সেদিন তুমি প্রেম নিয়ে এসেছিলে পর্ব ৫

সেদিন তুমি প্রেম নিয়ে এসেছিলে পর্ব ৫
ফারজানা আফরোজ 

অনিক গিটার হাতে নিয়ে টুং টাং শব্দ বাজালো। আজ যেন গিটার তার নিজস্ব সুর হারিয়ে ফেলেছে। শুভ্রতা এবং মিষ্টি অসহায় চোখে অনিকের দিকে তাকালো। অনিক মলিন হেসে বলল,

– মন খারাপ কেন তোদের? কী হয়েছে? নেহা, ভীষন রে’গে আছিস তাইতো?
নেহা ঠোঁট উল্টিয়ে বাচ্চাদের মত কাঁদতে লাগল। অনিক নেহাকে হালকা জড়িয়ে ধরে ভরাট কণ্ঠে বলল,
– এই বোকা মেয়ে কান্না করছিস কেন? আমি খারাপ কিছু বলেছি তোকে?
অভিমানী কণ্ঠে বলল নেহা,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

– তুই সিরিয়াস হচ্ছিস না কেন? আমরা ক্লাসমেট। দেখা যাবে তোর পড়াশোনা শেষ না হতেই আমার বিয়ে হয়ে যাবে। আমি তোকে ছাড়া বাঁ’চব না অনিক।
অনিক মুচকি হেসে বলল,

– তারমানে তুই আমাকে ভালোবাসিস সে কথা ডিরেক্টলি বলছিস?
– আমি তোকে ভালোবাসি একবারও বলেছি? আমার ভালোবাসা সস্তা না।
নেহার গাল ফুলানো দেখে আবারও মুচকি হাসলো অনিক। নেহার হাতের আগুলে স্পর্শ করে গিটারে সুর তুলল,
প্রেমে পড়া বারণ
কারণে অকারণ,

আঙুলে আঙুল রাখলেও হাত ধরা বারণ।
– শোন নেহু, আমি একটা ইউটিউব চ্যানেল খুলেছি। আজকাল ঘরে বসেই টাকা ইনকাম করা যায় তাছাড়া কয়েকজন বড় ভাইদের সাথে কথা হয়েছে যারা বিভিন্ন ব্যান্ড সংগীত পরিচালনা করেন ওনারা আমার গান খুব পছন্দ করেছেন। আশা করি খুব দ্রুত নিজের আলাদা প্লাটফর্মে নিজস্ব নামডাক হবে। কয়েকটা দিন অপেক্ষা করতে পারবি না?
নেহা অনিককে জড়িয়ে ধরে বলল,

– তোর জন্য কয়েকটা দিন কী সারাজীবন অপেক্ষা করতে পারব কিন্তু প্লিজ তুই আবার সেলিব্রেটি হয়ে আমায় ভুলে যাস না। সেলিব্রেটি হলে শত শত সুন্দরী মেয়ে তোর আশেপাশে থাকবে তখন এই নেহার দিকে ভুলেও তাকাতে ইচ্ছে করবে না।

অনিক গরম চোখে তাকালো। নেহা ঠোঁট চেপে হাসি দিল। শুভ্রতা ও মিষ্টি এতক্ষণ দুজনের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। এ’দুজনের অভিমান ক্ষণিকের জন্য। অনিক জাদু করে নেহার মন ভালো করে দেয়। নেহার জীবনে অনিক এসেছে ম্যাজিশিয়ান
হয়ে।

শুভ্রতা স্পন্দনকে দেখে চুপটি মেরে বসে রইল। স্পন্দন ক্লাস শেষ করে শুভ্রতাকে দেখে না দেখার ভান করে শুভ্রতার পায়ে আ’ঘাত করতেই শুভ্রতা শব্দ করে উঠল।

– আই ডিডেন্ট সী ইউ। পা সামনে বাড়িয়ে রেখেছেন কেন? নেক্সট টাইম এ’ধরনের ভুল করবেন না। ইডিয়েট।
শুভ্রতা স্পন্দনের কথায় তাজ্জব বনে গেল। ইচ্ছাকৃত ব্যা’থা দিয়ে আবার ধ’মক দেওয়া হয়েছে তাকে। হুট করেই মা’থা গরম হয়ে গেল। রা’গের বশে স্পন্দনের পিছু নিয়ে বলতে লাগল,

– সমস্যা কী আপনার? আমার সাথে পায়ে পড়ে কথা বলতে আসছেন কেন? আগে জানতাম চরিত্র’হীন এখন তো দেখছি ভীষন অ’সভ্য। আমি আপনার নামে কলেজ কর্তৃপক্ষের কাছে নালিশ জানাবো।

