সে আমার সুকেশিনী পর্ব ১০

সে আমার সুকেশিনী পর্ব ১০
রাউফুন

‘আপনার ভয়ানক কিছুই হয়নি। ডক্টর শুধু আশংকা করেছিলো আপনার ঘনঘন জ্বর হওয়ার কারণ টা কি আসলে খারাপ কিছু থেকে নয়তো? এই যে রিপোর্টে সব কিছু নরমাল। ডক্টর জানালেন আপনি কোনো বিষয়ে দীর্ঘদিন যাবৎ ভাবেন, অনেক সময় ওভার থিংকিং আরও নানান কারণ আছে। আপনার ব্লাডে সামান্য ইনফেকশন আছে সেটা দ্রুত সেরে যাবে ঠিক ঠাক মতো মেডিসিনস নিলে। মনে রাখবেন মেডিসিন কিন্তু বাদ দেওয়া যাবে না।’

কথা গুলো বলতে বলতে সায়র ভেতরে প্রবেশ করলো। হাশেম আলী যেনো মেয়ের প্রশ্নের হাত থেকে হাফ ছেড়ে বাঁচলেন। বিউটি কথাটা বিশ্বাস করতে পারলো না। উপরন্তুর সে চড়া গলায় বললো, ‘আপনি পার্মিশান ছাড়া কেন এসেছেন এখানে?দেখছেন না আমি আব্বুর সঙ্গে কথা বলছি? আমি আব্বুর সঙ্গে কথা বললে কেউই থাকে না। কেউ থাকুক এটা আমার পছন্দের বাইরে।’

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

‘আমার হবু স্ত্রী অসুস্থ তাকে দেখতে আসবো না? সেই কখন থেকে আসার জন্য ছটফট করছিলাম, সুযোগ পাচ্ছিলামই না। এদিকে আমার দম বেরিয়ে যাবার উপক্রম আর বলছেন আসবো না। মানা যায়?এখন এভাবে রিপোর্টস গুলো নিয়ে আসলাম। বলতে পারেন বড় সড় অজুহাত। আসার সময় বাইরে থেকে শুনলাম আপনি আংকেলকে জেড়া করছেন। তাই উনার হয়ে আমিই উত্তর দিলাম।’

হাশেম আলী খানিক বিষম খেলেন। তিনি সুড়সুড় করে বেরিয়ে গেলেন। যতোই হোক হবু জামাতা আর মেয়ের সামনে বসে থাকা যায় না। বিউটি কটমট করে তাকালে সায়র ক্যাবলামো করে হাসলো। ফিচেল গলায় বললো, ‘দেখুন, আপনি অসুস্থ তবুও কি বিরাগ! আপনি আমার জায়গায় থাকলে কি করতেন? আমি অসুস্থ হলে কি আপনি যেতেন না দেখতে?’
বিউটি সায়রের কথার পিঠে ঠাস করে জবাব দিলো,’নাহ যেতাম না। আমি কেন দেখতে যাবো? কি দায় পরেছে আমার?’
সায়রের মন খারাপ করলো বিউটির উত্তর শুনে। বললো, ‘আপনি তো মানবিকতা থেকেও বলতে পারতেন যে যেতাম। আপনি এমন কাটখোট্টা কেন? আপনি কি বিয়েটাতে সত্যিই রাজি নন?’

‘নাহ আমি এই বিয়েটা করতেই চাই না।’
‘কেন? আমাকে কি আপনার পছন্দ নয়? অবশ্য আপনি তো আমাকে দেখেনই না।’
বিউটি অসম্ভব অস্বস্তিতে পরলো। নিজেকে সামলে বললো, ‘আমার আপনাকে অপছন্দ তা নয়। আমি অন্য কাউকে পছন্দ করি। তাকেই ভালোবাসি। বিয়ে করলে তাকেই করবো।’

‘তাহলে এতোদিন বিয়ে করেন নি কেন? বাড়িতেই বা কেন বলেন নি? আপনার প্রেমিক কি সামনে আসতে লজ্জা পায়?’
‘সেসব আপনাকে বলতে বাধ্য নয় আমি! তবে সে আপনার আর আমার বিয়ের আগে ঠিক চলে আসবে দেখে নিয়েন।’
‘আচ্ছা আসি! তবে শুনুন, যদি আপনার প্রেমিক বিয়ের আগে না আসে তবে বিয়েটা আপনার আমাকেই করতে হবে। আগে আপনার প্রেমিককে সামনে আসতে বলুন তবেই মানবো আপনার প্রেমিক আছে। আমি নিজেই আপনাকে তার হাতে তুলে দেবো। আর যদি না আসে তাহলে..!’

