সে আমার সুকেশিনী পর্ব ৯

সে আমার সুকেশিনী পর্ব ৯
রাউফুন

‘সুপ্রিয় ভাই,আমার কপালে হাত রেখে দেখুন তো আমার কি জ্বর এসেছে?’
মিনহাজ অবাক হলো। সুপ্রিয়? বিউটির চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। সে আবারও বললো,’কি হলো সুপ্রিয় ভাই, দেখুন না। আশ্চর্য বার বার বলতে হয়?’

মিনহাজ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো। বুকের ভেতরে চিনচিন ব্যথা করছে তার। কেন এই ব্যথা তক্ষুনি ধরতে না পারলেও পরে বুঝলো। মিনহাজ বিউটিকে সোজা করে ধরলো। এখন সে হাত সরিয়ে নিয়েছে। জ্বর দেখার জন্য কপালে হাত রাখতে যেয়েও হাত ফিরিয়ে নিলো। কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে বিউটি তার হাত ধরে নিজের কপালে চেপে ধরলো।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

‘এবার বলুন জ্বর এসেছে না? এখানে আসার আগে থেকেই বুঝতে পারছিলাম জ্বর আসবে বুঝলেন। আর আমার একবার জ্বর করলে সাত দিন বিছানা ছেড়ে উঠতে পারি না। ভীষণ উইক হয়ে পরি। জ্বরের সময় টা একটা ঘোরের মধ্যেই থাকে।’
‘আপনি চলুন গাড়িতে। আপনার শরীর ভীষণ খারাপ৷ হঠাৎই এতো জ্বর বাঁধালেন কিভাবে?’
‘সুপ্রিয় ভাই, আপনি আমাকে তুই সম্বোধন করেন ভুলে গেছেন? এক্ষুনি তুই বলুন!’

মিনহাজ ভীষণ বিপাকে পরলো, এভাবে কিভাবে তুই বলবে সে? তার অন্য গাড়িটা পার্কিং প্লেসে। এখানে থেকে যেতে নিলে দশ মিনিট লাগবে। কিন্তু এভাবে একটা যুবতী মেয়েকে ধরে রাখাও উচিত না। মেয়েটা তো দূর্বলতায় হেলে পড়েছে তার উপর। লোকে তাকিয়ে আছে তাদের দিকে। দেখলে দেখুক তাতে সে বিন্দুমাত্রও ভ্রুক্ষেপ করলো না।

‘সুপ্রিয় ভাই, আমাকে কোলে করে গাড়ি পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারবেন তো? আমার ওজন বেশি না। এই ধরুন এইটি নাইন পাউন্ডস! আমার ভীষণ পানি পিঁপাসা পেয়েছে। আমাকে একটু পানি দিবেন?একদম ঠান্ডা পানি আনবেন। একেবারে শেষ করতে পারি যেনো। সেজন্য ছোট বোতল আনতে হবে। বড়টা আনলে পারবো না শেষ করতে। তখন আমার এঁটো আপনাকে খেতে হবে। কারণ পানি নষ্ট করা ঠিক না। আশ্চর্য, আমার শরীর কুলাচ্ছে না কেন? আমাকে ধরে রাখুন তো!’
‘তবে এতো কথা বলবেন না। চলুন আমি গাড়ি অব্দি আপনাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছি।’

‘আবার আপনি বলছেন সুপ্রিয় ভাই? আমার কথা না শুনলে আমি কি করি জানেন তো? ছোট বেলার কথা মনে আছে? একবার আপনার কাছে আম গাছ থেকে আম পেরে চেয়েছিলাম। অনেক বলার পরেও আপনি আমার কথা শুনেন নি সেজন্য আপনার হাতে জোরে কামড়ে দিয়েছিলাম। শরীরের চামড়া কতটা বাজে ভাবে ছিড়ে দিয়েছিলাম, ইশ! আপনার হাত থেকে কি বিশ্রি ভাবে রক্ত ঝড়ছিলো। পরে অনেক কষ্ট হয়েছিলো আমার জানেন?’

