সেদিন তুমি প্রেম নিয়ে এসেছিলে পর্ব ৭

সেদিন তুমি প্রেম নিয়ে এসেছিলে পর্ব ৭
ফারজানা আফরোজ 

বরিশালের লঞ্চে উইঠা
লইবো কেবিন রুম
বন্ধুরে মোর বু’কে লইয়া
দিব একটা ঘুম
ঠাইসা দিব একটা ঘুম।
মিষ্টির গান শোনে অনিক ধ”মক দিয়ে বলল,

– তুই আসলেই একটা অ’সভ্য মহিলা। কীসব অ’শ্লীল গান গাচ্ছিস ছি, ভুলে গেছিস কেবিনে একজন প্রাপ্ত বয়স্ক ছেলে রয়েছে। লজ্জা করছে না অ’শ্লীল গান গাইতে?
মিষ্টি অনিকের কথায় গুরত্ব না দিয়ে মুখ ভেংচি কেটে বলল,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

– হিংসা হচ্ছে তাই না ? প্রেয়সীর সাথে এক কেবিনে যাচ্ছিস কিন্তু হাগ কিংবা রোমান্স করতে পারছিস না সেকারণে বড্ড হিংসা হচ্ছে। নিজের ক্ষো’ভ আমাকে দেখাচ্ছিস কেন? তোকে আমি চুল পরিমাণ ভ’য় পাই না। তাছাড়া আমার মুখ, আমার কণ্ঠ, আমার সুর যা ইচ্ছে গাইবো তোর কী? নিজে তো প্রেমিক হওয়া সত্ত্বেও ছ্যাকা মার্কা গান গেয়ে আমাদের মুড নষ্ট করে দিস।
অনিক দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

– তুই আসলেই অ’সভ্য ম্যাক্স প্রো মহিলা। তোকে ইচ্ছে করছে টুপ করে ধ’রে বুড়িগঙ্গা নদীতে ফে’লে দিতে। আবর্জনার সাথে আরেকটা আবর্জনা পরিষ্কার হয়ে যাবে।
মিষ্টি অনিকের কথা শোনে অনিকের চু’ল ধরে টানতে লাগল। অনিক ব্যা’থায় কঁ’কিয়ে উঠল। নেহা রাগী গলায় বলল,

– মিষ্টির বাচ্চা, ছাড় বলছি, ও ব্যা’থা পাচ্ছে।
মিষ্টি নেহার কথায় পাত্তা না দিয়ে মা’রতে লাগলো। শুভ্রতা এবং নেহা মিষ্টিকে ছাড়িয়ে আনতেই অনিক ক্রন্দন মিশ্রিত কণ্ঠে বলল,

– সরি মা আমায় ক্ষমা। তুই সুশীল, ভদ্র মেয়ে তোকে বাজে কথা বলা আমার একদম উচিত হয়নি।
মিষ্টি শান্ত হয়ে ভাব নিয়ে বলল,
– কথা বুঝে শোনে বলবি আজকের পর থেকে বুঝেছিস বেদ্দপ পুরুষ।

শুভ্রতা এবং নেহা অসহায় চোখে একজন আরেকজনকে দেখে দম নিলো। মিষ্টির রা’গ হলে সে এমনই করে। একদিন অনিকের হাতে কা’মড় দিয়ে ফেলেছিল তারপর বেচারা পাঁচদিন ব্যাপী জ্বরে ভুগছিল। এ কারণেই অনিক মিষ্টির রাগকে ভ’য় পায়। নামের মতই মিষ্টি সে কিন্তু রাগ উঠলে বি’ষাক্ত হয়ে যায়।

– শুভ্রু, আমার জন্য আলাদা কেবিন নেওয়া যেত না? তোরা তিনজন যুবতী মেয়ের সাথে আমি অসহায় এক ছেলে এক কেবিনে থাকবো কীভাবে? আমার ভীষন রুচিতে বাঁধছে।
শুভ্রতা ভ্রু নাচিয়ে বলল,

