হৃদয়াসিক্ত কাঠগোলাপ পর্ব ৩০

হৃদয়াসিক্ত কাঠগোলাপ পর্ব ৩০
সাদিয়া জাহান উম্মি

হন্তদন্ত হয়ে হাসপাতালে এসে পৌছালো জায়ান।বিধস্ত অবস্থা ওর।জোড়ে জোড়ে শ্বাস নিচ্ছে ক্রমাগত।দৌড়ে সোজা করিডোরে বসা ফাহিমের কাছে গিয়ে থামলো।ফাহিম জায়ানকে দেখেই উঠে দাড়ালো।জায়ান অস্থির গলায় বলে,
-‘ আরাবী?আরাবী কোথায়?’

ফাহিম যথাসম্ভব নিজেকে সামলে রেখেছে।ও ভেঙে পরলে কিভাবে হবে?বাকিদের সামলাবে কে তাহলে?ফাহিম বলল,
-‘ আরাবীকে অটিতে নেওয়া হয়েছে।’
জায়ান ধরা গলায় প্রশ্ন করে,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

-‘ ওর অবস্থা এমন কিভাবে হলো ফাহিম?ও তো তোমাদের বাড়ি গিয়েছিলো।আমি নিজে ওকে বাড়িতে দিয়ে এসেছিলাম।বলেছিলাম বিকেলে আমি নিতে আসবো।তাহলে ওর এক্সিডে’ন্ট কিভাবে হলো?’
-‘ আমি জানি না ভাইয়া। শুধু জানি কোচিং থেকে ফেরার সময় দেখি রাস্তায় অনেক ভীড়। আমি বাইক থেকে নেমে ভীড় ঠেলে গিয়ে দেখি আমার বোনটা রক্তা’ক্ত অবস্থায় রাস্তায় পরে আছে।দ্রুত ওকে নিয়ে হাসপাতালে এস পৌছাই।এরপরেই আপনাকে ফোন দিয়ে জানাই।’

ধপ করে চেয়ারে বসে পরলো জায়ান।দুহাতে মুখ ঢেকে ফেললো।কিভাবে কি হয়ে গেলো।সকালেই তো ও হাসিখুশি মেজাজে দেখলো মেয়েটাকে।আর এখন কিনা?ভাবতে পারছে না জায়ান।কিছুতেই পারছে না।মনে হচ্ছে কেউ ওর কলিজটা টে’নে বের করে নিয়ে আসছে।যন্ত্র’নায় বুকটা হাশফাশ করছে।জায়ানের চোখ থেকে একফোটা অশ্রু গড়িয়ে পরলো।কেউ দেখার আগেই সেটা সবার অগোচরেই মুছে ফেললো।ফাহিম জায়ানের কাধে হাত রাখল।ওর নিজেরও কষ্ট হচ্ছে।কিন্তু সেটা দেখাতে পারছে না।ফাহিম বলে,

-‘ চিন্তা করবেন না ভাইয়া।আমাদের আরাবীর কিছুই হবে নাহ।’
জায়ান থম মেরে বসে রইলো।প্রায় আধাঘন্টা পরেই পরিবারের সবাই এসে হাজির হলো।না চাইতেও আসতে হলো লিপি বেগম আর ফিহাকে।কারন তাদের তো সাখাওয়াত পরিবারের কাছে ভালো সাজতে হবে।জিহাদ সাহেব মেয়ের অবস্থা শুনে প্রায় অচেতন অবস্থায় পরে আছেন।তাকে সামলাচ্ছেন মিহান সাহেব।

পরিবারের সবাই কাঁদছে।এর একটু পরেই আলিফা আসলো।ইফতি তাকিয়ে আলিফার দিকে।মেয়েটা কেঁদেকেটে একাকার অবস্থা করে ফেলেছে।ফাহিম চুপচাপ এককোনায় দাঁড়িয়ে।নূর এতোদিনের অভিমান সব এক জায়গায় ঠেলেঠুলে সরিয়ে এগিয়ে গেলো ফাহিমের কাছে।হাত রাখলো ফাহিমের কাঁধে।ফাহিম তাকালো পিছনে ঘুরে।নূর দেখলো ফাহিমের চোখজোড়া ভনায়ক লাল হয়ে আছে। কান্না আটকে রাখার জন্যেই এমনটা হয়েছে।নূর মোলায়েম স্বরে বলে,

