সে আমার সুকেশিনী পর্ব ৮

সে আমার সুকেশিনী পর্ব ৮
রাউফুন

বিউটি তড়িঘড়ি করে রিকশা থেকে নামলো। বিনুনি টা সামনে নিয়ে রেস্ট্রন্টের ভেতরে প্রবেশ করলো। পুরো রেস্ট্রন্টে একটা কাকপক্ষীও নেই। এক কোণায় একটা মাঝ বয়সী মহিলা বসে আছে। একদম শুকনো একজন পৌঢ়া,পরনে তার জর্জেট শিফনের শাড়ী। যেহেতু এখানে আর কেউ-ই নেই সে ধরে নিলো এটাই মিনহাজের বোন। বিউটি সালাম দিলো। বসার অনুমতি নিয়ে বসতে বসতে বললো,

‘দুঃখিত আমার একটু দেরি হয়ে গেলো। আপনি মিনহাজের স্যারের বোন রাইট? অনেক বেশি অপেক্ষা করালাম না তো? কখন এসেছেন?’
‘এতো ব্যস্ত হতে হবে না বোন! বেশি দেরি হয়নি! মাত্র দশ মিনিট অপেক্ষা করতে হয়েছে।’
‘রেস্ট্রন্টে আর কেউই নেই আপনি ছাড়া, এমন টা কেন?’

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

‘আমার পাগল ভাই, সে পুরো রেস্ট্রন্ট ফাঁকা করে দিয়েছে তুমি আসবে বলে।’
বিউটি বেশ অবাক হলো। শুধু মাত্র সে আসবে বলে মিনহাজ এই পুরো রেস্ট্রন্ট ফাঁকা করেছে।
‘আশ্চর্য, তাই বলে পুরো রেস্ট্রন্ট ফাঁকা করতে হবে।কোথায় উনি? মাথায় গন্ডগোল আছে নির্ঘাত!’

টেবিলে অনেক রকম খাবার সাজানো। রাহেলা খাবার খেতে বললে বিউটি কোল্ড কফির কাপে চুমুক দিলো। রাহেলা বিউটির কথা বলার ধরনে চমৎকার করে হাসলো। কোথায় উনি এই কথাতে কেমন একটা শাসনের সুর পেলো রাহেলা। মেয়েটা দারুন তো! দেখতেও বেশ! কি দারুন কন্ঠঃস্বর। মেয়েটির বয়স কত হবে? ইশ শোনা হয়নি মিনহাজের থেকে। কিন্তু এইভাবে সামনাসামনি কারোর বয়স জিজ্ঞেস করাটা অশোভনীয়।

‘মিনহাজ নেই এখন। একটু পর আসবে। তোমার পুরো নাম কি?’ প্রশ্ন করলো রাহেলা।
‘আমার নামের আগে পরে কিছুই নেই। শুধু মাত্র বিউটি। আপনিও বিউটি ডাকবেন।’
‘তোমার পরিবারে কে কে আছেন?’
‘বাবা-মা, ভাই-ভাবি, আমি!’
‘বাবা মার নাম কি?’

বিউটির কেমন যেনো লাগলো এই পর্যায়ে এসে। হঠাৎ এতো প্রশ্ন কেন করছেন মিনহাজ স্যারের বোন সে বুঝলো না। তবুও সে উত্তর দিলো। একজন প্রশ্ন করতেই পারে।
‘আব্বুর নাম হাশেম আলী, আম্মুর নাম শাহানা বেগম! ভাই লিপন, ভাবি সন্দিপ্তা!’

রাহেলার কেন যেনো গা শিউরে উঠলো। সে বিউটির হাত ধরলো। হাতে কিছু একটা খুঁজে পেতে চেষ্টা করলো। ডান হাতে না পেয়ে বাম হাতে খুঁজলো। বাম হাতের কনুইয়ের দিকে জন্মদাগ দেখতেই ঘাবড়ে গেলো সে। বিউটি পুরোটা সময় আশ্চর্যজনক ভাবে তাকে দেখে যাচ্ছিলো। আকস্মিক ভাবে রাহেলার এহেন কান্ডের কারণ কি কিছু বলতেও পারছিলো না। এমন ব্যবহারের মানে সে বুঝলো না। রাহেলা ঢকঢক করে পানি খেয়ে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করলো।
বিউটি তখনো অবাক পানে তাকিয়ে ছিলো রাহেলার দিকে। বললো,’আপনি হঠাৎই আমার বার্থ সাইন দেখলেন কেন? আমাকে কি কোনো ভাবে চেনেন?’

