হৃদয়াসিক্ত কাঠগোলাপ পর্ব ২৮

হৃদয়াসিক্ত কাঠগোলাপ পর্ব ২৮
সাদিয়া জাহান উম্মি

রেডি হয়ে আরাবী গাড়িতে উঠে বসলো।গন্তব্য আজ বাবাবাড়ি যাবে।নিহান সাহেব বিয়ের প্রস্তাবে নাকচ করে দিয়েছে।সেখানের পরিস্থিতি কেমন না কেমন।তাই সবাইকে সবটা ভালোভাবে বোঝানোর জন্যেই যাবে আরাবী।জায়ান এগিয়ে এসে আরাবীর সিটবেল্ট বেধে দিলো।তারপর নিজের জায়গায় সরে এসে বলে,

-‘ আমি বলেছিলাম আমি তোমার সাথে যাবো।তবে সরি।তা আর পারছি না।অফিসে কিছু জরুরি কাজ পরে গিয়েছে তাই আমায় যেতে হবে।তোমাকে পৌছে দিয়ে আমি অফিসে যাবো।চিন্তা করো না।আমি বিকেলে তোমাকে এসে নিয়ে যাবো।’
মুঁচকি হেসে আরাবী বলে,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

-‘ আরে বাবা এতো কৈফিয়ত দেওয়ার প্রয়োজন নেই।আপনার জরুরি বলেই আপনি যাবেন আমি জানি।সমস্যা নেই আপনি যান।বিকেলে আমাকে নেওয়ার জন্যে আসিয়েন।’

আরাবীর কথায় সস্থির নিঃশ্বাস ফেললো জায়ান।তারপর রওনা হলো মৃধা বাড়ির উদ্দেশ্যে।বাড়ির সামনে আরাবীকে নামিয়ে দিয়ে জায়ান চলে যায় অফিসে।আরাবী বাড়ির দিকে পা বাড়ায়।দরজার সামনে গিয়ে কলিংবেল বাজাতেই ঘরের হেল্পিংহেন্ড সায়মা এসে দরজা খুলে দেয়।আরাবী ঘরে প্রবেশ করে দেখে জিহাদ সাহেব সোফায় বসে আছেন।আরাবী সোজা গিয়ে বাবার পাশে বসে।জিহাদ সাহেব মেয়েকে দেখে মলিন হাসেন।আরাবী সালাম দিয়ে বলে,

-‘ বাবা কেমন আছো?’
-‘ এইতো মা। ভালো আছি। তুই কেমন আছিস?’
-‘ আলহামদুলিল্লাহ। আমি ভালো আছি।’
ওদের কথার মাঝে হঠাৎ ফিহার কণ্ঠ শোনা গেল,
-‘ ভালো তো তুই থাকবিই।আমার বিয়ে ভেঙে তো তোর আনন্দের শেষ নেই।’
অবাক হলো আরাবী।প্রশ্ন করল,

-‘ এসব কি বলছিস ফিহা?আমি কেন তোর বিয়ে ভাঙবো?’
-‘ একদম ন্যাকা সাজবি না তুই।’
লিপি বেগম ধমকে উঠলেন আরাবীকে।আরাবী বলে,
-‘ আম্মু এখানে ন্যাকা সাজার কিছুই নেই। আমি যা সত্য তাই বললাম।ইফতি ভাইয়া আলিফাকে ভালোবাসে।আর আলিফাও ইফতি ভাইয়াকে ভালোবাসে।আর জোড় করে কোনদিন কিছু হয় নাহ আম্মু।আর ইফতি ভাইয়া ফিহাকে ভালোবাসে না।সেখানে বিয়ে হলে ফিহা ভালো থাকবে না।’

এমন কথায় তেড়ে আসল ফিহা।রাগে ফুসতে ফুসতে বলে,
-‘ তোর জ্ঞান তোর কাছে রাখ।তুই নিজেই ওই বাড়িতে আমার বদনাম করেছিস।আর তা শুনেই তো তারা বিয়েতে রাজি হলো না।’
-‘ দেখ ফিহা তুই ভুল ভাবছিস।’

