাই যাচ্ছন?
তিশান স্যারকে দেখে মিষ্টি পিছনে গিয়ে লুকাল। শুভ্রতা এবং নেহা সালাম দিয়ে কথা ঘুরিয়ে বলল,
– স্যার, আমরা ব্যাচেলর মানুষ। বাসায় ফ্রীজ নেই মুরগি নিয়ে কোথায় রাখব সেজন্য নেইনি।
তিশান হাসলো। দোকানদারকে দু’কেজি মুরগির কথা বলে মিষ্টির দিকে তাকিয়ে বলল,

– লুকাচ্ছেন কেন? মুরগি উপহার হিসেবে দিচ্ছি খেয়ে রিভিউ দিবেন ওকে।
মিষ্টি বোকা হাসি দিল। তিশানের মুখের উপরে কথা সে বলতে পারবে না। নেহা ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করল,
– সরি স্যার। আমরা আপনার উপহার নিতে পারব না। আপনি কী দয়া দেখাচ্ছেন?

– দয়া হবে কেন? আপনারা আমার ছাত্রী। দেখলাম টাকা কম থাকাতে মুরগি নিতে পারছেন না তাছাড়া যা বাজার করেছেন একদিনের বেশি যাবে না তাই স্যার হয়ে নিজের বিবেক জাগ্রত হলো। ভার্সিটি টপ স্টুডেন্টের কষ্ট ভরা মুখটি সহ্য হচ্ছিলো না। তাছাড়া স্যার হিসেবে আমার দায়িত্ব আমার স্টুডেন্টের খেয়াল রাখা।

স্যারের লজিকের উপর নেহার লজিক বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। বাধ্য হয়েই মুরগি নিতে হলো।
– হঠাৎ এখানে কী করছিস তিশান?
স্পন্দনের প্রশ্নে তিশান তাকালো। শুভ্রতা স্পন্দনকে দেখে চমকে উঠল। নেহা বুঝতে পেরে বলল,
– স্যার এখন তাহলে আমরা আসি। সন্ধ্যা হয়ে যাবে।

– স্পন্দন উনার নাম আপনাদের নিউ ম্যাথ টিচার। আগামীকাল থেকে উনার ক্লাস পাবেন। স্পন্দন ওরা তোর ফাস্ট ইয়ারের টপ স্টুডেন্টের মাঝে তিনজন যদিও বা মিষ্টি নামের মেয়েটি বড্ড ফাঁকিবাজ।

স্পন্দন তিশানের কথায় সৌজন্য মূলক হাসি দিল। শুভ্রতা খেয়াল করল স্পন্দন তাকে দেখে কোনো রিয়েক্ট করছে না। মনে হচ্ছে যেন আজই প্রথম দেখা। সন্দেহ হলো শুভ্রতার। স্পন্দনের মনে কি তাহলে অন্যকিছু চলছে? কিন্তু প্রশ্ন করল না। সেও সৌজন্য মূলক হাসি ফিরিয়ে দিয়ে বিদায় নিলো। শুভ্রতারা চলে যাবার পরেই তিশান ভ্রু কুঁচকে বলল,

– ব্রো, ভালোই অভিনয় পারিস দেখছি। না হওয়া হবু বউকে মুরগি কিনে দেওয়ার কারণ কী? প্রেমে ট্রেমে পরে গেছিস নাকি? শাস্তির বিনিময়ে মুরগি।
স্পন্দন তিশানের পিঠে চা’পড় মেরে বলল,

– প্রেমে তো প্রথম দেখাতেই পড়েছিলাম বন্ধু কিন্তু মেয়েটা বুঝল না। সেদিন আমি আকাশসম প্রেম নিয়ে তার দরজায় দাঁড়িয়েছিলাম কিন্তু সে আমাকে উপেক্ষা করে দূরে সরিয়ে দিয়েছে। এখন দরজায় শাস্তি নিয়ে দাঁড়িয়েছি আর সে সেটা অতি যত্নে তুলে নিয়ে যাচ্ছে।
তিশান স্পন্দনের কথায় বাঁকা হাসলো। প্রশ্ন করল,

– পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে?
– সময় বলবে পরবর্তী প্ল্যান। আজকের পর থেকে মিস শুভ্রতার শান্তি আমি কেড়ে নিব। আমাকে ইগনোর করা, এই স্পন্দন চৌধুরীকে অপমান করার শাস্তি মিস শুভ্রতাকে পেতে হবে। স্পন্দন হাল ছাড়ার পাত্র নয়। বাই দা ওয়ে দোকানদার ভাই কী মুরগি ড্রেসিং করে দিয়েছে? আমি বারণ করে দিয়েছিলাম।

তিশান সশব্দে হাসতে হাসতে বলল,
– যেমনটা চেয়েছিস তেমনই হয়েছে। আজ ওরা তিনজন মুরগির পালক পরিষ্কার করবে। শাস্তিটা দারুণ মজার তবে মুরগির বদলে ছোট মাছের দরকার ছিল তাহলে শাস্তিটা আরো ব্যাটার হতো।
তিশানের কথায় আবারও হাসলো স্পন্দন। দুই বন্ধু মনের সুখে হাঁটতে লাগলো নিজস্ব গন্তব্যে।

গরম পানিতে মুরগি চুবিয়ে তিনজন পরিষ্কার করতে ব্যাস্ত। মিষ্টি রাগে গজগজ করতে করতে বলল,
– এ উপকার করল নাকি অপকার করল বুঝলাম না। চামড়া পরিষ্কার করতে করতে হাতের বেহাল দশা হয়ে যাচ্ছে। আগে জানলে এ মুরগি বাসায় নিয়ে ঢুকতাম না।

শুভ্রতা চুপচাপ কাজ করছে। তবে তার মন এখনও স্পন্দনের মাঝে। স্পন্দন কী প্রতিশোধ নিতে এসেছে? স্পন্দনের সাথে দেখাটা কাকতালীয় নাকি প্ল্যান। এ কথা শুভ্রতার মাথায় আসছে না। নেহা অতিষ্ঠ হয়ে একটানে মুরগির চামড়া ছিঁ’ড়ে বলল,

সেদিন তুমি প্রেম নিয়ে এসেছিলে পর্ব ৩

– ভেবেছিলাম চামড়া দিয়ে একদিন কাজে লাগাবো কিন্তু আমার পক্ষে আর সম্ভব হচ্ছে না। লাভের আশা করতে গিয়ে হাতের অবস্থা খারাপ করে ফেললাম। ফ্রী পাইলে যা হয় আরকি। জীবনেও আর ফ্রী জিনিস হাতে তুলব না।

সেদিন তুমি প্রেম নিয়ে এসেছিলে পর্ব ৫