‘না না চিনি না। হঠাৎই তোমার হাতে কালো দাগ দেখে পোঁড়া দাগের মতো লাগলো। তাই একটু চিন্তিত হয়েই দেখে ফেলেছি!’
বিউটির মোটেই এই অজুহাত পছন্দ হয়নি। সে জানে না রাহেলার এমন কাণ্ডের মানে কি! তবুও সে নিজেকে ধাতস্থ করে বললো,

‘আপনি ঠিক আছেন ম্যাম? আপনার কি এমন কিছু মনে পরেছে যার জন্য এমন হাইপার হয়ে গেলেন? শরীর খারাপ লাগছে? মিনহাজ স্যারকে ডাকবো?’
রাহেলা সম্বিৎ ফিরে পেলো। নিজেকে সম্পুর্ন ভাবে সামলে উঠতে সময় লাগলো তার। সে ধীরে সুস্থে বললো, ‘তোমার গ্রামের নাম কি?’

বিউটি কিঞ্চিৎ অবাকই হলো। তাকে নিয়ে এতো আগ্রহের মানে সে বুঝলো না। আর সে যে গ্রামেই ছিলো সেটাই বা কিভাবে জানলো? আর তার বার্থ সাইন কেন খুঁজে বের করে দেখলো। বিউটি গ্রামের নাম বললো। এসি রুমেও রাহেলা ঘামতে শুরু করলো।

‘ম্যাম আর ইয়্যু ওকে? আপনি কি আমাকে আগে কখনো দেখেছেন?’
‘নাহ, নাহ দেখিনি। আর দয়া করে আমাকে ম্যাম বলবে না। আপু বলো বা মিনহাজের মতো বুবু বলো প্লিজ।’
বিউটি কিছু বললো না। তবে একটা ক্ষীন সন্দেহ থেকেই জিজ্ঞেস করলো,’স্যারের কেমন বোন আপনি?’
ততক্ষণে রাহেলা নিজেকে সামলে উঠেছিলো। মিষ্টি হেসে বললো,’আমি তোমার স্যারের নিজের কেউ-ই না। আমি তার বাড়ির পরিচারিকা, এক্সিডেন্টলি মিনহাজের সঙ্গে পরিচয় আমার! কিন্তু মিনহাজ আমাকে নিজের বোনের মতোই ভালোবাসে। কখনোই বুঝতে দেইনি আমি তার রক্তের সম্পর্কের কেউ না।’

বিউটি মনে মনে মুগ্ধ হলো মিনহাজের প্রতি! সে কিছু মনে পরেছে সেভাবে বললো, ‘ওওহো আপু, আপনার নাম জিজ্ঞেস করা হয়নি। কি নাম আপনার?’
‘রাহেলা। রাহেলা বানু! আমার বৃদ্ধ স্বামী নওশের হোশেইন আর দুটো ছেলে আছে, একজনের নাম সুমন্ত, আর একজনের নাম নিহাত। স্বামীকে বৃদ্ধ বললাম কারণ, উনার বয়স আমার থেকে পঁচিশ বছর বেশি।’
‘এতো বছর বয়সী মানুষকে বিয়ে করলেন?’ যারপরনাই অবাক হলো বিউটি!

রাহেলা হাসলো। হেসে বললো, ‘আমার বিয়ে হয়েছে চব্বিশ বছর বয়সে। কিন্তু সে আমায় বিয়ের আগে বলেছিলো সে মনের মতো মানুষ পায়নি বলে এতো বয়স হয়ে যাওয়ার পরেও বিয়ে করেননি। উনি বলেছিলেন, আমাকে প্রথম দেখাই পছন্দ করে ফেলেছেন তাই বিয়ে করতে চান। আমি পাত্তা দিইনি। কিন্তু উনার চোখে আমি কখনোই খারাপ কিছু দেখিনি। আমিও অসহায় ছিলাম সেসময়। তখন অনেক গুলো বিয়েও ভেঙে গেছিলো।

তাছাড়াও আশ্রিত হয়ে আর কতদিন থাকা যায়। তখনকার সময় একটা মেয়ের জন্য চব্বিশ বছর অনেক বয়স৷ তাই নিজের স্থায়ী একটা ঠিকানা পেতে বিয়ে করতে রাজি হলাম নওশেরকে। তাছাড়া নানান জনের নানান কুটুক্তি এসব বন্ধ করা প্রয়োজন ছিলো। এক মাত্র বিয়ে করলেই তার থেকে পরিত্রাণ পেতাম। মিনহাজের বাসায় যখন আসি তখন আমার কুড়ি বছর। ওর বাসায় চার বছর থেকেছি।