-‘ আমি কোন ভুল ভাবছি নাহ।আমি ঠিকই ভাবছি।সবাই ঠিকই বলে জানিস আরাবী।রাস্তা থেকে তুলে আনা কোন ব্যাক্তি কারো আপন হতে পারে না।তাকে যতোই আদর যত্ন করা হোক না কেন।আর তুই তার জলজ্যান্ত প্রমান।’
জিহাদ সাহেব সাথে সাথে ধমকে উঠলেন ফিহকে,
-‘ বে’য়াদপ মেয়ে।মুখে লাগাম টানো।কিসব বলছো তুমি তোমার ধারনা আছে?’
ফিহার এমন কথায় আরাবী থমকে গেলো।বুকের ভীতরটা কেমন যেন মোচড় দিয়ে উঠলো তার।কি বলছে কি ফিহা?রাস্তা থেকে তুলে আনা মানে?আরাবী কাঁপা কণ্ঠে প্রশ্ন করে,

-‘ রাস্তা থেকে তুলে আনা মানে?কি বলছিস তুই আরাবী?’
-‘ কিছু না মা।তুই ও কথায় ধ্যান দিস না।’ জিহাদ সাহেবের অস্থির গলা।
লিপি বেগম তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলেন,

-‘ আর কতোকাল তুমি লুকাবে ফাহিমের বাবা?আর কতো?রাস্তা থেকে এই মেয়েকে তুলে এনে।তুমি যেভাবে আদর যত্ন করেছো।কই নিজের মেয়েকে তো কোনদিন করোনি? কে এই মেয়ে?কে? হ্যা?না আছে নাম পরিচয়?না আছে বাবা মায়ের পরিচয়?না আছে বংশ পরিচয়।কুরিয়ে আনা মেয়ের জন্যে কিসের এতো দরদ তোমার হ্যা?যে তার জন্যে নিজের আপন মেয়েকে এতো অবহেলা করছো তুমি?’

মাথায় যেন বজ্রপাত হলো আরাবীর।হৃদপিণ্ডটা মনে হয় কেউ খামছে ধরেছে।অসহ্য যন্ত্রনা হচ্ছে সেখানে।কি বলছে কি এসব তার আম্মু। ওর আব্বু আম্মু ওর আসল বাবা মা না?ওকে কুরিয়ে এনেছে?কি শুনছে এসব ও?ওর জন্ম পরিচয় নেই কোন?নাহ,এটা হতে পারে না।এটা সত্যি না।আরাবী একপা দুপা করে ওর বাবার সামনে গিয়ে দাড়ালো।না চাইতেও দুচোখ বেয়ে চোখের পানি ঝরছে আরাবীর।আরাবী শ্বাস টানলো লম্বা করে।তারপর নিজেকে শক্ত করলো।বেশ কঠিন স্বরে প্রশ্ন করে,

-‘ আব্বু?আম্মু কি বলছে এসব?আমি তোমার মেয়ে না।এইগুলো কি বলছে আম্মু?আব্বু,জবাব দেও।আমি কি তোমাদের মেয়ে না-কি নাহ?’
-‘ দেখ আরাবী মা আমার কথাটা শোন একবার।’
জিহাদ সাহেবকে থামিয়ে আরাবী আবার বলে,
-‘ শুধু এটুকু উত্তর দেও আব্বু।আমি তোমার মেয়ে নাকি নাহ?’

মাথা নিচু করে নিলেন জিহাদ সাহেব।ধুকরে কেঁদে উঠেন তিনি।কিভাবে সে বলবে যে হ্যা আরাবী তার জন্ম দেওয়া মেয়ে নাহ।তবে আরাবীকে কখনও হেলাফেলা নজরে দেখেননি তিনি। সর্বদা নিজের বড়মেয়ের স্থানে রেখেছেন।কখনও মনে আরাবীকে মনে করেন নি যে ও তার সন্তান নাহ।আরাবী আবারব একই প্রশ্ন করতেই থপ করে সোফায় বসে পরেন তিনি।পুরুষ মানুষ নাকি সহজে কাঁদেন নাহ।অথচ জিহাদ সাহেব আজ ভেঙেচুরে গুড়িয়ে গিয়েছেন।এভাবে নিজের সন্তানকে কষ্ট পেতে দেখতে হবে ভাবতেও পারেননি।জিহাদ সাহেব কান্নারত গলায় বলে উঠেন,

