হৃদয়াসিক্ত কাঠগোলাপ পর্ব ৩১

হৃদয়াসিক্ত কাঠগোলাপ পর্ব ৩১
সাদিয়া জাহান উম্মি

-‘ আরাবী আমার আসল মেয়ে নাহ। দত্তক নিয়েছি আমি ওকে।ও আমার পালক মেয়ে।’
জিহাদ সাহেবের এই মুখে এই কথা শুনে যেন সবাই আকাশ থেকে পরলো। বিষ্মিত দৃষ্টিতে সবাই তাকিয়ে।কিন্তু সবার মাঝে জায়ানের কোন রূপ কোন প্রতিক্রিয়া দেখা গেলো না।জায়ান পুরো নির্বিকার। ও শান্ত গলায় বলে,
-‘ সবটা জানতে চাই আমি বাবা।আমাকে সবটা বলুন।’

জিহাদ সাহেব বেশ অবাক হলেন।কি আশ্চর্য ব্যাপার।এমন একটা ভয়ানক সত্যি কথা তিনি বলে দিলেন।অথচ জায়ান তা শুনেও শান্ত হয়ে আছে।ঠিক কিভাবে? তবে তিনি আর মাথা ঘামালেন নাহ।দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলা শুরু করলেন,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

-‘ অফিস ছুটির পর বাসায় ফিরছিলাম।হঠাৎ দেখি রাস্তার পাশে ময়লার স্তুপে পাশে কাউকে বাচ্চা হাতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অবাক হয়েছিলাম।তার থেকে বেশি অবাক হয়েছিলাম যখন দেখলাম লোকটা বাচ্চাটাকে সেখানের ময়লার মাঝে রেখে চলে যাচ্ছিলো।আমি দ্রুত মোটর সাইকেল টান দিয়ে লোকটার কাছে যাই।

গিয়েই জিজ্ঞেস করি কেন এমন করলেন তিনি।কেন এই নবজাতক বাচ্চাটাকে এভাবে ফেলে রেখে গিয়েছেন।লোকটা বলে তিনি কিছুই জানেন নাহ।তাকে শুধু টাকা দেওয়া হয়েছে এই কাজের জন্য ব্যস।আমি আর কিছু বললাম না লোকটাকে।সেখান থেকে ফিরে এসে বাচ্চাটার কাছে এসে দাড়ালাম।বাচ্চাটাকে দ্রুত কোলে তুলে নিলাম।কি নিস্পাপ তার চাহনী।কি নিস্পাপ মুখশ্রী।

এমন মায়াবী পুতুল বাচ্চাকে কেউ কি করে এভাবে ফেলে আসার কথা বলতে পারে। সেদিন তীব্র শীত ছিলো।বাচ্চাটার গায়ে পাতলা একটা কাথা ছাড়া আর কিছুই ছিলো না।অথচ বাচ্চাটা কি সুন্দর তার ফোঁকলা দাঁতে আমাকে দেখে হাসছিলো।ওর নরম ছোটো ছোটো হাত দুটো দিয়ে আবার হাতের আঙুল মুঠোয় পুরে নিয়েছিলো।মায়াময়ী ডাগর ডাগর চোখ দিয়ে আমাকে দেখছিলো।

আমার অন্তর নারা দিয়ে উঠলো।অনেক আগে থেকেই মেয়ে সন্তানের অনেক শখ আমার।কিন্তু ফাহিম হবার পর কিছুতেই লিপি কনসিভ করছিলো না।তাই বাচ্চাটাকে দেখে তৎক্ষনাত সিদ্ধান্ত নিলাম।আজ থেকে ও আমার মেয়ের পরিচয়ে বড় হবে।আমি হবো ওর বাবা।আর ওই বাচ্চাটাই আমার মেয়ে আমার আরাবী।সেদিন রাতে আরাবীকে বাসায় নিয়ে আসলাম ।লিপি দেখে সেদিন কিছুই বলল না।

ওকে সবটা বলার পর ও নিজেও আরাবীকে আদর স্নেহ করতো।ফাহিম তো বোনকে পেয়ে যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছে এমন অবস্থা হয়েছিলো ওর।আমি আইনতভাবে আরাবীকে নিজেদের সন্তান হিসেবে দত্তক নিলাম।সবটা ভালোই চলছিলো।বিপত্ত ঘটলো ফিহা জন্ম হওয়ার পর থেকে।কিভাবে যেন লিপির মনে হিংসা সৃষ্টি হতে লাগলো।ফিহা হবার পর থেকে যেন আরাবী ওর দুচোখের বি’ষ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