স্পন্দন চারদিকে চোখ বুলিয়ে কাউকে দেখতে না পেয়ে শুভ্রতার হাতে হেচকা টান দিয়ে খোলা ক্লাসরুমে নিয়ে গেল। শুভ্রতা হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করছে কিন্তু সফল হতে পারেনি। স্পন্দন একটি হাতে শুভ্রতার চুলগুলো মুখের সামনে থেকে সরিয়ে বলল,

– আমার নামে বিচার দিবেন? তাহলে আমি আপনার পুরো পরিবারের নামে মান’হানির মা’মলা করব। সোসাইটিতে আমার সম্মানে আ’ঘাত করার জন্য আপনাকে এবং আপনার পরিবারকে তিন মাসের জেল কাটিতে ছাড়ব। করব মামলা?
– আমিও মামলা করব আপনার নামে। নারী নি’র্যাতন মামলার নাম শুনেছেন? একবার জেলে যান চৌদ্দ বছরের আগে ছাড়া নেই।
স্পন্দন হাসলো। শুভ্রতার মুখের কাছে মুখ এনে বলল,

– সব সময় চোখের দেখাটা সত্য হয়না মিস শুভ্রতা। একজন মেয়ের হাতে চু’মু দেওয়া মানেই ওই মেয়ে আমার গার্লফ্রেন্ড তা কিন্তু নয়। হতে পারে না সে আমার বোন? বোন, মা, কন্যা তিনজনের প্রতি ভালোবাসা একরকম আর স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসা ভিন্ন রকম। দুটোই আলাদা ফিলিংস।

সেদিন যে মেয়েটিকে দেখেছিলেন সে আমার একমাত্র চাচাতো বোন। চাচাতো বোন থাকা সত্ত্বেও তাকে আমি আমার আপন ছোট বোন হিসেবে দেখি। তাছাড়া মুনি সুস্থ নয় তাই আমি কিংবা আমার পরিবার সবার আগে মুনির ইচ্ছেকে প্রাধান্য দিয়ে আসছি তার কারণ ওর মনে সামান্যতম আ’ঘাত যেন না আসে। কিন্তু সেদিন আপনার ব্যাবহার আমার অবুঝ বোনের মনে বিশাল আ’ঘাত দিয়ে ফেলেছে।

স্পন্দন কথাগুলো বলে অদ্ভুদ চোখে তাকালো শুভ্রতার পানে। শুভ্রতা অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। নিজের ভুলের জন্য দোষারোপ করছে মনকে। শুভ্রতার ভাবনা চিন্তার মাঝে স্পন্দন অ’নৈতিক একটি কাজ করে ফেলল। শুভ্রতার গালে হঠাৎ করেই চু’মু দিয়ে ফিসফিস করে বললো,

– শা’স্তি পাওয়ার জন্য তৈরি তো ম্যাডাম? আজকে জাস্ট হালকার উপরে ছেড়ে দিলাম কিন্তু ভবিষ্যতে ছাড়ব কিনা সন্দেহ। সকলের চোখে আমি টিচার কিন্তু আপনার চোখে আমি অ’সভ্য। অ’সভ্য, চরিত্র’হীন উপাধি যেহেতু পেয়েই গেছি তাহলে অ’সভ্য হতে সমস্যা কী। শাস্তিটা দারুণ না? আরেকটা চাই?

শুভ্রতা ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে বিস্মিত হলো। কিছুক্ষণ আগের মুহূর্ত ভাবতেই শরীর কেঁ’পে উঠল। মাথার উপরে সবকিছু চলে যাওয়াতে বাচ্চাদের মত হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। স্পন্দন বোকা বনে গেল। তড়িৎ গতিতে শুভ্রতার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,

– এই এই কান্না করছেন কেন? আজব মেয়ে তো দেখছি। ওকে যান আমার চু’মু আমি ফিরিয়ে নিচ্ছি। আমার গালে চুমু দিয়ে আমার চুমু আমাকে ফিরিয়ে দেন দেখবেন সব আগের মতো হয়ে গেছে।
স্পন্দনের কথার বেড়াজালে শুভ্রতা স্পন্দনের গালে ঠুস করে একটা চুমু খেয়ে ফেলল। স্পন্দন চোখজোড়া একবার বন্ধ করে আবারও তাকালো। শুভ্রতা তখন কান্না মিশ্রিত কণ্ঠে বলল,