‘তাহলে কি?’
‘আমি সত্যিই ধরে নেবো আপনি সমকামী! ভালো থাকবেন। এখন আমি যাচ্ছি তবে বিকেলে আপনাকে দেখতে আপনার বাড়ি অবশ্যই আসবো। আপনি অমানবিক হতেই পারেন আমি তো নয়, হবু স্ত্রীর প্রতি একটা দায়িত্ব আছে না?’
বিউটি যেনো হোঁচট খেলো মনে মনে। যদি সুপ্রিয় ভাই না আসেন তবে? তাহলে কি এই লোকটাকেই বিয়ে করতে হবে তার? তার মাঝে কয়েকদিন সায়রের কথা মনে পরতো।

হইতো সে জীবনে প্রথম কোনো ছেলের চোখের দিকে তাকিয়েছিলো সেজন্য। সেজন্যই সুপ্রিয় ভাইকে ভাবতে গিয়ে সায়রের চোখ এঁকে ফেলেছিলো। এর আগে তো বাস্তবিক ভাবে সে কোনো ছেলের ধারে কাছেও ঘেঁষে নি। তাই হঠাৎই সায়রকে মনে পরাটা সম্পুর্ন মনের ভাবনা ছাড়া আর কিছু না। এখন তো তার সুপ্রিয় ভাইকে মনে পরছে। সেদিনের মতো একেবারে ভুলে বসে নি। সেদিন এই লোকের বকবকানির জন্য সে সুপ্রিয় ভাইকে একটু ভুলেছিলো। তাছাড়া আর কিছুই নয়।

সায়র বেরিয়েই যাচ্ছিলো, তখনই মিনহাজের মুখোমুখি হলো! মিনহাজের হাতে ফল আর লাল গোলাপ, অর্কিড সহ আরও বিভিন্নরকম ফুল দিয়ে বানানো ব্যুকে। সায়র ভ্রু কুচকে একবার মিনহাজ তো আরেকবার বিউটির দিকে তাকালো।
তারপর গাঢ় দৃষ্টে পর্যবেক্ষণ করলো মিনহাজকে। জোয়ান একজন সুদর্শন পুরুষ দেখছে ওকে, ছোট ছোট চোখে একরাশ কৌতূহল। তার লম্বা সুঠাম শরীর এবং প্রশস্ত অধরে ফিচেল হাসি। মিনহাজ এগিয়ে এসে জড়তা বিহীন নিঃসংকোচে সায়রের দিকে ডান হাত টা বাড়িয়ে দিলো।

‘হ্যালো, আমি মিনহাজ আহমেদ। মিস বিউটির অফিসের বস।’
সায়র তীক্ষ্ণ ভাবে বললো, ‘আপনি এখানে? কোনো দরকার ছিলো? সে অসুস্থ, এখন নিশ্চয়ই অফিসের কোনো কাজ করতে পারবে না। আমি বিউটির হবু স্বামী। আমাকে বলুন, আমি হেল্প করতে পারি!’

মিনহাজ ভেতরে ভেতরে একটা ধাক্কা খেলো। খুব ভালো ভাবেই উপলব্ধি করছে সায়র তার উপস্থিতি টা ভালো ভাবে নেইনি। সে সায়রকে চিনলেও সায়র তাকে চেনে না। রাহেলা বুবু তাকে সায়রের ছবি দেখিয়েছিলো। সায়রের বিরক্ত মাখা মুখের দিকে তাকিয়ে সে মিষ্টি হেসে বললো, ‘কাল রাতে উনাকে আমিই এখানে এনেছিলাম! তাই এজ আ হিউম্যান বিং, আজ আমি উনাকে দেখতে এসেছি!’

‘ওহ ধন্যবাদ আপনাকে। আমার হবু বউকে হসপিটাল অব্দি আনার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ আর কৃতজ্ঞতা! আর বিউটি শুনুন?’
বিউটি শুয়ে চোখ বন্ধ করে ছিলো। সে সুপ্রিয়কে নিয়ে ভাবছিলো। এর মধ্যে সায়রের কন্ঠ চোখ মেলে তাকালো। সায়র যে এখনো যায়নি সেটা তার ভাবনাতীত ছিলো। সায়র তাকে উদ্দেশ্য করে বললো, ‘আপনি বিয়ের পর আর এই চাকরি করবেন না। আমি চাই না আমার বউ এমন চিপ একটা জব করুক। হ্যাঁ আমি বলছি না যে আপনি একেবারেই চাকরি করতে পারবেন না। আপনি চাকরি করবেন তবে অন্য কোথাও!’