এর মধ্যে অনেক কথা শুনেছি অনেক জনের। মানুষ অনেক বাজে কথা বলতো মিনহাজ আর আমাকে জড়িয়ে। বিয়ে করলে সেসব থেকে মুক্তি পাবো ভেবেই বিয়ে করে নিলাম নওশেরকে। কিন্তু বিয়ের এক বছরেও তিনি আমাকে তার ঘরে নিয়ে যান নি। মিনহাজ আমার কথাতেই বিয়েতে রাজি হয়ে যায় খোঁজ না নিয়ে। মানুষ হিসেবে নওশের ভালো ভেবেই আর আমার মুখের দিকে তাকিয়ে কখনোই কিছু বলেনি।

কিন্তু আমার প্রথম বাচ্চা হওয়ার পর জানলাম তাঁর প্রথম স্ত্রী ছিলো। তিঁনি মা’রা গেছেন ব্রেস্ট ক্যান্সার হয়ে। তার ঘরে তিনটি সন্তান আছে। স্ত্রী মা’রা যাওয়ার পাঁচ বছর পর আমাকে বিয়ে করেছেন নওশের। বিয়ের পর বাচ্চা হওয়ার এক বছরের মাথায় আমি যখন জানতে পারলাম আমার স্বামী নওশের আগেও বিয়ে করেছিলো তখন যে কি অবস্থা হয়েছিলো আমার! যাক গে সেসব কথা বাদ দাও।’

বিউটি তখন অস্বাভাবিক ভাবে কাঁপছিলো। রাহেলার কথা শুনতে তার অনেক কষ্ট হচ্ছিলো। সে বললো, ‘আপনার হাসবেন্ড এর আগের সন্তানদের নাম জানেন?’
‘ হ্যাঁ, দুলাল, সায়র আর আঁখি!’
একদিকে বিউটির যেমন রাহেলার সরলতা পছন্দ হলো অন্য দিকে তার যে সন্দেহ ছিলো তা সত্যি হলো। সেদিন সে মারিয়ামের মুখে সায়রের বাবার নাম নওশের হোশেইন জানতে পেরেছিলো। সেই থেকেই নিজের ভাবনাকে সত্যি করতেই বাকিদের নাম জানতে চাইলো। বিউটি বললো,

‘আপনি জানেন, সায়র হোশেইন এর সঙ্গে আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে?’
রাহেলা যেনো আকাশ থেকে পরলো। একদিকে সৎ ছেলে আর একদিকে মিনহাজ। মিনহাজ, যে তাকে প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবাসে, বিশ্বাস করে। কিভাবে সে এই বিয়েটা ভাঙবে। একদিনের পরিচয় বোধহয় এতো কিছু জানা শোনা টা উচিত হয়নি। এভাবে সম্পর্কে বদলে যাবে সে কি জানতো? এতো কিছু সে কি করে সামলাবে! রাহেলাকে চুপ করে থাকতে দেখে বিউটি বললো, ‘ক্ষমা করবেন আপু, আসলে কি কথা বলতে আমাকে ডেকেছেন তা এখনো ক্লিয়ার হয়নি। আপনার আর আমার মাত্র একদিনের পরিচয়ে এতো কিছু বলে দিলেন? আমার কেন যেনো মনে হচ্ছে আপনি আমাকে আরও আগে থেকেই চেনেন!’

‘আসলে আমি তোমাকে যে কারণে ডেকেছি। কিভাবে বলবো ভেবে পাচ্ছি না।’
‘সমস্যা নেই আপু বলুন!’
‘তুমি কি এই বিয়েতে খুশি?’
এরকম একটা প্রশ্নের বিউটি কি উত্তর দেবে ভেবে পেলো না৷ তবুও বললো, ‘আমার আব্বু আম্মু বিয়েটা ঠিক করেছেন ঠিকই কিন্তু বিয়েটা আমি করতে চাই না। ইভেন শুধু সায়রকে কেন আমি কাউকেই বিয়ে করতে রাজি না। কিন্তু আপনি এতো কিছু জিজ্ঞেস করছেন কেন?’