কোনদিন ভালোভাবে দুটো কথা বলতো না আমার মেয়েটার সাথে।মেয়েটা আমার মায়ের ভালোবাসার জন্যে কাঙালের মতো করতো।আমি সব বুঝতাম কিন্তু কি করবো বলো?ভয় হতো পাছে না আবার লিপি রেগে গিয়ে আরাবীকে সব সত্যি বলে দেয়। কিন্তু দেখো আমি যেই ভয়ে এতোদিন চুপ ছিলাম। এতো কিছু মেয়েটাকে সহ্য করতে দিলাম।আজ তাই হলো।আমার মেয়েটা সব জেনে গিয়েছে আজ।এই কারনেই তো এতোটা মানষিক কষ্ট পেয়েছে।আজ আমার এই গাফিলতির কারনেই আমার মেয়েটার এই অবস্থা।আমি ব্যর্থ আজ বাবা হিসেবে।’

হু হু করে কেঁদে দিলেন জিহাদ সাহেব।মেয়ের জন্যে তার কষ্টে বুক ফেটে যাচ্ছে।জিহাদ সাহেব চোখ মুছে জায়ানের কাছে গেলো।তারপর জায়ানের হাত দুটো ধরে কাতর গলায় বলে,

-‘ আমি ওর জন্মদাতা না ঠিকই। কিন্তু ও আমার মেয়ে।আমি ওর বাবা। বিশ্বাস করো বাবা।আরাবীকে আমি কতোটা ভালোবাসি তা বলে বুঝাতো পারবো না।মেয়েটা আমার কলিজার টুকরো। যতো যাই হয়ে যাক না কেন।দুনিয়া একদিনে আর আমার মেয়ে একদিকে। আমার মেয়েকে কোনকিছুই আমার থেকে আলাদা করতে পারবে না।সে যতোই যা হয়ে যাক।কিন্তু বাবা তুমি আরাবীর এসব সত্যি জানার পর আরাবীকে অবহেলা করো না বাবা।তাহলে আমার মেয়েটা পুরোপুরি মরে যাবে বাবা। ওকে অবহেলা করো না।’

জায়ান ওর লাল হয়ে আসা চোখজোড়া বন্ধ করে নিলো।ওর নিজেরই ভীষণ কষ্ট হচ্ছে সবটা জানার পর।না জানি আরাবীর কেমন লেগেছে। জায়ান চোখ বন্ধ করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,

-‘ জায়ান সাখাওয়াত সেদিন আপনার মেয়েকে বিয়ে করে নিয়ে যাওয়ার সময়েই বলেছিলাম আপনার মেয়েকে আমি কোনদিন কষ্ট দিবো না।সবসময় আগলে রাখবো।আর আজও আমি জায়ান সাখাওয়াত আবারও আপনার কাছে ওয়াদা করলাম আপনার মেয়েকে আমি কোনদিন কষ্ট দিবো না।নিজের শেষ নিশ্বাস অব্দি ওকে আগলে রাখবো। যতো ঝড়ঝাপ্টা আসুক জায়ান সাখাওয়াত তার স্ত্রীর পাশে সর্বদা ঢাল হয়ে দাঁড়াবে।’

জিহাদ সাহেবের বুকে যেন পানি আসে।অবশেষে তিনি পেরেছেন তার মেয়ের জন্যে উত্তম জীবনসঙ্গী এনে দিতে। নিহান সাহেব এগিয়ে এসে জিহাদ সাহেবের কাধে হাত রেখে বলেন,
-‘ আরাবী শুধু আপনার মেয়ে না ভাই।আরাবী আমারও মেয়ে।আপনি চিন্তা করবেন না।আরাবীকে আমার পরিবার নিজেদের সবটা দিয়ে ভালোবাসবে।’
সাথি বেগম বলেন,

-‘ আরাবী মায়ের ভালোবাসা আগে পায়নি তো কি হয়েছে?এখন তো পায়? আমি ওর মা।ও আমার মেয়ে ভাই।’
মিলি বেগম বলেন,
-‘ আমিও তো আরাবীর মা।’
মিহান সাহেব বলেন,
-‘ আরেহ আমিও তো আরাবীর আরেকটা বাবা।’
ইফতি বলে,

