হৃদয়াসিক্ত কাঠগোলাপ পর্ব ২৯

হৃদয়াসিক্ত কাঠগোলাপ পর্ব ২৯
সাদিয়া জাহান উম্মি

আলিফাদের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে ইফতি।সে একনাগাড়ে ফোন দিয়ে চলেছে আলিফাকে।কিন্তু মেয়েটা ফোন ধরলে তো?অসহ্য রকম বিরক্ত হয়ে যে ইফতি কি করবে ভেবে পায় না।শেষে না পেরে আলিফার ছোটো বোন আহিয়ার ফোন লাগালো ইফতি।একটু পরেই ফোন রিসিভ হলো অপাশ থেকে।ইফতি গম্ভীরস্বরে বলে,

-‘ হ্যালো আহিয়া?আমি তোমার দুলাভাই বলছি।’
আহিয়া আচানক এমন একটা শুনে ভড়কে গেলো।অবাক স্বরে প্রশ্ন করে,
-‘ দুলাভাই মানে?’
-‘ দুলাভাই মানে তোমার একমাত্র বোনের জামাই হবো আমি।সেই হিসেবে তো আমি তোমার দুলাভাই তাই নাহ।এখন বলো এই মাথামোটা মেয়েটা কই?’

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

আহিয়ার অবাকের রেশ এখনও কাটেনি।তাও আর বেশি কিছু প্রশ্ন করল নাহ।বোনটার ইদানিং কি জানি হয়েছে।দিনের প্রায় চব্বিশ ঘন্টা রুমবন্দি হয়ে থাকে।কারনটা পুরো না বোঝলেও একটু আধটু বোঝেছে আহিয়া।তাই ও বলে,
-‘ আপু তো নিজের রুমে।ইদিনিং আপুর না জানি কি হয়েছে কারো সাথে কথা বলে না।সারাদিন রুমবন্দি হয়ে থাকে।’
দীর্ঘশ্বাস ফেললো ইফতি।বলে,

-‘ তোমাদের বাড়িতে এখন কে কে আছে?’
-‘ আব্বু অফিসে। আম্মু স্কুলে।আপাতত বাড়িতে আমি আর আপু ছাড়া কেউ নেই।’
-‘ বেশ। আমি তোমাদের বাড়িতেই আসছি।গেট খুলে দিও কলিংবেল বাজালে।’
-‘ আচ্ছা ভাইয়া।’
ইফতি ফোন কেটে সোজা আলিফাদের ফ্লাটে চলে গেলো।কলিংবেল বাজাতেই আহিয়া এসে দরজা খুলে দিলো।ইফতি দুটো চকোলেট দিলো আহিয়াকে।খুশি হয়ে আহিয়া বলে,

-‘ ধন্যবাদ ভাইয়া।’
-‘ মেনশন নট।আমার একমাত্র সালিকার জন্যে এটুকু কিছুই না।তা আমার বউটা কোন রুমে।’
-‘ আমার সাথে আসুন ভাইয়া।’
আহিয়া ইফতিকে নিয়ে আলিফার রুমের সামনে গেলো।দু তিনবার রুমের দরজায় নক করল।কোন জবাব এলো না। এদিকে রুমের ভীতরে সুয়ে থাকা আলিফা প্রচন্ড বিরক্ত হয়ে আছে এভাবে বার বার দরজায় নক করায়।শেষে না পেরে বিরক্ত হয়ে বলে,

-‘ কি সমস্যা?দরজা ধাক্কাধাক্কি করার মানে কি?’
-‘ আপু দরজাটা খুল।একটু দরকার আছে।আমার বাথরুমের লাইট জ্বলছে না।আমি গোসল করব আপু।দরজাটা খুল।’
আলিফা বিরক্ত হয়ে বিছানা থেকে উঠে দাড়ালো।তারপর গিয়ে দরজা খুলে দিলো।আলিফা দরজা খুলতে দেরি হুরমুর করে ইফতির রুমে প্রবেশ করতে দেরি নেই।ইফতি আলিফাকে টেনে রুমের ভীতরে এনে দরজা আটকে দিলো।এদিকে একটা ঘোরে ছিলো আলিফা।আচমকা ইফতিকে দেখে কি রিয়েকশন দিবে প্রায় ভুলেই গিয়েছিলো। একটু পর সবটা বুঝতে পেরেই চেচিয়ে উঠে আলিফা,