সায়র হনহনিয়ে বেরিয়ে গেলো। মিনহাজ সায়রের প্রতিটি কথায় আঘাত পেলেও মুখে ক্ষীণ হাসির রেখা ছিলো। বিউটি হতবুদ্ধি, হতবিহ্বল হয়ে সায়রের চলে যা-ওয়া দেখলো। বিয়েই হয়নি আর এখনই তার স্বাধীনতা লুট করার চেষ্টা করছে সায়র। কই তার সুপ্রিয় ভাই তো তাকে বলতো,“তোর ইচ্ছেরা স্বাধীন। ইচ্ছেরা স্বাধীন সব সময় স্বাধীন হতে হয় বুঝলি? তোর ইচ্ছেরা কখনোই যেনো অস্বাধীন না হয়। আমি তোর সব ইচ্ছে পূরণ করবো।”

মিনহাজকে দেখে বিউটি উঠে বসার চেষ্টা করলো। মিনহাজ দ্রুতবেগে গিয়ে বিউটির দুই কাঁধ ধরে ওকে ধরে বসালো। অকস্মাৎ স্পর্শে নড়েচড়ে উঠে বিউটি। এটা যে তার আশার প্রতিফলন নয় মিনহাজ বুঝলো। এভাবে স্পর্শ করাই বিউটির চোখমুখ শক্ত হয়ে আছে। তবুও মিনহাজ নিজের ব্যাক্তিত্ব বজায় রেখে ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইলো। বিউটি নিজেকে সামলে বললো, ‘স্যার দাঁড়িয়ে থাকবেন না প্লিজ। বসুন।’

মিনহাজ বিউটির কথায় বসলো সেখানকার একটা টুলসে।
‘এখন কেমন বোধ করছেন?’
‘জ্বী আগের থেকে ভালো!’
‘আচ্ছা। কিছু খেয়েছেন?’
‘জ্বরের সময় আমি কিছু খেতে পারি না।’
‘সেকি!আপনি খান নি? এভাবে না খেয়ে থাকলে আপনি আরও দূর্বল হয়ে যাবেন। অপেক্ষা করুন আমি খাবার চেয়ে পাঠাচ্ছি!’

‘প্লিজ এসব করবেন না। আমি খাবো না। মুখ তেঁতো বি’ষ হয়ে আছে।’
মিনহাজ বিউটির কথায় কর্ণপাত করলো না। পকেট থেকে ফোন বের করে কাউকে কল করলো। বিউটির ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছে। তাছাড়া কালকে মিনহাজ তাকে পছন্দ করে সেটা জানার পর আরও সে নিজেকে গুটিয়ে নিলো। নত মস্তকে একই ভাবে বসে রইলো সে। মিনহাজ কথা বলা শেষ করে বিউটির দিকে তাকালো। একদিনেই কি হাল হয়েছে মেয়েটার। সাদা ফ্যাকাসে লাগছে তাকে। মিনহাজ রয়েসয়ে বললো,

‘সুপ্রিয় কে? উনাকে কি আপনি পছন্দ করেন?’
যারপরনাই অবাক হলো বিউটি। বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
‘সুপ্রিয় নামটা আপনি জানলেন কি করে? আপনি কি তাকে চেনেন? বলুন, জানলেন কিভাবে?’
সুপ্রিয়র নাম তার মুখে শুনে উত্তেজিত হয়ে বিউটি তখন সম্পুর্ন ভাবেই মিনহাজের দিকে তাকিয়েছে। মিনহাজ শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে বিউটির দিকে। বিউটির সঙ্গে চোখাচোখি হয়েছে মুহুর্তের মধ্যেই। বিউটিও মিনহাজের পুরো মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। তার চোখ ভর্তি নোনাজল। মিনহাজের কাছে এ যেনো একটা স্বপ্ন। সে বিশ্বাস করতে পারছে না বিউটি তার দিকে পলকহীন ভাবে তাকিয়ে আছে। সুপ্রিয় নামটা শুনতেই বিউটির এই পরিবর্তন। তার মন আনন্দে পুলকিত হলো। মিনহাজ খুবই নরম কন্ঠে বললো,