– আমি আপনার চুমু ফিরিয়ে দিয়েছি। আর আমার চুমু…..
কথাগুলো বলেই হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরল। এতক্ষণে বুঝল সে কী কাজটা করেছে। রাগে কষ্টে লজ্জায় স্পন্দনকে ধাক্কা দিয়ে দৌঁড়ে পালালো ক্লাস রুম থেকে। স্পন্দন কিঞ্চিৎ সরে গিয়ে মৃদু হাসলো।
– বোকা মেয়ে, বারবার কেন যে আমার পাতানো ফাঁ’দে পা দিয়ে ফেলো। বয়স বেড়ে যাচ্ছে কিন্তু বোকামি স্বভাব যায়নি। আই লাইক ইট।

গোধূলি বিকেলের সোনালী আভা চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। কিছুক্ষণ পরেই সন্ধ্যা নেমে আসবে। বিকালের শেষ প্রান্তে স্পন্দন এক কাপ কফি নিয়ে তিশানকে ডেকে বলল,

– শুভ্রতা কখন প্রাইভেটে আসবে?
– আজ আসবে না। দু’দিন অফ রেখেছি। আগামীকাল বিকাল পাঁচটায় আসবে ওরা চারজন।
– প্রাইভেট পড়াস সপ্তাহে তিনদিন সেখানে আবার দু’দিন অফ রাখতে হয়। প্রতিটি সময়ের মূল্য নেই?
তিশান সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে মজার ছলে বলল,

– মিস করছিস শুভ্রতাকে? চাইলে তোকে একটা হেল্প করতে পারি।
স্পন্দন প্রশ্নসুচক দৃষ্টিতে তাকাল। তিশান সিগারেট ফেলে দিয়ে আরমছে বসে বলতে লাগল,
– আমি ফিন্যান্স পড়াচ্ছি তুই ওদের ম্যাথ পড়ানো স্টার্ট কর। ব্যাবস্থা আমি করে দিচ্ছি।
স্পন্দন নাক মুখ কুঁচকে বলল,

– অসম্ভব। আমার পক্ষে প্রাইভেট পড়ানো সম্ভব নয়। এক্সট্রা ঝা’মেলা।
– প্রাইভেট কী তোকে সবাইকে পড়াতে বলছি জাস্ট চারজন। কজ শুভ্রতা তার সঙ্গীদের ছাড়া একা প্রাইভেটে আসবে না। তুইও পরিকল্পনা মূলক প্রতি’শোধ নিতে পারবি।

স্পন্দনের তিশানের কথাগুলো পছন্দ হলো। ছয়টা থেকে সাতটা পর্যন্ত পুরো ষাট মিনিট শুভ্রতা স্পন্দনের সামনে থাকবে। মিনিটে মিনিটে শা’স্তি ভাবতেই স্পন্দনের আদলে খুশির জলক ফোটে উঠল।

রাত এগারোটা, শুভ্রতা বারান্দায় বসে আছে নিরালায়। আকাশে গোলাকার চাঁদ, মেঘের ভেলা মাঝে মধ্যে চাঁদকে ঢেকে দিচ্ছে। শুভ্রতা বেশ কিছুক্ষন চাঁদ দেখল। আজকে চাঁদের মাঝে তারা বেশি নেই। কলেজের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা বারবার চোখের সামনে রিপিট হচ্ছে। লজ্জায় শুভ্রতা চোখ ফিরাচ্ছে বারংবার।

স্পন্দনের সামনে দাঁড়ানোর ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। তবে স্পন্দনের সাথে অন্যায় করার জন্য মন থেকে প্রচুর গিল্টি ফিল হচ্ছে তার। না জেনে শোনে স্পন্দনকে থাপ্পড় মা’রাটা অন্যায় হয়েছে, পবিত্র সম্পর্কে অসম্মান করার জন্য নিজেকে বারবার দোষারোপ করছে।

– ইশ অনেক বড় ভুল করেছি। আগামীকাল সরি বলে দিবো। আচ্ছা সরি বললেই কি সমস্যায় সমাধান হয়ে যাবে? আমি কীভাবে ওনার সামনে দাড়াব? আমার প্রত্যেকটি কাজই তো অন্যায়। থাপ্পড় মেরে অন্যায় করেছি, বিয়ের আসর থেকে পালিয়ে গিয়ে বিশাল অন্যায় করেছি এমনকি আজকের ঘটনায় তো মারাত্মক আকারে অন্যায় করেছি।

সেদিন তুমি প্রেম নিয়ে এসেছিলে পর্ব ৪

এতগুলো অন্যায় নিয়ে কীভাবে ওনার সামনে দাঁড়াব? ভাবতে পারছি না। অতীত কেন বারবার পিছু নিচ্ছে আমার? অতীত ভুলতে চাই। অন্যায় করা অতীত ভুলে যাওয়াই আমার জন্য শ্রেয়।

সেদিন তুমি প্রেম নিয়ে এসেছিলে পর্ব ৬