-‘ আপনি?আপনি এখানে কেন?আর আমার রুমে ঢোকার পারমিশন কে দিয়েছে?’
ইফতি গিয়ে সোজা আলিফার বিছানায় বসে পরল।ভাবলেশহীনভাবে বলে,
-‘ আমার বউয়ের রুমে আমি প্রবেশ করব।এতে কারো পারআমিশন নেওয়ার দরকার আছে নাকি?’
ইফতির মুখে বউ ডাক শুনে কেমন যেন লাগল আলিফার।কেঁপে উঠলো মনটা কেমন যেন।তাও সেদিকে ভ্রু-ক্ষেপ করল নাহ আলিফা।রুক্ষ কণ্ঠে বলে,

-‘ কে বউ?কি বলছেন আপনি?মাথা ঠিক আছে আপনার?মুখে লাগাম টানুন।’
-‘ আমার মাথা ঠিকই আছে।শুধু তোমার মাথায় গোবড়ে ঠাসা তা বেশ বুঝতে পারছি আমি।’
প্রচন্ড রাগ লাগছে আলিফার।বলা নেই কওয়া নেই হুট করে হাজির হয়েছে লোকটা।এখন আবার কি উল্টাপাল্টা বকবক করছে।এমনিতেই ইফতিকে দেখেই কান্না পাচ্ছে আলিফার।অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে রেখেছে।আলিফা বলল,
-‘ দেখুন এখন আমি ঝগড়া করার মুডে নেই।প্লিজ চলে যান আপনি।’

ইফতি উঠে দাড়ালো।আলিফার কাছে এসে আলিফার একহাত ধরে টেনে নিজের কাছে আনলো ও।তারপর আলিফার একটা হাত আলিফার পিঠের পিছনে মুচড়ে ধরলো।ব্যাথায় ককিয়ে উঠলো আলিফা।ইফতি দাঁতেদাঁত চিপে বলে,
-‘ কি সমস্যা তোমার?ফোন ধরছো না কেন আমার? ভালোবাসি আমি তোমায়।বোঝনা কেন এটুকু?আমি জানি তুমি বোঝো তবুও কেন এমন করছো?তুমিও আমায় ভালোবাসো আমি জানি।তাও কেন এতো দূর দূর করছো আলিফা?আমার মাথা খারাপ করো না আলিফা পরিমান খারাপ হবে।আজ এইটুকুই বললাম।পরবর্তীতে আবার এমন করলে এর থেকে বেশি করবো আমি।তাই সাবধান।’

ছেড়ে দিলো ইফতি আলিফাকে তারপর চলে যাওয়ার জন্যে অগ্রসর হলো।এদিকে ইফতির মুখে ভালোবাসি শুনে সারাশরীর কাঁপছে আলিফার।আচমকা আবারও ইফতি ওর সামনে আসে। আঙুল উঁচিয়ে শাষানোর স্বরে বলে,
-‘ নেক্সট টাইম যেন আমার ফোন প্রথমবারেই রিসিভ হয় আলিফা।আর তৈরি হয়ে থেকো আমার বউ হবার জন্যে।’

ইফতি এগিয়ে গিয়ে ভালোবাসার পরশ এঁকে দিলো আলিফার কপালে।সর্বাঙ্গ কেঁপে উঠলো আলিফার।আবেশে চোখজোড়া বন্ধ হয়ে গেলো।সময় নিয়ে চোখ খুলতেই আশেপাশে কোথায় দেখতে পেলো না ইফতিকে।একটু আগে কি বলে গেলো লোকটা?তৈরি থাকতে তার বউ হওয়ার জন্যে?কি করবে লোকটা?কি করতে চাইছে?লোকটার বউ হবে তো ফিহা?তাহলে ওকে তৈরি হওয়ার কথা বলল কেন? উফ,মাথাটা আর চলছে না আলিফার।ধপাস করে বিছানায় সুয়ে পরল ও।