রাহেলা মনে মনে খুব খুশি হলো। যাক বিউটি এই বিয়েতে রাজি না। মিনহাজকে নিয়ে ভাবার সে ছাড়া আর কেউই নেই। তাই সে মিনহাজের কথা ভাববে। যার নুন খেয়েছে তার গুণ তো গাইতেই হবে। তাই রাহেলা কোনো ভনিতা না করেই বললো,

‘আসলে মিনহাজ তোমাকে পছন্দ করে। কিন্তু তোমার বিয়ে ঠিক হয়ে যাওয়ার পর সেটা কিভাবে কনফেস করবে বুঝতে পারছিলো না। তাই আমাকে বিষয় টা জানালে আমিই জোর করলাম ওঁকে তোমার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেওয়ার জন্য! তুমি কি না কি ভাববে সেসবও বলছিলো মিনহাজ। তুমি প্লিজ ওকে নিচুস্তরের মানুষ ভেবো না। আসলে জেদ টা আমিই করেছিলাম! মিনহাজ এই বিষয়ে বারণ করেছিলো। তুমি যদি বলো আমি যাবো তোমার বাসায় তোমার আর মিনহাজের বিয়ের কথা বলতে।’

বিউটির এহেন অবস্থায় কি রকম রিয়াকশন করা উচিত সে বুঝতে পারলো না। তার কি এখন উঠে চলে যাওয়া উচিত? না না তাহলে বেয়াদবি হয়ে যাবে। সে কিছু বলে উঠতে চাইলো কিন্তু পারলো না৷ মূর্তির মতো বসে রইলো একভাবে। মিনহাজ স্যার তাকে পছন্দ করে? অবিশ্বাস্য! অবশ্য সে একটু আধটু আন্দাজ করতো তবে সরাসরি বিয়ে অব্দি ভাবাটা একটু বেশিই হয়ে গেলো না?

রাহেলা বুঝলো বিউটি অপ্রস্তুত হয়ে গেছে। তাই সে বিউটির মাথায় স্নেহের হাত বুলিয়ে বললো, ‘তুমি সময় নাও বোন। স্বামী হিসেবে আমার ভাই মিনহাজ কিন্তু খারাপ হবে না। ওর মতো একজন মানুষ পা-ওয়া ভাগ্যের ব্যাপার।’
দীর্ঘ আলাপের পর রাহেলা চলে গেলো। বিউটির চোখ দিয়ে পানি পরছে। কেন সে জানে না৷ সুপ্রিয়র কথা মনে পরছে তার। আর মাত্র দশদিন বাকি আছে তার জন্মদিনের। বিউটি রেস্ট্রন্ট থেকে বের হলো।

মিনহাজকে এখন দেখা গেলো বাইরে। গাড়ি করে যাচ্ছে রাহেলা। বিউটির মনে হলো তার সমস্ত শরীর কাঁপছে। এমন ভাবে কাঁপছে যে সে হেলেদুলে হাঁটলো। কোনো রকমে বেরিয়ে রিকশার জন্য দাঁড়িয়ে পরলো। মিনহাজ তাকে সম্পুর্ন ভাবে অবলোকন করছিলো। না চাইতেও বিউটির পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। আশ্চর্যজনক ভাবে সে এই মুহুর্তে কথার খেই হাঁরিয়ে বসেছে। দারুন অস্বস্তির মধ্যেও সে অনুভব করলো তার গলা শুকিয়ে গেছে।

পানি খাওয়ার প্রয়োজন অনুভব করলো তীব্র ভাবে। রাহেলাকে চলে যেতে বলে বিউটিকে এক নজর দেখতেই সে দাঁড়িয়ে ছিলো। শখের নারীকে দেখার জন্য এতোটাই আকৃষ্ট, এতোটা তৃষ্ণার্থ ছিলো তার চোখ জোড়া যে লাজ লজ্জা ভুলে রাহেলাকে বলেই বসে, ‘বিউটিকে এক নজর দেখেই আসছি!’

সে আমার সুকেশিনী পর্ব ৭

রাহেলা কিভাবে যেনো হাসছিলো তার কথা শুনে। তার ভীষণ লজ্জা করছিলো তখন। বিউটির আশেপাশের কোনো দিকে খেয়াল নেই। একটা রিকশাও আসছে না। এদিকে তার মনে হচ্ছে সে পড়ে যাবে শরীর বল ছেড়েছে। সে শরীর ছেড়ে দিয়ে পড়তে নিলে না চাইতেও মিনহাজ তাকে ধরে ফেললো অত্যন্ত সাবধানে। বিউটি চোখ তুলে তাকালো। বললো, ‘সুপ্রিয় ভাই,আমার কপালে হাত রেখে দেখুন তো আমার কি জ্বর এসেছে?’

সে আমার সুকেশিনী পর্ব ৯