‘এখনো কথা বলে যাচ্ছেন? আর দাঁড়িয়ে থাকা যাবে না। আপনি দুলছেন কেমন দেখুন!’
‘কি আশ্চর্য, সুপ্রিয় ভাই আপনি আমার কথা আজও শুনছেন না। দিবো কামড়ে দিবো?’
বলতে না বলতেই বিউটি মিনহাজের হাত ধরে লোমশহীন, শক্ত পোক্ত হাতে দাঁত বসিয়ে দিলো। হতবিহ্বল মিনহাজ কোনো রকম আওয়াজ করতে ভুলে বিউটির দিকে তাকিয়ে রইলো। বিউটি হাসছে তার সঙ্গে সঙ্গে তার পুরো শরীর দুলছে। তার দাঁতে কি রক্ত লেগেছে? বিউটি হাসতে হাসতেই বললো,

‘সুপ্রিয় ভাই, এবারে বলুন তুই! তুইইইইইই! বলুন! আমার মনে হচ্ছে আমি সেই ছোট্ট বেলায় ফিরে গেছি। আর আমি না পানি খেতে চাইলাম। আপনি এখনো দাঁড়িয়ে থাকবেন? জানেন না তৃষ্ণার্থকে পানি পান করাতে হয়, পানি চাওয়া মাত্র তাকে হাতের কাছে পানি এগিয়ে দিতে হয়! এক্ষুনি পানি আনুন।
‘তোকে রেখে যেতে পারছি কই পানি আনতে? আচ্ছা আজকে এতো কথা বলছিস কেন!’

মিনহাজ নিজের রক্তাক্ত হাতের দিকে তাকালো।বিউটির দেওয়া প্রথম স্পর্শ। ব্যথায় টনটন করছে। তার মনে হচ্ছে তার হাতে সাপে কেটেছে। বিষ দাঁত বসানোই এতো ব্যথার উপদ্রব হচ্ছে। এটা বিউটির দেওয়া প্রথম স্পর্শ সেটা যেমন হোক। তাই যখন বিউটি তার হাতকে কা’ম’ড়ে ধরলো ব্যথা সহ্য করেও একদম নিশ্চুপ ছিলো। তাছাড়া আঘাত টা আকস্মিক ছিলো। সে কল্পনাও করেনি বিউটি এমন কিছু করতে পারে।

অসুস্থ মানুষের কথা শুনতে হয়। তাহলে তাদের মধ্যে একটা খুশির সঞ্চালন হয়। ভালো লাগে তাদের। তারা মনে করে এতে তাদেরকে অনেক বেশি প্রায়োরিটি দেওয়া হচ্ছে। তারা যেমন চাই তেমন ব্যবহার করলে খুশি হয়ে যায়৷ সেজন্য মিনহাজ বিউটির কথা মেনে নিয়ে বিউটিকে তুই সম্বোধন করলো।

‘আমি যেনো অজ্ঞান না হয়ে যায় সেজন্য এতো কথা বলছি সুপ্রিয় ভাই! অজ্ঞান না হয়ে যাওয়ার অনেক কলা কৌশল থাকে। এই যেমন ধরুন অনর্গল কথা বলতে থাকা, পানি খাওয়া, এবং কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে বড় বড় করে নিঃশ্বাস নেওয়া! এতে ব্রেইনে অক্সিজেন সাপ্লাই হবে, আর আমাকে সজ্ঞান রাখবে। ব্রেইন সজাগ থাকলে আমার অজ্ঞান হওয়ার সম্ভাবনা কমে যাবে। চলুন যাওয়া যাক।’

‘একা যেতে পারবেন?’
‘আবার আপনি?’
‘আচ্ছা স্যরি, চল যায়। একা যেতে পারবি? আমি কি ধরবো?’
‘আরে অনুমতি নেওয়ার কি আছে? জানেন আপনি আমার কল্পনায় কতবার আমাকে কোলে নিয়েছেন? নিন, আমাকে কোলে নিন!’

বিউটির জোরাজুরিতে মিনহাজকে না চাইতেও কোলে তুলে নিতে হলো। মিনহাজের প্রচন্ড অস্থির লাগছে। অস্বস্তিতে সারা শরীর বিমুঢ় হয়ে আসছে। তার থেকে পরিত্রাণ পেতে সে দ্রুত পা চালালো। বিউটিকে গাড়িতে বসিয়ে দিলো। গাড়ির কাছে যেতে যেতে বিউটি তাকে সুপ্রিয় ভাই বলে অনেক কিছু বলেছে। মিনহজ অনুভব করলো তার হৃদ যন্ত্রে আবার চিনচিন ব্যথা করছে।

মিনহাজ পানি এনে বিউটির সামনে ধরতে সে নিয়ে নিলো। অনেকটা পানি খেয়ে বোতল টা রেখে দিলো। মিনহাজ গাড়ি চালানো শুরু করলো।
‘কোথায় যাচ্ছেন সুপ্রিয় ভাই?’
‘তোকে হসপিটাল নিয়ে যাচ্ছি। এরকম জ্বর কি প্রায়ই হয়?’