এলোমেলোভাবে রাস্তায় হাটছে আরাবী।জীবনের মোড় যেন একনিমিষেই বদলে গেলো ওর।হঠাৎই একটা দমকা হাওয়া এসে এলোমেলো করে দিয়ে গেলো ওকে।জীবনেও যেটা কখনও ভাবতেও পারিনি আরাবী আজ ওর সাথে সেটাই হলো।যাকে ছোটো থেকে নিজের পরিবার বলে জেনেছে তারা নাকি ওর পরিবার নাহ।যাদের ছোটো থেকে আম্মু,আম্মু ডেকেছে তারা ওর বাবা মা নাহ।

যেই বাবার বুকে মাথা রাখলে জগতের শান্তি পেয়ে যেতো আরাবী।আজ থেকে আর সেই মানুষটার মুখ দেখতে পারবে না ও।যাকে ভাই বলে জেনে এসেছে।যেই ভাই তার মাথায় হাত রাখলে ভরসা পায় আরাবী আজ থেকে আর তাকে ভাই বলে ডাকতে পারবে না।মায়ের মমতা ছোটো থেকে যেটুই পেয়েছে ও আজ থেকে তার কিছুই পাবে না।সব সব কিছু হারিয়ে ফেললো আক আরাবী।কিছুই রইলো না ওর।

এতিম ও আজ থেকে।নাহ নাহ আজ থেকে না এতিম তো ছোটো থেকেই।সে তো বাবা বলে এতোদিন জেনে এসেছে যেই লোকটাকে সেই লোকটা ওকে আশ্রয় দিয়েছে।ভালো জীবন দিয়েছে।নাহলে যে জীবটা ওর কেমন হতো মাথায় আসতেই শরীর কেঁপে উঠছে ওর।সে আজীবন কৃতজ্ঞ থাকবে ওই মানুষটার উপর।আরাবী দিশেহারা পথিকের মতো গন্তব্যহীন হাটছে।চোখের জলে ঝাপসা হয়ে আসছে দৃষ্টি।হঠাৎ জায়ানের কথা মনে পরলো আরাবীর।লোকটা কি ওকে অবহেলা করবে?যদি জানতে পারে ও এতিম।ওর কোন বাবা মায়ের পরিচয় নেই।

আরাবী নিজস্ব কোন পরিচয় নেই।কি করবে আরাবী যদি জায়ান ওর মতো এতিম মেয়েকে মেনে না নেয়? ভাবতেই হাতপা ঠান্ডা হয়ে আসছে আরাবীর।হঠাৎ মানুষের চিৎকার চেঁচাচেচির ওর কানে ভেসে আসতেই চোখের জল মুছে আশেপাশে তাকায় আরাবী।বোঝল ও রাস্তার মাঝখানে এসে পরেছে।সেইজন্যই মানুষ চিল্লাচ্ছে।ভয়ে রূহ কেঁপে উঠলো আরাবীর।যতো যাই হোক ও মরতে চায় না।জায়ানের সাথে বেঁচে থাকতে চায় ও।

এখনও যে অনেক কিছু বাকি।কিন্তু ভাগ্য বোধহয় তা চায় না।তাই তো আরাবী রাস্তা থেকে সরে যাওয়ার আগেই একটা দ্রুতগামী গাড়ি এসে সজোড়ে ধাক্কা মারলো আরাবীকে।আরাবীর ছোট্টো শরীরটা ছিটকে পরলো রাস্তার কিনারায়।আরাবীর র’ক্তে ভেসে গেলো রাস্তা।আরাবী নিভুনিভু চোখে তাকিয়ে।

হৃদয়াসিক্ত কাঠগোলাপ পর্ব ২৮

ওর চোখের সামনে ধোয়াশা দেখতে পাচ্ছে ও।আর সেই ধোয়াশার মাঝে ভেসে উঠলো জায়ানের ছবি।আরাবী বাঁচতে চায়। কিন্তু তা বোধহয় বিধাতা চান নাহ।তাইতো এইভাবে সবটা ঘটে গেলো।আরাবী জোড়েজোড়ে শ্বাস নিচ্ছে।বেঁচে যাওয়ার জন্যে আশার আলো খুঁজে চলেছে।কিন্তু তা আর হলো না।আস্তে আস্তে ওর চোখজোড়া বন্ধ হয়ে গেলো।গভীর শ্বাস নিয়ে আরাবী শেষবার বলে উঠলো,
-‘ আ..আমি আপনার সাথে বাঁচতে চাই জায়ান।’

হৃদয়াসিক্ত কাঠগোলাপ পর্ব ৩০