– আলাদা কেবিন কেন দরকার? এক কেবিনে থাকলে সমস্যা কোথায়? ছেলে মেয়ে দুজন থাকলে না হয় বলতাম সমস্যা কিন্তু এখানে আমরা চারজন। তাছাড়া আমাদের বন্ধুত্ত্ব নিয়ে আমার বিশ্বাস আছে। আচ্ছা তোর যেহেতু খারাপ লাগছে তাহলে চল আজ রাত লঞ্চের ছাদে সবাই মিলে কাটিয়ে দেই। আড্ডা, গানে মজে উঠুক পূর্ণিমা তিথি।

শুভ্রতার কথা অনিকের পছন্দ হলো। কেবিনের দরজা অফ করে চারজন লঞ্চের ছাদের উদ্দেশ্য হাঁটা দিল। কোলাহলময় পরিবেশ চারপাশে লোকজন,মৃদুমন্দ বাতাসে খোলা আকাশের নিচে লঞ্চের ছাদে দাঁড়ানো একদল তরুণ তরুণী। বয়স্ক মানুষ নেই বললেই চলে। পাঁচ জোড়া কাপল, বন্ধু নিয়ে ঘুরতে আসা কয়েকজন এ নিয়েই ছাদ পরিপূর্ণ।

নদীর ঢেউ খেলা জলরাশির ওপর দাঁড়িয়ে আছে গোটা একটি শহর, দেখে মনে হবে পানিতে ভাসছে শহরটি। সে সাথে ভাসছে কপোত-কপোতীদের মনের হৃদয়ের ছোট্ট প্রেমের শহরটি। প্রেয়সীর হাতে হাত রেখে বাঁচতে চাওয়ার এক অনিবার্য ইচ্ছে, আলোয় জলমোল লঞ্চটি ভেসে বেড়াচ্ছে পানির উপর। ঢেউয়ের তালে তাল মিলিয়ে চলে জাহাজ।

আকাশে গোলাকার চাঁদ যেন মুচকি হাসছে, হাসির মাধ্যমে নিজের সৌন্দর্যকে দ্বিগুণ বাড়িয়ে প্রেম নিবেদন করছে প্রেমিক প্রেমিকার হৃদয়ে গভীরে। অনিক চাঁদের দিকে এক পলক তাকিয়ে নেহার দিকে তাকিয়ে স্পষ্ট গলায় বলল,

– আকাশের চাঁদের সৌন্দর্য আমাকে মুগ্ধ করতে পারেনা নেহু। তোর হাসির রেখা আমাকে আকাশসম মুগ্ধ করে।
লজ্জায় রাঙা হয়ে আসলো নেহার আদল। অনিক গিটারে সুর তুলল সে সাথে নেহাও তাল মিলিয়ে যুগলবন্দি হয়ে গাইতে লাগল,

চাঁদের সাথে আমি দেবো না তোমার তুলনা
নদীর সাথে আমি দেবো না তোমার তুলনা
তুমি চাঁদ হতে যদি দূরেই চলে যেতে
তুমি নদী হতে যদি দূরেই চলে যেতে…

শুভ্রতা মুগ্ধ হয়ে চাঁদ দেখছিল মিষ্টি পানির পিপাসা পেয়েছে বলে কেবিনের উদ্দেশ্য হাঁটা দিল। শুভ্রতা মুগ্ধ চোখে আপনমনে হাঁটছে। আচমকা ওড়নায় টান পড়াতে থেমে গিয়ে পিছন ফিরে তাকাতেই স্পন্দনকে দেখে ভয়ে ঢোক গিলে বলল,
– আপনি এখানে?
– আপনি যেখানেই থাকবেন সেখানে তো আমাকে যেতেই হবে ম্যাডাম। ম্যাডামের কী প্রেম প্রেম ভাব পাচ্ছে? মন কী প্রেমে পড়তে চাচ্ছে?
শুভ্রতা লাজুক চোখে তাকিয়ে দেখে মাথা নিচু করে বলল,