বিউটি চোখ বন্ধ করেই উত্তর দিলো, ‘ হ্যাঁ! অতিরক্তি গভীরে চিন্তা করলে আমার জ্বর এসে যায়। আপনাকে নিয়ে আজকে অনেক বেশি টেনশনে ছিলাম। একেবারে গভীরে চিন্তায় মগ্ন। সুপ্রিয় ভাই, আমি জানি আপনি আমার কল্পনায় এসেছেন। কিন্তু মনে হচ্ছে আপনাকে আমি বাস্তবে অনুভব করছি। আমাকে সোজা বাড়ি নিয়ে চলুন। আমি বাড়ি যাবো!’
‘তোর অনেক জ্বর, হসপিটাল নিতেই হবে!’

‘আচ্ছা, কল্পনায় কি গাড়িতেও বসা যায়? কি আশ্চর্য এমন হচ্ছে কেন? আমি আগে কল্পনা করেছি আপনি আমাকে সাইকেলে চরিয়েছেন। এবারে সোজা গাড়িতে বাহ কি উন্নত কল্পনা! মারিয়াম কি বলে জানেন? বলে আমি নাকি পা’গ’ল হয়ে গেছি। আপনি কখনোই আসবেন না আমার কাছে। কিন্তু মারিয়ামের ধারণাকে মিথ্যা প্রমাণ করে দিবো। আপনি আসবেন তাই না সুপ্রিয় ভাই?’

মিনহাজ কোনো কথা বললো না। চোখের কোণে পানি জমেছে। সে আড়ালে চোখ মুছে নিলো। বিউটি যেনো দেখতে পেলো। বললো, ‘আপনি কি কাঁদছেন নাকি? এর আগে কল্পনায় কখনোই আপনাকে কাঁদতে দেখিনি।’
‘চুপ করে বসে থাক!’ বললো মিনহাজ
বিউটি চোখ বন্ধ করে ফেলেছে। মিনহাজ দ্রুত হসপিটালের উদ্দেশ্য রওনা দিলো। মারিয়ামের ছাড়া আর কারোর নাম্বার তার কাছে নেই। তাই তাকে কল করে হসপিটালের ঠিকানা দিয়ে চলে আসতে বললো।

বিউটি যখন চোখ মেলে চাইলো তখন দেখলো তার সামনে তার মা-ভাবি বসে আছে। বিউটি চোখ এদিক সেদিক ঘুরিয়ে সবকিছু অবলোকন করলো। সে বুঝলো তাকে হসপিটাল আনা হয়েছে। শাহানা বেগম চোখের পানি ফেলছেন। বিউটি উঠে বসতে চাইলো। মাথাটা ঝিমিয়ে আসছে। সে মাথা চেপে ধরলো।
‘কি করছিস তুই? শরীরে এক ফোটাও শক্তি নেই কিন্তু উঠার তাড়া দেখছি অনেক!’

‘আম্মু, তুমি কাঁদছো কেন? এই সামান্য জ্বরে কেউ হসপিটালে আনে? আমি এখানে থাকবো না। বাড়ি যাবো।’
‘তোর কথা কে শুনছে শুনি? শুনুন মা, আপনি ওকে আমার জন্য ছেড়ে দিন। একটা কথাও শুনবে না। তাকে আবার এতো আদর। তার জন্য কেন কাঁদছেন মা?’ সন্দিপ্তার গম্ভীর গলায় বিউটি হেসে ফেললো শব্দ করে। বললো, ‘ভাবি এতো সিরিয়াস টাইপ কথা বলছো কেন? এমন ভাবে কথা বলছো যেনো আমি মা’রা যাচ্ছি।’

‘একটা থাপ্পড়ে সব গুলো দাঁত ফেলে দিবো। মায়ের মুখের সামনে এসব কি কথা? জানিস একটা মায়ের কেমন লাগে সন্তানের মুখে এমন ধরনের কথা শোনে?’ শাহানা বেগম হুহু করে কেঁদে দিলেন। লিপন ফলের ব্যাগ হাতে ভেতরে ঢুকলো। মারিয়ামও পিছু পিছু আসছে।
‘কি রে এভাবে জ্বর বাঁধিয়ে রাখলে হবে? এবারে অফিস কামাই করলে স্যার কিন্তু মাইনে কা’ট’বেন।’
বললো মারিয়াম।