-‘ নিজেকে সামলান এতো সহজে ভেঙে পরবেন না।আংকেলের অবস্থা একবার দেখুন।আপনাকেই তো তাকে সামলাতে হবে তাই নাহ?ইনশাআল্লাহ ভাবির কিছু হবে না।’
ফাহিম তাকিয়েই রইলো নির্নিমেষ।কেন যেন নূরের কথায় ফাহিম ভরসা পেলো অনেকটা।মনের মাঝে সাহসের সঞ্চায় হলো।

এদিকে সাথি বেগম কান্নার মাঝেই বার বার লিপি বেগমের দিকে তাকাচ্ছেন।তিনি উপলব্ধি করতে পারছেন এই লিপি বেগম আর ফিহার মাঝে কিছু একটা গন্ডগোল আছে।নাহলে এইভাবে নিজের মেয়ে আর বোনের এক্সি’ডেন্টের কথা শুনলে কেউ এতোটা শান্তভাবে থাকতে পারতো নাহ।এইযে তারা কান্না করছে।এইগুলা সব লোক দেখানো।তা বেশ বুঝতে পারছেন তিনি।কারন তিনিও যে মা।মায়েরা সব বোঝে।
তিনঘন্টা পর অটির দরজা খুলে বের হয়ে আসলো ডাক্তার।এই তিন ঘন্টা পর জায়ান নড়লো।সোজা গিয়ে দাড়ালো ডাক্তাদের কাছে।তার কাঁপা গলায় প্রশ্ন করলো,

-‘ ডক্টর?ওর অবস্থা কেমন এখন?’
ডাক্তার বলেন,
-‘ পেশেন্টের অবস্থা অনেক ক্রিটিকাল।পেশেন্ট হয়তো কিছু নিয়ে প্রচন্ড মানষিক আঘাত পেয়েছেন। তার উপর এতো বড় একটা এক্সিডে’ন্ট।মাথায় আঘাত পেয়েছে গুরুতরভাবে।ডান হাতটা ভেঙে গিয়েছে।পা দুটোতেও মারাত্মক আঘাত পেয়েছে।আপাততো শুধু আল্লাহকে স্মরণ করুন।চব্বিশঘন্টা আমরা তাকে অবজারভেশনে রাখবো।চব্বিশঘন্টা পর জ্ঞান না ফিরা পর্যন্ত কিছু বলতে পারছি না।’

সব শুনে জায়ান বাকরুদ্ধ হয়ে যায়।কি হয়ে গেলো এসব?যেখানে ভালোবাসার মানুষটার সামান্য কষ্টও জায়ান সহ্য করতে পারে না।আজ তো মানুষটার গোটা শরীরটা আঘাতে জর্জরিত।ছেলের অবস্থা দেখে এগিয়ে আসলেন নিহান সাহেব।ভরশা দিয়ে বলেন,
-‘ বউমা ঠিক হয়ে যাবে বাবা।’

জায়ান যেন বাবাকে পেয়ে নিজেকে সামলাতে পারলো না।বাবাকে জড়িয়ে ধরলো।নিহান সাহেব তার ঘারে আভাস পেলেন কিছু উষ্ণ জলের।তিনি বুঝলেন ছেলে তার নিশব্দে কাঁদছে।তিনি ছেলের পিঠে হাত বুলিয়ে দিলেন।বলেন,
-‘ ভেঙে পরিস না বাবা।তুই এমন করলে কি হবে?বউমার খেয়াল তো তোরই রাখতে হবে।’
-‘ ওকে তাড়াতাড়ি ঠিক হতে বলো বাবা।ওকে এই অবস্থায় আমি দেখতে পারছি না।সহ্য হচ্ছে না আমার।’
-‘ ধৈর্য ধর বাবা।সব ঠিক হয়ে যাবে।’

এদিকে মেয়ের শরীরের এই অবস্থা জেনে উঠে দাড়ালেন জিহাদ সাহেব।তিনি আজ আর তার হিতাহিতজ্ঞানে নেই।সোজা হেটে গেলেন লিপি বেগম আর ফিহার কাছে।বিনাবাক্যে সজোড়ে চ’র মেরে দিলেন লিপি বেগমের গালে।এরপর ফিহাকে।হঠাৎ জিহাদ সাহেব এমন করায় চমকে উঠলো সবাই।ফাহিম দ্রুত পায়ে এগিয়ে আসলো।কাঁপতে থাকা জিহাদ সাহেবকে জড়িয়ে ধরে সামলে নিলো।এদিকে লিপি বেগম অবাক হয়ে বলেন,