– একদমই না।
– চোখ মনের কথা বলে।
– আমাকে শা’স্তি দেওয়ার জন্য এসেছেন?
– হুম শা’স্তি দেওয়ার জন্য এসেছি কিন্তু ভ’য়ানক শা’স্তি নয়, প্রেমের শা’স্তি দেওয়ার জন্য এসেছি।
শুভ্রতা চমকে উঠল। অদ্ভুদ চোখে তাকালো সে। স্পন্দন মায়াবী চোখের প্রেয়সীকে দেখে ঠোঁট জোড়া চেপে ধরে চোখ বন্ধ করে রইল। দীর্ঘ সময় পর চোখ দুটো মেলে শুভ্রতাকে উদ্দেশ্য করে বলল,

– প্রেমিকের হৃদয় খু’ন করার জন্য প্রেয়সীর চোখের চাহনীই যথেষ্ট। ধা’রালো অ’স্ত্র বরাবরই ব্যর্থ হবে প্রেমিকের মনে আ’ঘাত করতে।

শুভ্রতা শুনল। হঠাৎ মনে হল মনের ভীতরে লুকিয়ে থাকা প্রেম পাখিটা ডানা মেলে ঝাপটা ঝাপটি করছে। শুভ্রতার মন বলল, শুভ্রু তুই প্রেমে পড়েছিস। মা’রাত্মক প্রেম রোগে আ’হত হয়েছিস। স্পন্দন ছেলেটা তোকে প্রেম রোগে আক্রান্ত করেছে। সহসা মন আবার বলে উঠল, শুভ্রু ভুল করছিস স্পন্দন তোকে ফাঁ’সাতে চাচ্ছে।

প্রেম রোগে আক্রান্ত করে তোকে আ’ঘাত করার জন্য প্ল্যান করেছে ভুলেও সে ফাঁ’দে পা দিস না। তোর অ’ন্যায়ের শা’স্তি তোকে ছ’লনার মাধ্যমে দেওয়ার চেষ্টা করছে। শুভ্রতা মনের দু’কথাকেই পাত্তা দিল। হঠাৎ বলার মত কথা শব্দ ভান্ডার থেকে ফুরিয়ে গিয়েছে। প্রেম পাখিটা বিড়বিড় করে বলছে, ছ’লনা হোক আর যাই হোক প্রেম কিন্তু এসে গেছে। বর্ষার ঋতু প্রেম নিয়ে এসেছে তোর দরজায়। সেদিন প্রেমিকের প্রেম নিবেদন ফিরিয়ে দিয়েছিলি। এ ভুল আর করিস নে।

– কী ভাবছেন?
ছলাৎ ছলাৎ করে উঠল শুভ্রতার মন। চাঁদের আলোয় মুগ্ধ হয়ে ভাবছিল স্পন্দনের কথা। হঠাৎ প্রেম কেন তার মনে ধরা দিলো। সে তো ভালোবাসেনি স্পন্দনকে তাহলে আজ বেপরোয়া এ মন স্পন্দনের ভালোবাসার জন্য আকুতি মিনতি কেন করছে। সবই কী নিয়তির খেলা? শুভ্রতা বুঝল না।

– আমাকে ফলো কেন করছেন? আপনাকে প্রত্যাখ্যান করার শা’স্তি দিচ্ছেন?
স্পন্দন মুচকি হাসলো। শুভ্রতা সেই হাসিতে কাবু হয়ে পড়ল। মনকে ধমক দিয়ে বুঝালো, মেয়েদের বেপরোয়া হতে নেই।
স্পন্দন বলল,

– আইসক্রিম খাবেন? দেখলাম লঞ্চে পাওয়া যাচ্ছে।
শুভ্রতা বারণ করতে গিয়েও পারল না। স্পন্দনের ডাকে সাড়া দিয়ে চলল আইসক্রিমের উদ্দেশ্য। তিশান সবকিছু এতক্ষণ পর্যবেক্ষণ করে মিটিমিটি হাসতে লাগল। মনে মনে বলল,

– দোস্ত পাঠিয়ে দিয়েছিস। এতক্ষণে তোর কথার প্যাচ বুঝলাম। ‘আ’ঘাতে নয় ভালোবাসায় শা’স্তি দিবো’
স্পন্দনের বলা বাক্যটি বিড়বিড় করল তিশান। স্পন্দন বুঝতে পেরেছিল শুভ্রতা তার প্রতি ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পড়েছে । এ সুযোগটাই বেছে নিলো স্পন্দন।