-‘ মানছি তুই আমার জন্মের সন্তান নাহ?তাই বলে কি আমি তোর বাবা নাহ?বল?জন্ম দিলেই কি বাবা মা হওয়া যায়?এইযে আমি তোকে ছোটো থেকে বড় করেছি এতে কি তোর কোনদিন মনে হয়েছে যে আমি তোর বাবা নাহ?মারে যতো যাই হোক।তুই আমার বড় মেয়ে।তুই আমার সন্তান।আমার আরাবী মা তুই।’

আরাবী বাবার পায়ের কাছে বসে পরে।বাবার হাটুর ভাঁজে মুখ লুকিয়ে চিৎকার করে কেঁদে উঠে আরাবী।সে মানতে পারছে না কিছুতেই মানতে পারছে না।লিপি বেগম এখনও রাগি চোখে তাকিয়ে।ফিহা রাগে চিৎকার করে বলে,
-‘ আম্মু এই মেয়েকে বেড়িয়ে যেতে বলো এই বাড়ি থেকে।ওকে আমার সহ্য হচ্ছে না।এই বাড়িতে হয় এই মেয়ে থাকবে নয়তো আমি।বের করে দেও ওকে।’

লিপি বেগম ফিহার কথামতো তেড়ে গেলেন আরাবীর কাছে।আরাবীর চুল মুঠি করে ধরে ওকে টেনে দাড় করালো।ব্যাথায় কুকিয়ে উঠলো আরাবী। করুন গলায় বলে,
-‘ আম্মু ব্যাথা পাচ্ছি আমি।’
-‘ কে তোর আম্মু?আমি তোর আম্মু নই।আমাকে আম্মু বলে ডাকবি না। বেড়িয়ে যাহ এখান থেকে।তোর চেহারাও আমার দেখতে ইচ্ছে করছে না।’

জিহাদ সাহেব তাড়াতাড়ি এগিয়ে যান।লিপি বেগমের কাছ থেকে আরাবীকে ছাড়ানোর চেষ্টা করতে থাকেন।লিপি বেগম ছেড়ে দেন আরাবীকে।জিহাদ সাহেব বলেন,
-‘ পাগল হয়ে গিয়েছো তুমি?কি করছো কি এসব তুমি?’
লিপি বেগম চিৎকার করে উঠলেন,

-‘ যা করেছি ভালো করেছি।একটা রাস্তার মেয়ের জন্যে আজ তুমি আমার সাথে এইভাবে কথা বলছ।ঠিক আছে আজ আমি দেখে নিবো।তুমি কাকে চাও আমাকে নাকি এই রাস্তার মেয়েকে।যদি এই মেয়েকে বেছে নেও।তাহলে আমি এই মুহূর্তে ফিহাকে নিয়ে এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাবো।’
-‘ ঠিক আছে তাই হবে চলে যাও তুমি।তোমার মতো মানুষকে যে আমি ভালোবেসে বিয়ে করেছি ভেবেই নিজের উপরেই রাগ উঠছে।’

লিপি বেগম কান্না করে দিলেন জিহাদ সাহেবের কথায়। কাঁদতে কাঁদতে বলেন,
-‘ আজ এই দিন দেখার বাকি ছিলো আমার। শেষে কিনা এই মেয়ের জন্যে তুমি আমাকে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে বলছো?ঠিক আছে তাই হবে।আমি শুধু বাড়ি ছেড়ে না এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবো।থাকো তুমি এই মেয়েকে নিয়ে।’
লিপি বেগম দৌড়ে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলেন।জিহাদ সাহেব নিজেও ভয় পেয়ে গেলেন।শতো হোক তিনি তার স্ত্রীকে ভালোবাসেন।নিজের ভালোবাসার মানুষটার মৃত্যু কামনা তিনি কখনই করবেন নাহ।আরাবী চিৎকার করে উঠলো।দরজা পিটাতে লাগলো।কান্না করতে করতে বলে,

-‘ আম্মু প্লিজ এমন করো না।আমি চলে যাবো আম্মু।তুমি বের হও।আমি আর কোনদিন এই বাড়িতে আসবো না কোনদিন নাহ।প্লিজ আম্মু বের হও তুমি।আমি হাত জোড় করে বলছি আম্মু।আমি জীবনে আমার চেহারা তোমাদের দেখাবো না।তুমি এমনটা করো না আম্মু।’