-‘ আমি ভাবির ভাই আছি না।’
-‘ আমিও তো ভাবির বোন।’ এগিয়ে এসে বলে নূর।
জিহাদ সাহেব আর ফাহিম খুশিতে বাকহারা হয়ে যান। আরাবীর কঁপালে যে আল্লাহ্ এতো ভালো একটা পরিবার লিখে রেখেছেন কোনদিন ভাবতেও পারেননি তিনি।সত্যি আল্লাহ্ মহান।তিনি সব পারেন।ফাহিম চোখের কোণের জলটুকু মুছে নিয়ে ম্লান গলায় বলে,

-‘ বোনটার আমার ভাগ্য অনেক ভালো।তাই তো সে আপনাদের মতো পরিবার পেয়েছে।যারা ওকে এতোটা ভালোবাসে।’
নূর ভরশা দিয়ে বলল,
-‘ ভাবিকে আমরা সবাই অনেক অনেক ভালোবাসা দিবো। যাতে ভাবির একটুও মন খারাপ না হয় কোনদিন।’
ফাহিম কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলে,
-‘ ধন্যবাদ।’

জিহাদ সাহেব লিপি বেগমের দিকে তাকালেন। যে আপাততো মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে।জিহাদ সাহেব তাচ্ছিল্য হেসে বলে,
-‘ যাকে তুমি এতোটা অবহেলা আর তুচ্ছ করেছ।দেখো সেই আজ এই গোটা পরিবারের কাছে তাদের চোখের মনি।আফফোস লিপি তুমি বুঝলে না।তুমি আরাবীকে সামান্য ভালোবাসাটুক কোনদিন দেও নি।অথচ মেয়েটা আমার তোমাকে সবটা দিয়ে ভালোবেসেছে।

মনে পরে লিপি একবার তোমার জ্বর হয়েছিলো।আমি বাসায় ছিলাম না সেদিন।ফাহিম গিয়েছিলো ট্যুরে।মেয়েটা আমার সারারাত জেগে তোমার সেবা করল।একফোটা বিশ্রাম নেয়নি।বারবার আমায় ফোন দিয়ে বলেছে বাবা আম্মুর কিছু হবে না তো?আম্মু ঠিক হয়ে যাবে তো।অথচ তোমার নিজের উদর থেকে জন্ম নেওয়া মেয়ে।তোমাকে এতোটা অসুস্থ দেখেও পরে পরে ঘুমোচ্ছিলো।ভিডিও কলে ছিলাম সেদিন।সবটা দেখেছি তো আমি।তোমার একটুখানি হাত কেটে গেলে তোমার আগে আরাবীর চোখের পানি ঝরে।আর আজ নাকি তুমি তার সাথে এমন ব্যবহার করলে লিপি।তোমার একটুখানিও কি বিবেকবোধ নেই? ঠিক কি দিয়ে তৈরি তুমি লিপি?’

লিপি বেগমের চোখ থেকে টপটপ করে অশ্রু ঝরছে।তার বিবেক তাকে জাগিয়ে তুলেছে।সত্যিই তো ছোটো থেকে মেয়েটাকে সব সময় তুচ্ছতাচ্ছিল্যই করে এসেছে সে।অথচ আরাবী সর্বদা নিস্বার্থভাবে ভালোবেসেছে।আজ তার সাথেই এমন জঘ’ন্য ব্যবহার করলেন তিনি।অপরাধবোধে বুক ভাড় হয়ে আসল তার। তার মন শুধু এটুকুই ভাবলো ঠিক কিভাবে তিনি মুখ দেখাবেন আরাবীকে?ঠিক কি কিভাবে? তিনি মুখোমুখি হবেন আরাবীর?বড্ড অন্যায় করে ফেলেছেন মেয়েটার সাথে।

হৃদয়াসিক্ত কাঠগোলাপ পর্ব ৩০

ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন।কেমন হয়েছে জানাবেন।প্রচন্ড ঠান্ডা লেগেছে। সেই সাথে মাথা ব্যাথা।তাই কি লিখেছি নিজেও জানি না।

হৃদয়াসিক্ত কাঠগোলাপ পর্ব ৩২