লিপন এগিয়ে এসে সন্দিপ্তার হাতে ফলের ব্যাগ দিয়ে বললো, ‘আমার বোনের জন্য এক্ষুনি কে’টে দাও। ওঁকে দ্রুত সুস্থ হতে হবে। দেখেছো কেমন ফ্যাকাসে লাগছে একদিনেই।’
‘ভাইয়া, তুমিও দেখছি আমার অনেক যত্ন করছো। কি ব্যাপার বলো তো? সবাই এতো আদর যত্ন করলে কি মনে হয় জানো? মনে হয়, আমি মৃ’ত্যু পথ যাত্রী আর তোমরা আমার শেষ ইচ্ছে পূরণ করছো। আশ্চর্য!’
লিপন ঠাস করে চড় বসিয়ে দিলো বিউটির গালে।
তার চোখ লাল ভীষণ।

‘এমন বিশ্রি কথা কেন বলছিস? নিজের অবস্থা দেখেছিস? জ্বরে কাহিল অবস্থা কিন্তু উল্টাপাল্টা কথা বলা বন্ধ করছিস না। ভাইয়া কি তোকে ভালোবাসে না?’
শাহানা বেগম ডুকরে উঠলেন মেয়ের এমন লাগামহীন কথায়। হাশেম আলী হসপিটালের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছেন। বিউটির চোখে পানি চিকচিক করছে। এতো কষ্ট কেন হচ্ছে তার? সে নিজেকে সামলে বাবাকে না দেখতে পেয়ে বললো, ‘আব্বু আসে নি? আব্বু কোথায়? অবশ্য না এসে থাকলে সেটা ভালোই করেছে। আব্বুর শরীর কিন্তু ভালো না।’

সবার মুখে আসল হাসি নেই। কেমন মুখে জোর করে হাসি টেনে আছে। এমন মিথ্যা হাসির অভিনয়ের কারণ বিউটি আচ করতে পারলো না। ‘আচ্ছা ওঁরা কি বুঝতে পারছে না আমি ওঁদের অভিনয় ধরে ফেলেছি!’
বিউটি খেয়াল করলো দরজা থেকে একটা ছাঁয়া সরে যাচ্ছে। বিউটি হাসলো। কারণ সে জানে সে কে। তাই একটু জোরেই ডাকলো, ‘আব্বু এমন লুকিয়ে আছো কেন? তুমি এসেছো আর আমার সামনে আসছো না এটা কেমন কথা? আর তোমরা সবাই বাইরে যাও তো। আমি আব্বুর সঙ্গে কথা বলবো। বাবা মেয়ের মাঝে তৃতীয় জন এলাউ না। আম্মু তুমিও না।’

সবাই ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে দেখছে তাকে। মারিয়াম মুখে হাত চেঁপে ধরে কাঁন্না আটকাচ্ছে। সবার মুখের অবস্থা কেমন করুণ। হাশেম আলী আর যেতে পারেন নি। মেয়ে তাকে দেখে ফেলেছে। তিনি ভেতরে এলেন। সবাই বাইরে চলে গেলো। বাবা মেয়েকে একটু স্পেস দিলো। তাছাড়া বাবার সঙ্গে কথা বলার সময় বিউটি আর কাউকে এলাউ করে না। সব সময়ই এমন করে সে।

‘আমাকে হসপিটাল কে এনেছে আব্বু?’
‘তোমার অফিসের বস। উনি ভীষণ ভালো একজন মানুষ। সারারাত ঘুমোন নি তিনি। তুমি পুরো একদিন অজ্ঞান ছিলে। আর সায়র এসেছে। তোমাকে একবার দেখবে। কথা বলতে চাইছে!’
‘আমার এখন তুমি ব্যতীত আর কারোর সঙ্গে কথা বলতে ভালো লাগছে না আব্বু।’

সে আমার সুকেশিনী পর্ব ৮

হাশেম আলীর চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। কন্ঠ কেমন ভার ভার লাগছে।মেয়ের মুখের দিকে তাকাতে পারছেন না তিঁনি। বিউটি বললো,’আব্বু আমার দিকে তাকাচ্ছো না কেন?তোমরা কি লুকাচ্ছো আমার থেকে?এমন জ্বর তো আমার আগেও হয়েছে। কই তখন তো তোমাদের এমন দেখাইনি। কি হয়েছে বলো তো?ডক্টর কি বলেছে? আমার ভয়ানক কিছু হয়েছে নাকি?

সে আমার সুকেশিনী পর্ব ১০