তিশান স্যারকে লঞ্চে দেখতে পেয়ে অবাক হলো মিষ্টি। স্যারের মিটিমিটি হাসি দেখে স’ন্দেহজনক তাকালো। কিন্তু ভ’য়ে টু শব্দটি উচ্চারণ করল না। তিশানের চোখ ফাঁকি দিয়ে চলল ছাদের উদ্দেশ্য। তিশান মিষ্টিকে দেখতে পেয়ে না দেখান ভান করে মিষ্টির পিছনে হাঁটতে লাগলো, সহসা কেঁশে উঠল। মিষ্টি পিছনে স্যারকে দেখতে পেয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। ক্যাবলাকান্তের মত দাঁড়িয়ে থেকে আমতা আমতা করে বলল,

– বিসমিল্লাহির রহমানির রাহিম স্যার।
তিশান মিষ্টির কথা শোনে হা করে তাকিয়ে থেকে বলল,
– মানে?
মিষ্টি ভীত কণ্ঠে বলল,

– সালাম দিয়েছি স্যার।
– বিসমিল্লাহির রহমানির রাহিম এটা সালাম?
মিষ্টি হুসে এসে জিভে কা’মড় দিয়ে বলল,

– সরি স্যার, আসসালামু আলাইকুম। আপনাকে দেখে দু’আ পড়ছিলাম তো ভুল করে সালামের বদলে বলে ফেলেছি।
– আমাকে ভয় পাওয়ার কারণ? সেদিন জড়িয়ে ধরেছিলাম সেজন্য? আমার হবু বউকে আমি জড়িয়ে ধরব নাকি ধরব না সেটা একান্ত আমার ব্যাপার। তাই নয় কী?

মিষ্টি তটস্থ হয়ে যায়। তিশানের গ্রামের বাড়ি বরিশাল। পাশাপাশি এলাকা। পারিবারিক সম্মতিতেই তাদের আকদ সম্পন্ন হয়। তিশান চেয়েছিল মিষ্টির অনার্স কমপ্লিট হবার পর বিয়েটা হোক, সবকিছু ভালোই চলছিল কিন্তু বিপত্তি ঘটে অনিককে নিয়ে।

মিষ্টিকে অনিকের সাথে দেখতে পেয়ে তিশান রে’গে যায় এবং ভ’য়ানক শা’স্তি স্বরূপ দীর্ঘ পাঁচ মিনিট মিষ্টিকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে, এবং ধমক দিয়ে বলেছিল, পরেরবার ভুল করলে লোকজনের সামনে কিস করে দিবে সেই ভ’য়ে মিষ্টি তিশানকে ভীষন ভ’য় পায়। তিশানের ব্যাপারে ফ্রেন্ডের না বলার কারণ সারপ্রাইজ। বিয়ের দিন চমকে দিবে সে সবাইকে। কিন্তু আজ মনে অন্য কথা চলছে মিষ্টির, মা বলেছে সারপ্রাইজ দিবে এখন আবার তিশান বাড়ি যাচ্ছে। দুটোর মাঝে যোগ সূত্র আছে কোনো? ভেবে পাচ্ছে না মিষ্টি।

– এই মহারানী কী ভাবছেন?
তিশানের ডাকে সজ্ঞানে ফিরে আসলো মিষ্টি। তিশান মিষ্টির একদম নিকটে দাঁড়িয়ে বলল,
– ভালোবাসি।
মিষ্টির হৃদকম্পন দ্রুত গতিতে উঠানামা করতে লাগলো। লাজুক মুখটি ফ্লোরে স্থির রেখে বলল,

সেদিন তুমি প্রেম নিয়ে এসেছিলে পর্ব ৬

– বাড়িতে কেন যাচ্ছি আমরা?
তিশান হেসে বলল,
– সারপ্রাইজ।

সেদিন তুমি প্রেম নিয়ে এসেছিলে পর্ব ৮