-‘ তুমি আমায় মারলে?’
এই কথায় যেন আরও রেগে গেলেন জিদাদ সাহেব।দাঁতেদাঁত চিপে বলেন,
-‘ হ্যা মারলাম।কিন্তু মন ভড়লো না আরো মারতে ইচ্ছে করছে।’
তারপর ফিহার দিকে তাকিয়ে বলে,

-‘ আর তুই?আমার ঘৃনা হচ্ছে নিজের প্রতি এটা ভেবে যে আমি তোর জন্মদাতা।জন্মের সময় তোকে মে’রে ফেললেই ভালো ছিলো।তোর মতো কুলঙ্কার সন্তান যেন আল্লাহ্ কারো ঘরে না দেন।’
-‘ বাবা!’
-‘ চুপ বাবা ডাকবি না তুই আমায়।আমি তোর বাবা নই।আজ থেকে আমার দুটো সন্তান।তুই আমার জন্য মৃ’ত।’
ফাহিম এতোক্ষনে মুখ খুলল,

-‘ কি হয়েছে বাবা?কেন এমন করছো তুমি?’
ফাহিমের থেকে সরে আসলেন জিহাদ সাহেব।বলেন,
-‘কেন এমন করছি?জিজ্ঞেস কর তোর মায়ের কাছে কেন এমন করছি।’
ফাহিম তাকালো ওর মায়ের দিকে।

-‘ মা!’
লিপি বেগম গালে হাত দিয়ে কাঁদছেন।জিহাদ সাহেব রাগি গলায় বলেন,
-‘ ওদের জন্যে।শুধুমাত্র ওদের জন্যে আমার মেয়েটার এই অবস্থা হয়েছে আজ।কেন আমি আমার মেয়েটাকে আটকালাম নাহ।ওকে বুকের মাঝে আগলে নিলাম না।আমার মেয়েটা আজ মৃ’ত্যুর সাথে লড়ছে শুধুমাত্র ওদের জন্যে।ফাহিম ওদের বল আমার চোখের সামনে থেকে সরে যেতে।সহ্য হচ্ছে না ওদের আর আমার।’

জায়ান এতোক্ষন চুপ থাকলেও এইবার আর পারলো না।আরাবীর এই অবস্থা কেন হয়েছে তা ওকে জানতেই হবে।আর সেই কারনের পিছনে যে এই মা মেয়ের হাত আছে বেশ বুঝতে পারছে জায়ান।ওদের অনেক আগে থেকেই সন্দেহ করতো জায়ান।

কিন্তু পাকাপোক্ত কোন কিছু চোখের সামনে না পরায় কিছু বলতে পারতো না।তবে আজ আর জায়ান পিছপা হবে না।ওর কাঠগোলাপের এমন অবস্থার যেই করেছে বা যার কারনেই হয়েছে তাদের কাউকেই ছারবে না ও।সে যেই হোক না কেন।কাউকে রেহাই দিবে না।ঠিক যতোটা কষ্ট ওর কাঠগোলাপ পেয়েছে তার থেকে চারগুন বেশি ভুগবে তারা।জায়ান এগিয়ে গেলো জিহাদ সাহেবের কাছে।তারপর গম্ভীর গলায় বলে,

-‘ বাবা আজ আরাবীর জন্যে হলেও আমায় সবটা সত্যি সত্যি বলুন বাবা।আমি সব জানতে চাই।কি কারনে আজ আরাবীর এই অবস্থা হয়েছে।আমি সব জানতে চাই।’
জিহাদ সাহেব জায়ানের প্রশ্ন শুনে একটুও ঘাবড়ালেন না।অনেক হয়েছে আর লুকাবে না কারো কাছে কিছু।সব সত্যি বলে দিবে।হোক সে আরাবীর জন্মদাতা না।

তাই বলে কি সে আরাবী তার মেয়ে নাহ?আরাবী তার মেয়ে।কিন্তু আজ এই অ’মানুষ দুটোকে শাস্তি দেওয়ার জন্যে হলেও সবাইকে এই সত্যি বলতে হবে আজ তাকে।জিহাদ সাহেব বড় করে শ্বাস নিলেন।তারপর কাঁপা গলায় বলে উঠেন,
-‘ আরাবী আমার আসল মেয়ে নাহ।দত্তক নিয়েছি আমি ওকে।ও আমার পালক মেয়ে।’

হৃদয়াসিক্ত কাঠগোলাপ পর্ব ২৯

ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন।কেমন হয়েছে জানাবেন।ছোটো হওয়ার জন্যে দুঃখিত।কিন্তু ঠান্ডার কারনে লিখতে পারি না এর থেকে বেশি।

হৃদয়াসিক্ত কাঠগোলাপ পর্ব ৩১