বার বার একই কথা বলছে আরাবী।ফিহাও কান্না করে লিপি বেগমকে বের হতে বলছেন।জিহাদ সাহেব চেয়েও কিছু করতে পারছে না।একদিকে তার ভালোবাসার মানুষ আত্ম’হত্যা করতে চাইছেন।আর একদিনে তার মেয়ে।আজ তিনি এমন এক কাঠগড়ায় দাঁড়ানো যে তিনি এদিকও যেতে পারছেন নাহ ওদিকেও যেতে পারছে না।আরাবী গিয়ে জিহাদ সাহেবের সামনে দাড়ালো। বাবার হাত দুটো নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে ধুকড়ে কেঁদে উঠলো।বলল,

-‘ আব্বু তুমি আম্মুকে বের হতে বলো।আমি আর কোনদিন এখানে আসব নাহ।তুমি তার কথা মেনে নেও আব্বু।আমার আম্মুর যেন কিছু না হয় আব্বু প্লিজ।আব্বু তোমার পায়ে পরি।আব্বু আমি নাহলে মরে যাবো আব্বু আমার আম্মুর কিছু হলে।
আরাবী জিহাদ সাহেবের পা ধরতে নিলেই তিনি আরাবীকে থামিয়ে দেন।মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলেন,
-‘ তুই যা চাস তাই হবে মা।’

জিহাদ সাহেব মনের পাথর রেখে লিপি বেগমকে বলেন,
-‘ তুমি বের হয়ে আসো লিপি।আরাবী আর কোনদিন এই বাড়িতে আসবে না।তুমি যা চাও তাই হবে।বের হয়ে আসো।’
এই কথা শুনে সাথে সাথে বের হয়ে আসলেন লিপি বেগম।আরাবী তার সামনে গিয়ে কান্নারত গলায় বলে,
-‘ আমি আর এখানে আসব না আম্মু।তুমি ভালো থাকো আম্মু।’

তারপর জিহাদ সাহেবের কাছে এসে জিহাদ সাহেবকে জড়িয়ে ধরে সজোড়ে কেঁদে দেয় মেয়েটা।
-‘ তুমি আমার আব্বু।আমি জানি তুমি আবার আব্বু।আমি তোমার মেয়ে।সে যাই হয়ে যাক না কেন।তুমি আমাকে যেভাবেই এনে থাকো না কেন।আমি শুধু এটুকু জানি তুমি আমার আব্বু।’
-‘ মারে তুই আমার মেয়ে।আমার আরাবী তুই।কে কি বলল কানে নিবি না।তুই আমার মেয়ে ছিলি,আছিস আর সারাজীবন থাকবি।’

ফিহা গিয়ে আরাবীর হাত চেপে ধরে।টেনে আরাবীকে সরিয়ে আনে।রাগি গলায় বলে,
-‘ অনেক হয়েছে তোর মেলোড্রামা।যা বের হো এখান থেকে।আর কোনদিন এখানে আসবি নাহ।’
ফিহা টানতে টানতে আরাবীকে বাড়ির বাহিরে ধাক্কা দিয়ে বের করে দিলো।দরজা বন্ধ করে দিলো ফিহা।আরাবী অশ্রুসিক্ত নয়নে দরজা বন্ধ অব্দি ওর বাবার দিকে তাকিয়ে রইলো।যতোক্ষন দেখা গেলো তাকিয়েই রইলো।

হৃদয়াসিক্ত কাঠগোলাপ পর্ব ২৭

ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন।কেমন হয়েছে জানাবেন।অল্প একটু রহস্যের সন্ধান জানলেন আপনারা।এখনও আরো বাকি।ধৈর্য ধরুন সব জানবেন। আমি ভালো গল্প লিখিনা আমি জানি।আল’তুফাল’তু গাজাখুরি গল্প লিখি।আপনারা যারা আমার এই গল্প পড়েন তাদের কাছে আমি কৃতজ্ঞ।আমি আপনাদের মনমতো লিখতে পারিনা তার জন্যে আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত।

হৃদয়াসিক্ত কাঠগোলাপ পর্ব ২৯