‘কাল জ্বরের ঘোরে আপনি আমাকেই সুপ্রিয় ভাই বলছিলেন। কে উনি? আপনি কি উনাকে খুব ভালোবাসেন?’
মিনহাজের কথায় সম্বিত ফিরে পেলো বিউটির। একটু থতমত খেয়ে মিনহাজের দিক থেকে চোখ নামিয়ে নিলো মুহুর্তেই। একটু লজ্জাও পেলো বৈকি এভাবে তাকানোতে। সে একদম চুপ করে রইলো। তার আর কিছু বলতে হলো না। তার নিশ্চুপ থাকাতে মিনহাজ নিজেই যা বুঝার বুঝে নিলো। মিনহাজ শ্লেষ কন্ঠে বললো,

‘আপনি গতকাল অন্তত পঞ্চাশ বার সুপ্রিয় ভাই আর শেষের দিকে দশবার মারিয়ামের নাম নিয়েছেন। মারিয়াম তো আপনার বেস্টফ্রেন্ড! আর বাকি যা বুঝলাম আপনি আপনার সুপ্রিয় ভাইকে খুবই ভালোবাসেন, তাকে নিয়ে কল্পনা করেন, তাকে নিয়েই ভাবনায় ডুবে থাকেন। আচ্ছা অফিসে আপনি যখন অন্য মনস্ক থাকেন তখন কি আপনি আপনার সুপ্রিয় ভাইকেই কল্পনা করেন? আপনি উনাকে অনেক ভালোবাসেন তাই না? যদি তাই হবে, তাহলে অন্য একজনকে বিয়ে করছেন কেন?’
বিউটি মাথা নত করলো। মিনহাজের কোনো প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে শুধু বললো,

‘ধন্যবাদ স্যার। কাল আপনি আমার জন্য অনেক করেছেন। কিন্তু এই বিষয়ে আমি কিছুই বলতে পারছি না।’
মিনহাজ মলিন হাসলো। তার প্রশ্নের যে উত্তর সে পাবে না বিউটির থেকে, সে জানতো। তবুও নির্লজ্জের মতো প্রশ্ন করলো। দুই জনেই বেশ কিছুক্ষণ নিরব ভূমিকা পালন করলো। আচানক মিনহাজ বিউটির হাত ধরে ফেললো। দ্বিতীয় বারের মতো বিউটি চোখ বড় বড় করে তাকালো মিনহাজের দিকে।

মিনহাজ করুন স্বরে বললো, ‘আপনি প্লিজ সায়রকে বিয়ে করবেন না। বিয়ে যেহেতু করছেন-ই তবে সেটা আমাকে কেন নয়? আমি যেদিন আপনাকে প্রথম দেখেছিলাম সেদিনই কিছু একটা ফীল করেছিলাম। আপনাকে দেখার পর আমি না চাইতেও আপনাকে ভেবে গেছি সর্বক্ষণ! বিঁধাতা শুধুমাত্র আমার জন্য আপনাকে সৃষ্টি করেছেন। কারণ তিনি জানেন কেউ আমার চেয়ে বেশি আপনাকে ভালবাসতে পারবে না।

যখন আমি আপনার কথা ভাবি তখন মনে হয় আপনি ছাড়া আমি অর্থহীন। আমি চাই আমার জীবনের প্রতিটি সময় আপনার সাথে কাটাই। প্রতিটি সেকেন্ড আমি আপনার জীবনের সাথে ভাগ করতে চাই। জীবনটা অনেক সুন্দর, যদি কারো ভালোবাসায় এ জীবন পূর্ণতা পায়, যদি কেউ আপনার কষ্টটা ভাগ করে নিতে চায়। আর আমি আপনার কষ্ট গুলো নিতে চাই। আমার সকল আনন্দ আপনার মাঝে বিলিয়ে দিতে চাই। আমি আমার থেকেও আপনাকেই বেশি ভালোবাসতে চাই। আপনি কি সেই অধিকারটুকু আমাকে দেবেন?’

বিউটি এক ঝটকায় মিনহাজের থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিলো। ক্ষোভের সহিত বললো,
‘মিষ্টার মিনহাজ আহমেদ কন্ট্রোল ইয়্যুরসেল্ফ! এটা হসপিটাল। আর হ্যাঁ আমি কাউকেই বিয়ে করতে চাই না আমার সুপ্রিয় ভাইকে ছাড়া।’

সে আমার সুকেশিনী পর্ব ৯

মিনহাজের চোখ মুখে খুশির ঝলক খেলে গেলো। তার চোখের পানি চিকচিক করছে। সে চোখে হেসে বললো,
‘আর যদি বলি, আমিই তোর সুপ্রিয় ভাই তখন?’

সে আমার সুকেশিনী পর্ব ১১